বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট’ গঠনের মূল ইতিহাস
মোদাস্বার হোসেন মধু বীর প্রতীক
১. মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট গঠনের ইতিবৃত্ত
১৯৭২ ইং সালের ১০ই জানুয়ারী মাতৃভূমি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য কারা বরণ শেষে বাংলার মাটিতে পা রাখার সাথে সাথেই এক শ্রেণীর কুচক্রী রাজনীতিবিদ সহ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বড় ভাইয়েরা বঙ্গবন্ধুর সরলতার সুযোগে তাঁকে কান কথায় ভুলিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে বাঁকা পথে নিয়ে যাবার জোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু বাংলার নয়নমণি, স্বাধীন বাংলার স্থপতি ভুল পথে অগ্রসর হননি। বিশাল দেহ ও মনের অধিকারী জাতির পিতা বাঙালী মনে করে পিস কমিটির চেয়ারম্যান, মেম্বার, দালাল, রাজাকার ও আলবদরদের সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তবে, তিনি যদি বড় ভাইদের স্বার্থপর কথাগুলো না শুনে রাজাকার আলবদর ও দালালদের নির্যাতন করার কথা শুনতেন, তাঁর হাজার সন্তানের শাহাদাত বরণ ও পঙ্গুত্ব বরণের কথা শুনতেন, তবে কোনদিন তিনি সাধারণ ক্ষমার কথা মুখে উচ্চারণই করতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধু বাংলার মাটিতে পা রাখার পর থেকেই মুজিব বাহিনীর বড় ভাইয়েরা শুধু এটাই তাঁকে বলেছে যে, ‘আপনার নামে বাহিনী তৈরি করে আমরা যুদ্ধ করে বাংলা মা’কে স্বাধীন করেছি।
’ ১৯৭২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শুধু মুজিব বাহিনী বলে খ্যাত যোদ্ধাদের কথাই শুনেছেন। অথচ, তাঁর নির্দেশ পেয়ে সর্বপ্রথম বাংলার যে সব কুলি, মজুর, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতীর সন্তান ভারতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছে, শাহাদাত বরণ করেছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, তাঁদের কথা তাঁর কর্ণ পর্যন্ত স্পর্শ করেনি। যদি করত তবে তাঁর সেই সব সন্তানেরা কোন দিন বাংলার মানুষের নিকট আবর্জনা হয়ে বেঁচে থাকত না।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের রোগ মুক্তি বিশ্রামাগার, কলেজগেট, ঢাকা
বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার কিছুদিন পর মোহাম্মদপুরের এক সমাজ সেবক শ্রদ্ধেয় মৃত নজরুল ইসলাম চাচা বঙ্গবন্ধুকে সেই বীরঙ্গনাদের (মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে অবস্থানকারী) কথা জানালে চুপিচুপি বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধেয় মৃত নজরুল ইসলামের সাথে বাবর রোডে বীরাঙ্গনাদের দেখতে আসেন। এবং তাদের টাকাসহ জামাকাপড় ও কম্বল প্রদান করেন।
প্রতিটি বীরঙ্গনার মাথায় হাত দিয়ে ‘মা’ বলে ডাক দিয়ে তিনি তাঁদের সান্তনা দিয়েছিলেন। বাবর রোড থেকে ফেরার সময় শ্রদ্ধেয় নজরুল চাচা মোহাম্মদপুরের কলেজ গেটে অবস্থানরত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন যে কলেজ গেটে বেশ কিছু পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করেছন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার বিবরণ নজরুল চাচা বঙ্গবন্ধুকে শোনালেও তিনি তখনকার পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং বর্তমানের ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রোগমুক্তি বিশ্রামগার’-এ যান নি। একটা চিরন্তন সত্য কথা হলো এই যে যোদ্ধা যদি যুদ্ধ করেন তবে তাঁকে শাহাদাত বরণ থেকে শুরু করে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হবেই।
খাঁটি যোদ্ধাদের মধ্যে অন্ততঃ ১% পার্সেন্ট হলেও যুদ্ধে শাহাদাত বরণ অথবা পঙ্গুত্ত্ব বরণ করবেই। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট পর্যন্ত এখনও কোন শহীদ অথবা পঙ্গু মুজিব বাহিনী খুঁজে পাই নাই। নাই। তাহলে কি এতে করে প্রমাণ হয় না যে মুজিব বাহিনীর ভাইয়েরা কতটুকু যুদ্ধ করেছেন? এবং আদৌ করেছেন কিনা? তার পরেও উক্ত বাহিনীর বড় ভাইয়েরা বঙ্গবন্ধুকে শুধু ‘মুজিব বাহিনী’র ধারণাই দিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সহ আর কোন বাহিনীর কথা তিনি শোনেননি।
জানেননি। কিন্তু যখন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও বিশ্রামাগারে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা হুইল চেয়ার ক্রাচ নিয়ে পঙ্গু অবস্থায় পিতার সাথে দেখা করার জন্য ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে তাঁর বাসস্থান ও গণভবনে যাতায়াত শুরু করল, তাঁকে সময় সুযোগ বুঝে বিরাক্ত করতে লাগল, তখনি তিনি ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের সম্বন্ধে অবগত হতে লাগলেন।
একদিনের কথা। বঙ্গবন্ধুর গাড়ির চালক ফকিরদ্দীন (আমার সেসময়ের বন্ধু; বর্তমানে ফইক্কা পাগল) একদিন আমাকে গোপনে খবর দিল যে আজ বিকাল ৩:০০ টা হতে ৪:০০ টা নাগাদি বঙ্গবন্ধু গণভবনে নারকেল গাছ লাগাবেন। খবরটা পেয়ে আমি মোদাস্বার হোসেন মধু বীরপ্রতীক, কুমিল্লার মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বীরপ্রতীক, নোয়াখালীর নুরুল আমিন বীরপ্রতীক ও সিলেটের মো. আদূর রহমান তাঁর সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
রহমান ছাড়া আমরা তিনজনই হুইল চেয়ারে চলাচল করি। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক জান্তা বাহিনীর গুলিতে চির জনমের মত পঙ্গু হয়ে পুরুষত্ত্ব পর্যন্ত হারিয়েছি। আর রহমান? গুলি লেগে তার পুরুষাঙ্গের অংশ বিশেষসহ ১টি অণ্ডকোষ পর্যন্ত উড়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু প্রস্তুতি নিচ্ছেন নারকেল গাছ লাগানোর। এমন মুহূর্তে আমরা ৪ জন এক সাথে গণভবনে প্রবেশ করতে গেলে নূর ইসলাম নামে একজন সাধারণ প্রহরী আমাদের বাধা প্রদান করতে উদ্যত হয়।
বন্ধু নূরুল আমিন বীর প্রতীক (মৃত) নূর ইসলামকে লাল চোখে ধমক দিয়ে ওঠে, ‘এ্যাই ব্যাটা তুই কেরে? আমরা আমাদের নেতার সাথে দেখা করব। ভাগ!’
এখনকার মত তখন বঙ্গবন্ধুর মত একজন প্রধানমন্ত্রীর ফটকে কোন ভারী প্রটোকল অথবা হাতে হাতে মোবাইল ছিল না। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর গণভবনে বোধ হয় একটি টেলিফোনই ছিল। আমাদের মতো চারজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে গণভবনের একেবারে ভেতরে দেখে ডাক দিলেন, “ফকির!” বঙ্গবন্ধু তাঁর গাড়ীর চালক ফকিরুদ্দীনকে স্নেহ করে ডাকতেন “ফকির। ”
তড়িৎ গতিতে ফকির তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
তিনি আমাদের চারজনের দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরা কারারে? এরা কী চায়?’ পাতলা মুখের ফকিরউদ্দীন আমাদের কথা বলার পূর্বেই প্রথমে মৃত নুরুল আমিন বীর প্রতীক তাঁর নাম ঠিকানা, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরসহ সব পরিচয় বঙ্গবন্ধুকে জানায়। বাকি আমরা তিনজনও আমাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় তাঁকে দেই। চার জনের মধ্যে আমি মধু, নুরুল আমিন ও নজরুল ইসলাম সহ তিনজনই তাঁকে বলি, ‘আমাদের শরীরে এখনও পাক বাহিনীর বুলেট রয়ে গেছে। ভারতের ডাক্তাররা শরীরের সব গুলি বের করতে পারে নি!’ তিনি নারকেল গাছ লাগাবার কথা ভুলেই গেলেন। ফ্যাল ফ্যাল চোখে কতক্ষণ আমাদের দিকে চেয়ে থেকে ফকিরের দিকে চেয়ে বলে উঠলেন, ‘ফকির, টেলিফোনটি নিয়ে আয়!’
ফকির দৌড় দিয়ে ঘর থেকে ফোনের তার ছুটিয়ে নিয়ে এলো তাঁর সামনে।
তিনি গণভবনের ঘাসের উপর বসে পড়লেন। কাকে যেন টেলিফোনে বললেন I need you now. So please meet me. আমরা বলা শুরু করলাম, ‘আমাদের আরো চিকিৎসা দরকার। আমাদের শরীরের গুলি আপনি বের করে দেন!’ তিনি সেই মুহূর্তে আমাদের মাথায় হাত রেখে বলতে লাগলেন, ‘তোমরা দেশ স্বাধীন করেছ। তোমরা ত’ দেখছ যে দেশের সব কিছু ধ্বংস!’ তাঁর বাকি কথা শেষ করার পূর্বেই সিলেটের রহমান তার প্যান্ট এবং জাঙ্গিয়া খুলে ফেলে একেবারে উলঙ্গ হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘লিডার! আমরা বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা আপনার নির্দেশের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং এমন ভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছি। ’
বঙ্গবন্ধু রহমানের দিকে দেখেই দুই চোখ ঢেকে ফেললেন।
কেঁদে ফেললেন। অভিমানী ও উত্তেজিত, অল্পবয়সী মুক্তিযোদ্ধা রহমান আবার বলে উঠলো, ‘আপনার নির্দেশে যা হারিয়েছি ফিরিয়ে দিন। কামলা খেটে যাব। চিকিৎসার দরকার নাই। ’
মুক্তিযুদ্ধে লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ হারা উত্তেজিত রহমান বঙ্গবন্ধুর সামনে কথাগুলো বলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
আমরাও অশ্রু সংবরণ করতে পারি নি। বঙ্গবন্ধু ও ফকির… তাঁদের চোখেও পানি। রহমান ও আমরা তিনজন। ইতোমধ্যে ফকিরুদ্দীন একটি গামলায় করে চানাচুর, মুড়ি, সরষের তেল আর পেঁয়াজ দিয়ে মাখিয়ে এনেছে। বঙ্গবন্ধু ফকিরকে নির্দেশ দিলেন, ‘গামলাটা ধরে রাখ।
ওরা মুড়ি খাক। ’ ফকিরুদ্দীন পাথরের মূর্তির মতো গামলা ধরে দঁড়ালো। আমাদের চারজনকে মুড়ি নিতে ইশারা করে তিনিও আমাদের সাথে একই গামলা থেকে মুড়ি নিয়ে খেতে লাগলেন। আমরা চারজন আর বঙ্গবন্ধু… সব মিলিয়ে পাঁচ জন একসাথে মুড়ি খাচ্ছি। দু/তিন বার মুড়ি হাতে নিয়েছি।
হঠাৎই দেখি বঙ্গবন্ধু তাঁর স্নেহ ভাজন গাড়িচালক ফকিরুদ্দীকে ধমক মেরে বললেন, ‘কীরে মুড়ি খাওয়া তোর বাবার নিষেধ আছে? তুই খাচ্ছিস না কেন?’ হায়, তাঁর কাছে আহত মুক্তিযোদ্ধা, গাড়ির চালক হতে শুরু করে সবাই ছিল সমান। সেদিন অর্থাৎ ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে তিনি সেভাবেই অনুভব করেছিলেন। ইতোমধ্যে গণভবনে এসে হাজির হলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী। আমার গর্বিত জীবনে সেদিন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী আর স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের প্রথম সেনাপতির
কথোপকথন শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। জেনারেল সাহেব এসে প্রধানমন্ত্রীর সামনে সোজা দাঁড়িয়ে মাথা নত করে চোখে চোখ ফেলেছেন।
তিনি জেনারেল ওসমানীকে বললেন, ‘জেনারেল, কেমন আছেন? আপনি কি জানেন এরা কারা?’ জেনারেল ওসমানী সিলেটের রহমানকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতেন বিধায় বললেন, ‘হ্যাঁ, প্রাইম মিনিস্টার। ওরা কলেজের ছাত্র। ওরা আপনারই কথায় পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আজ ডিসএবল হয়ে পড়েছে। ’ একথা শুনে তিনি আরো বেশি অস্থির হয়ে পড়লেন। জেনারেলসহ সবাই এক সাথে মুড়ি খেলাম।
বঙ্গবন্ধু সবার মাখায় হাত দিয়ে স্নেহভরে বলতে লাগলেন, ‘আমি তোদের চিকিৎসা করাবো। তোদের শরীরের ভেতরের গুলিও বের করার ব্যবস্থা করবো। ’ আমরা তাঁর স্নেহবিজড়িত সান্ত্বনা নিয়ে ফিরে এলাম গণভবন থেকে। সেদিন আর প্রধানমন্ত্রী গণভবনে নারকেল গাছ লাগাতে পারেননি।
আজও সেই ফকিরুদ্দীন, গার্ড নূর ইসলাম ও আমি সেদিনের ঘটনাসহ পরের অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছি।
প্রায় একমাস পরে সেপ্টেম্বর ৭২-এর ১৪ তারিখ প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধের মহান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনী ওসমানী ও মুক্তিযুদ্ধের চীফ অব স্টাফ জেনারেল এম. এ. রব বীর উত্তমসহ এক আলোচনায় মিলিত হন। এছাড়াও সেদিনের আলোচনায় আরো উপস্থিত ছিলেন যুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একমাত্র জেনারেল ওসমানী ছাড়া প্রত্যেক সেক্টর কমান্ডারকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও প্রত্যেকটি সেক্টরে মেজর, ক্যাপ্টেন, লেফটেন্যান্ট এমনকি সিভিল হতেও মিলিয়ে ৪/৫ অথবা ৫/৬ জন সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তার পর আরো ছিল কোম্পানি কমান্ডার, সেকশন কমান্ডার সহ কত না মুক্তিযোদ্ধা! সবাই মিলিয়েই মুক্তিযুদ্ধ।
এই যারা যুদ্ধ করেছে, এদের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে আরও একটি বাহিনী ছিল। যার নাম ছিল মুজিব বাহিনী। বিজয় যখন বাঙালীর দোরগোড়ায়, তখন এরা অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস নাগাদ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সহ গোটা দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে পরিত্যক্ত অস্ত্র কুড়িয়ে ‘জয় বাংলা!’ ‘জয় বাংলা!’ বলে দেশে প্রবেশ করে হয়ে যায় মুজিব বাহিনী। বঙ্গবন্ধুর নামে নাম নেওয়া এই বাহিনী কতটুকু যুদ্ধ করেছেন কি না করেছেন তা’ কোনো ভাবেই বলা সম্ভব নয়। তবে, বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে আহত প্রায় ৫,০০০ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা দেন।
এদের মধ্যে একজনও ‘মুজিব বাহিনী’র মুক্তিযোদ্ধা নেই। অথবা, স্বাধীনতার পর এত বছরেও কোনো শহীদ মুজিব বাহিনী পরিবারের কোনো সন্তানকে আমরা দেখতে পাই নাই। এ থেকেই বোঝা যায় যে ‘মুজিব বাহিনী’ দেশের জন্য যুদ্ধ করার পূর্বেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। অথচ ‘মুজিব বাহিনী’র বড় ভাইয়েরা পরিত্যক্ত কিছু অস্ত্র হাতে করে ‘জয় বাংলা’ বলে বাংলাদেশে ঢুকেই হয়ে গেল বড় মুক্তিযোদ্ধা। যাঁরা ছিলেন ছাত্রলীগের বড় ভাই, যাঁরা ছিলেন ছাত্র নেতা… সেই সব বড় ভাইয়েরাও দেশ স্বাধীন হবার পরে নিজেদের স্বার্থ নিয়ে টানাটানি শুরু করলেন।
কুটিল রাজনীতি দিয়ে তাঁরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন। বড় ভাইয়েরা কান কথায় বঙ্গবন্ধুকে ভুলাতে চেয়েছিলেন যে তাঁর নামে গঠিত বাহিনীই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। কিন্তু, যখন প্রকৃত আহত মুক্তিযোদ্ধারা পুরাতন গণভবন অথবা ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেছেন, তখন তিনি বুঝতে পেরেছেন যে ‘মুজিব বাহিনী’র বাইরেও কত অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ছিল! বঙ্গবন্ধু যখন ‘মুজিব বাহিনী’র কোনো যোদ্ধাকে আহত বা পঙ্গু হিসেবে খুঁজে পাননি, তখন তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতিকে আমাদের কথা জিজ্ঞেস করেন। তারপর যখন তিনি দেখলেন যে এই সব কুলি, মজুর, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতীর সন্তান ও স্কুল কলেজের ছাত্ররাই সর্বাগ্রে দেশের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং তারাই আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে বা শহীদ হয়েছে, তখন তিনি সেইসব আহত, পঙ্গু ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ভেবে, তাঁদের পরিবারগুলোর ভবিষ্যৎ ভরণ পোষণের কথা ভেবে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গঠন করেন ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাষ্ট। ’
মুক্তিযুদ্ধের চীফ অব স্টাফ মরহুম জেনারেল এম. এ. রব বীর উত্তমকে প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে বঙ্গবন্ধু গঠন করেন ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট।
’ ট্রাষ্ট গঠনে স্বর্গীয়া ইন্দিরা গান্ধী ৭২ লক্ষ রুপী বাংলাদেশ সরকারকে অনুদান হিসাবে প্রদান করেন। এই ৭২ লক্ষ রুপীসহ মোট ৪ কোটি টাকা মূলধন ও মিসেস আদমজীর কোকো কোলা কোম্পানী, মিসেস মাদানীর গুলিস্তান সিনেমা হল, চু চিন চৌ রেষ্টুরেন্টসহ গোটা গুলিস্তান ভবন, নাজ সিনেমা, ওয়াইজ ঘাটে মুন সিনেমা, নবাবপুরের মডেল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী, হাটখোলায় হরদেও গ্লাস কোম্পানী, ঢাকার পূর্ণিমা ফিলিং ষ্টেশন, মেটাল প্যাকেজেস কোম্পানী, মিমি চকলেট কোম্পানী, সিরকো সোপ এন্ড কেমিক্যাল কোম্পানী, মিরপুরে বাক্স রাবার কোম্পানী, চট্টগ্রামের ইষ্টার্ন কেমিক্যাল কোম্পানী, হোমেদিয়া ওয়েল কোম্পানী, বাক্সলী পেইন্টস কোম্পানী, আলমাস, দিনার সিনেমাহল সহ মোট পাঁচটি সিনেমা হল ও ১৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং ৮৮, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় একটি একতলা বিল্ডিংসহ মোট ২২টি প্রতিষ্ঠান নিঃশর্ত দান করে সেগুলো চালনার জন্য বঙ্গবন্ধু গঠন করে দেন ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট। ’ মুক্তিযুদ্ধের চীফ অব স্টাফ মরহুম জেনারেল এম এ, রব বীর উত্তম ও মুক্তিযুদ্ধে চার নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সি,আর,দত্ত ছাড়া আর কেউই কল্যাণ ট্রাষ্টকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারেন নি। উক্ত দু’জনই শুধুমাত্র সরাসরি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন। বাকি যত জন এসেছেন তারা সবাই এম,ডি, পদে ডেপুটেশনে এসেছেন।
দু/তিন বছর থেকে আবার চলে গেছেন। গাড়ি চালক, জি. এম., ডি. জি. এম., এম. ডি. সহ সবাই বিভিন্ন সময়ে ডেপুটেশনে এসেছেন। আবার চলে গেছেন। বাংলাদেশের জীবনে যেমন যেভাবে সরকার বদল হয়েছে ঠিক তেমন ভাবেই কল্যাণ ট্রাষ্টের পরিচালক বা এম, ডি, বদল হয়েছেন। আর দেশকে না চালিয়ে যেমন প্রত্যেকটি সরকার নিজকে চালাতে চেয়েছেন, বিভিন্ন প্রকার আমলার পাল্লায় পড়ে ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট’-ও সেভাবেই চলেছে।
বুকভরা আশা নিয়ে যাদের কল্যাণের কথা চিন্তা করে এই ট্রাস্ট গঠিত হয়েছিল, সেই ট্রাস্ট হতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো কল্যাণ আজ পর্যন্ত করা সম্ভব হয় নাই। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ছিল যে এই ট্রাষ্টের আয় থেকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভরণ পোষণ হবে। মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে। তাঁদের ছেলে মেয়ের বিয়ে হবে। সকল কল্যাণমূলক কাজ করবে কল্যাণ ট্রাষ্ট।
কিন্তু তদন্ত করলে দেখা যাবে, কল্যাণ ট্রাষ্টের আয় থেকে কর্মকর্তারা হজ্ব করে হাজী হয়েছেন। বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। রঙ্গিন টি, ভি, ফ্রিজের মালিক হয়েছেন। কিন্তু যাদের কল্যাণের জন্য ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছিল, তাদের বাড়িতে রঙিন টি, ভি, কিম্বা ফ্রিজের প্রশ্নই ওঠে না। মীরজাফরী রাজনীতি আর আমলাদের কারণেই যেমন দিন দিন দেশটা ধ্বংস হতে চলেছে, আমাদের ট্রাষ্টও আমলাদের হাতে পড়ে বিলুপ্তপ্রায়।
রাজনৈতিক ভাবে প্রতিটি সরকার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহার করেছেন। এম, পি, থেকে মুক্তিযোদ্ধা বড়ভাইয়েরা পর্যন্ত হুইল চেয়ারে চলাচলকারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ যুদ্ধাহত মুক্তি যোদ্ধাদের ব্যবহার করেছে। করে নিজেরা লাভবান হয়েছে। হয়েছে গাড়ি বাড়ির মালিক। কিন্তু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা? তিন বেলা খাবারও তাঁদের ভাগ্যে জোটে না।
একটু মাথা গোঁজার ঠাই পর্যন্ত তাঁদের হচ্ছে না। ২৯ বৎসরের বাংলাদেশে এক এক করে এক ডজনের উপর সরকার অতিবাহিত হয়েছে এর মাঝে অর্ধ ডজন বিচারপতি পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করেছেন। কিন্তু দেশমাতৃকার কল্যাণে কেউই সাফল্যব্যঞ্জক উন্নয়নে সক্ষম হন নি। তেমনিভাবে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্টের চেয়ারম্যান স্বয়ং দেশের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হয়।
যাহোক, আগের কথায় ফিরে আসি।
মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী ও পঙ্গুত্ব বরণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট প্রতিষ্ঠার পর থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চীফ অফ স্টাফ জেনারেল মরহুম এম. এ. রব বীর উত্তম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে ৪ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সি. আর. দত্ত বীর উত্তম… এই দু’জনই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের এই দুই বীর বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার আমলে কল্যাণ ট্রাষ্টের আয় থেকেই আহত যোদ্ধাদের ভাতা প্রদান করা হত। কল্যাণ ট্রাষ্ট গঠনের মূল ইতিহাসের সারাংশ এই দুই চেয়ারম্যানই কিছু কিছু জানতেন। জেনারেল মরহুম এম. এ. রব. বীর উত্তমের মুখে কল্যাণ ট্রাস্ট গঠনের ইতিহাস কিছু কিছু শুনেছি। মরহুম জেনারেল এম. এ. রব বীর উত্তম বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্টের প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন বলে অনেক কিছুই অবগত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু মাঝে মধ্যে গুরুতর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে অস্থির হয়ে পড়তেন। আমার জানা মতে তখনকার ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্বর্গীয়া শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও মুক্তিযুদ্ধের তথা বাংলাদেশের প্রথম প্রধান সেনাপতি জেনারেল মরহুম আতাউল গনি ওসমানীও ট্রাষ্ট গঠনের কথা জানতেন। হয়ত আরো অনেক ব্যক্তিত্ব এই গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকতে পারেন যা আমি জানি না। তবে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট আমাদের চোখের সামনে গঠিত হয়েছে বলে ট্রাষ্টের সংবিধানসহ এর জন্ম ইতিহাস আমার জানা।
এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল।
এদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ হতে শুরু করে অনেকেই জানেন আজকের ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগার’ ১৯৭৩-এর মার্চ মাস হতেই ‘আহত, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’ হিসেবে থাকার সময় হতে ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত কোনো দিন বঙ্গবন্ধু কলেজ গেটে অবস্থানরত আহত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে আসেননি। যাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে জন্মদাতা পিতা-মাতাকে উপেক্ষা করে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে আহত হয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছি, পুরুষত্ব হারিয়েছি… কলেজ গেটে অবস্থানরত সেই আমাদের তিনি দেখতে আসেন নি। কতজন আমাদের দেখতে এসে এবং আমাদের অভিমানের কথা শুনে কেঁদে-কেটে, অশ্রু বিসর্জন করে গেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কেন আমাদের দেখতে আসেন নি? এর উত্তর একমাত্র মোহাম্মদপুরের মরহুম নজরুল চাচা এবং আমি জানতাম। আসলে আমাদের মতো আহত যোদ্ধাদের দু/তিন জনকে দেখলেই তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন।
কেঁদে ফেলতেন। সান্ত্বনার ভাষাও হারিয়ে ফেলতেন। আর, সেসময় কলেজ গেটের এই বিশ্রামাগারে ২২৯ জন বিভিন্ন প্রকারের পঙ্গু ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা–কারো বুকে, পেটে, কোমরে, কলিজায় গুলি। চির জনমের মত পঙ্গু হয়ে গেছে। হাঁটতে পারে না।
হুইল চেয়ারে চলাচল। কারো হাত নেই, কারো পা নেই। কারো শেলের আঘাতে চোখ, নাক নেই। মুখ পোড়া। এক সাথে ২২৯ জন এমনতর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে সহ্য করতে পারতেন না বলেই বঙ্গবন্ধু ১০ই জানুয়ারী ১৯৭২ থেকে ১৪ই আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত কলেজ গেটে মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারে আসেননি।
আসতে পারেন নি। এমনটাই আমি শ্রদ্ধেয় মৃত নজরুল চাচার মুখে শুনেছি এবং শুনে কেঁদেছি পর্যন্ত।
বাবর রোডে অবস্থানরত একটি তিন তলা লাল রঙের বাড়িতে অবস্থান করতেন এই সোনার দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারীনী বীরাঙ্গনারা। সেখানে তাঁরা কতজন থাকতেন তা’ একমাত্র মরহুম নজরুল চাচা আর বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কেউই অবগত ছিলেন না। আমরা তাঁদের দূর থেকেই দেখেছি।
শুধু একজন বীরাঙ্গনা তাঁর নিজ পরিচয় দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারে আসতেন এবং গল্প গুজব করে আমাদের সময় দিতেন। আমার মনে আছে যে তিনি বলেছিলেন তিনি বিএ পাশ এবং তাঁর নাম ’ডলি’। আসল নামটি আমি জানতে পারিনি। আমি বরাবর সাক্ষাৎ হলে সালাম করে তাঁকে ’ডলি আপা’ বলে ডাকতাম। ডলি আপা অনেক বার আহত, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা সেন্টারে এসেছেন।
এক সাথে চা খেয়েছেন। বলেছেন, ‘তোরা কিন্তু কম দিস নি। আমি নারী। নারীত্ব লুণ্ঠন করে নেওয়ায় আমার যেমন সব শেষ হয়ে গেছে, তেমনিভাবে তোদেরও তো পুরুষত্ব শেষ হয়ে গেছে। আমার চেয়ে তোরা কি কম? আমি ত’ হাঁটতে পারছি।
তোরা ত’ আর কোন দিন হাঁটতেও পারবি না!’
আমার সেই ডলি আপা নাকি পরে পুলিশের কমিশন চাকুরী পেয়েছিলেন। কিন্তু আজ এখন ডলি আপা কোথায় আছেন কেমন আছেন জানি না! সেদিনের ডলি আপার কথা টেনে বলতে হয় যে জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে পাক জান্তাবাহিনীর বিরুদ্ধে যাঁরা সামনাসামনি যুদ্ধ করেছেন, যাঁরা গেরিলা যুদ্ধ করেছেন, তাদের ক্ষতির কোন হিসাব নাই। মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করতে যেয়ে পাক জান্তাবাহিনী অথবা তাদের এদেশীয় দোসররা দুই লক্ষাধিক মা বোনের ইজ্জত লুটে নিয়েছে। সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে চির জনমের মত পঙ্গু হয়ে গেছে। শুধু চির জনমের মত হাঁটা চলার শক্তি হারায়নি।
বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের মত শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের পুরুষত্ব পর্যন্ত হারিয়েছেন। মোহাম্মদপুরের পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব নজরুল ইসলাম (মৃত) চাচার আবেদন আর অনুরোধে বঙ্গবন্ধু মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে অবস্থানরত ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মা, বোন, যাঁরা ইজ্জত হারিয়েছিলেন তাঁদের মাত্র ক’জনকে দেখে আর গণভবনে হুইল চেয়ার ও ক্রাচে ভর করা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে অত্যন্ত অস্থির বোধ করেছেন। এবং এর ফলশ্রুতিতে চার কোটি টাকা মূলধন দিয়ে গঠন করেছিলেন ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট’। মহান মুক্তিযুদ্ধের চীফ অব স্টাফ মরহুম জেনারেল এম. এ. রব বীর উত্তম সাহেবকে সরাসরি চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে বলেছিলেন, ‘আমার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শাহাদাত বরণ ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, একমাত্র তাদেরই ট্রাষ্ট থেকে ভাতা ও ভরণ পোষণ প্রদান করা হবে। ’
২.
পিছন ফিরে তাকালে আজ মনে হয় দেশ স্বাধীনের পরপরই একটা গোপন ষড়যন্ত্র অবশ্যই হয়েছিল।
এবং যতদূর সম্ভব আমাদের শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরাই সেটা করতে বসেছিলেন। যেমন ষড়যন্ত্র হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের খেতাব নিয়ে। এটা সুস্পষ্ট যে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে কোন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা নেই। এই সাত বীরশ্রেষ্ঠ সেনা, বিমান বা নৌবাহিনীর বিভিন্ন পদে আসীন ছিলেন। অথচ, আমার জানা মতে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আমার সাথী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মোহাম্মদ শামসুদ্দীন ও আমি… আমরা দু’জনেই বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের অধীনস্থ ৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা।
শামসুদ্দীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাব-সেক্টরে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে একাই ১৮জন পাক সেনা ও ৭/৮ জন রাজাকারকে হত্যা করার পর সাথীদের জীবন রক্ষা করে নিজে সাহাদাত বরণ করেন। অথচ তাঁর বৃদ্ধা মাতা মালেকা খাতুন মাত্র পনেরোশ’ টাকা মাসিক রাষ্টীয় সম্মানী ভাতা ছাড়া আর কিছুই পাননি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শামসুদ্দীন এফ. এফ. বা ফ্রিডম ফাইটার অর্থাৎ সেনাবাহিনীর বাইরে সাধারণ জনতা হতে রিক্রুট বলে তাঁর ভাগ্যে একটি রাষ্ট্রীয় খেতাব জোটে নি। মুক্তিযুদ্ধের বীর শ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক খেতাবগুলো নিয়ে যেমন একটা টানাটানি ও ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ঠিক তেমনিভাবে বড় ভাইয়েরা বঙ্গবন্ধুকে নানা রকম কান কথায় ভুলিয়ে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন ভারতে উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের। অথচ তাঁরাই প্রকৃতপক্ষে নেতার ডাকে সাড়া দিয়ে সর্বপ্রথম অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ভেতর থেকে উঠে আসা এই যোদ্ধারাই হয়েছেন শহীদ। হয়েছেন চিরজনমের মত পঙ্গু। হাঁটতে পারলেও বাকি জীবন শুনতে হয়েছে ‘খোঁড়া’ অপবাদ। মুজিব বাহিনীর বড় ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ২/১টা প্রতিরোধ ও প্রতিবন্ধকতা ছাড়া পাক জান্তাবাহিনীর সাথে সামনা সামনি যুদ্ধ বলতে গেলে করেনই নি। যদি তারা পাক বাহিনীর সাথে সামনা সামনি যুদ্ধ করতেন তবে অবশ্যই ২/৫ জন যুদ্ধাহত মুজিব বাহিনীর সৈন্য থাকতেন।
কিন্তু, আমার জানা মতে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্টে’র মাধ্যমে রাষ্টীয় সম্মানী ভাতা প্রাপ্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজনও মুজিব বাহিনী নেই। একটি শহীদ পরিবারও শহীদ মুজিব বাহিনীর নেই। তার পরও বড় ভাইয়েরা বঙ্গবন্ধুকে কান কথা বলেছিলেন, ‘আমরাই আপনার নামে বাহিনী মানে মুজিব বাহিনী গঠন করে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। ’ হয়ত তিনি তাঁর প্রিয়ভাজনদের কান কথায় প্রকৃত উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যুদ্ধাহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ভুলেই যেতেন। কিন্তু, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ও হাসপাতালের সামনে মুক্তিযোদ্ধা রেষ্ট হাউস থেকে যখন হুইল চেয়ারে চলাচলকারী সম্পূর্ণ পঙ্গু, হাত কাটা, পা কাটা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা পুরাতন গণভবন ও বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে ভিড় জমাতে লাগল, কান্নাকাটি করতে লাগল কি উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করা শুরু করলো, তখন তিনি একদিন বলা চলে বিরক্ত হয়েই জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী সাহেবকে ডেকে আমাদের পরিচয় জানতে চান।
জানতে চান আমরা কেমন করে পঙ্গু হলাম। জেনারেল সাহেব আমাদের অনেককে চিনতেন। রহমান নামের এক সিলেটি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা (যার যুদ্ধ অবস্থায় শেলের স্পিন্টার লেগে লিঙ্গটা উড়ে গেছে)- কে দেখিয়ে বললেন, ‘এরা স্কুল, কলেজে পড়ত। আপনার ডাকে সাড়া দিয়ে এরাই যুদ্ধ করেছে এবং আহত ও পঙ্গু হয়েছে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভারতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পাকবাহিনীর সাথে সামনা সামনি লড়াই করে পঙ্গুত্ত্ব বরণ করেছে।
অনেক শাহাদাত বরণও করেছেন। ’ বঙ্গবন্ধু মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনলেন এবং জানতে চাইলেন, ‘এদের কে কমান্ড করলো? কার কমান্ডে এরা যুদ্ধ করলো?’ জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী বঙ্গবন্ধুকে জানালেন এই দেশটিকে যুদ্ধের স্বার্থে ১১ ভাগে ভাগ করা হয়। আর বাঙালীর বিচক্ষণ সেনা অফিসারদের এক একটি ভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জেনারেলের মুখে বিস্তারিত তথ্য শুনে হতবাক হয়ে গেলেন বাংলাদেশের সেরা মানব। আমাদের মাথায় হাত দিয়ে দোওয়া করলেন।
আশ্বাস দিলেন, ‘তোদের চিকিৎসা হবে। তোদের যা দরকার হবে আমি সব ব্যবস্থা করব। তবে কটা দিন তোরা অপেক্ষা কর। ’
এভাবেই কল্যাণ ট্রাস্টের শুরু। প্রথম দুই চেয়ারম্যান অর্থাৎ রব সাহেব ও সি,আর,দত্তের সময় কল্যাণ ট্রাষ্টের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান লাভ করেছে।
জিয়াউর রহমান সরকারের পর এরশাদ সরকার ক্ষমতায় এসে অবশ্য আহত মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা শতকরা ৫০ ভাগ বৃদ্ধি করে দেন। কিন্তু, কল্যাণ ট্রাষ্ট থেকে চেয়ারম্যান প্রথা উঠিয়ে দিয়ে এস, ডি, প্রথা চালু করেন। চেয়ারম্যান থাকবেন সরাসরি রাষ্ট্রপ্রধান আর একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিকে ডেপুটেশনে এম,ডি, পদে নিয়োগ করা হবে। ডেপুটেশনে আসা এম, ডি. পরিচালকদের চাকুরীর মেয়াদ হবে দু/তিন বছর। এই এম,ডি,রা কল্যাণ ট্রাষ্টে এসে দেখেন অগাধ সম্পত্তি চারপাশে।
ট্রাষ্টের ৫টি লাভজনক সিনেমা হলসহ সব ক’টি প্রতিষ্ঠানই লাভজনক। ট্রাষ্টে ডেপুটেশনে আসা এম,ডি, পরিচালকগণ বেমালুম ভুলে যান এটা কার কল্যাণে ট্রাষ্ট। কাদের কল্যাণে নির্মিত। কর্ম পালনের কথা ভুলে যান। তারা বলেন যে দু/তিন বছরে আর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারদের কি কল্যাণ করা সম্ভব? তাই নিজেরা ট্রাষ্টের টাকায় বিদেশ ঘোরা ও হজ্ব পালন করা শুরু করেন।
শুরু করেন বাড়ি নির্মাণ। গাড়ি ক্রয়। আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তার পরেও বিলুপ্ত প্রায় ট্রাষ্টের আজো যে সম্পদ রয়েছে, তাও হাজার কোটি টাকার উর্ধে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।