পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় ,,,,,পথের পাশেই আছে মোর দেবালয়
শক্ত কাঁকর বিছানো সরু পথ সোজা চলে গেছে পুবদিকে, ডানে উচু প্রাচীর ঘেরা বিশাল এক দিঘী। কেন প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছে বুঝতে পারেনা মিতু একেবারেই। একবার গ্রীলের ছোট গেট টপকে ভেতরে গিয়ে দেখেছিল সেই বিশাল দিঘীটাকে। চারপাশ বুনো আগাছায় ছেয়ে আছে। তেলকুঁচার লতা জড়িয়ে আছে কালকাসুন্দি আলকুশি আর ভাট ফুলের ঝোপের গায়ে।
তেলকুঁচার লাল টুকটুকে ফলগুলো ঝুলছে। পানিতে ছোট ছোট শাপলা পাতার উপর আরো ছোট সাদা ফুল ফুটে আছে। পানি ফল গাছের অপরুপ সুন্দর খাজকাটা সবুজ পাতাগুলো পানির বুকে মেলে দিয়েছে তাদের রুপের ডালি। মিতু সেদিন অনেকটা সময় বসেছিল সেই দিঘীর ধারে।
কাঁকর বিছানো সেই পথ দিয়ে কিছুদুর হেটে গেলেই হাতের বা দিকে রেলপথ ।
সেটা পার হয়ে গেলেই মাটির রাস্তা । মসৃন মিহি ধুলোয় ঢাকা সে পথ আঁকাবাঁকা হয়ে চলে গেছে পাহাড়ের দিকে। বড্ড প্রিয় ধুলো ঢাকা এই পথ তার। খানিক এগোতেই রাস্তার দুপাশে বেশ নীচুতে কিছু আদিবাসীদের মাটির ঘর। মিতু মাঝে মাঝে নেমে ঘুরে ঘুরে দেখে কি করছে তারা।
কোন উপজাতি কোনদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি তাদের। ভাষা না বোঝাই হয়তো সেই কারণ।
হাতের বায়ে লম্বা বারান্দা আলা নির্জন নিরিবিলি এক আশ্রম। সেটা পেরোলেই শুরু হয় সেই গভীর অরন্য । বিশাল বিশাল দানব আকৃতির শাল সেগুন আর মেহগনীর সারি।
মনে হয় কত যুগ আগের সেই গাছ। নীচে শ্যাওলার পুরু আস্তরন যেন কার্পেট বিছানো, মাঝে মাঝে পা ডুবে আসে তার, ভয়ে সরে যায় মিতু । মোটা মোটা লতাগুলো এগাছ ওগাছ পেচিয়ে আছে পথ আগলে রেখেছে। সেগুলো সরিয়ে হেটে যেতে কষ্ট হয় তার। তারপরও সেই বুনো ঝোপঝাড় আর লতায় আটকানো পথ মিতুর ভারী পছন্দ।
মাথার ওপর ঘন গাছের পাতা দুপুরের রোদকে আড়াল করে রেখেছে। যখন একটু আলো দেখা যায় বুঝতে পারে সামনে কোন ছোট্ট পাহাড়ী ঝিরি নুড়ির উপর দিয়ে রিমঝিম নুপুর বাজিয়ে চলেছে আপন মনে। বড় একটা পাথরের উপর বসে পা চুবিয়ে সেই শীতলতা উপভোগ, আহা তার কাছে মনে হয় স্বর্গের স্বাদ। ওপাশে পাহাড়ের গা ছেয়ে আছে কত রকম ফার্ন আর বিদ্যাপাতার গাছ। কচি সবুজ পাতার আকাবাকা কিনারে হাল্কা কালো রঙ্গের নকশা করা বিদ্যাপাতা মিতু অনেকবার চেষ্টা করেছে টবে বুনতে, বাঁচেনি।
কখনো কখনো সেই বিষকাটালী আর ভাটফুলের গাছের ঝোপের কাছে আসলে শরীরটা ভার হয়ে উঠে মিতুর। এটা প্রায়ই ঘটে। ভুতপ্রেত আছে কি ভয়ে গা ছম ছম করে উঠে একেক সময়। ভয়ের নাগপাশ আষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে তাকে। তারপরও সেই বন বিথীকার অমোঘ আমন্ত্রন সে ফেরাতে পারেনা।
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলে সেই দুর্ভেদ্ধ্য গহীনতায়। তার মনে হয়েছিল এই ভয় কোন অশরিরী আত্মার নয় এ হলো অতিকায় অজগরের আকর্ষন। একদিন ফিরে গিয়ে দেখেছিল কালো আর হলুদের চিতি চিতি দাগওয়ালা বিশাল এক অজগর তাকে নিঃশব্দে অনুসরন করে চলেছে।
শীতকাল আসেনি এখনো, তবে আসি আসি করছে। পাতাঝরা গাছের পাতা কিছু কিছু ঝরে পরেছে।
দুপায়ে সেই মচমচে শুকনো পাতা মাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে মিতু সেই টিলার দিকে। একটু দূরেই আমলকি তলায় একদল হরিনের ঝাক । কি যে সুন্দর মায়াকাড়া কাজল কালো চোখ তুলে মিতুকে দেখে নিল এক পলক। বুঝলো এর থেকে কোন ভয়ের আশংকা নেই । একটু দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলতে শুরু করলো।
সামনেই সেই ছোট টিলা যার মাথার কাছে এক মঠ। মাটির ধাঁপ বেয়ে বেয়ে মিতু উঠে আসে তার চুড়োয়।
আজ জাহিদ বলেছে মিতু যেন অবশ্যই আসে দেখা করতে তাদের সেই প্রিয় পাহাড়ী টিলায়। সে কিছুদিনের জন্য বাইরে যাবে। মিতু তো তাকে অনেক ভালোবাসে তার জন্য সে জীবন দিতে পারে সেকি এখানে একটু কষ্ট করে আজ আসতে পারবে না?
জাহিদের কথা ফেলতে পারেনা মিতু সে তার যত কষ্টই হোক।
মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুপুর বেলাতেই সে আসে মাঝে মাঝে । মিতু তাকে অনেকদিনই বলেছে তাদের বাড়ীর কাছের সেই দিঘীর ধারে আসার জন্য। জাহিদ রাজী হয়নি। তার নাকি ভালো লাগেনা সেই পরিবেশ।
কি আর করা মিতুকেই আসতে হয় ।
সেই টিলার মাথায় বিশাল ঝুরি আলা বট গাছে গা হেলিয়ে পাশাপাশি বসে কতশত আবোল তাবোল গল্প তাদের। ভবিষ্যতের কত স্বপ্ন রচনা।
আজ মিতু এসে দেখে জাহিদ তার আগেই এসে বসে আছে সেখানে, তাদের সেই প্রিয় জায়গাটিতে তার অপেক্ষায়। কেমন এক জ্বলজ্বলে চাহনী যেন কতকাল তার আসার পথ পানে চেয়ে আছে বুঝি।
'কি হলো এত দেরী করলে যে'? অনুযোগের সুর জাহিদের গলায়।
"কৈ দেরী মা ঘুমালো তারপর আসলাম, তুমি তো আর কোনদিন গেলেনা আমাকেই এতখানি পথ পেরিয়ে আসতে হয়", একটু অভিমান হয় মিতার।
'যাবো যাবো সোনা খুব শিঘ্রী যাবো দেখে নিও, রাগ করো না, তোমার জন্য অপেক্ষা করতে কষ্ট হয় আমার '।
জাহিদের মিষ্টি কথায় মনটা হাল্কা হয়ে উঠে মিতুর।
'বসো বসো লক্ষী দাঁড়িয়ে আছো কেন'? বলে পাশের জায়গাটিতে চাপড় মারে জাহিদ।
টুপ করে বসে পড়লো মিতু শাড়ীর আচল গুটিয়ে।
"কবে যাবে তুমি বাইরে ? ঠিক ঠিক কতদিন থাকবে একটু বলতো আমাকে জাহিদ, তোমার সবসময় এই হেয়ালী কথা আমার ভালোলাগে না" ।
যাবো যাবো হাতের কাজটা শেষ হলেই যাবো, দু তিনমাসের মধ্যেই ফিরে আসবো চিন্তা করোনা সোনা আমার '।
আস্তে আস্তে পেছন থেকে জাহিদের একটা হাত মিতুর কাধ জড়িয়ে ধরে। মিতু অবাক হয় জাহিদের আচরণে, এমন তো কোনদিন করে না।
"হাত সরাও কি করছো কেউ যদি দেখে ফেলে"!
'না না কে দেখবে ? এখন কেউ এদিকে আসবেনা' জাহিদ বলে ওঠে।
"তারপরও এটা ঠিকনা জাহিদ" ।
'কেন ঠিকনা ? আর কদিন পরেইতো তুমি আমার বৌ হয়ে বাড়ী আসবে তাইনা ?'
"যখন যাবো তখন দেখা যাবে" বলে ঠেলে জাহিদের হাত সরাতে চেষ্টা করে মিতু।
না না দূরে ঠেলে দিওনা লক্ষী আজ তোমাকে একটু আদর করতে দাও আবার সেই কত পরে দেখা হবে আমাদের'।
জাহিদের মিনতি মাখা সেই চোখের আকুতি মিতু ফেলতে পারে না। আস্তে আস্তে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে নিয়ে আসে জাহিদ মিতুকে।
এই আদরের মধ্যেও মিতুর মনে হয় জাহিদের হাত এত বরফ শীতল কেন?
জানতে চাইলে তার গলায় আদর করতে করতে বল্লো,
'শীতকাল তাই হয়তো মিতু' ।
জাহিদের সেই বরফ শীতল আলিঙ্গন আরো দৃঢ় হয়ে উঠে, মিতুর শ্বাস আটকে আসে, মনে হচ্ছে যেন হাড়গোড় সব ভেঙ্গে যাচ্ছে। ঠেলে সরিয়ে দিতে চায় সে কিন্ত জাহিদের শক্তির কাছে পেরে ওঠেনা। মিতুর মনে হচ্ছে জাহিদ যেন ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পেচিয়ে রেখেছে। কোনমতে মিতু হাপাতে হাপাতে বলে ওঠে
"জাহিদ ছাড়ো আমাকে"।
না সোনা আজ ছাড়বোনা' কেমন অদ্ভুত গলায় হিশ হিশ করে বলে উঠে জাহিদ।
গলা থেকে মুখ সরিয়ে মিতুর মুখের কাছে নিয়ে আসে মুখ চুম্বনে উদ্যত।
মিতু চেয়ে দেখে সবুজ জ্বলজ্বলে পুতির মত চোখ গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে এক প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে। ভয়ার্ত মিতু নিস্পলক তাকিয়ে দেখলো জাহিদের মুখটা এগিয়ে আসছে। আস্তে আস্তে দুই ঠোট ফাক হয়ে আসলো জাহিদের, ফাক দিয়ে বের হয়ে আসলো এক ছুঁচালো জিহবা যার মাঝখানে চেরা।
যদিও মেয়েটাকে আস্ত গিলতে কষ্ট হয়েছে তারপরও শীতকালটা ভালোই কাটবে তার। খাবারের জন্য তাকে আর ভাবতে হবেনা দু তিন মাস। এখন কোনমতে শরীরটাকে টেনে নিয়ে গর্তে ঢুকতে পারলেই হলো সবার চোখ এড়িয়ে। আবার আগামী বছর শীত শেষে এমন কোন মিতু পেলেই হলো। ভাবতে ভাবতে দীর্ঘ শরীরটা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে থাকে এক বিশাল অজগর যার কালো শরীরে হলদে হলদে চিতি চিতি দাগ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।