মনে রবে দীর্ঘশ্বাসে, আর ১মিনিট নীরবতায়....! আমার কিশোরীবেলা পর্ব ১ : একটি ঘাস অথবা নামের গল্প, নামটি দূর্বা
আমার কিশোরীবেলা পর্ব ২ : আঁধারে বসবাসকারী আমি
আমি নিজের মাঝে খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম, জানতাম না কিসের মাঝে তলিয়ে যাচ্ছি। মূলত মানসিক যন্ত্রণাকে শারীরিক যন্ত্রণায় রূপান্তর করার প্রক্রিয়া চলতো। আমি খুঁজতাম কিসে যন্ত্রণা বেশি যেমন, মরচে পড়া ব্লেড অথবা রেজর বা ভোঁতা কাঁচ দিয়ে কাটাকাটি করলে যন্ত্রণা বেশি পাওয়া যায়, তবে এপ্লাই করার হয়নি এমন একটি প্ল্যান ছিলো হাতুড়ি দিয়ে নখ থেতলে ফেলা। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের 'একজন দুর্বল মানুষ' গল্পটা পড়ে এই কথা মাথায় আসে।
ঐ সময় আমি ঘোরগ্রস্ত এক জীবনযাপন করতাম, আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে নিজেকে যন্ত্রণা দেয়ার একেকটি পথ খুঁজেছি।
এভাবে ক্লাস নাইনে উঠলাম।
ঠিক সেই সময় আমার প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলছে, মে মাসের ২০তারিখে সায়ন মারা গেলো। যারা আমার আগের লেখা পড়েছে অথবা চেনে,সায়নের ব্যাপারটা সবাই মোটামুটি জানে তাই বিস্তারিত লিখছি না আর। সায়ন মারা যাওয়ার পর আমি স্তব্ধ, সায়ন নাই এ ব্যাপারটার অপরাধবোধে আমার ভিতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছিলো।
ইনসমনিয়াক হয়ে পড়লাম, সেই সাথে এক্সামে আমার মত এলেবেলে ছাত্রী রোল ১০এর ঘরে চলে আসাতে সবার নজরে আমি এসে পড়লাম।
আমাকে সবাই গুরত্ব দেয়া শুরু করলো, পাত্তা দিতে লাগলো। আমাকে আমি দিয়ে নয় আমার রেজাল্ট দিয়ে বিচার করা হলো!
আমি তখনো ঐ লাইফ থেকে বের হতে পারিনি । আমি পড়াশোনা করার মত মেয়ে কখনো ছিলাম না, আমি এখনো পর্যন্ত বলতে পারবো না ক্লাস সেভেনের পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি কোনদিন টানা ১ঘন্টা পড়েছি কিনা। দুঃখজনক যে আমি আসলেই ছাত্রী শব্দটার কলঙ্ক!
বছরের শেষের দিকে আমার বোনের সাথে আন্দোলন ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হলো, দীর্ঘ ৮বছর প্রেমের পর বিয়ে। আমি মহা খুশি হলাম, আমার বিড়ালের পর নতুন একটি ফ্যামিলি মেম্বার আসছে।
বিয়ের আগের রাতে আপুতি ঝগড়া করে ভাইয়াকে ফোনে বললো,তুই ভাগ তোরে আমি বিয়া করুম না।
আমি তাদের ঝগড়া দেখে ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে ঘুমাতে গেলাম,বাসাভর্তি মেহমান। ফ্লোরে শুয়ে চিন্তা করলাম আমরা কি কি করতাম, কতটা ঘুরতাম। আমি রাতে প্রায় যখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম আমার বোন গালে হাত দিয়ে দেখতো গাল ভেজা কিনা...এসব ভেবে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। আম্মু আপুতিকে গিয়ে বললো আমি কাঁদছি, আমার বোন আসলো আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো আর আমি হাউমাউ করে কাঁদছিলাম।
অথচ আমি অপেক্ষা করেছি ওর বিয়ের...তখন বোন কি তা বুঝতে পেরেছিলাম।
ক্লাসে টেনে আরো ভালো রেজাল্ট করে উঠলাম, স্যারদের টার্গেট আর্টসের মাঝে A+ পাবো এই আমি। ঠিক ঐ সময়টায় ভার্চুয়াল লাইফে কিছু অসম্ভব ভাল বন্ধু হলো। ওরা আমার কথায় বুঝতে পেরেছিল আমি চাপা কিছুর মাঝে আছি। বন্ধুগুলো আমাকে সাপোর্ট দিয়ে ঐ লাইফটা থেকে বের করার চেষ্টা করতে লাগলো।
ক্লাস টেনের প্রথম সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট বোর্ডে টানিয়ে দেয়া হলো। বোর্ডে আমি সহ আমার ১৩টা ক্লাসমেটের রোল নেই। ধাক্কা খেলাম আমি, কারণ বোর্ডের নিচে লেখা ছিলো যে যাদের রোল নেই তার এই স্কুল থেকে বাদ তাদের অন্য স্কুল থেকে পরীক্ষা দিবে।
আমি পুরা শেষ তখন কারণ আমি বাদ পড়বো এটা এক কথায় অসম্ভব। বাসায় ফিরে এসে ২দিন না খেয়ে না ঘুমিয়ে চুপচাপ বসে থাকলাম আর চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো!
স্কাউটিং করতাম তাই হাতের কাছে দড়িতে ফাঁস লাগিয়ে বসে রইলাম।
আম্মু গেলো প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে আমার ব্যাপারে কথা বলার জন্য। মূল সমস্যাটা ছিলো যে আমি এত বছর খামখেয়ালি ভাবে পড়াশোনা করেও ভাল রেজাল্ট করেছি। কিন্তু আমি ম্যাথে উইক ছিলাম, আর অঙ্কে যে সমস্যাটা হয় প্র্যাকটিস না করলে তালগোল পাকিয়ে যায়। আমি হাত কাটাকাটি অথবা টর্চার করে যতটুকু পড়েছি সেই তুলনায় আমার ম্যাথ প্র্যাকটিস হয়নি এবং আমি ম্যাথে ফেল করেছিলাম।
আমার আম্মুকে আমার রেজাল্ট কার্ড দেখানো হলো।
৭টা সাবজেক্টে আমার A+ ছিলো ম্যাথে ফেল। আম্মু রিকোয়েস্ট করলো আমাকে প্রিটেস্ট পর্যন্ত সুযোগ দিতে। কিন্তু প্রিন্সিপালের এটা জানার দরকার ছিলোনা যে একটা মেয়ের লাইফ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার তখন স্কুলে ১০০% পাশ দরকার যার জন্য সে সবকিছু করতে পারে।
সে কিছুতেই এলাউ করলো না, আম্মুর কথা ছিল যে মেয়ে ৭টা সাবজেক্টে A+ পেয়েছে সে চাইলে ম্যাথেও ভালো রেজাল্ট করবে। কিন্তু আমার স্কুলের প্রিন্সিপাল রিকোয়েস্ট রাখেনি।
পরে অবশ্য আমাদের ১৪ জনের মাঝে ১১ জনকে ৪ সাবজেক্টে ফেল করার পর ও এলাউ করা হয়। শুধু যে ৩ জনের গার্জিয়ান দেখা করেছিল তারা হয় না!
আমার মনে পড়ে এরপরে এমন একটা রাত নাই আমি হাউমাউ করে কাঁদি নাই,নিজেকে অপয়া ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হত না। আমার নিজের প্রতি রাগ, ক্ষোভ অভিমানের মাত্রা বেড়ে গেলো।
প্রিটেস্টের আগে রেজিস্ট্রেশন বোর্ড থেকে বদলে অন্য স্কুলে যেতে হবে। আমার মাথায় একটা চিন্তা ঢুকে গিয়েছিলো আমি আর ভালো রেজাল্ট করতে পারবো না।
৩টা মাস আমাকে বাসায় বসে থাকতে হয়েছিলো এবং আমি বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলাম। একা একা ঘুরতাম রিকশায়। বরাবর আমি টমবয় টাইপ ছিলাম, মেয়েসুলভ নেকু নেকু ব্যাপার আসতো না আমার। তখন আমি ঘুরতাম, লাস্ট একা একা ঘুরতে গিয়েছিলাম ময়নামতিতে।
নতুন স্কুলে গেলাম।
নতুন ক্লাসমেট সবকিছু নতুন। আমার নতুন স্কুলের টিচারগুলো অসম্ভব ভালো ছিলো, ভীষন ভাল মানুষ প্রত্যেকে। আমি আদরের ছিলাম তাদের কিন্তু আমি পড়াশোনা করতাম না কারণ যে ৩টা মাসে আমি ভেঙে পড়েছি যে ৩টা মাসের প্রত্যেকটা দিন আমি বিশ্বাস করেছি আমাকে দিয়ে আর হবেনা সেটা কাটিয়ে নতুন করে শুরু করা আমার জন্য সম্ভব ছিলোনা।
আমার ফ্যামিলি অথবা আত্মীয়ের মাঝে আমার মা ছাড়া আমি কাউকে পাশে পাই নাই। আমি যাকে সবচে ভালবাসি আমার সেই বোন বলেছিলো যেনো আমি এক্সাম না দেই।
আমাকে উত্সাহ দেয়ার মত কেউ ছিলোনা নতুন করে শুরু করার, দিন দিন দাবিয়ে রাখছিলো আমার চারপাশ।
আমি অনেকবার সুইসাইডের চিন্তা করেছি কিন্তু আম্মুর জন্য পারিনি। সত্যি কথা বলতে আমি মহিলাটাকে কম জ্বালাই নাই, আমি মরে গেলে আম্মুর কি হবে এটার কারণে মরতে পারিনি আর!
টেস্ট পরীক্ষার আগ দিয়ে পরিচয় কুম্ভকর্ণের সাথে একটা ফোরাম সাইটে। আমি কথা খুব কম বলতাম কারণ ভাবতাম ও আমার চে ১৫বছরের বড়। ও চেষ্টা করছিলো একটা নর্মাল লাইফে আমাকে নিয়ে আসতে কিন্তু আমি ছিলাম হতাশায় ডুবে।
এস.এস.সি এক্সামের আগে বিদায় অনুষ্ঠান। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম সব, আমার কেন জানি স্কুলের টিচার, স্কুল বিল্ডিং এর উপর মায়া পড়ে গিয়েছিলো। আমার ক্লাসমেটরা কাঁদতে কাঁদতে ফেইন্ট হয়ে গেছে, আমি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না সামলানোর চেষ্টা করছি। আমাকে দেখে হিস্ট্রি ম্যাডাম ডাক দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। আমি সেদিন এভাবে মানুষের সামনে কেঁদেছিলাম।
আমার ম্যাডামরা প্রত্যেকে অসম্ভব মায়াময়ী ছিলো, যে মায়া চাইলে কাটানো যায় না।
এবং আমি এস. এস. সি পরীক্ষা দিলাম. . . . . ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।