আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নূর বিবির নূরাণী কর্ম!

Islam.com.bd মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম published by mofiz on Sun, 05/22/2011 - 19:48 মাওলানা তারিক জামিল একজন বিশ্বখ্যাত দা'ঈ, দীন প্রচারক। বক্তৃতার যাদুময়তার কারণে তাঁর নাম এখন মানুষের মুখে মুখে। হৃদয় গলে'র পাঠক-পাঠিকাদের উদ্দেশ্যে আমি এখন যে ঘটনা বর্ণনা করতে যাচ্ছি, এই মনীষীই হলেন সেটির বর্ণনাকারী। এই ঘটনা তাঁর নিজ এলাকাতেই ঘটেছে। এবং যাকে নিয়ে এই ঘটনা, তিনি মাওলানার আত্মীয়।

আসুন আমরা মাওলানার মুখ থেকেই সেই ঘটনা শ্রবণ করি এবং শিক্ষা গ্রহণ করে তদানুযায়ী আমল করার চেষ্টা করি। মাওলানv বলেন, এক ইন্সপেক্টর- পুলিশ অফিসার। উচ্চশিক্ষিত। আমাদের আত্মীয়। সেই সাথে আমার পিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধুও।

তার দৈহিক গঠন খুবই সুন্দর। গায়ের রঙ ঈষr লালবর্ণ। উচ্চতা সাড়ে ছয় ফুট। সব মিলিয়ে দেখার মতো সুপুরুষ। এদিকে আমাদের খান্দানে ছিল একটি মেয়ে।

নাম নূর বিবি। দেখতে ‡মvটেও সুন্দর নয়। এলাকার সবাই তাকে শ্রীহীন মেয়ে হিসেবে জানত। সুন্দরী মেয়ে বলতে যা বুঝায়, উহার ছিটেফোটাও তার মধ্যে ছিল না। তাছাড়া নূর বিবি ছিল অশিক্ষিত।

কিন্তু আশ্চর্যের কথা হলো, ইন্সপেক্টর সাহেবের মা নিজ ছেলের জন্য এই নূর বিবিকেই পছন্দ করলেন। ছেলেকে বললেন, আমার মন খুশি করতে চাইলে এই নূর বিবিকেই বিয়ে করতে হবে। ইন্সপেক্টর সাহেব বড় অফিসার। তার কথায় উঠাবসা করে কত মানুষ! তাকে সম্মান জানায় কত বনী আদম!! আর তার জন্য কিনা এই অশিক্ষিত কুশ্রী মেয়ে! বড় বিপাকে পড়লেন ইন্সপেক্টর সাহেব। একদিকে কালো-কুশ্রী মেয়ে অন্য দিকে মায়ের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা।

কোন্ দিকে যাবেন তিনি? তিনি কি মায়ের তামান্না পূর্ণ করতে গিয়ে অশিক্ষিত কালো মেয়েকে বিয়ে করবেন? নাকি নিজের পছন্দমত সুশ্রী-শিক্ষিত মেয়ে তালাশ করবেন? কিন্তু কী করবেন তিনি কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না। অবশেষে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে পরামর্শের জন¨ চলে এলেন আমার পিতার কাছে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বললেন, বন্ধু! যদি মায়ের কথা মানি, তার ইচ্ছাকে পূর্ণ করি, তবে জীবনে কখনো এই বিপদ থেকে আমি মুক্ত হতে পারব না। কোনোদিন ওই মেয়েকে আমি আপন করে নিতে পারব না। আর যদি মায়ের কথা না মানি, তাহলে তিনি আজীবন আমার উপর অসন্তyষ্ট থাকবেন।

মোট কথা আমি এখন উভয় সংকটে নিপতিত। অতএব, তুমিই এবার বলো, কী করব আমি। আমার বাবা ভেবে-চিন্তে পরামর্শ দিলেন। বললেন, মায়ের কথা মেনে নিয়ে নূর বিবিকেই বিয়ে করে নাও। অফিসার সাহেব বললেন, ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ, মায়ের কথাই মেনে নিচ্ছি।

এরপর বিয়ের তারিখ হলো। নির্দিষ্ট দিনে বিয়ে হলো। শুরু হলো নতুন জীবন। জীবনের নতুন অধ্যায়। অফিসার সাহেব মায়ের মন রক্ষার্থে নূর বিবিকে বিয়ে করলেও মন থেকে ওকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।

আর স্বামী তার স্ত্রীকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ না করলে, মন থেকে ভালো না বাসলে, দাম্পত্য জীবনে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কথা, তাদের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হলো না। অবস্থা এই দাঁড়াল যে, নূর বিবি যদি ঘরের ভিতরে থাকে, তাহলে তার স্বামী থাকে বাইরে। আর নূর বিবি বাইরে থাকলে স্বামী থাকে ঘরে। মোটকথা কোনো ভাবেই ওদের মধ্যে খাপ খাচ্ছিল না। পাঠকদের কাছে নূর বিবির আরেকটv দিক এখনো অজানা রয়ে গেছে।

সেটি হলো, নূর বিবি দেখতে ফর্সা না হলে কী হবে, চারিত্রিক গুণাবলীর দিক দিয়ে সে ছিল সত্যিই নূর; নূরের মতোই উজ্জ্বল; দীনদার-পরহেজগার। সে চিন্তা করে দেখল, আমি তো আসলে এই উচ্চশিক্ষিত সুদর্শন স্বামীর উপযুক্ত নই। অতএব আমি যদি প্রথমেই তার কাছ থেকে স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করতে চাই, স্ত্রীর যাবতীয় অধিকার কড়ায় গণ্ডায় আদায় করতে চাই তাহলে এই ইচ্ছা আমার জন্য কোনোদিনও সুফল বয়ে আনবে না। বরং বলা যায়, চাওয়া পাওয়ার এই ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা হবে আমার জন্য আত্মঘাতী। এরূপ করলে স্ত্রীর মর্যাদা পাব তো দূরের কথা, তvর সাথে ঘর-সংসার করাও সম্ভব হবে না।

একদিন হয়তো তালাক দিয়ে দূর দূর' করে আমাকে বিদায় করে দিবেন। সুতরাং স্বামীর মন পেতে হলে আমাকে অন্য পথ ধরতে হবে। আর সে পথ হলো, স্বামী থেকে কোনো কিছু চাওয়া-পাওয়ার প্রত্যাশা না করে শুধুই দেওয়া আর দেওয়া। অর্থাr আমি কী পেলাম তার হিসেব না করে আমি কী দিলাম সেই হিসেব করা। স্বামীর মন জয় করতে হলে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা ছাড়া আমার সামনে দ্বিতীয় আর কোনো পথ খোলা নেই।

এসব কথা চিন্তা করে নূর বিবি তার উচ্চশিক্ষিত সুন্দর সুপুরুষ স্বামীর জন্য নিজেকে স্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন না করে দাসী হিসেবে পেশ করল। স্বামীর সেবায় নিজেকে বিলীন করে দিল সম্পূর্ণরূপে। স্বামী পুলিশ অফিসার। বাসায় ফিরেন গভীর রাতে। বিয়ের প্রথম প্রথম নূর বিবি এতরাত পর্যন্ত জেগে থাকত না।

ঘুমিয়ে যেত। কিন্তু এখন? এখন রাত যত গভীরই হোক না কেন, স্বামী না আসা পর্যন্ত তার অপোয় সে বসে থাকে। ঘুমকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। মনকে শাসিয়ে বলে, হে আমার মন! ত্যাগ ছাড়া দুনিয়াতে বড়কিছু অর্জন করা যায় না। যায় না স্বামীর হৃদয়রাজ্যের রাণী হওয়া।

তাই কষ্ট যতই হোক না কেন, ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা তোমাকে প্রদর্শন করতেই হবে। স্বামীর মন জয়ের জন্য যে কোনো কষ্টকে বরদাশত করতে হবে, অম্লান বদনে, হাসি মুখে। প্রতিদিন গভীর রাতে স্বামী যখন বাসায় ফিরে দরজায় নক্ করেন তখন নূর বিবি সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতে তার মুহূর্তকাল বিলম্ব হয় না। আর বিলম্ব হবেই বা কেমন করে? সে তো দরজার পাশেই বসে থাকে স্বামীর দিল্ জয়ের আশায়! দরজা খুলে দিয়ে নূর বিবি স্বামীর হাত থেকে হাসিমুখে মাল ছামানা নিজের হাতে নিয়ে নেয়।

স্বামী ঘরে প্রবেশ করার পর নূর বিবির মনে চায় মোসাফাহা-মোয়ানাকা করতে। মনে চায় ব্যাবহারিকভাবে ভালোবাসার কিছু আদান-প্রদান করতে। কিন্তু সে তো দাসী! দাসী হিসেবেই সে নিজেকে সঁপে দিয়েছে স্বামxর পদতলে। আর মোসাফাহা-মোয়ানাকা? ভালোবাসার বিনিময়? সে তো স্বামী-স্ত্রীর কাজ। তাদের জন্যেই এসব মানায়।

এসব কথা ভেবে নূর বিবি তার এ ইচ্ছাকে জোর খাটিয়ে দমন করে রাখে। তারপর স্বামীর জন্য অজুর পানি এগিয়ে দিয়ে তাজা রুটি বানিয়ে গরম গরম খেতে দেয়। খাওয়া দাওয়া শেষে স্বvমী শুয়ে পড়ে। নূর বিবি তখন পরম আন্তরিকতা নিয়ে স্বামীর মাথায় বিলি কাটে। গোটা শরীর টিপে দেয়।

অতঃপর স্বামী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলে সেও খানিক দূরত্ব বজায় রেখে পাশে শুয়ে পড়ে। কারণ, দাসীর জন্য তো এ-ই বড় পাওয়া! নূর বিবির এভাবেই কাটে গোটা রাত। আহা! কত ইচ্ছে জাগv স্বামীকে একান্ত করে কাছে পাওয়ার। কত তামান্না জাগে স্বামীর সোহাগ লাভের। কিন্তু... ... কারণ ঐ একটিই, স্বামীর মন জয় করা।

সকালে স্বামীর অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে নূর বিবি। তারপর স্বামীর জন্য জুতো পালিশ করে, কাপড় চোপড় প্রস্তুত করে রাখে। আর প্রস্তুত করে রাখে বিwভন্ন প্রকার নাস্তা। আর স্বামী বেচারা নাস্তা খেয়ে চুপচাপ ডিউটিতে চলে যায়। নূর বিবির সাথে একটা কথাও বলে না।

কী অদ্ভূত এই জগত! কত শক্ত মানুষের হৃদয়!! এভাবে অবিরাম তিন বছর সাধনা চালায় নূর বিবি। খুশির কথা হলো, নূর বিবি তার সাধনায় কামিয়াব হয়। সফল হয় পরিপূর্ণভাবে এবং তার এই সফলতা ছিল এমন সফলতা যা কল্পনাকেও হার মানায়। কেননা তিন বছর পর দেখা গেল, নূর বিবি তার স্বামীর মন এভাবে জয় করে নিয়েছে যে, স্বামী তার গোলাম বনে যায়। যে নূর বিবির দিকে স্বামী ঘৃণাভরে চোখ তোলে তাকাত না, যার সাথে একটি কথাও হাসিমুখে বলত না, যাকে দীর্ঘকাল দেখিয়েছে তাচ্ছিল্যের ভাব, সেই নূর বিবিই এখন ঘরের নূর, স্বামীর হৃদয় জগতের নূর।

যে নূর আলোকিত করে আছে স্বামীর গোটা হৃদয়াকাশ। যে নূর ছাড়া স্বামী একটি দিনও একা থাকতে পারে না। যে নূরের কথা সারাদিন তার মনে পড়ে। যে নূরের চেহারা সারাদিন ভাসে মনের আয়নায়। ওহ! সেবা ও খেদমতের কত শক্তি! খেদমতের কত পাওয়ার!! এরপর এক এক করে নূর বিবি তিন সন্তানের মা হয় এবং এক সময় তার হায়াত শেষ হয়ে যায়।

সে চলে যায় দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়ে। মাওলানা আরো বলেন, নূর বিবির কথা আমার মনে নেই। কারণ, আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম। তবে এতটুকু পরিস্কার মনে আছে যে, নূর বিবি মারা যাওয়ার পর তার তিন সন্তানকে বুকে জড়িয়ে তার ইন্সপেক্টর স্বামী স্ত্রীর কথা মনে করে ছোট্ট শিশুর মতোই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত। নূর বিবি মারা যাওয়ার দীর্ঘদিন পর সেই অফিসার তার বংশের আরেক রূপসী নারীকে বিয়ে করে ঘরে আনেন।

কিন্তু সেই রূপসী নারx একটি দিনও তাকে শান্তি দেয়নি। দেয়নি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে। আর দিবেই বা কী করে? সে তো ব্যবহার-চরিত্রে ছিল নূর বিবির সম্পূর্ণ উল্টো। যদিও খোলসটা ছিল বড়ই মোহনীয় ও চিত্তাকর্ষক। কিন্তু হৃদয় তো আর খোলসের সৌন্দর্য দিয়ে জয় করা যায় না! আমরা দেখেছি, এই রূপসী নারীকে বিয়ে করার পর আজীবন ঐ অফিসার কপাল চাপড়ে ফিরেছে এবং নূর বিবি' নূর বিবি' বলে মাতম করতে করতে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! তাই আমি বলি, রূপের পাখায় ভর করে পরিবারে সুখ আসে না। শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে মনে প্রশান্তি লাভ হয় না। বরং প্রকৃত সyখ-শান্তি লাভের জন্য প্রয়োজন, দীনদার, চরিত্রবতী, অনুগত স্ত্রী। চাই তার রূপ-সৌন্দর্য কমই হউক কিংবা না-ই থাকুক। অতএব, আসুন আমরা নিজেরাও এসব গুণে গুনান্বিত হই আর ছেলে-মেয়েকেও দীনদার এবং উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান করে গড়ে তুলতে নিরলসভাবে চেষ্টা করি।

আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। আমীন॥ [সূত্র : বেহনূ ছে খেতাব] ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।