নাজমুল ইসলাম মকবুল
মাথায় আগুন পেটে পানি তারে আমি উস্তাদ মানি
নাজমুল ইসলাম মকবুল
‘‘মাথায় আগুন পেটে পানি, তারে আমি উস্তাদ মানি’’ বাল্যকালে শুনেছিলাম মজার ছোট্ট এ ধাধাটি। যার সঠিক উত্তর হচ্ছে আমার আজকের লেখার বিষয় ‘‘হুক্কা’’। হুক্কা সম্পর্কিত পুরনো শ্র“তিমধুর যথেষ্ট মজার মজার ধাধা পই ছিল্লক প্রবাদ প্রবচন পুঁথি ও গান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমাদের প্রাচীণ সাহিত্য ভান্ডারে।
নব্বইয়ের দশকে সৌদি আরবের জেদ্দা শহর থেকে মদীনা শরিফে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র রওজা মোবারক জিয়ারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রাইভেট কারযোগে যাওয়ার পথে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এক পর্য্যায়ে বিশ্ব রোডের পার্শ্বে বিশাল এক হোটেলের সামনে গাড়ি পার্ক করলেন চালক। আমাদের দেশের ষ্টেডিয়ামের মতো বিশাল আয়তনের হোটেলটি দেখে একটু অবাকই হলাম।
বিভিন্ন স্থানে কিছুটা দুরে দুরে ফোরের উপর বিছানাসমেত থরে থরে সাজানো বাহারি কারুকার্যখচিত চার পাচটি করে লম্বা বড় নলের খাসি হুক্কা শুভা পাচ্ছে হোটেলটিতে। জীবনে অনেক ধরনের হোটেল দেখলেও হুক্কার হোটেল দেখাতো দুরের কথা কল্পনাও করতে পারিনি। অবাক হয়ে নামলাম হোটেলটিতে। দেখলাম আরবীয়ানরা বিভিন্ন গ্র“পে বিভক্ত হয়ে উন্মুক্ত বিশাল এরিয়ার হোটেলটিতে বসে হুক্কায় আয়েশের সাথে টান দিচ্ছে আর আমাদের দেশের ঘাপলা খেলার মতো এক ধরনের খেলা খেলছে। সেসাথে মাঝে মধ্যে লাল চা গলধকরণ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে গভির রাত অবধি।
হাতমুখ ধোয়া ও ইস্তিনজা শেষ করে লাল চা গিলে কিছুণ হাটাহাটি করে জীবনের প্রথম দেখা ব্যতিক্রমধর্মী একটি হোটেলের মনোরম দৃশ্যগুলো উপভোগ করে নিতান্ত ভালই লাগলো। দেখলাম সেখানেও বাঙ্গালীরা হুক্কায় তামাক ভরার চাকরি করছে। আলাপচারিতায় তাদের কুশলাদি সহ দেশের বাড়ী থেকে নিয়ে বেতন টেতনের খোজখবরও নিতে কসুর করলামনা। হুক্কার হোটেলে কিছুণ কাটিয়ে ফুরফুরে মেজাজে আবার চেপে বসলাম গাড়িতে। শা শা করে প্রায় দুইশত মাইল বেগে ওয়ানওয়ে হাইওয়ে দিয়ে ছুটছে গাড়ি।
এসব রোড দিয়ে চলাচলের সময় গাড়ির গতিবেগের সম্পুর্ণটা ছেড়ে দিতে কোন ড্রাইভারই কসুর করেননা। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি হাইওয়ের পাশে বিশাল বিশাল এমন অনেক হুক্কার হোটেল আছে সৌদি আরবে, যা না দেখলে বিশ্বাষ করতেও কষ্ট হবে। তবে আমাদের দেশে হুক্কার হোটেল কোথাও দৃষ্টিগোচর হয়নি। পরানের এই হুক্কা ছিল আমাদের দেশে এক সময়ের গ্রাম কিংবা শহরের মানুষের নিত্যব্যবহার্য একটি আজব চিজ। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হুক্কাকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু ুদ্র ও কুটির শিল্প।
অনেক লোকই হুক্কা, হুক্কার ছিলিম, নল, নাছরা ইত্যাদি তৈরি করে এবং তামাক উৎপাদন করে তা বাজারে বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করতো। ব্যপারিরা শহর কিংবা মফস্বলের প্রতিটি বাজারেই তামুক তৈরির জন্য কাট বাশ বা অন্যান্য জিনিস দিয়ে তৈরি বড়ো ডালায় এক ধরনের গ্যাস বা গন্ধযুক্ত তামাক গাছের পাতা শুকিয়ে গুড়ো করে এর স্তুপ নিয়ে বসতেন এবং গুড়ের চিটা ও অন্যান্য খুশবুদার মশল্লার সমন্বয়ে হাত দিয়ে রুটির কাইয়ের মতো আচ্ছামতো মলে তৈরি করতেন স্বাদের তামাক। এরপর দশ টাকা পাঁচ টাকা দুটাকা এক টাকা সহ বিভিন্ন দামের ছোট বড় আয়তনের গুলি তৈরি করে সাজিয়ে রাখা হতো ডালার মধ্যে এবং বিক্রয় করা হতো দেদারছে। তামাকের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো যে জিনিসটি তার নাম হচ্ছে টিকি। জ্বলন্ত কাটের আঙারা গাইল ছিয়ায় কুটে তাতে ভাতের ফ্যান পানি ও কিছু লতাপাতার নির্যাস দিয়ে তৈরি করা হতো খামিরের মতো।
গোলাকার ছোট ছোট করে ডাম বা চাছের মধ্যে দিয়ে রোদ্রের তাপে শুকিয়ে নেয়া হতো। যতœ সহকারে সংরন করে রাখা হতো সারা বৎসর ব্যবহারের জন্য। এ কাজটি সাধারণত গৃহিণীরাই করতেন। টিকি জ্বালানো এবং ফুৎকার দিয়ে লাল করার দায়িত্ব ছিল সাধারণত বাড়ির কিশোর কিশোরিদের।
সেকেলে যুগে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই দুচারটি বিভিন্ন আকৃতির হুক্কা থাকতো।
কর্মস্থলে বা সাথে রাখার জন্য নারিকেলের ঠালি দিয়ে তৈরি ছোট সাইজের হাত হুক্কা, বাড়ির শুভা বর্ধন ও ঘরে বা টংগিতে বসে আয়েশ করে টানার জন্য খসি (খাসি) হুক্কা, বৃন্দাবনী হুক্কা, দুই নালা হুক্কা, বাদশাহী হুক্কা ইত্যাদির প্রচলন ছিল বহুরূপি। ছোট হাত হুক্কা ব্যবহারে নলের প্রয়োজন হতোনা। পুরো নারিকেলের ঠালি (টোল) মুখ দিয়ে ছিদ্র করে সেখানে লাগানো হতো আকারভেদে কারুকার্যখচিত নাছরা। নাছরার উপরে একটি মাটির মনোরম ছিলিমে তামাক ভরে উপরে বসানো হতো জ্বলন্ত টিকি। নাছরার ভেতরে ছিদ্র থাকতো উপর থেকে নিচ অবধি।
নারিকেলের ঠালিতে ভরা থাকতো অর্ধেকেরও বেশি পানি এবং উপরিঅংশে মুখ লাগিয়ে টানার জন্য ছোট একটি ছিদ্র থাকতো। ঐ ছিদ্রে মুখ লাগিয়ে জোরছে টান দিলে গুড়ুম গুড়–ম পানির শব্দ হয় এবং মুখে আসে ধোয়ার কুন্ডলী। এতে নাকি ধুমপায়ির লাগে দারুন আরাম এবং মনে জাগে আজব ফুর্তি। এসব হুক্কা কর্মস্থলে বিশেষ করে কৃষি কাজের সময় জমিনের আইলে রেখে মাঝে মধ্যে কয়েক দম নিয়ে আবার কাজে লাগতো কৃষকরা। এতে নাকি তাদের মন সতেজ ও চাঙ্গা হতো।
বৃষ্টি বাদল থেকে রার জন্য হুক্কাটিকে জমিনের আইলে রেখে বাশের ছাতা দিয়ে ঢেকে রাখা হতো যতœ সহকারে। ৭১এ অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছাতা দিয়ে হুক্কা ঢেকে রাখার আদলে জমিনের আইলে অস্ত্র রেখে ছাতা দিয়ে ঢেকে রাখতেন এবং হালচাষের ভান করতেন। পাকিস্থানী হানাদাররা লাইন ধরে চলাচলের সময় সুযোগ বুঝে পেছন থেকে গুলি করে তাদের পুরো লাইনকেই ধরাশায়ি করতেন বলে ব্যাপক জনশ্র“তি আছে। খসি (খাসি) হুক্কা, বৃন্দাবনী হুক্কা, দুই নালা হুক্কা, বাদশাহী হুক্কা ইত্যাদি পিতল তামা এ্যলুমিনিয়াম বা অন্যান্য জিনিস দিয়ে মুল কাঠামো তৈরি করা হতো প্রতিযোগিতামুলকভাবে অত্যন্ত যতœ সহকারে নজরকাড়া কারুকার্য সহকারে। উপরিভাগে আকারভেদে নাছরা ফিটিং করা থাকতো।
মাথায় চিলিম ও চিলিমে সময়মতো ভরা হতো সাধের তামাক। বাড়ির শয়নক থেকে শুরু করে টংগি ঘরে শালিশি বিচার আচারে সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে এমনকি বিবাহ অনুষ্ঠানেও হুক্কার ব্যবহার ছিল অবশ্যম্ভাবী।
আগেকার যুগে রাজা বাদশাহরা তাদের রাজ দরবারে দৃষ্টিনন্দন ডিজাইনের মনোরম কারুকার্যখচিত হুক্কা রাখতেন এবং সিংহাসনে বসে আয়েশ করে পরানের হুক্কায় সুখটান দিতে দিতে রাজ দরবার পরিচালনা করতেন বলে জানা যায়। গ্রামের মোড়লরা সালিশি বিচারালয়ে বসে হুক্কায় আয়েশের সাথে গুড়–ম গুড়–ম টান দিতেন আর পরিচালনা করতেন সালিশি বিচার আচার। এক মোড়ল কিছুন টেনে অন্যজনের হাতে নল ধরিয়ে দিতেন।
নল লম্বা থাকায় বড়ো হুক্কাটিকে যথাস্থানে রেখেই নল ঘুরিয়ে পালাক্রমে সবাই টানতেন আর মুখ দিয়ে ছাড়তেন ধোয়ার কুন্ডলি। ধোয়ার বিচ্ছিরি গন্ধে মজলিসের পরিবেশ হয়ে যেতো অন্যরকম। সিংহভাগ বিচারকেরই হুক্কা টানার নেশা ছিল বিধায় তাদের কাছে গন্ধটা ভালই লাগতো। কিন্তু ছিটেফোটা অধুমপায়ীদের নিকট গন্ধটা ছিল বিরক্তিকর। আগেকার যুগে অনেক গৃহিণীরাও হুক্কা সেবন করতেন বলে জানা যায়।
বর্তমান যান্ত্রিক যুগেও অজো পাড়াগায়ে নিতান্ত দরিদ্র এলাকায় হুক্কার ছিটেফোটা ব্যবহার দৃষ্টিগোচর হয়। তামাক বা টিকি ফুরিয়ে গেলে বা নিজের না থাকলে হুক্কা সেবনের নেশায় অনেকেই এ বাড়ি থেকে ওবাড়ি যেতেন কেহবা সময়মতো ধার কর্জ করে এনেও নিবারন করতেন দারুন ওই নেশা। আগেকার যুগে গল্প গুজব ধাধা কিচ্ছা কাহিনি বিচার আচার সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি এমনকি বিয়ের আসরেও হুক্কার অনুপস্থিতি কল্পনাই করা যেতোনা। নিজ বাড়িতে বাহারি ডিজাইন ও আকৃতির কয়েকটি হুক্কা রাখা ছিল আভিজাত্যের লন। এতে মান মর্যাদা বেড়ে যেতো প্রমাণ সাইজের।
অতিথি বা বন্ধু বান্ধব আসলে হুক্কা দিয়ে আপ্যায়িত করা ছিল বহুল প্রচলিত সামাজিক রেওয়াজ। এমনকি তখনকার সময়ে চায়ের চেয়েও হুক্কার কদর ছিল আকাশচুম্বি। অনেক অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা শুধুমাত্র তামাক ভরে দেওয়া টিকি জ্বালানো হুক্কার পানি বদল করার জন্য আলাদা শ্রমিক নিয়োগ দিতেন বর্তমান পি,এস এর মতো। বিয়েপাগল কোন কোন লোক তামাক ভরে দেওয়ার অজুহাতে একাধিক বিয়েও করতেন বলে জানা যায়। তামাক ভরে দেয়া ও বাড়তি খায় খেদমত করার জন্য পরবর্তী বিয়ে বলে প্রথম স্ত্রীকে প্রবোধ দিতেন।
প্রথম স্ত্রী পরবর্তী স্ত্রীদের দাসি, বান্দি বা হাঙ্গার বেটি বলে সম্বোধন করে মনের ঝাল কিছুটা হলেও নিবারন করতেন। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে এখনও বিয়েশাদীতে বিয়ে বাড়ীর প থেকে পঞ্চাইতি দাওয়াত দেয়া হয় ‘‘পান তামাক খাইতা নউশা তুলতা’’। এ থেকেই বুঝা যায় এক সময় হুক্কা (তামাক) ছাড়া বিয়ের আসর জমতইনা। বৃদ্ধরা হুক্কা টেনে হুক্কুর হুক্কুর কাশি কাশতেন অবিরাম। হুক্কা এবং হুক্কুর হুক্কুর কাশি যেন একই সুত্রে গাথা।
কাশি নিবারণের জন্য শিয়রে রাখতেন তালমিছরি আর চুষে চুষে খেতেন। কফ ফেলার জন্য বৃদ্ধরা শিয়রে রাখতেন চিলিমছি। তবুও উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া রেওয়াজ হুক্কা সেবন পরিত্যাগ করতেননা। হুক্কায় ব্যবহৃত পোড়া তামাককে বলা হয় গুল এবং তা দাতের মাজন হিসেবে ব্যবহার করতেন ঘরের সকলেই। হুক্কায় ব্যবহৃত পানি বিভিন্ন রোগের ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো বিশেষ করে মাথায় চক্কর দেয়া বা মাথা ঘুরানো সহ মহিলাদের অন্যান্য ব্যায়ারামে।
বর্তমানে হুক্কার স্থান দখল করে নিয়েছে বিড়ি, মিক্সার, চুরুট, গোলাওয়ালা দেশ বিদেশের নামী দামী সিগারেট ইত্যাদি। তবে ধুমপানে কোন উপকারতো নেইই বরং স্বাস্থ্য অর্থ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক তিকর তাই এ ব্যাপারে মানুষ সচেতন হওয়ায় ধুমপানের প্রবণতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু নেশাখুররা ‘‘ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য তিকর’’ ‘‘ধুমপানে বিষপান’’ ‘‘ধুমপান মৃত্যু ঘটায়’’ এসব শ্লোগান শুনেও এর মারাত্মক কুফল জেনেও তাচ্ছিল্যের সাথে ধুমপান চালিয়ে যাচ্ছে দেদারছে। সময়ের পথ পরিক্রমায় বর্তমানে হুক্কার ব্যবহার হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো যান্ত্রিক এ যুগে কর্মব্যস্থ মানুষের ব্যস্থতা দিনকে দিন বেড়ে যাওয়া। হুক্কা বহন করা এবং রাখাও আরেকটা বাড়তি ঝামেলা।
হুক্কা হয়ে গেছে এখন সেকেলে মডেল। এছাড়া ব্যাপক জনসচেতনতা ও শিার হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিও এর একটি কারন বলা যায়। সময়ের ব্যবধানে হুক্কা ছিলিম ও তামাক ব্যবসায়ীরাও ব্যবসা পরিবর্তন করে বাধ্য হয়ে ধরছেন অন্য পেশা বা ব্যবসা। হুক্কা হয়ে যাচ্ছে যাদুগরে সংরণ করে প্রদর্শনের বস্তু।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।