আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এই মানুষে হবে মাধুর্য-ভজন/তাই তো মানুষ-রূপ গঠলেন নিরঞ্জন

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ মানবসভ্যতার প্রত্যেক জাতিরই হয়তো-বা মূল সংবিধানের পাশাপাশি একটি করে অলিখিত সংবিধানও রয়েছে। যে অলিখিত সংবিধানে সেই জাতিসত্তার প্রকৃত স্বরূপ প্রতিফলিত। বাংলাদেশ তথা বাংলাও এর ব্যতিক্রম নয় ।

বাংলার অলিখিত সংবিধান গড়ে উঠেছে বাংলার সাধকগণের গভীর চিন্তাসমৃদ্ধ বাণীতে। যেমন চতুর্দশ শতকের কবি চন্ডীদাস- এর ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। ’ কিংবা সপ্তদশ শতকের কবি আবদুল হাকিম- এর ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। ’ তদ্রুপ বাংলার মরমীকূল শিরোমনি লালন- এর অনেক বাণীই বাংলা অলিখিত সংবিধানে হীরকদূত্যিসম বিরাজমান। তারই একটি - এই মানুষে হবে মাধুর্য-ভজন/তাই তো মানুষ-রূপ গঠলেন নিরঞ্জন কিন্তু, কি এর মর্মার্থ? বয়ান করার চেষ্টা করি।

সুদূর অনন্তলোকে অনাদিকাল থেকে এক আদি অন্তহীন নিরাকার নিরঞ্জন বাস করছেন। সমস্ত বিশ্বজাগতিক রূপ ও কাঠামোর যিনি উৎস । তিনি কী এক অজ্ঞাত কারণে নিজেকে প্রকাশ করবেন ভাবলেন। অর্থাৎ নিরাকার সাকার রূপ ধরবেন। তাই হল।

তিনি স্বরূপে প্রকাশিত হলেন। সৃষ্টি করলেন বিশ্বজগৎ। তারপর মানুষ-রূপ সৃষ্টি করলেন। কিন্তু,মানুষ-রূপ সৃষ্টি করলেন কেন? এই মানুষে হবে মাধুর্য-ভজন ... তাই ... অর্থাৎ মানুষ পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে জগতের রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করবে। বিশ্বজগতের সৌন্দর্যের আরাধনা করবে।

সুতরাং মানুষ সুন্দরের আরাধনা না করলে নিরাকার ঈশ্বর কর্তৃক জগৎ সৃষ্টির পরিকল্পনাই যে ব্যর্থ হয়ে যাবে। কেননা, সমস্ত রকম সুন্দরের মাঝেই নিহিত নিরঞ্জন ঈশ্বর। মানুষের কর্তব্য কেবল তাঁকে খুঁজে বের করা। এ জগৎ সংসারেই তিনি নানারূপে প্রকাশিত। সেই ঐশ্বরিক সৌন্দর্যের অনুসন্ধানই মানবজীবনের অন্যতম সাধনা লালন এর মতে।

ঈশ্বরের সৃষ্টিতে সৌন্দর্য-মাধুর্য আস্বাদন করাই মানবজন্মের পরমব্রত। অর্থাৎ, লালন শিল্পের ওপর অসীম গুরুত্ব দিচ্ছেন। কেননা, শিল্পের মূলে রয়েছে সৌন্দর্য। মানুষকে শিল্পরসিক এবং শিল্পস্নাত হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন লালন। সমস্ত দুঃখের মাঝেও সুন্দরকে খোঁজার তাগিদ রয়েছে লালন এর এই অপূর্ব বাণীতে ।

লালন মানুষকে ঈশ্বরের সন্ধানে শিল্পের সাধনায় নিমগ্ন হতে বলছেন। নইলে কি হবে? নইলে ঠকতে হবে। লালন বলছেন, এবার ঠকলে আর না দেখি কিনার অধীন লালন তাই ভাবে। শিল্পসাধানার মাধ্যমে ঈশ্বর আরাধনায় মগ্ন হওয়ার পাশাপাশি মানুষকে অতি অবশ্যই নৈতিক জীবন যাপন করতে হবে। জীবন যেহেতু বিরল এক ঘটনা, একটি মহার্ঘ বিষয়; তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই অমূল্য।

মানবজন্ম তো সম্ভব হতে নাও পারত। সম্ভব যখন হয়েছে, তখন মস্ত এক অলীক ঘটনা ঘটে গেছে, কাজেই এখন জীবন-নদীর নৌকা বাইতে হবে সু-ধারায় (কু-ধারায় নয়)। লালন বলছেন- কত ভাগ্যের ফলে না জানি/ মন রে পেয়েছ এই মানব-তরণী/ বেয়ে যাও ত্বরায় সু-ধারায়/ যেন ভরা না ডোবে অনেকেই গানটা শোনার সময় এই লাইনগুলি ঠিক বুঝতে পারে না। অথচ লালন সহজ একটি কথা বলছেন। বলেছেন:নৌকা (ভরা বা ভারা) যাতে না ডোবে সে কারণে সু-ধারায় নৌকা বাইতে হবে ... এখানে যে নৈতিক জীবনযাপনের ইঙ্গিত রয়েছে তা আমরা লালন- এর গানে বহুবার দেখেছি ... এবং বাঙালি মরমীগুরুর কাছে এমনটাই তো স্বাভাবিক।

নৈতিক জীবনে অটল থেকে মানুষকে শিল্পসাধনায় ঈশ্বরের সন্ধান করে জীবন সার্থক করতে হবে। কারণ এ জীবন যে দূর্লভ। তাই তো বাংলার অলিখিত সংবিধানের অন্যতম রচয়িতা লালন বলছেন, এমন মানব-জনম আর কি হবে মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে। Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।