আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জোছনা ও নীলুর স্বপ্ন…

বিদ্রোহী কবিতা পড়ুন...। its all about me....!!! জানালার দিকে অনেকক্ষন ধরে একমনে তাকিয়ে আছে নীলু । বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, ঝুম বৃষ্টি । এরকম বৃষ্টি নীলুর অনেক পছন্দ । একমনে বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে কত অসংখ্য বার যে অজানা্ এক ভুবনে চলে গেছে সে তার হিসেব নেই ।

হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো বৃষ্টির একেকটা ফোটায় যেন নীলুর একেকটা স্বপ্ন আঁকা । গাছের পাতায় কিংবা ছোট এক টুকরো পাথরের গায়ে লেগে যেমন বৃষ্টির ফোটাগুলো অনেকগুলো ছোট ছোট ফোটায় ভেঙে পড়ে, নীলুর স্বপ্নগুলোও তেমনি রঙবেরঙয়ের শাখা প্রশাখা মেলে ছুটে চলে এদিক সেদিক । কিন্তু ইদানিং কি যেন একটা হয়েছে নীলুর । বৃষ্টি দেখলে অস্থিরতা বেড়ে যায় । ভেতরের অস্থিরতা চাপা দিতে বড় কষ্ট হয় তখন ।

একমনে তাকিয়ে থাকা উদাস দৃষ্টিতে অদৃশ্য ওই কষ্টের সবটুকু বেরিয়ে আসে । চাপা দেয়া এই কান্না বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ে তখন । হয়ত এতে ওই কষ্টের কিছুটা উপশম হয়! কান্নার মত গভীর কিছু নেই । দু:খ একজনেরটা আরেকজনকে স্পর্শ না করলেও কান্না ঠিকই পারে । আর তাই আকাশের কান্নায় মনের ওই হাহাকারে কিছুটা হলেও ভেজা স্পর্শ খুজে পায় নীলু ।

তিন ভাই বোনের মধ্যে মেঝো নীলু । বড় বোন দিলু আর ছোট ভাই সোহেল । দুই বোনের সাথে মিলিয়ে ডাকতে গিয়ে সোহেল থেকে হয়ে গেছে সলু । এটা নিয়ে বড়ই বিপদে বেচারা সোহেল । ক্লাসে টিচাররা মাঝে মাঝে সিক্সটিন বলে তো ডাকেই, বন্ধুরা নীলু-দিলুর সাথে মিলিয়ে এটাকে শিলু বানিয়ে দিয়েছে।

আর পাড়ার বদ ছেলে জামিল, বয়সে সোহেলের একটু বড় । ও সোহেলকে দেখলেই দূর থেকে চিল্লানো শুরু করে, - এ্যাই শীলু, শোন…. - এ্যাই এদিকে আয় না রে... বলে কাছে ডেকে এনে হাত দুটোকে উপরে তোলে “শীলা কি জোয়ানী” গানের সাথে কোমরটা নাচিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাচতে শুরু করে। পিত্তি জ্বলে যায় ওর। কিন্তু জামিলকে আবার একটু ভয়ও পায় সোহেল, তাই কিছু বলতে পারে না । একদিন অগত্যা নিলু কে বলে সোহেল ।

ছোটবেলা থেকেই স্বাস্থ্য চেহারায় জবরদস্ত নীলুর চোখ বড় বড় করে দেয়া রাম ঝাড়ি খেয়ে জামিল এরপর থেকে আর সোহেল কে ক্ষেপায় না। এই হচ্ছে পাড়ার জুনিয়র ছেলেপুলেদের কাছে নিলুর ইমেজ । আর ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় অতিশয় মনোযোগী হওয়ায় ক্লাশের ফার্ষ্ট গার্ল নীলুর কদর টিচারদের কাছে সবসময়ই একটু বেশী ছিল । ক্লাশ ক্যাপ্টেন হওয়ায় ক্লাসমেটদেরও সমীহ পেয়ে অভ্যস্ত । বাইরের আর সবার কাছে তাই কিছুটা ভাব ধরা কঠিন হৃদয় বিশিষ্ট মেয়ে হিসেবেই বেড়ে ওঠা ।

কঠিন আর এই ভাব ধরা নিলুর ভেতরকার ছোট্ট নীলুটাকে তাই খুব কম মানুষই চেনে। এদের মধ্যে একজন হলো নীলুর প্রিয় বান্ধবী নিপা, আর আরেকজন নীলুর আম্মু । ওর খুব কাছের বন্ধুদেরও একজন তাই মা। কঠিন নিলুর ভেতরকার নারীত্বকে বের করতে তাই মাঝেমধ্যেই লিপিস্টিক, চুড়ি কিংবা কাজল দিয়ে বসিয়ে দেয় আয়নার সামনে। আনমনে সাজতে বসে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হয় নীলু।

এত সুন্দর একজোড়া চোখ ওর! কাজল মাখা ছলছলে ওই চোখের দিকে তাকালে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন হৃদয়টাও মায়ায় আটকে যেতে বাধ্য। সাজতে সাজতে নিজের ভূবনে হারিয়ে যায় একসময়। যেখানে লালপেড়ে সাদা শাড়ি, খোপায় গোলাপ ফুল আর দুইহাত ভর্তি কাচের চুড়ি পড়ে ইচ্ছেপরীর দেশে চলে যাওয়া যায়। সেখানে নীলুর সাথে অজানা কিন্তু খুব কাছের একটা মানুষকে অনুভব করে সে। যার হাতের স্পর্শে লজ্জায় লাল হযে ওঠে নীলুর গাল ।

হাতে হাত রেখে ওরা হাটতে থাকে, অনেক দূর পর্যন্ত। কখনো রেল লাইনের পাশ ঘেষে, কখনোবা লাইন দুটোতে দুজন হাত ধরাধরি করে কিংবা কখনো পড়ন্ত বিকেলের রোদে নদী পাড়ের বালিয়াড়ির ধার ঘেষে যতদূর দুচোখ যায়। এভাবে হাটতে হাটতে একসময় সন্ধ্যা আসে। জোছনা খুব প্রিয় নীলুর। মেঘের আড়ালে ঢেকে যাওয়া চাদের মত হালকা জোছনায় লুকোচুরি খেলে ওরা।

চিৎকার করে নীলুর বলতে ইচ্ছে করে তখন…. ‘হে পৃথিবীর মানুষ শোনো… আমি আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ’। পরক্ষনেই কি যেন একটা বিষাদ এসে মলিন করে দেয় নীলুকে। অজানা আশঙ্কা ভর করে মনের কোনে। ঢাকার শহূরে কলকব্জার কড়িকাষ্ট পরিবেশে বড় হয়েছে সে । বাবা মার অনেক আদুরে হওয়ায় কখনো চোখের আড়াল হতে দেয় নি।

প্রকৃতিটাকে তাই কাছ থেকে দেখা হয় নি কখনো । বান্ধবীদের সাথে বাইরে যাবার সুযোগ এলেও মাযের মুখের দিকে চেয়ে যেতে ইচ্ছে হয় নি। নীলু চোখের আড়াল হবে এটা ভাবতেই মা’র মুখটা এতটুকু হয়ে যায়। মায়ের এরকম মুখটা দেখা মাত্রই নীলু ভূলে যায় সব। অপূর্ণ স্বপ্নগুলো ওখানেই চাপা পড়ে থাকে।

এইতো সেদিনও ভার্সিটিতে থার্ড ইয়ার ফাইনাল শেষে ছুটিতে বান্ধবীরা মিলে বান্দরবান বেড়াতে যাবার প্লান করলে খুশিতে নাচতে ইচ্ছে হচ্ছিল ওর। এবার হয়ত পাহাড়ের ওই চুড়ায় ওঠে ভোরের কুয়াশা ভেঙে জেগে ওঠা সূর্যের প্রথম নিষ্পাপ আলো গালে মাখার স্বপ্নটা পুরন হবে। খুব কাছ থেকে ছুয়ে দেখবে বুনো ফুলের পাপড়িতে জমে থাকা শিশির কিংবা রাত হলে হাজার হাজার জোনাকির আলোয় আধো ভয় আধো অভিভূত চোখে দেখা হবে রাতের প্রকৃত সৌন্দর্য্যৃ। কিন্তু হয়নি সেবারও। বান্ধবীরা সবাই এসে অনুরোধ করলেও মা রাজি হ্য়নি দিতে।

রুনু, বাধন, শিমু ওরা কত জোর করলো। মা বলল, - আমি আমার নীলুকে ছেড়ে একরাতও থাকতে পারব না মা, তোমরা যাও ও পরে কোন একসময় যাবে। তাছাড়া বিয়ে হোক, জামাই নিয়ে ঘুরাবে দরকার হয়। ওরা বলল, - আন্টি, আমরা সবাই তো যাচ্ছি ও তো আমাদের সাথেই থাকবে ভয় নেই কোনো… - ও ছোটবেলা থেকেই বাইরে কোথাও থাকেনি…. - কিচ্ছু অসুবিধা নেই আন্টি আমরা তো আছি.. তাছাড়া মাত্র তো তিনটা দিন। নীলুর পাহাড় দেখার অনেক শখ.. - না ঠিক আছে..কিন্তু.. জোরাজোরির এক পর্যায়ে নীলু লক্ষ্য করলো ওর আম্মু ইতস্তত করছে, ঠোট কেপে কথা আটকে যাচ্ছে, বান্ধবীদের অনুরোধ ফেলতেও পারছে না, আবার রাখতেও পারছে না।

সকাতর নয়নে নীলুর দিকে তাকিয়ে বলল, - কিরে মা, যেতেই হবে…? না গেলে হয় না? মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে নীলু ভুলে যায় পাহাড়ের কথা, সূর্যের কথা কিংবা জোছনার কথা। মাকে জড়িয়ে ধরে শিশুদের মত কাদতে কাদতে বলে, - যাব না আমি কোথাও তোমাকে ছেড়ে মা। এক মুহুর্তের জন্যও না। যাওয়া হয়না আর বান্দরবান। বান্ধবীরা ঘুরে এসে গল্প করে নীলুর কাছে।

নিলুর চোখ ছলছল করে ওঠে। সেদিন বাসায় ফিরে কারো সাথে কথা না বলে সোজা নিজের ঘরে বসে থাকে জানালার দিকে চেয়ে। ঘরের পুব পাশের জানালাটা ওর খুব ভালো বন্ধু। নীলুর কষ্টের মূহুর্তগুলোর যেমন সঙ্গী এই জানালা তেমনি আনন্দের মুহুর্তগুলোরও। বৃষ্টি এলে এই জানালার পাশে এসে দাড়ালে দমকা বাতাসে বৃষ্টির ঠান্ডা পানির ছাট এসে মুখে পড়ে।

কি যে ভাল লাগে তার তখন! অবশ্য বাজের শব্দ ভীষন রকম ভয় পায় নীলু, জানালা ছেড়ে তখন ঘরের ঠিক মাঝখানটায় এসে বসে থাকলে্ও মনটা ঠিকই পড়ে থাকে জানালায়। ভীরু চোখে আবারো স্বপ্নের জাল বুনে চলে… একদিন ইচ্ছেমত বৃষ্টিতে ভিজবে, বাজ পড়লেও ভয় পাবে না, প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে ঠান্ডায় কেপে উঠলেও ঘরে ফিরবে না। খোলা মাঠে চিত হয়ে শুয়ে থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির ফোটা খেতে নিশ্চই অনেক মজা! আসুক জ্বর, বকুক আম্মু কোন কিছুকেই পরোয়া করেব না সেদিন নীলু, কারন তার পাশে থাকবে তার সেই চিরচেনা আপন মানুষটি যাকে সে সবসময় ভাবে। ভাবতে ভাবতে আশ্চর্য হয় নীলু। একটা অচেনা মানুষকে কেন এত আপন মনে হয় ওর! তবে আজ এই চীরচেনা জানালাটাকেই বড্ অচেনা লাগছে।

চোখে ভাসছে বান্ধবীদের তৃপ্তিমাখা উজ্জল মুখ, কতই না আগ্রহ নিয়ে বান্দরবার ট্যুরের গল্প করে ওরা। ইস! যদি যেতে পারত নীলু! জানালার পাশে এলোমেলো উড়তে থাকা লাল রঙের ফড়িংটাকে দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না সে। বালিশে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদে ওঠে। ফড়িং হয়ে জন্মালেও বোধ হয় ভালো হতো এর চেয়ে! যেদিক ইচ্ছে উড়ে বেড়াতো। থাকুক না এক সপ্তাহের আয়ু।

তবুও তো স্বাধীনতা আছে। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যায় নীলু। ঘুম ভেঙে গেলে আবার সেই জানালা। অবার সেই বৃষ্টি। এভাবেই বয়ে যায় সময়।

এতো প্রিয় বৃষ্টির শব্দটাও অসহ্য লাগে মাঝে মাঝে। জানালার দিকে তাকানো উচ্ছল দু চোখে ভর করে উদাসীনতা। পাবে কি কখনো নিলু তার সেই আপন মানুষটির দেখা!! হবে কি মানুষটি তার স্বপ্নের মত? নাকি দুপুরের পোড়া রোদের মতো কাঠখোট্টা কেউ এসে জুটবে কপালে! জীবনটাকে বানিয়ে দেবে মরুভূমি। দিবা স্বপ্ন দেখে দেখে যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। জেগে থেকে দিবা স্বপ্নের আকূলতার চেয়ে ঘুমের স্বপ্ন অনেক মধুর।

কারন, ঘুমিয়ে থাকা স্বপ্নের প্রতিটা মুহুর্ত জীবন্ত। ঘুম ভেঙে গেলে যদিও সব অর্থহীন তবুও অন্তত ঘুমিয়ে থাকা সময়টাতে তো বাস্তব মনে হয় সব। দিবা স্বপ্নের কল্পনার মত প্রতি মুহুর্তে স্বপ্ন ভঙ্গের ভয়ে ভীত থাকতে হয় না। একটা সুন্দর স্বপ্নের প্রতিক্ষায় প্রতিদিন ব্যাকুল থাকে তাই নীলু। যেখানে সত্যি সত্যি দেখতে পাবে সে তার দিবা স্বপ্নের সেই আপন মানুষটাকে।

খুব কাছে থেকে ছুয়ে দেখবে তখন তাকে। সে নিশ্চই তাকে কষ্ট দেবে না এতো! না বললেও বুঝে নেবে নীলুর ছোট ছোট চাওয়াগুলোকে। পূরন করবে সব একটা একটা করে। আগে থেকে কিছুই জানবে না নীলু। প্রতিটা ইচ্ছাপূরন হবে একেকটা সারপ্রাইজ।

একেকটা স্বপ্ন পূরন হবে আর খুশিতে মরে যেতে ইচ্ছে করবে নীলুর! খুব বেশী কিছু তো চায়না নীলু। জোস্না আর বৃষ্টির সাথে তাকে কাছে পাওয়া, ব্যাস এটুকু হলেই খুশি। হঠাৎ এসে তাকে একদিন বলুক সেই মানুষটা, চল নীলু আজ তোমাকে কাশফুল গাছের ফাকে টুনটুনি পাখির বাসা দেখাবো। নীলু সেই বাসা দেখবে অবাক নয়নে। এত্তো সুন্দর হয় টুনটুনি পাখির বাসা!! মনের অজান্তেই চোখের কোনে ঝিলিক দিয়ে উঠবে একটা ছোট্ট ঘরের ছবি।

ঘরটা তার নিজের। যেখানে থাকবে ওরা দুইজন। ঠিক এই টুনটুনি পাখির বাসাটার মতই সাজাবে নীলু ঘরটাকে। ঠিক তার মনের মত করে। অর্থবিত্তের প্রাচুর্য না থাকলেও সে ঘরের বেড়ার ফাক গলে ঠিকই সাদা জোস্না এসে পরবে তাদের গায়ে, কোন এক অন্তিম মুহূর্তে… অনুভব করবে সে তার প্রিয় মানুষটাকে… খুব কাছ থেকে… ( উৎসর্গে: রাত্রি, যে আমাকে বলেছিল, আমি তাকে কখনওই এত্তো খুশি করতে পারবো না।

জানিস রাত্রি? হয়ত তোকে সত্যিই এত্তো খুশি করতে পারব না কখনো… কিন্তু বিশ্বাস কর, তোকে এত্তো খুশি অবস্থায় দেখতে পেলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হতে পারতো না!) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।