Shams দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুলের পটভূমিতে জন্ম নেওয়া সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের সৃষ্টি মধ্যেই নিহিত ছিল বাঙালির শোষণ-বঞ্চনা, দমন-পীড়ন, দুর্ভোগ-লাঞ্ছনার ইঙ্গিত। তাই সেসময় 'ঝুঁটা আজাদি'র উপলব্ধি নিয়ে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ও ভূমি সংস্কার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, তেভাগা-হাজং-টঙ্ক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট কর্মীরা ছিলেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকায়। তাই ব্রিটিশ উপনিবেশের উত্তরাধিকারী পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই প্রবলভাবে চলছে কমিউনিস্ট নিগ্রহ। দেশের কারাগারগুলোতে রাজবন্দী বলতে তখন শুধুই বামপন্থী নেতা-কর্মী। সাতচল্লিশ-পরবর্তী সময়ে যাঁরা জনস্বার্থে জনতাকে জাগাতে চেয়েছিলেন, তাঁদের পাইকারি হারে কারাগারে ঢোকানো হয়।
ব্রিটিশের চালু করা কারা-শাস্তির চর্চা তখনও প্রবলভাবে বলবত ছিল কারাগারগুলোতে। খাবার কম দেওয়া, তামাক নিষিদ্ধ করা, অমানুষিক শারীরিক শ্রম আদায় করে নেওয়া_ এসব ছিল কারাগারের নিয়মিত চিত্র। তার মধ্যে অন্যতম ছিল তেলের ঘানিকলে পশুর পরিবর্তে কয়েদিদের ব্যবহার। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে কমিউনিস্টরাই প্রথম এই অমানবিক শাস্তির প্রতিবাদ করে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য কারাগারে।
১৯৪৯ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও রাজশাহী কারাগারের কমিউনিস্ট বন্দীরা চার দফায় মোট ১৫০ দিন অনশন করেন। খুলনা কারাগারে পিটিয়ে হত্যা করা হয় কমিউনিস্ট কর্মী বিষ্ণু বৈরাগীকে। ওই সময় ঢাকা কারাগারে অনশনকারীদের জোর করে ফিডিং করাতে গেলে ৮ ডিসেম্বর শিবেন রায়ের মৃত্যু হয়।
১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশের কারাগারগুলোতে বন্দিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বন্দিদের ওপর জুলুম-নির্যাতন বাড়ছিল।
এমনকি কারাকর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে হিন্দু-মুসলমানসহ আদিবাসী বন্দিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে থাকে। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের রাজবন্দিরা ১৫ দিনের নোটিশে কারাগারে নির্যাতন বন্ধসহ সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে উসকানি দেওয়ার প্রতিবাদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে একটি স্মারকলিপি পাঠান। কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে বন্দিরা এদিকে রাজবন্দিদের দিয়ে ঘানি টানানো, তাঁদের মৃত্যুদণ্ড-প্রাপ্তদের সেলে রাখাসহ নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৫০ জন বন্দি ১৯৫০ সালের ৫ এপ্রিল অনশন শুরু করেন। পরে এক হাজারের বেশি বন্দি তাঁদের সঙ্গে অনশনে যোগ দেন।
একপর্যায়ে রাজবন্দীদের দাবির মুখে তৎকালীন আইজি প্রিজন মোহাম্মদ আমিরুদ্দিন আলোচনায় বসতে রাজি হন।
জেলেই কমরেডরা এক তাৎক্ষণিক মিটিং করে ১২ জন প্রতিনিধিকে আলোচনার জন্য পাঠান। উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সে আলোচনার সমাপ্তি ঘটে। আইজি প্রিজন চলে যাওয়ার আগমুহূর্তে শ্বেতাঙ্গ জেল সুপার বিল (W.F Beale) কে একটি সাংঘাতিক নির্দেশ দিয়ে যান। সেটা হল: বন্দি কমিউনিস্ট নেতাদের বিচ্ছিন্ন করে মৃত্যুদণ্ড-প্রাপ্তদের জন্য নির্ধারিত সেল বা ১৪ নম্বর সেলে রাখার নির্দেশ। কারাবন্দি কমিউনিস্টরা সেদিন নেতা মেনে নিয়েছিলেন কমরেড আবদুল হককে (১৯২০-১৯৯৫)।
তার নেতৃত্বেই সারারাত বৈঠক চলে। ঐতিহাসিক সেই বৈঠকে একমতে মিলতে অনেক বিতর্ক আসে। আবদুল হকসহ সংখ্যাগরিষ্ঠের মত ছিল, 'খাপড়া' ছেড়ে কেউ যাবে না।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতরে দ্বিতীয় প্রাচীর ঘেরা খাপড়া ওয়ার্ড। কারাগারের ভিতর কারাগার! ওয়ার্ড মানে নির্দিষ্ট চতুষ্কোণাকৃতি একখানা বেশ বড় ঘর।
টালির ছাউনি থাকায় রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায় বলা হত 'খাপড়া'। খাপড়া ওয়ার্ডে ওই সময় বন্দির সংখ্যা ছিল ৪১। তাঁদের মধ্যে দুজন ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও কর্মী।
সোমবার ২৪ এপ্রিল, ১৯৫০; সারারাত মিটিংয়ের পর সকাল ৯টায় কমরেডরা আবার আলোচনায় বসলে জেল সুপার বিল সরাসরি ঢুকে পড়েন খাপড়া ওয়ার্ডে। জেল সুপার রাজবন্দীদের ১৪ নম্বর সেলে যেতে চাপপ্রয়োগ করেন।
কমরেড আবদুল হক বিলকে এ বিষয় নিয়ে কিছু বলতে গেলেই জেল সুপার চিৎকার করে 'খাপড়া'র দরজা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। নির্দেশ দেওয়ার পরই বিল দৌড়ে বের হয়ে যেতে চাইলে তার পথরোধ করে দাঁড়ান কমরেড বাবর আলী, দেলোয়ার ও রশীদউদ্দীন। বিল হান্টারের আঘাতে বাবর আলীর কব্জি ভেঙে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে হুইসিল বাজান। সঙ্গে সঙ্গে চল্লিশজন সশস্ত্র সিপাহি ঘিরে ফেলে খাপড়া ওয়ার্ড। 'খাপড়া'র ভেতরে সে মুহূর্তে সিদ্ধান্ত হয়, মূল দরজায় প্রতিরোধ রাখতে হবে।
কমরেড প্রসাদ রায় ছুটে গিয়ে 'খাপড়া'র নড়বড়ে দরজায় কাঁধ লাগিয়ে আটকে রাখেন। উল্টো পাশের প্রবল ধাক্কায় দরজা আটকে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাইরে থেকে লাঠিধারী পুলিশ জানালা দিয়ে লাঠি ছুড়ে মারতে থাকে। নিরস্ত্র রাজবন্দিরা থালা-বাটি, দোয়াত-ওষুধের শিশি ছুড়ে আক্রমণ আটকানোর চেষ্টা করতে থাকেন। এরই মধ্যে দরজার ফাঁক দিয়ে নল ঢুকিয়ে গুলি চালালে কমরেড প্রসাদ রায়ের বাম ঊরুতে সাতটি বুলেট বিদ্ধ হয়।
তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে বৃষ্টির মতো গুলি চালাতে চালাতে 'খাপড়া'য় ঢুকে পড়ে আর্মড পুলিশ। রাইফেলের গর্জনে ফেটে পড়ে কারাগার। রক্তে ভেসে যায় খাপড়া ওয়ার্ড। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে দেয়াল থেকে ছাদ পর্যন্ত লালে লাল হয়ে যায়। সেখানেই ঝরে পড়ে ছয়জন কমরেডের জীবন।
নিরস্ত্র ৩৯ জন বন্দীর ওপর ১৮০টি গুলি বর্ষণ করা হয়! অবিরাম গুলির পর শুরু হয় তিন দফায় লাঠিচার্জ। এর মধ্যে একবারের জন্য 'খাপড়া'য় ঢোকেন বিল। আবদুল হককে খুঁজে বের করে হাতের হান্টার দিয়ে তার মাথায় তীব্র আঘাত করেন। মাথা ফেটে লুটিয়ে পড়েন কমরেড। গুলিবিদ্ধ বিজন সেন চিৎকার করে বলে ওঠেন_ "আমরা মরি নাই কমরেড, আমরা বিজয়ী হয়েছি, ভবিষ্যৎ আমাদের।
" এ কথা বলেই প্রাণ হারান তিনি। হাসপাতালে মারা যান কমরেড কম্পরাম সিং।
অন্যায়ে বিরুদ্ধে লড়াই করে শহীদের হলেন:
১. কমরেড বিজন সেন (রাজশাহী),
২. কম্পরাম সিং (দিনাজপুর),
৩. আনোয়ার হোসেন (খুলনা),
৪. সুধীন ধর (রংপুর),
৫. হানিফ শেখ (কুষ্টিয়া),
৬. সুখেন ভট্টাচার্য (ময়মনসিংহ),
৭. দেলোয়ার হোসেন (কুষ্টিয়া)। খাপড়া ওয়ার্ডে ওই বর্বর আক্রমণে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন ৩১জন কমরেড।
স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম জেলহত্যার শহীদদের স্মরণে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে স্মৃতিফলক ও শহীদ মিনার নির্মিত হয়, যা উদ্বোধন করেছিলেন কমরেড মণি সিংহ (১৯০১-১৯৯০)।
সেই স্মৃতি ফলকে খোদাই করা রয়েছে সাত শহীদ ও আহতদের নাম। খাপড়া ওয়ার্ডের লড়াই আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবিস্মরণীয় প্রেরণা _ রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন ফ্র্যাঙ্কিনস্টাইনের দানব হয়ে অন্যায়-অবিচারে মেতে উঠে, তখন সেই দানবের বিরুদ্ধে অবিচল লড়ে যাওয়ার আহ্বান। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।