আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবি সৈয়দ শাহীন এবং তাঁর কবিতায় প্রেম, ভালবাসা

বিজয় তোমাকে বিনম্র অভিবাদন সাহিত্যের একটি বিশেষ সৌন্দর্য আর মেধামণ্ডিত শাখাটির নাম হচ্ছে কাব্য সাহিত্য। এর একটি প্রশাখায় অবস্থান কবিতা নামের দিগ-পাশ-তল শব্দ-অলঙ্কারের সুষম ও পরিমিত ব্যবহারের এক নিপুণ মাধ্যম বলা যায়। আমার হাতে কবি সৈয়দ সাহীনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ: উজানে স্বজন খুঁজি.. প্রথম বলতে গিয়ে আমি আটকে উঠছিলাম! প্রথম- কেন? সত্যি কি প্রথম না আমিই ভুল করছি! তবে এই প্রথমের পিছনে দীর্ঘ আড়াই যুগ সময় ব্যয় হয়েছে...। বহুদিন বিলেতের সাহিত্যাঙ্গন থেকে তিনি ছিলেন বিচ্ছিন্ন... আশির দশকের কবি সৈয়দ শাহীন ২১ শতকের দিত্বীয় দশকে এসে গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। আমি এটাকে এক ধরনের উদাসীনতাই বলবো... তবে সৈয়দ সাহীন শুধু কবি নন, তিনি একজন কথাশিল্পীও, ১৯৯৭ সালের বইমেলায় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ঘর ছাড়া ঘর’ প্রকাশিত হয়।

তাঁকে আমি শুধু কবি বা কথা সাহিত্যিক বললেও ভুল হয়ে যাবে তিনি একজন সার্থক নাট্যকার হিসাবেও সব্যসাচী। কাব্য সাহিত্যের নানা প্রকার আর শ্রেণীর দিক দিয়ে “কাব্যনাটক ও গীতি নাট্য” একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। যদিও সবাই কবিতা লেখার যোগ্যতা-দক্ষতা অর্জন করে ফেলতে পারেন, তবুও অনেক সফল কবিকেই কাব্যনাটকের ক্ষেত্রে খানিকটা হলেও জটিলতা, মনস্তাত্বিক বাধা এবং শব্দালঙ্কারের ব্যবহারে তুখোড় হলেও কিছুটা সীমাবদ্ধতায় আক্রান্ত হন বৈকি! কারণ কাব্য নাটক এবং গীতিনাট্য রচনার বেলায় আছে সুনির্দিষ্ট ধরন, চলন আর কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা। সৈয়দ সাহীন কবিতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে না রেখে তার বিস্তারের একটি মৌলিক ক্ষেত্র তৈরী করতে তাঁর লেখা ‘ওই শুনি শঙ্খধ্বনি’ এবং ‘অনুসর্গের পালা’ গীতি বা কাব্য নাটকগুলো অন্যতম এবং তিনি যথেষ্ট প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পেরেছেন। সৈয়দ সাহীনের অনেক রচনাই আমার ভাললাগার উপজীব্য বিষয়।

আমি তাঁর সাহিত্য প্রতিভার প্রতি বরাবরই অনুসক্ত। আমার হাতে কবির কাব্যগ্রন্থ ‘উজানে স্বজন খুঁজি’, প্রকাশকাল: একুশের বইমেলা ২০১১। প্রকাশ করেছে সত্তিক প্রকাশনী, সম্ভবত সাত্তিক হবে। মুদ্রণ ত্রুটি বলে মনে হচ্ছে। প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করছেন সাত্তিক সাহীন।

সাত্তিক সাহীন, সৈয়দ সাহীনের ছেলে। কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি একজন শিল্পীকেও আমরা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি। প্রচ্ছদের ছাপ যথেষ্ট রুচির পরিচয় বহন করছে। আমি সাত্তিককে ১০০তে ৯৯ শতাংশ মার্ক দিতে পারি.. এক পার্সেন্ট আমার একান্তই নিজস্ব বিচারে বাদ দিয়েছি তা প্রচ্ছদের কালার কম্বিনেশনের জন্য। আমার বিশ্বাস আপনাদের কাছে হয়ত ১০০ ভাগই যতার্থ প্রংসশনীয় হতে পারে।

আমার অভিবাদন সাত্তিককে। গ্রন্থিত হয়েছে সর্বমোট ৫০টি কবিতা এবং সেগুলোকে বিভক্ত করা হয়েছে তিনটি পর্বে, যেমন; আদিপর্ব, মধ্যপর্ব ও অন্তপর্ব। সূচীতে পৃষ্টা নাম্বার মুদ্রিত হয়নি, পর্বগুলোকে ভাগ করতে খালি পৃষ্টায় ছোট করে সাদাকালো গ্রন্থের প্রচ্ছদ সংকলিত হয়েছে। আমার উপর দায়িত্ব ন্যাস্ত হয়েছে গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা করতে এবং বলা হয়েছে আলোচনার জন্য একটি বিষয় বেছে নিতে... । যাইহোক আমার কাছে তাঁর কবিতায় প্রেম, ভালবাসার বিষয়কে সাশ্রয়ী মনে হয়েছে।

তবে প্রেম বা ভালবাসাকে আমরা বিভিন্ন সময়ে কাল-পাত্রভেদে ভিন্নভিন্ন ভাবে দেখি, নর ও নারী প্রেম, ঈশ্বর প্রেম, সমাজ ও দেশজ প্রেম ইত্যাদি। তবে প্রেমের সবগুলো বিষয় নিয়েইতো উজানে স্বজন খুঁজি গ্রন্থের কবিতা । তবে আমি শুধুমাত্র মানবীয় অর্থে নর-নারীপ্রেম নিয়ে আলোচনা করবো। যেমন এই গ্রন্থের আমার প্রিয় একটি কবিতা; ন- হইলে। গ্রন্থের সর্বশেষ কবিতা।

আমার আলোচনার শুরু এই কবিতা দিয়ে। ন-হইলে এই কালাকাল বৃথা যাইবে ন- হইলে এই স্বর্ণালী ধূসর হইবে। --- আমরা সময় ধরবো, সাঁতার কাটবো। তুমি পদ্ম কুঁড়াবে আমি পুষ্প ছড়াবো --- সবশেষে আমি কবি হবো তুমি কাব্য দেবে আমরা কবিতা কেটে কেটে নকশী কাঁথা বুনবো। ন- হইলে এই শিল্প বিবর্ণ হইবে ন-হইলে এই স্বর্ণলী ধূসর হইবে সাধু ও চলিত ভাষারীতির মিশ্রণে তাঁর এই গদ্যছন্দের কবিতাটি একটি অভিনব সৃষ্টি।

এখানে সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের সংক্ষেপণ নিয়ে কোন রকম জঠিলতার সৃষ্টি হয়নি। একটা অস্বাভাবিক গতিতে উচ্চারিত তার ছন্দও কাব্যবিন্যাস। এখানে গুরুচণ্ডালী দোষটা অনায়াসে পরিহারকৃত। সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাধু-চলিত ভাষার বিষয়ে যথেষ্ট বাধ্যবাধকতা আছে তবে কবিতার বেলায় সেটাকে উৎরে গেছেন সয়ং রবীন্দ্রনাথই, তাহাও বিশেষ করে গদ্যছন্দের কবিতায়। নারীপ্রেম বিষয়ে সৈয়দ সাহীন সম্ভবত অসাধারণ অনুভূতিপ্রবণ।

কবিতাটির মধ্যে নর এবং নারী প্রেম বিষয়ক শৈল্পিক রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। প্রতিনিধিত্ব করছে বিশ্বাস, স্বপ্ন এবং অঙ্গিকার। সৈয়দ সাহীনের কবিতা গ্রন্থে প্রেম ও ভালবাসা নিয়ে কবিতার বিষয় হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন প্রেম, নারী, যৌবন, জীবন, স্বদেশ ও সমাজকে। দেবী কবিতায় আমরা দেখি এমন করে: ঈশ্বরের দোহাই ফিরিয়ে নিওনা মুখ দারুন অভিমানে সংকুচিত হয়ো না। জন ডনের কবিতার মতই আরেকটি আবেদন দেখতে পাই- যেমন; For god sake hold your tongue, and let me love.. কবিতাটিতে প্রেমের বিষয়টাকে আপেক্ষিকভাবে তাঁর অধরা রূপ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তিনি।

কবিসত্তার অনন্ত শূন্যতাকে পরিহার করতে এমনই আবেদন তাঁর কবিতায়। অসাধারণ প্রেমময় সৌন্দর্য মন্ডিত পংক্তির মধ্যে ছন্দের অলংকারময় চিত্রায়ন। আমারও সবুজ আছে কবিতাটিতে তিনি বলছেন; এই এক জীবনে কত দেখবি গৌরী এই এক যৌবনে কত ধরবি রং বাহার! আবার এই এক জনম গৌরী আর তো বেশী নয়। এইভাবে একে একে ইচ্ছেরা পাখা মেলে হোলি খেলে রং ছড়ায় এই হয় এই ভাবেই হয়ে যায় শিশিরের স্বপ্নীল ঘাসে পতন। ভেবোনা, আমারও সবুজ আছে।

ভেবোনা, আমারও সবুজ আছে। এই লাইনটির ভেতর দিয়ে কবি তার যৌবণের কথাই বলছেন, চ্যালেঞ্জ করছেন গৌরী বলে আখ্যায়িত তার প্রেমিকাকে। বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণাজাত অস্থিরতা, তাঁর কবিতার নামকরণ, চরণ ও শব্দবিন্যাস এবং ছন্দ-অলঙ্কার প্রয়োগের মধ্যেও আভাসিত হয়েছে। প্রেম প্রত্যাশায় তাঁর আকুতি আরূঢ় আত্মসমর্পণে পরিণত হয়েছে কখনো কখনো। কখনো আবার প্রণয়িনীই হয়ে উঠেছে স্বৈরিণী।

সৈয়দ শাহীন তার ‘প্রেম’ কবিতায় মুখরিত জলসায় সব কোলাহল একপাশে ঠেলে যে তানপুরা সুর তোলে বলি ভাল আছি। পরানের গহীনে গলিয়ে বরফ ও বললে বেশ। রেশটুকু তার মনের মধ্যে রয়েই গেলো। এবং আবার দেখা হলো হঠাৎ করে যেমন হয়ে যায় ঠোঁটে মোনালিসার রহস্য ধরে বলল যাচ্ছে দিন চলিচলি। জনান্তিকে একান্তে বললেম রাতের প্রহর স্বপ্বে আঁকড়ে ধরে রাখে।

প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও কবির প্রতি প্রণয়ে স্থিত হচ্ছে না সেই নারী। শুধু শুধু তার সম্মোহনী দৃষ্টি দিয়েই কবিকে আকৃষ্ট করছে বার বার। তার রহস্যময় আচরণে জটিল হয়ে যাচ্ছে কবির অন্তর। মোনালিসার ঠোঁটের রহস্যের মতো কবির কাছে প্রেম যেন একান্তই রহস্যময় তারপরও তিনি বিশ্বাসবিচ্যুত হোননি কারন পরিশেষে তিনিই বলছেন; পদ্মফুলে সুবাসিত ওর হাত দুটি টেনে ভালবাসার ঢালি বুকের তৃষিত অলিন্দে এইতো সুখে আছি। কবির আরেকটি কবিতা- রাধা আমি এবং নিমগ্ন প্রহর রাধাকে প্রায় ভাবি জিজ্ঞেস করি কি এতো মগ্ন প্রেমে! আবার তাঁর ইচ্ছে করে... রাধাকে প্রায়ই ইচ্ছে হয় নিয়ে যাই ব্রজধাম আরন্যক গোধুলীর মায়াবী খেলায় গায়ে মাখি সমাহিত সুখের প্রলেপ প্রেমের জলকেলী আর কি চাই! এখনও কখনও সেইভাবে রাধার সাথে হয়নি দেখা।

তবুও কবি তার প্রেম প্রত্যাশায় উদগ্রীব। প্রেম উচ্ছ্বাসে অভিহিত যৌবন তাঁর কাছে বৈরী অথচ আকাঙ্খায় পরিণত হয়েছে শেষ পর্যন্ত। আর সব উদার প্রেমিক কবির মতো সৈয়দ সাহীনের জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত জিজ্ঞাসার নিরন্তর উৎস এই পৃথিবী ও পার্থিব জীবন। অনেকটা হতাশামগ্ন, সীমাহীন শূন্যতায় আচ্ছন্ন যদিও কিন্তু তিনি বাস্তবতা নিয়ে আশাবাদী... তুমি চলে গেলে কবিতাটির একটি পর্বে তিনি লিখেছেন; তুমি চলে গেলে আমার শৈল্পিক তুলি সব শুকিয়ে যাবে যতসব ভালবাসা খরজলে নিদাঘ ঘৃণা হবে! কবিতাটিতে শব্দের নির্মান কুশলতাও জটিল নয় । চিত্রকল্প বেশ মনোরম।

উপমা ও দৃশ্যকল্প রূপকার্থে ও চিত্রকল্পে সরস। খরজলে নিদাঘ ঘৃণা হবে- কবির ভেতরের উদ্বেগ, শংসয়, ঘৃণা আর অতৃপ্ততাকে চিত্রিত করছেন খরজল শব্দের নান্দনিক উপমায়। মেটাপোর অত্যন্ত সাবলীল এবং শৈল্পিক। কবিতার নির্মাণ শৈলীতে গদ্যগুণসমৃদ্ধ আধুনিকতার ছাপ বিদ্যমান। পোড়ামুখী তুই দিলি কি আর দিবি কি আর নিবি পোড়ামুখী বল গলা জলে গলায় দড়ি এ কোন পিরিত বল! ঘর ছাড়াইয়া ঘর বাঁধিলি সেই ঘরেতে ঘর বাধাঁলি বিরান মাঠে চিতা দিলি আর কি দিবি বল পোড়ামুখী আর কি নিবি বল.. চমৎকার পদ্যছন্দে বাধিত সহজ পঙক্তিমালা।

শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সৈয়দ শাহীন কোন চাতুর্যতা কিংবা জোর জবরদস্তী করেননি। কবিতাটির চিত্রাংকনে সংশ্লিষ্ট পরিবেশ ও কবিতার গল্প নির্মাণের প্রয়োজনেই তিনি এসব শব্দকে অতি সহজ সরল ভাবেই প্রয়োগ করেছেন। সহজ স্বীকারোক্তিতে সেটা শুধু বক্তব্যে ও চিন্তায় কাব্যদেহে সমাচ্ছন্ন হয়নি। সহজ শব্দচয়ন কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর বিচিত্র উপমা ও চিত্রকল্পের উপাখ্যান এবং ভাষা ব্যবহার কৌশল আমাদেরকে একদিকে যেমন একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে জাগিয়ে তুলেছে আমাদের চিরন্তন আগ্রহ ও কৌতুহল।

চটপটে পঠিত, একান্তই সারল্যও ছন্দবদ্ধ। তার সঙ্গে আছে সেই ঘুরে ঘুরে ধ্বনি, কিংবা শব্দচিত্রের পর শব্দচিত্রের বিন্যাসে একটা আবর্ত সৃষ্টি, এক প্রচ্ছন্ন আর্কেস্ট্রার নিবিড়তা। যেমন আরেকটি কবিতায় আমরা দেখি: জলছল আঁখি ছলছল মন ছলছল করে যেথা মর্মর ব্যথা মোর মোর-তুমি নাই ঘরে। আবার মনের ঘরে মন রাখো দেহের পরে দেহ আজ ভালবাসার জলসাঘরে লয়ের সমারোহ। এখানে আরো বেশ কিছু কবিতায় যেমন ভালবাসা: পক্তিমালা ভালবাসা: কথা মালা অথবা ভালবাসা: পদাবলী ভালবাসা: শব্দাবলী একই রকম ছন্দের বা ছন্দবদ্ধ পঙ্ক্তি তাঁর কবিতায় বিরল নয়.. যেমন: তোমায় যেদিন কাছে টানি হাটতে জনারণ্যে একশ একটা পাখি উড়ে আমার উদ্যানে অথবা আমার চোখে যেদিন তুমি রাখলে তোমার চোখ সাত সাগরের পিয়াস এসে ধরফড়ালো বুক।

শব্দ ব্যবহারের দক্ষতায়, উপমা রূপকের চাতুর্যে, চিত্রকল্পের পরিকল্পনায় তিনি পূর্ণত নাগরিক বৈদগ্ধের অধিকারী। রোমান্টিকতা তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য, সেহেতু নারী প্রণয় তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় অনুষঙ্গসমূহের অন্যতম। সকল কবির ন্যায় তিনিও ভালোবাসার আশায় উদ্দীপিত, নারী সৌন্দর্যে নিবেদিত, এবং শুধু নারী প্রণয়ের বিনিময়েই আত্মসর্বস্ব বিসর্জন দিতেও অপরাঙ্মুখ থাকেন। কখনো আবার ভালোবাসা হারানোর আশঙ্কায় হন বেদনাহত। এমনকি অবস্থার প্রেক্ষিতে কখনোবা বিদ্রোহী প্রেমিকও।

এসবের প্রত্যেকটিতেই রয়েছে শিল্পীসুলভ আবেগের অকপট প্রকাশ। প্রেম যে পরম আকাঙ্ক্ষার বিষয় তা তাঁর কবিতা পাঠের প্রারম্ভেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। জলপাই রং শাড়ীর রমণী খেলা আসো কিবা নাহি আসো খেলাঘর নন্দিনীর সাথে ঘর সংসার আলাপচারী ব্রজের রমনী ইত্যাদি কবিতাগুলো মুলত প্রেম বা ভালবাসার রঙ তুলিতে চিত্রায়িত একেকটি আলাদা আলাদা নির্মাণ শৈলী। পদ্য ছন্দের সারল্যতাকে ছাড়িয়ে তাঁর গদ্য কবিতায়ও পাওয়া যায় ক্ষেত্র বিশেষে বাঁধা ছন্দের ধ্বনিস্পন্দন৷ তাতে তাঁর গদ্য কবিতার চারিত্র্য বিনষ্ট হয়নি। আপন কবিসত্তা নিয়ে সংশয় ও সাহস দুটোই ব্যক্ত হয়েছে তাঁর কবিতাগুলোতে।

খুবই স্পষ্ট ও সরল স্বীকারোক্তি। হৃদয় ছোয়া উপমা উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি, অনুপ্রাস, প্রতীক ও রূপকল্পের বৈচিত্রময়তাই মুলত আধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ কাব্যগ্রন্থের ভালবাসা ,প্রেম ও বিরহকে কেন্দ্র করে সবগুলো কবিতা নিয়ে আজ আলোচনা সম্ভব না। হয়ত একটা দীর্ঘ আলোচনা হতে পারতো, এবং আমার বিশ্বাস আমি আলোচনা করবো। কারন আগেই বলেছি সৈয়দ সাহীনের সাহিত্যের প্রতি আমার উদাসীনতা রয়েছে।

আমি বলবো উজানে স্বজন খুঁজি কাব্যগ্রন্থে শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি বাছ বিচার করেননি। দুর্বোধ্য শব্দ চয়নের মাধ্যমে অভিধানের ধারস্থ হননি এবং কবিতার গতি, ছন্দময়তাকে বিনষ্ট করতে দেননি । সত্তর দশকে এসে কবিতায় রাজনৈতিক ভাষা শ্লোগান প্রধান করে কথা ক’য়ে উঠলেও কোথাও কোথাও সহজতা হয়ে পড়ল যোগ গদ্য-পদ্য প্রধান। যেখানে ভাবের সন্ধান মিললেও শিল্প ব্যাহত হলো কিন্তু আশির দশকের শেষের দিক থেকে নব্বুইয়ের দশকের কবিদের ভেতরে দ্রুত চেঞ্জ লক্ষণীয় এবং সেখানে সহযোগীতা করলো সাহিত্যের ছোট কাগজগুলো কিন্তু সে যাত্রার ধ্বনিই হয়ে পড়ল জটিল-কুটিল। জটিল-কুটিল অর্থে দুর্বোধ্যতার প্রচারণাকে বুঝাতে চাচ্ছি।

শব্দ ব্যবহারের চাতুর্যতায় শিল্পময় সুন্দর ও কবিতার গতি বিচ্যুত বলা যায়। অভিধানের সাহায্য নিয়ে কবিতা যদি লেখার মানুষিক প্রক্রিয়া বাড়ে তাহলে সাহিত্যে নতুন শব্দের যোগন দেবে কারা? কবিদেরইতো সেখানে এগিয়ে আসার চিন্তা করতে হবে। শব্দ চয়নকে বস্তুনিষ্ট ও স্বাভাবিক রাখা কবিদের জন্য অতি বাঞ্চনীয়। বর্তমান সময়ে তৃতীয়বাংলার কবিদের ভেতরেও সে রকম একটা শব্দ বিলাসিতার উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সৈয়দ সাহীন সম্পূর্ণ আলাদা।

খুবই সুস্পষ্ট ভাবে তিনি এড়িয়ে গেছেন কৃত্রিমতাকে। সুন্দর ও নান্দনিক চিন্তাকে তিনি লালন করেন। তিনি সচেষ্ট এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধে বিশ্বাসী। সৈয়দ শাহীন দীর্ঘদিন পর প্রকাশ করেছেন কাব্যগ্রন্থটি, তবে প্রকাশনার কাজে নিশ্চয়ই তাড়া করেছেন। এবং প্রকাশকনার বিষয়ে নিতান্তই উদাসীনতা কাজ করেছে।

কবিতায় যদি মুদ্রণ ত্রুটি থাকে সেটা মারাত্বকভাবে আপত্তিজনক। আমার মনে হয় তিনি এ বিষয়ে যথেষ্ট সাবধান থাকবেন আগামীতে। সৈয়দ সাহীন তিনি সুন্দরের স্বপ্নকে লালন করেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণায় । আর তাঁর এ যাত্রার জন্য তিনি হৃদয়ে সঞ্চিত রাখেন কবিতায় প্রেমের মন্ত্রমুগ্ধতা । আর এ মন্ত্রমুগ্ধতাতেই অবগাহন করে তিনি সামনের দিকে এগুতে চান ।

কবিকে অভিবাধন এবং সাহিত্যে তাঁর আবারও শোভাযাত্রা কামনা করছি। আর যেন আমরা তাঁকে না হারিয়ে ফেলি। আমার বিশ্বাস কবিরা যেখানে যে অবস্থানে বা পরিবেশে থাকেন না কেন তাকে কবিতায় ফিরে আসতেই হয়। আর এ বিশ্বাসের সবচেয়ে বড় উদাহরন কবি সৈয়দ শাহীন। পাঠক গ্রন্থটি পড়ার সুযোগ পেলে হয়ত আরো বেশি উপকৃত হতে পারতেন।

আমার আলোচনার ভেতর দিয়ে হয়ত অনেক বিষয়ই স্পষ্ট নাও হতে পারে। তাই পাঠকদের অনুরোধ করবো গ্রন্থটি পাঠের সুযোগটা গ্রহণ করতে। জয় হোক কবি ও কবিতার।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।