বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাকে ‘বিভীষিকাময়’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। এসব রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। সরকারি বাহিনী বিপুলসংখ্যক নাগরিককে বিনা বিচারে হত্যা করেছে। অনেক নাগরিককে গুম করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুসহ নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্রের উলঙ্গ শক্তি প্রদর্শনে নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারদলীয় ক্যাডাররা। অবৈধভাবে নির্বিচারে গ্রেফতার প্রতিদিনকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাওয়ার পথও বন্ধ করা হয়েছে। বিচার বিভাগকে ক্রমবর্ধমান এবং অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণের মাধ্যমে সরকারবিরোধীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথও রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। ২০১১ সালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বুধবার ও বৃহস্পতিবার রিপোর্ট তিনটি প্রকাশ করে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বগ্রাসী দুর্নীতি রাষ্ট্র ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে নানা উপায়ে। নারী, শিশু, সংখ্যালঘু, গার্মেন্টকর্মী, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসহ প্রত্যেক শ্রেণী-পেশার মানুষের ওপরই নেমে এসেছে অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কড়া সমলোচনা করা হয়েছে এসব রিপোর্টে। বলা হয়েছে, এখানে ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।
এ অবস্থার অবসানের জন্য সরকার পরিবর্তনে নিয়মতান্ত্রিক পন্থাকে বন্ধ করার জন্য সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়সক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। তার পরিবর্তে সংবিধানে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের বিধান সংযোজন করা হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার রিপোর্ট:
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগকে অতিমাত্রায় রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। এর ফলে সরকারবিরোধীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সঙ্কুুচিত হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি একটি মারাত্মক সমস্যা।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে সরকার। গুম, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন, খেয়ালখুশিমত গ্রেফতার ও আটক রাখার জন্য দায়ী নিরাপত্তা বাহিনী। নিরাপত্তারক্ষীরা সাংবাদিকদেরও হয়রানি করছে।
বৃহস্পতিবার রাতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে সাতটি বিভাগে এদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকাণ্ডের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। স্বভাবতই মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রলয়ের ওই রিপোর্টে মার্কিন সরকারের মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছে।
বিচার বিভাগ : বিচার বিভাগ সম্পর্কে ওই রিপোর্টে বলা হয়, আইনে আছে বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা সত্ত্বেও উচ্চ আদালতে নিয়োগ দিয়েছে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর অনেক মামলায় তারা বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেন। এতে সমস্যা বেড়েছে। বিরোধী দলের সদস্যদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সঙ্কুচিত করা হয়েছে।
২০ অক্টোবর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ১০ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দিয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ওইসব বিচারককে অভিনন্দন জানানো থেকে বিরত থাকে। তারা বলেন, ওই নিয়োগ রাজনৈতিক। বছরজুড়ে প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের মাধ্যমে আগের সরকারের আমলে করা মামলা থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের রেহাই দেয়া হয়েছে। সরকার বলছে, ওইসব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এক্ষেত্রে অনেক অব্যাহতি দেয়ার ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে সুশীল সমাজে। সরকারি বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও বাইরে থেকে প্রভাব বিস্তার করা ছিল একটি সমস্যা।
সরকারের দুর্নীতি : সরকারি কার্যক্রমের অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার রিপোর্টে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী আইন ও বিধি-বিধান থাকলেও সরকার তার যথাযথ প্রয়োগ করে না। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এখানে দুর্নীতি করলেও শাস্তি হয় না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ‘দন্তহীন বাঘ’ আখ্যা দিয়েছে। দুদক দুর্নীতি দমনে সিরিয়াস নয় এবং রাজনৈতিকভাবে হয়রানির জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে শাসক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেসব মামলা হয়েছিল কোনো আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে নির্বাহী আদেশের বলে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
গণমাধ্যম : সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে সরকার।
এক্ষেত্রে সেলফ সেন্সরশিপ চলছেই। নিরাপত্তা বাহিনী হয়রানি করছে সাংবাদিকদের। সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত আছে। সরকারি দলের লোকজন সাংবাদিকদের ওপর হামলা করছে, তাদের নামে মামলা দিচ্ছে। যেসব সাংবাদিক সরকারের সমালোচনা করে তাদের সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী হয়রানি করে থাকে।
সংবিধানের সমালোচনা করলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গণ্য করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ চ্যানেল ওয়ান ও যুমনা টিভি নামের দুটো টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়, যা ২০১১ সালে অনএয়ারে আসতে পারেনি।
গুম ও নিখোঁজে নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা : নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্য সাধারণ ক্ষমার অধীনে কাজ করেন। এক্ষেত্রে র্যাবের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ওই রিপোর্টে নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে বলা হয়, পুরো বছরে যেসব নিখোঁজ ও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে অভিযোগ আছে, তা ঘটিয়েছে বেশিরভাগই নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা।
২০১১ সালে নিখোঁজ ও অপহরণের ঘটনা বেড়ে যায়। কিন্তু এর সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে কতগুলো অপহরণ ঘটেছে রাজনৈতিক উদ্দেশে। কিছু অপহরণ ঘটেছে টাকার জন্য। আবার কিছু অপহরণ ঘটেছে স্থানীয় শত্রুতা থেকে।
মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা অধিকার-এর মতে, ৩০টি নিখোঁজের ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত বলে অভিযোগ আছে। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯। র্যাব বলছে, যেসব নিখোঁজের ঘটনায় তাদের দায়ী করা হচ্ছে, সেসব ঘটনা র্যাব বা পুলিশ সেজে অন্যরা ঘটিয়েছে। অধিকার উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি র্যাব ঢাকা শহরের উত্তর শাহজাহানপুর থেকে একজন ইমাম ও বিক্রয়কর্মী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামকে আটক করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, রফিকুলের জামাই পুলিশে গিয়ে অভিযোগ করেছেন, র্যাব অফিসাররা আটক করেছে রফিকুলকে।
তাকে জোর করে একটি কভার্ডভ্যানে তুলে নেয়া হয়েছে। এ সময় র্যাব সদস্যদের কেউ কেউ ছিলেন সাধারণ পোশাকে। কিন্তু র্যাব এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বছর শেষে রফিকুল কোথায় তা অজ্ঞাতই রয়ে যায়। ওদিকে ২০১০ সালের জুনে র্যাব সদস্যরা ঢাকা সিটি কমিশনার চৌধুরী আলমকে আটক করে বলে অভিযোগ আছে।
কিন্তু ২০১১ সাল শেষ হয়ে গেলেও জানা যায়নি চৌধুরী আলম কোথায় আছেন।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড : ওই রিপোর্টে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অনেক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব এ সময়ে অপ্রত্যাশিত শক্তি ব্যবহার করেছে। র্যাবের খেয়ালখুশিমত কার্যক্রমের ঘটনা অনেক। এতে বলা হয়েছে, র্যাব ও পুলিশসহ নিরাপত্তারক্ষীরা আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করছে।
তারা প্রহার করছে। এমনকি বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং জয়নুল আবদিন ফারুককে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, ২০১১ সালে পুলিশ হেফাজেত ২১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১১৬ জনই মারা গেছে কারাগারে থাকা অবস্থায়।
সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে : মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা এখনও ভঙ্গুর। যে কোনো রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করার আশঙ্কা রয়েছে। বিরোধী দলের জাতীয় সংসদ বর্জনের বিষয়ে রিপোর্টে বলা হয়, বিরোধীরা স্পিকার নিরপেক্ষ নয় বলে বারবার অভিযোগ করছে। তারা সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোর কার্যক্রমে বিভিন্নভাবে অংশ নিলেও সংসদ অধিবেশনে নিয়মিত যাচ্ছে না।
অ্যামনেস্টির মানবাধিকার রিপোর্ট :
বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
বুধবার রাতে লন্ডন থেকে প্রকাশিত অ্যামনেস্টির ২০১১ সালের মানবাধিকার রিপোর্টে এ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে বাংলাদেশ সরকার তার প্রতিশ্রুতি রাখেনি। র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গত বছর ৫৪ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে। বিনা বিচারে আটক, নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। রিপোর্টে বলা হয়, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছে। নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।
২০১১ সালে অসংখ্য নারী এবং শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যার ব্যাপারে অ্যামনেস্টির রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালে মোট ৫৪ জনেরও বেশি মানুষকে র্যাব এবং পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে। ২০০৪ সালে র্যাব গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত তাদের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে অন্তত ৭০০ জন।
অবশ্য র্যাব সবসময় দাবি করে বলেছে, এনকাউন্টারেই এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। রিপোর্টে লিমন হোসেনের ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরে বলা হয়, ১৬ বছর বয়সী লিমনকে ২০১১ সালের ২৩ মার্চ র্যাব কর্মকর্তারা পায়ে গুলি করে। র্যাব কর্মকর্তারা তখন দাবি করে, সে একজন দুষ্কৃতকারী। র্যাবের সঙ্গে গোলাগুলির সময় তার পায়ে গুলি লেগে থাকতে পারে। কিন্তু লিমন জানায়, সে ছিল একা।
গরু নিয়ে বাড়িতে ফিরছিল। তখনই র্যাব সদস্যরা তাকে আটক করে পায়ে গুলি করে। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি আজও।
বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাগুলো তদন্ত করতে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলে অ্যামনেস্টি দাবি করেছে।
নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, আটক অবস্থায় পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনীর হাতে নির্যাতন এবং নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে।
২০১১ সালে অন্তত ৩ জন আটক অবস্থায় পুলিশের নির্যাতনে মারা গেছে। এসব নির্যাতনের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সরকার এসব ঘটনা তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিলেও সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। আমার দেশ প্রকাশের বৈধ লাইসেন্স নেই বলে অভিযোগ তুলে পুলিশ দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর পুলিশ হেফাজতে মাহমুদুর রহমানের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।
মাহমুদুর রহমান ওই নির্যাতনের বর্ণনা আদালতে দিয়েছেন। মাহমুদুর রহমান জানান, ক্যান্টনমেন্ট থানায় পেছনে হাত বেঁধে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। তাকে এমনভাবে পেটানো হয় যে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সরকারের দুর্নীতির খবর প্রকাশের জন্যই মাহমুদুর রহমানের ওপর এই নির্যাতন চালানো হয়।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কড়া সমালোচনা : বিবিসি জানায়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করছে না।
অ্যামনেস্টি ২০১১ সালে বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন গতকাল প্রকাশ করেছে। সেখানে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল নিয়ে একটি অধ্যায় রয়েছে।
সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুরুতে এ বিচার প্রক্রিয়ায় অনেক ত্রুটি ছিল, তার কিছু কিছু সংশোধন করা হলেও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে এবং এ ট্রাইব্যুনাল পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করতে পারছে না।
প্রতিবেদনটির বাংলাদেশ অধ্যায় নিয়ে অ্যামনেস্টির বাংলাদেশ গবেষক আব্বাস ফয়েজ বিবিসি বাংলাকে সরাসরি বলেছেন, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এখনও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হতে পারেনি বলেই তারা মনে করেন।
অ্যামনেস্টি বলেছে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে হলে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশাপাশি যাদের বিচার করা হচ্ছে, তাদের মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ গবেষক আব্বাস ফয়েজের কথায়, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা ক্ষতির শিকার হয়েছেন, তাদের বিচার পাওয়ার অধিকার যেমন রয়েছে, তেমনি যাদের বিচার চলছে, তারা যাতে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন বা তারা যেন নির্যাতনের শিকার না হন, সেটি নিশ্চিত করাও জরুরি। ’
ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তকে যে দেশের অন্য কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না, এটি মানবাধিকারের জন্য একটি বড় সমস্যা বলে তিনি অভিহিত করেন। বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখতেও তিনি পরামর্শ দেন। ফয়েজ অভিযুক্তদের জামিন পাওয়ার অধিকার বিষয়টিও তোলেন এবং একই সঙ্গে সাক্ষ্যদানকারীদের নিরাপত্তা বিষয়টির প্রতিও গুরুত্ব দেন।
তবে ফয়েজ বলেন, জামিন পাওয়া বিষয়ে কিংবা সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার পর আদালতের বিধিমালায় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে—যা ইতিবাচক।
কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে আরও অনেক পরিবর্তন আনা দরকার বলে অ্যামনেস্টির অভিমত এবং তারা তাদের এ বক্তব্য বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছেন।
ফয়েজ বিবিসিকে আরও বলেন, ‘অভিযু্ক্তদের আইনজীবীরা যথাযথ তথ্য পাচ্ছিলেন না। এখানে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা আসলে ঠিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে খাপ খায় না। আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, এসব ক্ষেত্রে আমরা মোটেই সন্তুষ্ট নই। ’
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচার প্রক্রিয়া অ্যামনেস্টি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানান ফয়েজ।
সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটলে অ্যামনেস্টি আপত্তি জানাবে বলেও তিনি জানান।
নারীর প্রতি সহিংসতা : প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর মার্চে প্রকাশিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য চিকিত্সাসেবা, আইনি সহায়তা এবং কাউন্সিলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, কর্তৃপক্ষ এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। যৌন ও অন্যান্য নির্যাতনের শিকার অনেক নারী ও শিশু সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কোনো সহায়তা পায়নি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার : পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের হাতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভূমি দখল হয়ে যাওয়া ঠেকাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অ্যামনেস্টি বলছে, পার্বত্য জেলাগুলোতে দু’পক্ষের সহিংস সংঘর্ষে সম্পত্তির ক্ষতির পাশাপাশি হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বাধা না পেয়ে বাঙালিরা প্রায়ই পাহাড়িদের ঘরে আগুন দিচ্ছে। সেনাবাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সামনেই এটা ঘটছে। ’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন :
বাংলাদেশে হত্যা ও গুম বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে হংকংভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, আওয়াম লীগ সরকার মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে এখনও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের শর্ত পূরণ করা হয়নি বলে মন্তব্য করেছে এইচআরডব্লিউ।
সরকার আইনে কিছু বিধিবিধান সংশোধন করলেও যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যার মতো বিষয়গুলোর সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এখনও নির্ধারণ করা হয়নি বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। বাংলাদেশ বিষয়ে এইচআরডব্লিউ’র বার্ষিক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পুলিশি নির্যাতন, নির্বিচারে গ্রেফতার, এমনকি গুমের নতুন নতুন অভিযোগও বাড়ছে। গতকাল প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিয়োজিত র্যাব সদস্যদের বিচার করার পরিবর্তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ধরনের ঘটনার কথা অস্বীকার করেছেন।
২০১১ সালে সরকার শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের দণ্ডিত করে এবং এনজিওগুলোর বৈদেশিক মঞ্জুরি বিলম্বিত করার মাধ্যমে সুশীল সমাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে।
মিডিয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে একটি বিল প্রণয়নের কাজও চলছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নারী ধর্ষণ, যৌতুক সম্পর্কিত সন্ত্রাস, এসিড হামলা ও যৌন নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য একটি আইন তৈরি করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর নির্বিচার গ্রেফতার, নির্যাতন এবং হেফাজতে রেখে হত্যার ঘটনা অব্যাহত আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সরকার বিন্দুমাত্র সায় দেবে না।
কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের অভিযোগের তদন্ত হয়নি এবং দায়ীদের কোনো শাস্তি দেয়া হয়নি। ২০০৪ সাল থেকে অন্তত ১৬০০ লোক র্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সামরিক বাহিনী ও পুলিশ অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সন্দেহভাজনদের ওপর নির্যাতন, নৃশংস ও অমানবিক শাস্তি অব্যাহত রেখেছে। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহের বিচার ২০১১ সালেও অব্যাহত ছিল। সামরিক আদালতগুলোতে প্রত্যেক আসামির বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা প্রমাণ উপস্থাপনসহ বিচারের মানদণ্ড অগ্রাহ্য করে গণবিচারে প্রায় ১ হাজার জওয়ানকে দণ্ডিত করা হয়েছে।
২৭ জুনের একটিমাত্র বিচারে ৬৬৬ জন আসামির মধ্যে ৬৫৬ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। আরও ৮৪৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তাদের অনেকের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। বিডিআর বিদ্রোহের পর তদন্ত চলাকালেই ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা কোনো আইনজীবীর সহায়তা না-ও পেতে পারেন।
শ্রমিক নেতাদের নিপীড়ন ও বিদেশি অনুদান বিলম্বিত করে নাগরিক সংগঠনগুলোর ওপর ২০১১ সালে নিন্ত্রয়ণ আরও কঠোর করেছে সরকার। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের ওপর সরকার নজরদারি বাড়িয়েছে, এর স্টাফদের হুমকি দেয়া হয়েছে এবং হয়রানি করা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূসকে বয়সের অজুহাত দেখিয়ে সরিয়ে দেয়ার পর তার অনুসারীদের হয়রানি করা হয়েছে।
সংবাদ সূত্র ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।