স্কুলে যখন ভর্তি হইনি, খেলা মানেই বুঝতাম বোনদের সাথে হাড়ি-পাতিল খেলা। সাদা কাগজ টুকরো টুকরো করে মিথ্যামিথ্যি ভাত, আম্মার টবের গাছের পাতা ছিড়ে সবজি, আর ভেঙে যাওয়া হাড়ি-পাতিলের টুকরো দিয়ে মাংস রান্না করতাম। মিথ্যামিথ্যি অফিস যাওয়া, পুতুলদের ঘুম পাড়ানো - সবই হত।
বিকালবেলা বড় দুই বোন পাশের মাঠে খেলতে যেত। আমরা দুই বোন তখনও ছোট বলে যাওয়ার অনুমতি পেতাম না।
একদিন বড় দুই বোন নিয়ে গেল আমাকে। চুপচাপ মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখছিলাম। গোল্লাছুট না দাঁড়িয়াবান্দা কি যেন বলে, সেটা খেলছিল ওরা। সেই খেলা শেষ হলে শুরু হল ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা। একজন চোর সবাইকে ধাওয়া করবে, যাকে ছুঁয়ে দিবে সে চোর হবে, আবার সে সবাইকে ধাওয়া করবে।
এইবার আমাকে খেলায় দুধভাত হিসেবে নেয়া হল। দুধভাতে সুবিধা হল কখনও আমাকে ছুঁয়ে ফেললেও আমি চোর হব না। এটা আসলে সান্ত্বনামূলক পুরস্কার, যেটা পিচ্চিদের দেয়া হত।
যা হোক, দৌড়াদৌড়ি করে যাচ্ছি মনের সুখে। মাঠের এক পাশে কাঠমিস্ত্রীরা কাঠ কাটছিল।
প্রতিবার ঐদিক দিয়ে দৌড়ানোর সময় মাথাটা একটু কাত করে সরিয়ে নিচ্ছিলাম যাতে মাথায় না লাগে। এক সময় মনে হল, আমি তো শুধু শুধুই মাথা কাত করছি, আসলে ওটা আমার মাথায় লাগবে না। এর পরের বার ঐ দিক দিয়ে দৌড়ে যাওয়ার সময় আর মাথা কাত করলাম না। বেশি পন্ডিতি করলে যা হয়, তা-ই হল। ধড়াম করে একটা কাঠের সাথে আমার পিচ্চি মাথার সংঘর্ষ হল।
কপালের একদিকে কেটে রক্ত বের হতে থাকল। ব্যথা কতটুকু পেয়েছিলাম মনে নেই, ভয়েই চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলাম। বড় দুই বোন তাড়াতাড়ি আমাকে বাসায় নিয়ে এল। আম্মা ওদেরকে বকতে বকতে আমাকে ড্রেসিং করে দিলেন। আমাদের মাঠে খেলতে যাওয়া বন্ধ।
মাঠে খেলা বন্ধ হলেও আমরা বসে থাকতাম না। ঘরেই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতাম। কত যে ঠাস-ঠুস, ধড়াম-ধুড়ুম বাড়ি খেয়েছি কত কিছুর সাথে। তবে এখন আর কাঁদতাম না। নইলে বাড়িতেও খেলা বন্ধ হয়ে যাবে।
বাড়িতে আরও খেলতাম কানামাছি। একজনকে চোর হতে হত। একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে তার চোখ বাঁধা হত। এরপর সে সবাইকে ছু্ঁয়ে দিতে চাইত। যাকে ছুঁতে পারত সে হত চোর।
আর যতক্ষণ সে ছোঁয়ার চেষ্টা করত ততক্ষণ বাকীরা ছুটে পালাতে চাইত আর মুখে সুর করে বলতে থাকত, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাস তাকে ছোঁ।
ঘরে আমাকে খেলায় ঠিকমতই নেয়া হত, আর ছোটবোনকে রাখা হত দুধভাত। একটা সময় ঘরে এসব খেলা মুশকিল হয়ে গেল, ফার্নিচারের সংখ্যা কিছু বেড়ে যাওয়ায়। তখন আমরা নিয়মিত বিকালবেলা ছাদে চলে যেতাম। অন্যান্য ফ্ল্যাটের পিচ্চি-পাচ্চারাও চলে আসত।
সবাই মিলে গোল্লাছুট, ছোঁয়াছুঁয়ি, কানামাছি ছাড়াও ফুলটোক্কা আর এক্কা-দোক্কা খেলতাম।
ফুলটোক্কা খেলাটা আমার খুব পছন্দের ছিল। দুইটা দল করা হত। একেক দলের একেকজন রাজা থাকত, প্রতি দলে তিন-চারজন করে প্রজা থাকত। রাজা তাদের প্রজাদের প্রত্যেককে একটা করে ছদ্মনাম দিত গোপনে।
এরপর মাঝখানে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে মুখোমুখি বসত দুই দলের প্রজারা। এক দলের রাজা আরেক দলের কোন এক প্রজার চোখ দুই হাতে বন্ধ করে তার নিজের কোন এক প্রজাকে ডাক দিত ছদ্মনামে, আয়রে আমার গোলাপ ফুল। গোলাপ ফুল নামের প্রজা তখন এসে চোখ-ঢাকা প্রজার কপালে একটা টোকা মেরে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসে থাকত। এরপর এই চোখ-ঢাকা প্রজাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হত অন্য দলের প্রজাদের সামনে। সে এখন বলবে, কে তাকে টোকা দিয়েছে।
যদি ঠিকমত বলতে পারে তাহলে চোখ-ঢাকা প্রজা তার নিজের জায়গা থেকে একটা লাফ দিয়ে এগিয়ে আসবে, আর না পারলে যে টোকা দিয়েছিল, সে লাফ দিয়ে এগিয়ে যাবে। এভাবে লাফ দিয়ে দিয়ে এক দলের প্রজা অন্য দলের রাজত্বে চলে গেলে সেই দল জিতে যাবে।
এইখানে চলত নানান রকম চোরামি। যার যার দলের রাজা নিজের প্রজাদের বুদ্ধি শিখিয়ে দিত অন্য দলের প্রজাদের ঠিকমত চেনার জন্য। তাদের জন্য সংকেত থাকত।
একবার খুক করে কাশলে একজন, দুইবার খুক করে কাশলে আরেকজন, হাঁচি দিলে আবার আরেকজন। অথবা কোন ইশারা থাকত, কপালের চুল সরালে একজন, কান চুলকালে আরেকজন, থুতনি ধরে চিন্তা করতে থাকলে আরেকজন। মাঝে মাঝে আগেই চুক্তি করে নেয়া হত যে এইসব চোরামি করা চলবে না। রাজাকে সরিয়ে রাখা হত অনেক দূরে যাতে সংকেত দিতে না পারে। এরপরও চোরামি চলত।
যেমন চোখ ধরে যখন নিয়ে যাচ্ছে প্রজা চেনার জন্য, তখন হয়ত কেউ বলে উঠল, এই এত জোরে চোখ ধরলে তো ব্যথা পাবে। এটা আসলে একটা সংকেত।
এই খেলাটা স্কুলেও সময় পেলে খেলতাম। স্কুলে অবশ্য মাঠে খেলার সুযোগ ছিল কম। ক্লাসে বসেও নানান রকম খেলা খেলতাম।
তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল নাম-দেশ-ফুল-ফল। একটা অক্ষর দিয়ে দেয়া হত, সেই অক্ষর দিয়ে মানুষের নাম, দেশের নাম, ফুলের নাম আর ফলের নাম লিখতে হবে। সবাই আলাদা করে লিখবে। এরপর মিলানো হবে। যাদেরটা একরকম হবে তাদের দুজনেরটাই কাটা পড়বে।
যে কয়টা কাটা না যায়, সেগুলোর প্রত্যেকটার জন্য ১০ কিংবা ১০০ করে নম্বর পাবে। এইভাবে খেলা শেষ হলে নম্বর যোগ করে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ...... লাড্ডু ঘোষণা করা হবে। এখানে সবাই চেষ্টা করত আনকমন নাম লিখতে। কিন্তু দেখা যেত যারা আনকমন লিখতে চাইত তাদেরটাই বরং কমন হয়ে কাটা পড়ত। আর ভুল নাম লিখলেও কাটা পড়ত।
মাঝে মাঝে কেউ দেশের নামের জায়গায় রাজধানী লিখে ফেললে সেই নিয়ে চলত তুমুল বিতর্ক। মানুষের নাম হত সবচেয়ে মজার। যে যাই লিখুক, এটা তো ভুল ধরা যাবে না। গ দিয়ে গাবলুশ, ম দিয়ে মোটু - সবই নাম। ফুল-ফলের নাম নিয়েও তর্ক বেঁধে যেত।
ল দিয়ে লাল গোলাপ, আ দিয়ে আতাফুল - এগুলো নিয়ে প্রায়ই অবজেকশন উঠত। একবার তো কে যেন খ দিয়ে খয়েরী গোলাপ লিখেছিল। শেষ পর্যন্ত সে আর তর্কে টিকতে পারেনি, তাকে নামটা কাটতেই হয়েছে।
ছোটবেলায় দোস্তি পাতানোও ছিল একটা খেলার মতই। দুজনের বুড়ো আঙ্গুল একসাথে করলেই হয়ে যাবে 'ভাব'।
আর কোন কারণে একটু তর্কাতর্কি হলেই কাইন আঙ্গুল (কনিষ্ঠাঙ্গুলি) একসাথে করে নিয়ে 'ভাব' কেটে হয়ে যাবে 'আড়ি'। ঝগড়া মিটলেই বুড়ো আঙ্গুল একসাথে করে আবার 'ভাব'। তবে মাঝে মাঝে একটু অন্যরকমও হত। একবার কোন এক কারণে রেগে গিয়ে আমার এক সখীকে স্বার্থপর বলেছিলাম। সে এতে মান করে আমার সাথে কথাই বন্ধ করে দিল।
পরে আরেক সখীর মধ্যস্থতায় ব্যাপারটা মিটমাট হয়। তখন আঙ্গুলের ধার না ধেরে সে আমার কাছে এসে দুই হাত দিয়ে খামচি মেরে 'ভাব' করে নিল। এই খামচি-মারা 'ভাব' এখনও টিকে আছে।
আরেকটা মজার ব্যাপার ছিল। কারও সাথে কিছু মিলে গেলে সাথে সাথে তাকে চিমটি কাটা হত।
শুধু চিমটি কেটে বসে থাকলে আবার হবে না। সাথে সাথে কাঠ ছুঁতে হবে, লাল রঙের কিছু একটা ছুঁতে হবে। আর মুখে বলতে হবে, চিমটি! কাঠ ছোঁয়া! লাল ছোঁয়া! এটা না করলে যে চিমটি খেয়েছে সে পাল্টা চিমটি কাটবে। কাঠ আর লাল ছুঁয়ে ফেললে আর চিমটি কাটা যাবে না। কাঠ তো হাতের কাছেই ছিল, কাঠের বেঞ্চ ছুঁয়ে দিলেই হত।
লাল খুঁজে পাওয়া নিয়ে ঝামেলা হত। বইয়ের ক্যালেন্ডার দিয়ে দেয়া মলাটে খুঁজে বের করতে হত লাল রঙ। চট করে সময়মত খুঁজে না পেলে চিমটি খেতে হত লাগাতার।
মজার একটা খেলা ছিল স্কিপিং বা দড়িলাফ। এই লাফ গোণা হত।
একবারে না আটকে কে কতবার লাফ দিতে পারে। বড় বোন ছিল এই খেলায় সিদ্ধহস্ত, না কি সিদ্ধপদ বলব। একবারে দুই-তিনশ' ছাড়িয়ে যেতে পারত। আমি মনে হয় কোনমতে একশ'র কাছাকাছি যেতে পারতাম। এরপর কোন না কোনভাবে দড়িতে পা জড়িয়েই যেত।
তবে বেশ কয়েকটা স্টাইলে দড়িলাফ শিখেছিলাম। ওগুলোই বেশি করতাম। সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা বেশি করতাম না।
একটু উপরের ক্লাসে উঠে কাগজ কেটে কার্ড বানিয়ে রাম-শ্যাম-যদু-মধু খেলা শিখেছিলাম। তবে কাগজের টুকরার আরও মজার খেলা ছিল চোর-পুলিশ।
চার টুকরো কাগজে 'চোর', 'ডাকাত', 'পুলিশ' আর 'দারোগা' লেখা হত। এরপর কাগজগুলো ভাঁজ করে ছড়িয়ে দেয়া হত। সবাই একটা একটা করে তুলত আর লুকিয়ে দেখত কি আছে। যে দারোগা সে দেখিয়ে দিত সবাইকে নিজেরটা আর তার স্কোর লেখা হত ৯০০। এরপর সে জানতে চাইত কে পুলিশ।
পুলিশ উত্তর দেয়ার পর দারোগা তাকে বলত চোর অথবা ডাকাত খুঁজে বের করতে। সে বাকী দুইজনের মধ্য থেকে ঠিকমত চোর বা ডাকাত খুঁজে বের করতে পারলে তার স্কোর হত ৭০০, আর যাকে খুঁজে পেয়েছে সে পেত ০। আর ভুল করলে পুলিশ পাবে ০, চোর পাবে ৪০০, ডাকাত পাবে ৬০০। তারপর আবার চলবে কাগজ ভাঁজ করে বেছে নেয়া। এইভাবে খেলা শেষে স্কোর যোগ করে আবার সেই প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, লাড্ডু ঘোষণা।
মাঝে মাঝে খেলোয়াড়ের সংখ্যা বেশি হলে পকেটমার যোগ করা হত, তার স্কোর থাকত ৩০০। সবাই চাইত দারোগা হতে, তাহলে নিশ্চিত সর্বোচ্চ স্কোর। এই খেলাতেও ছিল চোরামি। দারোগার কাগজের টুকরায় চিহ্ন রাখত কেউ, যাতে সব সময় দারোগার কাগজটাই তোলা যায়। এই চোরামি বন্ধ করতে নিয়ম করা হত পালা করে একজন একজন করে কাগজ তুলবে।
তারপরও কিছু চোরামি চলতই। দেখা যেত যে দারোগা পায়, সে বারবারই পায়।
অনেক কিছু মনে পড়ে। সবই যদি লিখে রাখতে পারতাম!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।