'মানুষ কাছে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়' বাংলাদেশের কোন উপন্যাস ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পাবে বলে আপনি মনে করেন ? আহমদ ছফা’র ‘ওঙ্কার’
বাঙলা উপন্যাস কতোটুকু গতি পেয়েছে কিংবা কাল পরিক্রমায় এগিয়েছে তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘লালসালু’ থেকে আক্তারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ হয়ে ‘খোয়াবনামা’ পর্যন্ত গেলে আপনাকে একটু ভেবে-চিন্তে সামনের দিকে যেতে হবে । তবে উপরের ‘কোট’ করা কথাকে যদি আপনি নজরে আনেন তবে আপনাকে একটু নড়েচড়ে বসতে হবে , একটু বই-পত্তরও ঘাটাঘাটি করা লাগবে বৈকি । নতুবা এই কথার মাজেজা আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিতে পারে কিংবা দিবেও । কারণ , উপরের ‘কোট’ উক্তিটি স্বয়ং আহমদ ছফার । তো , বলছিলেম আহমদ ছফা যখন তাঁর লেখালেখি নিয়া কথা বলেন আর তা যদি কোনো নির্দিষ্ট বইয়ের কিংবা তাঁর বইয়ের দিকে ইঙ্গিত করেন তখন পাঠক হিসেবে আমাদের একটু চেখে দেখার তাগিদ থাকে বৈকি ।
আর সেটা যখন ক্ল্যাসিক পর্যায়ে চিহ্নিত হয় তখন তো পড়তেই হয় ।
শহীদুল ইসলাম খোকন । সিনেমেকার । ঢাকার মেইনস্ট্রিম বাণিজ্যিক সিনেমার এক দাপুটে সিনে-পরিচালক । উনার সিনেমা আমি কমবেশি দেখেছি ।
আমার জানামতে উনার সিনেমা দু’য়েকটা বাদে প্রায় সবগুলোই ব্যবসাসফল । রুবেল-মৌসুমি আর হুমায়ূন ফরিদীকে নিয়ে বেশিরভাগ সিনেমাই উনি নির্মাণ করেছেন । এখন খুব একটা সিনেমা করেন না । মাঝেমাঝে করেন । ঈদ কিংবা বিশেষ দিবসে মুক্তিপ্রাপ্ত ঢাকার সিনেমাকে নিয়া উনি সপ্তাহান্তে দৈনিক পত্রিকায় মাঝে মাঝে রিভিউ বা সমালোচনা ধরণের কিছু লেখেন ।
এই হলো মোদ্দাকথা শহীদুল ইসলাম। তো , আগের বয়ানের সাথে এই লোকের কি মিল আছে বা থাকতে পারে , যারা এই প্রশ্ন মনেমনে ভাবছেন তাদের একটু মিনমিনে গলায় বলি ... এই শহীদুল ইসলাম ভদ্রলোক আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’ নিয়া এক্কান সিনেমা ইতিমধ্যে বানিয়ে ফেলেছেন । এবং তা বোধহয় বছর পাঁচেক হবে । এবং তা যথারীতি অন্যসব সৃষ্টিশীল সিনেমার মতো ব্যবসায় লালবাত্তি জ্বালিয়ে মুখ থুবরে পড়েছে । এ আর নতুন কী ।
তো ... এই ভদ্রলোক আহমদ ছফা’র ‘ওঙ্কার’ নিয়া কেনোইবা সিনেমা বানালেন , কিংবা তিনি কি জানতেন না যে এই জাতীয় সিনেমা বানিয়ে পয়সা কামানো যায় না , বড়োজোর প্রশংসা কিংবা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পাওয়া যায় । কি জানি হয়তোবা জেনেও থাকবেন বোধকরি ! না হলে একজন বাণিজ্যিক সিনেমার পরিচালক কেনো এই ধারার সিনেমা বানাতে যাবেন ?
সামন্তপ্রভুদের দিন বোধহয় শেষ হয়ে এলো ... এই আত্মপ্রসাদে যেমন অতিসরলীকরণ আছে তেমনি কৃষকদের দিন এলো কিংবা সুদিন বুঝি এলো এই বৈপরীত্যতেও মেলা হ্যাপা আছে । জমিদার-তালুকদারেরা জমির মালিকানা হারিয়েছে এটা ঠিক কিন্তু বেশিরভাগই নানাভাবে-নানা ধান্দায় ব্যবসাপাতিতে নানা কূট-কৌশলে নিজের অবস্থান , অবস্থার পরিবর্তনকে খুব বেশি পরিবর্তিত হতে দেয় নি , ব্যতিক্রমও নাই তাও নয় । সেই হারানো , না হারানোর ঢামাঢোলে একদিন ‘দ্বি-জাতি’ তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়ে যায় । পূর্ববঙ্গ তখন পূর্ব-পাকিস্থান ।
এমনি এক ক্রান্তিকালের পটভূমির আখ্যান-চিত্রভাষ্য । বাবা মামলা-মোকদ্দমায় জমিজমা হারিয়ে নির্বাক , এতে উস্কানি ছিলো প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মোক্তারের । ছেলে বিএ পাশ । বেকার । মোক্তারের একমাত্র মেয়ে ।
প্রায় নিঃস্ব তালুকদারের বিএ পাশ ছেলের সাথে বিয়ে হয় মোক্তারের একমাত্র মেয়ের । ততোদিনে তালুকদার গতো হয়েছেন । বোনকে নিয়ে শ্বশুরের শহরে বাড়িতে আসে সে ...সাথে নতুন বউ । নতুন চাকুরি , নতুন অফিস , সংসার এই চলছিলো ।
এতো সরল লেখা কী আহমদ ছফার ? এই প্রশ্ন মাথায় রেখেই দেখবো ...
‘গর্গর’ জান্তব শব্দে জানালার কাছে নতুন বউ এক হাত উপড়ে তুলে নাড়াচ্ছে আর মিছিলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে ।
‘বোবা’ তাইলে মেয়েটা ! আর মিছিলই বা কেনো হচ্ছে ? ‘আসাদ’ নামে এক ছাত্র মারা গেছে ... সেই থেকে ঢাকা তথা সমগ্র দেশ উত্তাল । স্বামীপ্রবর প্রতিদিন এসব দেখেও না দেখার ভান করে অফিস থেকে আসে , মিছিল এগিয়ে আসতে দেখলে অন্য রাস্তা নয়তো ছাতা দিয়ে মুখ আগলে সরে পড়েন । তারপরেও কারা যেনো রাতের আঁধারে পোস্টার লাগিয়ে যায় তার বাড়ির দেয়ালে । এদিকে বোবা স্ত্রীলোকটা শুরু করেছে আরেক উৎপাত , মিছিল দেখলেই জান্তব ‘গর্গর’ শব্দে জানালা কাছে গোঁ গোঁ করতে থাকে । মাঝ রাত্তিরে উঠে সে এই প্রায় একই কান্ড করে , কখনো পুকুরধারে , কখোনো বা বারান্দায় ।
এর মাঝে অবাক কান্ড হলো সে মাঝে মাঝে হারমোনিয়াম নিয়ে রাতের অন্ধকারকে হকচকিয়ে দিয়ে অ্যা...আ...অ্যাঁয়... করে !
‘তোমার আমার ঠিকানা , পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর , বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগান আর স্লোগান চারিদিকে , যখন-তখন , দিন নাই-রাত নাই । নয়মাস ... দীর্ঘ নয়মাস পর এলো সেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি । কতো লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত সময় , লেখা হলো কতোশতো মহাকাব্য-উপন্যাস রক্তে রাঙানো হলো ইতিহাস । বোবা মেয়েটি কি তার বাক-স্বাধীনতা পেয়েছিলো ?
‘বাঙলা …!’ এই ছিলো তার রক্তেস্নাত কন্ঠের প্রথম ও শেষ বাক্য । দীর্ঘ নয় মাস সে যুদ্ধ করেছে নিজের সাথে , দেশের সাথে , পাকিস্থানের সাথে ।
বাকস্থিত স্বামী যে কিনা এই ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নিজের মতো করে চলতে চায় সেই থমথমে পরিবেশে আজন্ম বোবা স্ত্রী কীনা যুদ্ধকে টেনে এনেছে নিজ গৃহে । স্বামী-সংসার , দেশ-মাতৃভাষাকে সে তার নিজের মধ্যে ধারণ করেছে আপন মহিমায় । স্বামী প্রবর কী সেই সংগ্রাম , বিশেষ করে দেশের এই সার্বিক অবস্থায় বাহির ও ঘরের সংগ্রামকে ভালোভাবে নিতে পেরেছিলেন ? শঙ্কা নিয়াই কি বোবা স্ত্রীর মুখ চেপে ধরেন ? কিন্তু ভাষাহীন , বাক্যহীন গুমোট নিস্তব্দতা কতোদিন স্থায়ী হয় ? মিছিল-স্লোগান এলে সে জানালার লোহার শিক ধরে অনড় হয়ে লৌহ কঠিন বজ্রমুষ্টি উঁচিয়ে তার সরব বিদ্রোহী সত্ত্বাকে জানান দেয় । বাকহীন-মুখের ভাষা-অধিকার ছিনিয়ে আনার জন্য সে মরিয়া । স্লোগান-মিছিলের আওয়াজের মুখগুলো যতোটুকু দেখা যায় ততোটুকু পর্যন্ত সে তার জানালার শিক ধরে হাত নাড়িয়ে চাপিয়ে দেওয়া অপভাষাকে সে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে মাতৃভাষা , দেশ-সংগ্রামকে বেগবান করেছে ।
হুমায়ূন ফরিদী এই সিনেমায় সামান্য সময় ধরে ছিলেন । যতোক্ষণ ছিলেন তা মোক্তার চরিত্রকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন আপন মহিমায় । বিশেষ করে যখন তার বোবা মেয়েকে দেখতে এসে দেখেন যে বাড়ির দেয়ালে ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ স্লোগান সাঁটা তখন যে এঙ্গেলে এক চোখকে কুঁচকে তাকান লেখাটার দিকে , তা অবিশ্বাস্য , অকল্পনীয় । এ শুধু হুমায়ূন ফরিদীর পক্ষেই সম্ভব ।
আর বিএ পাশ চাকুরে কিংবা স্বামীর ভূমিকায় যিনি ছিলেন তিনি তাঁর স্বকীয় অভিনয়শৈলী দিয়ে এই সিনেমাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন ।
তিনি আমাদের মাহফুজ আহমেদ । শাবনুর । বরাবরই রোমান্টিক-বাণিজ্যিক ঘরানার সিনেমাভেনেত্রী । আমি উনার সিনেমা প্রায় অনেকগুলোই দেখেছি । এই সেদিন ইন্টারে পড়াকালীনও হলে গিয়ে দেখেছি , ইভেন অনার্সে পড়াকালীন ২০০৬ কিংবা ’০৭ ও হলে গিয়ে দেখেছি ।
তো উনারে আমি এইরকম সিরিয়াস মূলধারার সিনেমায় দেখেছি বলে মনে পড়ে না । শাবনুর এই সিনেমায় যা দেখিয়েছেন ... তা এককথায় এই সিনেমার প্রাণ ।
বোবা চরিত্রকে যেভাবে প্রাণবন্ত করে ফুঁটিয়ে তুলেছেন তা এককথায় অসাধারণ । তাঁর সারাজীবনের শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর একটি হবে এই ‘বাঙলা’ সিনেমা । এই সিনেমা দিয়ে শাবনুর বুঝিয়ে দিলেন ... তিনি কতো বড় অভিনেত্রী , তাকে দিয়েও ভালো সিনেমা সম্ভব এবং সেটা নিজ অভিনয় দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি ।
শহীদুল ইসলাম খোকন ক্যানোইবা এই দায় নিবেন ? জেনেশুনে ক্যানো তিনি লস প্রজেক্টে হাত দিলেন ? মেইনস্ট্রিম পরিচালক খোকন এফডিসি ঘরানার যে সিনেমা করেন তা এই ‘বাঙলা’য় চাইলেও হবে না জেনেও যিনি এই সিনেমায় হাত দেন বা তৈরি করেও ফেলেন উত্তর হবে হয়তো এই সিনেমাটা দেখা । ভদ্রলোক কী পারেন আর না পারেন তা এই সিনেমা দিয়া বুঝিয়ে দিয়েছেন । একটু এদিক-সেদিক বাদে সবকিছুই মুন্সিয়ানার ছাপ ছিলো । বিশেষ করে শাবনুরের রক্তেস্নাত মুখ দিয়ে ‘বাঙলা’ শব্দ বলানো । মহাসিন্দোর মহাকল্লোল , মহাধ্বনির-মহাসংগ্রামের দলিল এই ‘ওঙ্কার’ বা ‘বাঙলা’ দেখলে ঠকবেন না আশা করি ।
আর ছফা সঞ্জীবনী চেখে দেখতে চাইলে পড়তে পারেন ‘ওঙ্কার। ’ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।