আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জলে কার ছায়া

স্বপ্ন ছুঁয়ে একদম অন্যরকম এখানকার বিকেলগুলো। হালকা লাল আলো আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে গাছের সবুজের ওপর। নদীটা খুব একটা বড় না। কিন্তু পানি আছে। স্রোতও মন্দ না।

নদীর পাড়ের ঘাসের উপর পা ভাঁজ করে বসেছিল জাহিদ। কেমন যেন রহস্যময় লাগে এখান থেকে নদীর ওপাড়টাকে! যেন অন্য এক জীবন প্রবাহ ওখানে, অন্য এক গল্প। এপাড়ে নদী ছুয়ে ছুয়ে গিয়েছে ধানক্ষেত। আর তার ভিতরই এক পাশে ছোট্ট ঘাট। সারাদিনে মানুষজন প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে।

সন্ধ্যার একটু আগে অথবা রাত আরো গাঢ হলে কেউ কেউ ফিরে আসে হাট থেকে। নিজেদের ভেতর গল্প করতে করতে গ্রামের আবছা অন্ধকারের পথে হেঁটে বাড়ি ফিরে তারা। আলো কমে আসছে। গ্রামের পথে পা বাড়ায় জাহিদ। পুরোনো অশ্বথ গাছটার কাছে আসতেই অন্ধকার থেকে যেন ফুঁড়ে বের হয় আবুল মিয়া।

কিছুটা ভয় পেয়ে যায় জাহিদ। এই লোকটা এমনই। এর আগেও এমন করেছে। সারাদিন কি এখানেই বসে থাকে সে? জিজ্ঞেস করা দরকার, মনে মনে ভাবে জাহিদ। "স্লামালাইকুম মাস্টর সাব", দাঁত বের করে হাসে আবুল মিয়া।

"ডর খাইছেন?"। "না , ভয় পাই নি। আমি এত সহজে ভয় পাই না আবুল মিয়া। তোমার খবর ভালো তো?"। " গরীবের আর থাকা।

আপনে যে ডর খান না, হেইটা আমি জ়ানি"। "বাড়িতে এস আবুল। তোমার সাথে কথা আছে। " সামনে পা বাড়ায় জাহিদ। এই গ্রামে আসার তৃতীয় দিনের মাথায়ই স্কুলে ঢুকে পড়েছে ও।

কিছু তো করতে হবে। আর তাই সাত দিনের মাথায় সে মাস্টার সাহেব! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্স এ পাশ করে গ্রামের স্কুলের মাস্টার! ভালোই! মনে মনে হাসে জাহিদ। উঠোনে পা দিয়েই নিজের ঘরটায় হারিকেন জ্ব্লতে দেখল ও। নিশ্চয়ই চাচী এসে জ্বেলে দিয়েছেন। গ্রামে আসার পর থেকেই যত্নের চূড়ান্ত করছেন এই মহিলা।

অথচ এই গ্রামের সাথে কোন সম্পর্কই ছিল না ওর। শেষবার এসেছিল বাবা মার সাথে । তখন ওর বয়স আট। ছোট চাচার বিয়ে ছিল। বিয়ের পর সকালবেলা উঠোনে বসে ছিলেন চাচী।

জাহিদ ঘোরাঘুরি করছে আশেপাশে। "এই দিকে আসো তো বাবু", লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল ও! পাশে বসিয়েই টুকটুক করে কথা শুরু করে দিলেন চাচী! হাতে দশ টাকা দিয়ে বললেন, লাড্ডু খাইও। এরপর আর গ্রামে আসা হয় নি। বাবা মারা গেলেন পরের বছর। তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে মামাদের সংসারে উঠলেন মা।

মানুষের দিন যে কত খারাপ যেতে পারে বুঝতে শিখল জাহিদ। এখন মা নেই। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। কোন পিছুটান নেই ওর। কথাটা কি সত্যি? সত্যিই কি কোন পিছুটান নেই ওর?"সারাদিন কই থাকো বাবা? গ্রামে এত ঘোরাঘুরি কইর না।

নতুন আইছ। অসুখ বাধাইবা", হাত মুখ ধুতে ধুতে চাচীর কথা শুনতে পায় জাহিদ। ঘরে ঢোকার কিছুক্ষন পরেই নাস্তা নিয়ে আসে মুন্নি। ওর চাচাত বোন। ওর যে একটা চাচাত বোন আছে তাও জানত না জাহিদ! "মুন্নি বই নিয়ে আস।

আজ অংক করবা শুধু। " মুন্নিকে পড়া দেখিয়ে দেয়ার কাজটা জাহিদ নিজেই শুরু করেছে। আর চাচীও বোধহয় খুশি এতে। চাচার সাথে দেখা হয় না বেশি। প্রথম দিন আসার পর রাতে জাহিদের সাথে কথা বলতে এসেছিলেন তিনি।

"বাবা, এটা তোমার নিজের ঘর। ভাইজান-ভাবী নাই তাতে কি। আমরা আছি। তুমি চিন্তা কইর না। " স্কুলের ব্যাপারটাও চাচারই ঠিক করে দেয়া।

"ত্রিকোনমিতি শুরু করব আজ"। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে মুন্নি। মেয়েটা বুদ্ধিমতী, সহজেই বুঝতে পারে পড়াশোনা। রাতে খাওয়ার পর চুপ করে শুয়ে ছিল জাহিদ। কি অদ্ভুত ব্যাপার! যেই জাহিদ এক সপ্তাহ আগেও রাতের এই সময়ে আড্ডা মেরেছে বন্ধুদের সাথে, অথবা জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে তুমুল তর্ক করেছে ঢাকা শহরের আলো ঝলমলে কোন রেস্টুরেন্টে, কিংবা ফোনে কথা বলেছে নীরার সাথে সে আজ প্রায় অজগ্রামে ,ঘরের ভিতর শুয়ে শুনছে ঝিঁঝিঁর ডাক।

টিম টিম করে জ্ব্লছে হারিকেন। আচ্ছা এখন কি করছে নীরা? গল্প করছে শাহেদ এর সাথে? নাকি চুল বেঁধে দিচ্ছে ছোট বোনের? নাহ, এভাবে হচ্ছে না। নীরার কাছ থেকে পালাতেই তো জাহিদের এই অজ্ঞাতবাস, অথচ সে নিজেই নীরাকে প্রতি মুহুর্তে ভেবে চলেছে। এভাবে হয় না। জানে জাহিদ।

কিন্তু আর কি করার ছিল ওর? "দেখো, তোমার চাকরি হচ্ছে না। তাতে কী? আমার পক্ষে তোমাকে ছাড়া থাকে সম্ভব না। আগামীকালই আমরা বিয়ে করব", খুব শান্তভাবে কথাগুলো বলেছিল নীরা। "তাছাড়া একদিন তো চাকরি হবেই"। "নীরা শোন, তোমাকে এখন আমি বিয়ে করলে তুমি কোথায় থাকবে? শাহেদ তোমাদের বাসায় এসে রয়েছে।

তোমার বিয়ের তারিখ পর্যন্ত ঠিক। বিয়ের পর আমেরিকায় যাওয়ার জন্য তোমার পাসপোর্ট করা আছে। এখন আমাকে বিয়ে করলে তোমার আপা তোমাকে ঘর থেকে বের করে দিবেন। তখন কি হবে? " চুপচাপ চোখ মুছছিল নীরা। পরের দিন এসে আবার বলে গিয়েছিল, আগামী পরশুই আমরা বিয়ে করব।

জাহিদ জানে নীরা যা বলছে তাই করবে। কিন্তু সে নিজে এভাবে নীরার জীবনটা অনিশ্চিত করে দিতে পারে না। তাই এই পালিয়ে আসা। কিন্তু কোথায় পালাবে ও? নিজের কাছ থেকে পালানো যায় না। সকালে ব্যাগ থেকে শার্ট টা বের করার সময় চিঠিগুলো চোখে পড়ে ওর।

মেসের ম্যানেজার এসে দিয়ে গিয়েছিল লেটার বক্স থেকে। কি আর হবে। সে একই চিঠি। হয়ত দুই একটা ইন্টারভিউ এর ডাক, আর বাকি সবই দুঃখিত জানিয়ে পাঠানো চিঠি। স্কুলের এখনো দেরি আছে।

তাই চিঠিগুলো দেখতে থাকে ও। কি ব্যাপার। এই কোম্পানির চিঠি কেন? এটার ইন্টারভিউ তো অনেক আগেই দেয়া হয়েছে। কোন সম্ভাবনাই ছিল না, তখনই বোঝা গিয়েছিল, আগে থেকেই লোক ঠিক করা আছে। চিঠিটা খুলতেই হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থাকে জাহিদ।

এপয়েনমেন্ট লেটার। এসেছে কিছুদিন আগে। যেদিন ও ফিরে যেতে বলেছিল নীরা কে। সেই নীরা কে, যার সাথে দিনের পর দিন সব কিছু ভাগ করে নিয়েছিল। যার সাথে দেখা না হলে নাকি জাহিদের দিনটাই খারাপ যেত।

নটায় একটা মাত্র আপ ট্রেন আছে ঢাকায় যাওয়ার। কিছুক্ষন পরেই নিজেকে স্টেশনে দেখতে পায় ও। "আজকে ঝামেলা আছে। আপ ট্রেন আসবে না আজ", বিরক্তমুখে কথা গুলো বলে যায় স্টেশন মাস্টার। "ডাউনটা ঢাকা থেকে আসল একটু আগে।

সেটাতেও সমস্যা", বিড়বিড় করে স্টেশন মাস্টার। " চাকরি পেয়েছি বলেই কি আমি নীরার কাছে ছুটে যাচ্ছি? তাই বুঝি এমন হল? ", স্টেশনের বাইরে বেঞ্চটায় বসে মনে মনে ভাবে জাহিদ। তারপরই খামটা পকেটে ঢুকিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। আগামীকাল পহেলা শ্রাবণ। নীরার বিয়ে।

" কি ব্যাপার, আমাকে না নিয়েই চলে যাচ্ছ? ঢাকা থেকে আসতেই অনেক ঝামেলা হয়েছে। এখন তোমার বাড়ি একা খুঁজে বের করতে পারব না"। তিন বছর ধরে পরিচিত গলার স্বরটা শুনে, বিদ্যুৎ গতিতে ঘুরে তাকায় জাহিদ। " তুমি, তুমি এখানে? "। "হ্যাঁ, আমার কাছ থেকে না পালাতে চেয়েছিলে? ঢাকায় যেতে চাইছিলে কেন তাহলে? বেঞ্চের উপর বসে কাঁদছিলে কেন?"।

“ সাবধানে পা দাও, এখানে কাদা আছে” , আস্তে করে বলে জাহিদ। এক হাত দিয়ে শাড়িটা একটু উচুঁ করে ধরে রাখে নীরা, আরেকটা হাত শক্ত করে ধরে আছে জাহিদ। মেঘ জমছে আকাশে, আজ পহেলা শ্রাবণ। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।