মন্দটাই মনে রাখে মানুষ। ভালোটা হাড়গোড়ের সঙ্গে মাটিতে মিশে যায়
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সালমান খানের জন্ম ১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্সে। সম্প্রতি টাইম ম্যাগাজিন নির্বাচিত বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির মধ্যে স্থান পেয়েছেন সালমান। ১০ মে ২০১২ রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি এই বক্তৃতা দেন।
আজ এখানে বক্তৃতা দিতে পারা আমার জন্য সত্যিই এক বিরাট সম্মানের ব্যাপার।
আমি বেশ বুঝতে পারছি যে, এখানে দাঁড়ানোয় ৩৫ বছরের নিজেকে তোমাদের তুলনায় অনেক বয়স্ক দেখাচ্ছে! কিন্তু আমার নিজের কাছে মনে হচ্ছে, আমি যেন আমার ছোট ভাইবোনদের কিছু বলতে এসেছি। আজ আমি তোমাদের সঙ্গে কিছু চিন্তাভাবনা শেয়ার করতে চাই। এমন কিছু ব্যাপার, যা নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি, দেখতাম এবং এখনো দেখছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমরা একটি বড় ডিগ্রি অর্জন করতে যাচ্ছো। নিঃসন্দেহে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্মান।
এই সম্মান তোমাদের জীবনকে অনেকখানি এগিয়ে দেবে। তোমাদের এই অর্জন কাজে লাগিয়ে কীভাবে পৃথিবীর সামগ্রিক উন্নয়ন আরও বৃদ্ধি করা যায়, পৃথিবীটাকে আরেকটু সুন্দর করা যায়, সেটা নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে।
২০০৯ সালে আমি যখন খান একাডেমি শুরু করি তখন আমি একটা সাজানো-গোছানো, সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝপথে। আমার ভিডিওগুলো দেখে তখন পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে লোকজন ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লিখত। কিন্তু একদিকে চাকরি আরেকদিকে খান একাডেমি, দুটোকে একসঙ্গে সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
আমি তখন আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমাদের হাতে কী পরিমাণ টাকা-পয়সা আছে তার হিসাব করতে বসলাম। আমি তাকে বোঝালাম কীভাবে খান একাডেমি দিয়ে শিক্ষার প্রচলিত ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে মানুষের শেখার ধরনকেই আমূল বদলে ফেলা যাবে, কীভাবে পৃথিবীজুড়ে মানুষ ঘরে বসে বিনা খরচে শিখতে পারবে, সভ্যতাকে কত সহজে কতখানি এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। আর একবার এই সম্ভাবনা মানুষ বুঝতে পারলে এই মহৎ কাজে বিনিয়োগের অভাব হবে না। এমন এটাসেটা অনেক কিছু বুঝিয়ে আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম! আর পুরোপুরি খান একাডেমির কাজে লেগে গেলাম। আস্তে আস্তে নয় মাস কেটে গেল, অনেক কিছু করতে চেষ্টা করলাম, অনেক লোকজনের সঙ্গে কথা বললাম, মিটিং করলাম।
কিন্তু যা ভেবেছিলাম তার কিছুই হলো না।
সত্যি কথা বলতে কি, আজ যখন লোকে শোনে আমি হার্ভার্ড, এমআইটিতে পড়াশোনা করেছি, তারা মনে করে কত সহজেই না আমি ভিডিও বানানো শুরু করেছি আর রাতারাতি খান একাডেমি গড়ে তুলেছি। কিন্তু কেবল আমিই জানি সেই সময়গুলো কতটা কঠিন ছিল। দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গিয়েছিল প্রায়। আমার তখন ৩২ বছর বয়স, একটি ছেলেও হয়েছে, বাড়ি কেনার জন্য ৩০-৪০ হাজার ডলার ডাউনপেমেন্ট দিতে হবে—এমন অনেক সমস্যা তখন আমাকে ঘিরে রেখেছে।
সে সময় কেউ আমাকে দেখলে বলত আমি নির্ঘাত বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছি। আমি আমার পরিবার নিয়ে অনেক সুন্দর একটা জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আর আমিই সবকিছু নিজের হাতে নষ্ট করে ফেলেছি। সেই সময় একটা জিনিসই আমাকে একটু আশার আলো দেখাত, আর তা হলো অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা ভরা চিঠি।
কিন্তু তার পরও, একটা পর্যায়ে আর চালাতে না পেরে আমি হতাশার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলাম। যখন প্রায় ঠিক করেই ফেলেছিলাম সবকিছু ছেড়ে দেব, ঠিক তখনই আমার কাছে খান একাডেমির নামে ১০ হাজার ডলারের অর্থ পুরস্কার আসে।
এর আগে বেশির ভাগ লোক পাঁচ কিংবা ১০ ডলার করে পাঠাত। সেটাই ছিল তখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় অঙ্কের টাকা। সেটি পাঠিয়েছিল এই রাইস বিশ্ববিদ্যালয়েরই ১৯৭৫ সালের ব্যাচের একজন, তার নাম অ্যান ডোয়ার। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ই-মেইল করি। সে কাছেই থাকত, একদিন দুপুরে আমরা এক রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে কথা বলছিলাম।
অ্যান আমার কাছে জানতে চাইল আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী। আমি বললাম, এখনকার মতো আমি সারাজীবন ধরে ভিডিও বানিয়ে যেতে চাই! আমি বলেই যাচ্ছিলাম এটা নিয়ে আমার কত স্বপ্ন, কত কিছু করার আকাঙ্ক্ষা। কীভাবে খান একাডেমি সারা পৃথিবীর শিক্ষাব্যবস্থা বদলে দিতে পারে! সে বলল, ‘বুঝলাম তোমার অনেক বড় পরিকল্পনা! কিন্তু তুমি নিজে চলছ কীভাবে?’ আমি তখন বোধহয় একটু বেশি জোরেই বলে ফেলেছিলাম, ‘আমার তো চলছে না!’
যাই হোক, আমার কথা শুনে তিনি গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন, আমরা বিদায় নিলাম। আমি যখন বাড়ির প্রায় কাছে পৌঁছে গেছি, তখন অ্যানের কাছ থেকে আমি একটি মেসেজ পাই। সেখানে লেখা, ‘তোমার নিজেরও তো চলতে হবে, তাই আমি টাকার অঙ্কটা বাড়িয়ে এক লাখ ডলার করে দিচ্ছি।
’ আমি আরেকটু হলেই গাড়ি নিয়ে সোজা গ্যারেজে ধাক্কা খেতে যাচ্ছিলাম!
সেই মুহূর্তে টাকার অঙ্কের চেয়েও বেশি সাহায্য করেছিল খান একাডেমির সম্ভাবনার ওপর অ্যানের গভীর আস্থা। আজকে এসব শুনে অনেকেই বলবে, অ্যানের অঢেল টাকা ছিল, তাই সে সাহায্য করতে পেরেছে। আমার অত টাকা-পয়সা নেই যে, কাউকে এক লাখ ডলার দান করে দিতে পারি। এখানেই আমার দ্বিমত। আমি অন্তত এমন ৫০ জনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, যাদের আর্থিক অবস্থা অ্যানের চেয়েও অনেক ভালো ছিল।
কিন্তু তারা তো এগিয়ে আসেনি!
একটা কথা আমি খুব জোর দিয়ে বলব, যদি কখনো এমন অবস্থানে থাকো, যেখানে তোমার একটু সাহায্যে অন্যের অনেক বড় কোনো উপকার হতে পারে, তবে কখনো তাকে উপেক্ষা করো না। আমি সব সময় যা করতে চেষ্টা করি এবং অন্যদেরও করতে বলি, তা হলো কখনো যদি দেখ কেউ অসাধারণ কোনো কিছু করছে কিংবা করার চেষ্টা করছে, চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থেকো না। তাকে প্রশংসা করো, ধন্যবাদ জানাও, তার কাজের স্বীকৃতি পেতে সাহায্য করো। তার বসকে জানাও কী সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে তার মধ্যে। তার পরিবারকে জানাও কত বড় কাজ করছে সে।
তুমি কল্পনাও করতে পারবে না তোমার ছোট্ট একটি পদক্ষেপ, একটি প্রশংসা বাক্য কীভাবে একজন মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। তোমার উৎসাহে কেউ হয়তো তার জীবনের লক্ষ্যই বদলে ফেলতে পারে। একজন ইতিবাচক চিন্তাধারার মানুষ তার চারপাশের অসংখ্য মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে, তাই সব সময় ইতিবাচক চিন্তা করো। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যদি তুমি তোমার স্বপ্ন সফল করতে চাও, সব সময়, সবকিছু থেকেই শিখতে চেষ্টা করো। নতুন কিছু শেখার জন্য নিজেকে সব সময় প্রস্তুত করে রাখা কতটা দরকার তা আমি বলে বোঝাতে পারব না।
তোমাদের সামনে যে সময় অপেক্ষা করছে, তা তোমরা শেখার জন্য বিনিয়োগ করো। আমি খান একাডেমির সঙ্গে আছি বলে মানুষ কীভাবে শিখতে শিখতে জীবন বদলে ফেলে, এ ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। ২০০৮ সালে দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত একজন রোগীর কাছ থেকে আমি একটি চিঠি পাই। তখন তার জীবনের মেয়াদ আর মাত্র দুই মাস। কতখানি ইতিবাচক মনোভাব থাকলে মৃত্যুপথযাত্রী একজন মানুষ লিখতে পারে, ‘আমার অনেক দিনের শখ ছিল ক্যালকুলাস শিখব, এখন খান একাডেমি আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে।
আশা করি জীবনের শেষ দুই মাসের মধ্যেই আমি ক্যালকুলাস শিখে ফেলতে পারব!’ কী অসাধারণ মানসিক শক্তি, কতখানি তীব্র শেখার ইচ্ছা। সেই চিঠি দেখার পর আমি ঠিক করেছি, যতদিন বেঁচে থাকি, কখনো শেখা থামাব না।
১৯৯৮ সালে আমি যখন তোমাদের মতো গ্র্যাজুয়েশন করি, তখন আমার কিছু কাজ নিয়ে একটা কম্পিউটার ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ ছাপা হয়। আমার সেটা নিয়ে খুবই গর্ববোধ হয়েছিল। কিন্তু আমার তেমন কোনো লক্ষ্য ছিল না।
নিজেকে নিয়ে কোনো পরিষ্কার ধারণাই ছিল না যে, আসলে আমি কী করতে চাই। একটা চাকরি শুরু করার দুই মাসের মধ্যেই আমি আরও বেশি বেতনে আরেকটা চাকরি পাই, আর সেখানে চলে যাই। সেখানে প্রথম তিন দিনেই বস আমাকে বেশ ভালো করে বুঝিয়ে দেন, আমি তাঁর চোখে কতটা অযোগ্য। ব্যাপারটা ভেবে দেখো! মাত্র ২৩ বছর বয়সে সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রি, ম্যাগাজিনে ছাপানো প্রশংসা, সবকিছু নিয়ে রাতের বেলা আবিষ্কার করলাম আমি হোটেল রুমে বসে বসে কাঁদছি। আমি জীবনে আসলেই কী করতে চাই তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
সেই রাতে মনে হচ্ছিল চোখের সামনে পৃথিবীটা দুলছে, সবকিছু অর্থহীন লাগছে। কিন্তু তার পরও পরদিন ভোরে উঠলাম, কাজ করলাম, গত রাতের চেয়ে একটু ভালো লাগল। এক সপ্তাহ পর আরেকটু মানিয়ে নিতে পারলাম, দুই মাসের মধ্যে আবার নতুন এক জায়গায় কাজ করা শুরু করলাম!
যখন সাফল্য আসবে, তাকে উপভোগ করো, কিন্তু এটাও খেয়াল রেখো, তুমি ঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছ কি না। যতই বড় হও না কেন, মনে রেখো সবকিছুরই একটা শেষ আছে। সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটিও জ্বলতে জ্বলতে একদিন নিভে যাবেই।
তাই ব্যর্থতার জন্য প্রস্তুত থেকে সাফল্যকে উদ্যাপন করো। ছোট ছোট খুশির বিষয়কে অবহেলা করো না, আবার দু-একবার হোঁচট খেলেও হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পোড়ো না। এখন থেকে ১০-১৫ বছর পর হয়তো এগুলো মনে করেই তুমি হাসবে, ভাববে কী ছেলেমানুষই না ছিলাম!
জীবনকে, এখনকার সময়কে একটা অনন্য সুযোগ হিসেবে দেখো। সাফল্যের পেছনে যতই ছুটে চলো না কেন, এই মানবিক ব্যাপারগুলো ভুলে যেও না। প্রাণ খুলে হাসো।
প্রিয়জনদের সময় দাও, তাদের বলো কতটা ভালোবাসো। চারপাশের মানুষের জন্য কিছু করো। মনে করো, এটা তোমার কল্পনা থেকে ফিরিয়ে আনা দ্বিতীয় জীবন। এ জীবন আফসোসের জন্য নয়।
সূত্র: ওয়েব সাইট, প্রথম আলো ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।