আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হায় ঈশ্বর!

আসেন দুর্নীতি করি। আর এই দুনিয়াটাকেই খুচাই! ১. আজ পূর্নিমা রাত। চাদটা যেনো আহ খুব খুশি। চাদের রূপটা বরাবরই রহস্যে ঘেরা। শরৎকালে যখন নদীর পাড়ে শুয়ে শুয়ে চাদের সাথে মেঘেদের লুকোচুরী দেখতো ও, তখন মনে হতো এক অসম্ভব সুন্দরী লাজুকতায় হেটে যায়।

আবার যখন গ্রীস্মের রাতে তারা ভরা আকাশে চাদ হাসে তখন মনে হয় এ এক ষোড়শী। ঢাকা শহরের চাদটা নিঃসঙ্গ রাজকন্যা। যে এতো ভীড়ে থেকেও একা। এক অস্হির জনপদকে সে আলো দিয়ে যায়, আর সে জনপদ তাকে সাধুবাদ দিতে ভুলে যায়। শাহেদ কমলাপুর রেলস্টেশনে দাড়িয়ে, ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে।

ওর কাছে যেনো সময়টা থমকে গেছে। সামনে দাড়িয়ে আছে একটা নিকষ কালো অন্ধকার, যেখানে পৌছেনি কোনো শীতের স্বর্নালী রোদ অথবা কৃষ্ঞপক্ষে জোনাকীর আলোখেলা। বুকের ভিতর এক অদ্ভূত পাথর জমে আছে ওর। মানুষের কখনো কি এমন মনে হয়েছে যে প্রবল বিশ্বাসটা বছরের পর বছর আকড়ে ধরে আছে এটাই একসময় সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে দাড়ায়? শাহেদের কান্না শুকিয়ে গেছে বহুআগে, হ্রদয়টা হয়ে গেছে এক শক্ত পাথর। কখনো ফুল ফোটেনি, কখনো ফুটবে না।

পরীক্ষাটা শেষ করেই জানতে পারলো খবরটা। বাসা থেকে আসা ফোনটা ধরেই শুনতে পেলো মা শুধু কাদছে। প্রথম দুটো মিনিট কিছুই বলতে পারলো না। শাহেদ বুঝতে পারে কি হয়েছে, হঠাৎ যেনো ওর মাথাটা শূন্য হয়ে যায়। উদ্দেশ্যহীনভাবে বলে,"মা, আমি রাতের ট্রেনে আসছি।

খুব বেশী সময় লাগবে না, আমি একবার তাকে দেখবো!" ওর মা কিছুই বলতে পারছে না, ওর কাকা ও পাশ থেকে বললো," বাবা, তোমার জন্য আমরা অপেক্ষা করবো। তোমার বাবা বার বার তোমার কথা বলছে! বাবা, আর রাগ কইরো না। চইলা আসো" শাহেদ ফোনটা কেটে দেয়। কিছুদিন ধরে বাবা অসুস্হ ছিলেন। অনেক বয়স হয়েছিলো মানুষটার।

একসময় নিজের আদর্শ মনে হতো। জ্ঞান হবার পর কখনো শুনেনি নামাজ কাযা করেছে, কখনো শুনেনি মিথ্যা বলেছে। সবাইকে প্রান খুলে শুধু দিয়েই গেলো, অসম্ভব ধার্মিক এক মানুষ। বাবার সাথে সে কথা বলে না ৬ টা বছর। বাসাতে শুধু দুবার গিয়েছিলো ওর ছোটবেলার স্মৃতিগুলো নিয়ে আসার জন্য।

বাবা বহুবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, শাহেদ কথা বলেনি। সে কিছুই বলেনি। যখন বাবার কোনো চিঠি আসতো, ওর বুকের ভিতরটা দুমড়ে যেতো। বাবা সন্তানের কাছে ক্ষমা চাইবে এটা মেনে নেবার জন্য প্রস্তুত ছিলো না ও, তাই চিঠিগুলো কোনো খুলেও দেখেনি। মা কান্নাকাটি করতো বলে মাকেও ফোন দেয়াটা বন্ধ করলো! ঐ দেখা যায় ট্রেনের হেডলাইট, ঝিক ঝিক শব্দ।

একটা উজ্জ্বল আলো দূর থেকে যত কাছে আসছে আলোটা তিনভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, যেনো একটা ত্রিভূজ। রেলস্টেশনে ঢুকবার আগেই গতিবেগ কমতে থাকে। ট্রেন ভর্তি মানুষ এতক্ষন যারা নেশার মতো কু ঝিকঝিক চলার গানে মগ্ন ছিলো, তাদের নেশাটা কাটতে লাগলো। আস্তে আস্তে ট্রেন জনশূন্য হতে লাগলো। এমন সময় একটা টোকাই উদাম গায়ে ছোট্ট হাতটা পাতে,"ভাইজান, দুইদিন ধইরা খাই না।

দুইটা টাকা দেন, ভাত খামু। আল্লাহ আপনের ভালো করবো!" শাহেদ ওর দিকে তাকায়,"তোর আল্লাহকে বলিস আমার ভালো করা লাগবে না। উনি যেনো নিজের ভালো করেন। তোকে দুইটাকা দিলে তো ভাত হবে না। এই নে ৫০ টাকা!" ছেলেটা ৫০ টাকা হাতে নিয়ে চলে গেলো দ্রুত, কোনো কথা বললো না!শাহেদ কি বলেছে সেটা শুনলে ওর আর টাকা পাওয়া হবে না, সবাই ট্রেনে উঠে যাবে।

শাহেদ কাধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে ট্রেনের দিকে হাটতে লাগলো! ২. শাহেদের সামনে তালতলা মসজিদের ইমাম দাড়িয়ে,"বাবা, তোমার বাবার জানাযায় তুমি থাকবা না কেমনে হয়? যাই হইছে ভুইলা যাও। তোমার বাবারে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। এখন কোনটা ভুল হইছে, কোনটা ঠিক সেইটা নিয়া কথা বলার সময় না। একবার কলেমা পড়ো, ওজু কইরা জানাযায় দাড়াও। মরার পর সে আর আমাদের কিছু না, সে তখন আল্লাহর হেফাজতে।

তার জন্য একটু দোয়া করো। সে বড় অসহায় এখন!" শাহেদ হাসলো, শাহেদের চাচা ইমামকে বললো,"চাচা, ওরে কলেমা পড়ানোর ব্যাবস্হা করতেছি! আপনারা নামাজে দাড়ান। তারপর আমরা সবাই কাজটা সারি" শাহেদ বললো,"চাচা, আমার বাবা জানতো আমি নাস্তিক, সে জানতো বলেই আমাকে বলেছে নিজ হাতে যেনো কবর দেই। আপনি যদি না বলেন তাহলে আমি চলে যাই। এসব আমার কাছে বাহুলতা ভালো লাগে না।

বাবাকে একবার দেখতে চেয়েছিলাম, দেখেছি.....!" চাচা ওর হাত ধরে বললো,"একটু চুপ থাক বাবা। আজকের দিনের জন্য মানুষটাকে একটু শান্তি দে!তোর কিছুই করতে হবে না, তুই বসে থাক!"এই বলে চাচা চোখ মুছতে মুছতে ঘরের ভিতরে চলে যায়,"এই সবাই জানাযার জন্য রেডী হও, ভাইয়ের জন্য দোয়া কর!" শাহেদ আস্তে করে বাসা থেকে বেরিয়ে পরে। এই মেঠো পথটা ধরে হাটতে থাকলে মনে হয় গ্রামটা আগের মতোই আছে। রাস্তা ঘাট কিছু নতুন, আর কিছু বাড়ি। তবু ঐ দিগন্ত জোড়া ধানী ক্ষেত।

বোরো কেটে সোনালী রং এর ছনের ঢিবি দাড়িয়ে আছে মাঠের উপর। নতুন ধান কাটার গন্ধে এখনও চারিদিক মৌ মৌ। মাঠটার ও পাশেই শুয়ে আছে ছোট বোনটা। এখন জঙ্গল হয়ে গেছে ওখানে। পাশে একটা পুকুর।

বসন্তে ঐ পুকুরে খেলা করতো শিমুল ফুল। লাল টক টকে শিমুল! ৩. ৭ বছর আগের কথা এখনও যেনো মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। ওর ছোট বোনটা সবে টেনে উঠলো। রোল নম্বর এক। প্রথম পার্বিক কিছুদিন পরই।

ও স্কুল থেকে আসছিলো। বললো,"তেতুল খাবি ভাইয়া?" শুনেই শাহেদের মুখ ভরে যায় লালায়, তোতলাতে থাকলো। বোন একটা মুচকী হাসি দিয়ে বললো,"তুই এখানে বোস, আমি নিয়ে আসি বাসা থেকে। " শাহেদ বসে থাকে অনেকক্ষন। ওর বোনের আসতে দেরী হবে দেখে বাসায় হাটা দিলো।

দেখলো অনেক মুরুব্বী মানুষ। এর মধ্যে পাশের গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব, মুখে চাপা দাড়ি। ও তাকে দেখেই সালাম দেয় বিশাল। তাকে দেখে ঐ ইমাম সাহেব তার মাথার চুল নেড়ে দেয়, সালামের উত্তর দিয়ে বলে,"আছর নামাজ পড়ছো? চলো মাগরিবের সময় হয়ে এলো! একসাথে নামাজ পড়ি। " শাহেদ ওর বোনটিকে দেখতে পেলো না।

সোজা চলে যায় কল পাড়ে। ওজু করে নামাজ পড়ে যখন সবাই মিলে মাদুড় পেতে খেতে বসলো, তখন শাহেদের বাবা এসে বললো,"রূপতলার ইমাম সাহেবের বয়স বেশী না, গত মাসে ৩২ হইছে। পাত্র হিসেবে পছন্দ হইছে। রানুর বিয়েটা পরবর্তী জুম্মাবার ঠিক করে ফেললাম!" শাহেদের হাতটা থেমে গেলো প্লেটের উপর,"আব্বা, সামনের মাসে ওর পরীক্ষা। ওর বয়স কেবল ১৫।

এই বয়সে বিয়া দিবা?" ওর বাবার মুখ শক্ত হয়ে গেলো," শাহেদ, তুমি এভাবে কথা বলতেছো কেন?" এমন সময় ওর মা একটা তরকারী বাটি মাদুরে দিয়ে বললো," আমি বলছিলাম কি, ও ম্যাট্রিক পরীক্ষাটা দিয়ে তারপর দিলে ভালো হতো না? আল্লাহ চাহে তো কত পাত্রই তো আসবে। এত কম বয়সে..." শাহেদের বাবা তার দিকে কঠিন ভাবে তাকায়,"আমাকে জ্ঞান দাও তাই না? এইসব ভূয়া কথা কোথায় শিখছো? তোমারে যখন বিয়ে করি তখন তোমার বয়স কত ছিলো? আমার মায়ের বিয়া হইছিলো ১২ বছর বয়সে। আমাগো নবিজীর এক বৌ এর বয়স ছিলো ৯। তোমরা এইসব নাফরমানী কথা বলতেছো কেন?" এমন সময় তালতলার ইমাম বললো মুখে ভাত নিয়েই," শুধু এখানেই না, কোরান শরীফে আরও বেশ কয়েকটা জায়গায় বলা আছে, মেয়েদের বিয়ের জন্য বয়স কোনো ব্যাপার না। সাংসারিক বিচার বুদ্ধি হইলেই বিয়া দেয়া যায়।

এখন নাফরমানরা মুশরিক দের টাকায় দেশ চলে। তারা চায় ইসলাম ধ্বংস হোক। তাই নানা কথা বলে এই জিনিসটার বিরোধীতা করতেছে। তার মানে বুঝে দেখেন, ইসলামের বিরুদ্ধে কত বড় ষড়যন্ত্র হইলে তারা এইটা করে! জন্ম হায়াত মৌত আর বিয়া সব তো আল্লাহর হাতে, তাই না?" শাহেদ ভাত রেখে উঠে যায়। সে রাতে বাবার সাথে তুমুল তর্ক করে, বাবা রান্না করার চলা হাতে উঠোনে নিয়ে ওকে মারতে থাকে যতক্ষন না অজ্ঞান হয়ে যায়।

টানা দুদিন অজ্ঞান থাকার পর প্রথম মুখটি দেখে ওর বোনের। ওর পাশে বসে মাথায় ঘোমটা দিয়ে কোরান শরীফ পড়ছিলো। ও হাসি দিয়ে বললো,"কিরে? তোর বিয়ে হয়নি? আমি স্বপ্নে দেখলাম তুই ম্যাট্রিক পরীক্ষায় গোল্ডেন এ পেয়েছিস। আমাদের বাসায় মিস্টির বন্যা!" ওর বোনটা ওকে দেখে ওকে জড়ায় ধরে," চুপ থাক তুই। ঘুমা।

" পরের শুক্রবার ওর বিয়ে হয়ে যায়। শাহেদ সেদিন বাসায় ছিলো না। রাগে দুঃখে নদীর পাড়ে বসে ছিলো সারা রাত। পরদিন বাসায় ফিরলে ওর বাবা ওকে আটকে রাখে। দুদিন পর ওর ঘরের তালা খুলে দেয়।

ও সেবার ইন্টার দিলো। বোনের বাসায় মিস্টি দিতে এসে দেখে পুরোটা বোরখায় মোড়া। শুধু চোখ দুটো খোলা। ওকে দেখে দূর থেকে বসতে বলে। আগে বোনটা জড়ায় ধরতো, এখন আস্ত আস্তে কথা বলে।

চোখের দিকেই তাকিয়ে বুঝতে পারে বোনটা সুখে নেই, চোখ ছল ছল। ঐ হারামী ইমামটা মারে কিনা জানে না। শাহেদের হাত দুটো মুষ্টি হয়ে শক্ত হয়ে থাকে। চোখটা ভিজে যায়। তার কিছু দিন পরেই মারা যায় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে।

শোনা যায় ওকে হাসপাতালে না নিয়ে বাসায় পানি পড়া আর তাবিজ দিয়ে চিকিৎসা করানোর চেষ্টা করে। মনে পড়ে যখন ওর বোনের লাশটা কবর দেবার আগে কাউকে দেখতে দেয়া হয়নি। কবর দেবার কয়েক মিনিটের জন্য বোনের মুখের কাপড়টা সরিয়েছিলো কারন মৃত মেয়েদের লাশের চেহারা বেশীক্ষন খোলা রাখা ঠিক না, শয়তান নজর দেয়, মানুষের মনে খারাপ জিনিস জাগে! বোনের লাশটা যখন কবর দেয়া হলে ও বাবার সামনে দাড়ায়, চোখ দিয়ে পানি ঝরছিলো ওর, আঙ্গুলটা তার দিকে দিয়ে তুলে চিৎকার করে বলে,"এই মানুষটা খুনী, একজন জল্লাদ! এই মানুষটাই আমার বোনটাকে মারছে। একজন শয়তানের হাতে তুলে দিছে। আমার বোনটাকে আর পড়তে দিলো না!" বাবার মুখে থুথু দিয়ে চলে আসে সেদিন! বাসা ছাড়ে, গ্রাম ছাড়ে।

শহরে এসে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, পাথর বানায়, ঈশ্বরকে ঘৃনা করতে শেখে। বহুবছর পর শাহেদ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো! উৎসর্গ: টু মাই ফাট্টু! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।