আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এই আমাদের আজ, কাল, পরশু এবং তারপর.....

মনে হচ্ছে কোন এক অদৃশ্য হাতের কারুকাজে আমরা সব পুতুল নাচের পাত্র-পাত্রী। হাঁটছি, ছুটছি, হাসছি, কাঁদছি সবই সেই অদৃশ্য হাতের ইশারায়। আমাদের গতকাল, আজ এবং আগামীকাল সব একরকম। একই বাদ্য, একই বাদক এবং সেই একই সুর বেজে বেজে ক্লান্ত হয়ে বেসুরো যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মূর্ছা যাচ্ছে মুহূর্মুহু। মনে হচ্ছে আমাদের দু'পায়ের পাতা কোন অশুভ হস্তক্ষেপে ঘুরে গিয়ে উল্টো দিকে হাঁটছে কোন অন্ধকার গুহার উদ্দেশ্যে।

এই চলা বড় ক্লান্তিকর। এর যেন শেষ নেই। আমাদের দিনের শুরুটাই হয় খবরের কাগজের প্রথম পাতা জুড়ে নানান ভয়, আশংকা, যন্ত্রণা আর অস্থিরতার মিশেল দেখে। টেলিভিশন, ইন্টারনেট কোথাও এর তেমন ভিন্নতা নেই। এটাই আমাদের মেনে নেয়া জীবন যাপন।

এইতো সেদিন আমাদের শৈশব ছিল। আমাদের নির্ভয়, নিশ্চিন্ত সকাল-বিকেল ছিল, আমাদের মাঠ ছিল, পথ ছিল, অন্যায় হস্তক্ষেপ বিহীন আনন্দ ছিল। আজকে আমাদের সন্তানদের জন্য ওসবের কিছুই অবশিষ্ট নেই। এক ভিষন অস্থিরতায়, অনিশ্চয়তায় বড় হ্তে হচ্ছে ওদের। পারিপার্শিকতার কল্যাণে-অকল্যাণে আজকের একটি শিশু অনেকখানি চোখ খোলা রাখতে শিখেছে।

সেসবের সুযোগ দিতে হচ্ছে একেবারে প্রয়োজনেই। এই তথ্য-প্রযুক্তির যুগে আমরা কিভাবে তাদের অন্ধকারে রাখি, কিভাবে তাদের বিকাশের দরজা বন্ধ করে দেই? আমার আট বছরের মেয়ে জানতে চায় লিবিয়ার বর্তমান অবস্থা কি, ভূমিকম্পে আর সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্থ জাপান এখন কেমন আছে, পৃথিবীর কোন অঞ্চলের মানুষ খাবার না পেয়ে সবচেয়ে কষ্টে থাকে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং কি, দুষ্টু লোকেরা কেন বাংলাদেশের ফল আর মাছে ফর্মালিন দেয়, সোলার পাওয়ার বাংলাদেশে কেন অনেক বেশী করে চালু হচ্ছে না এমন হাজারও তথ্য সন্ধান। টেলিভিশন, খবরের কাগজ বা ইন্টারনেট ইত্যাদি নিয়ে আমার দোটানার দ্বন্দ আর ভীতি জমতে থাকে। গতকাল এক বন্ধুর পাঁচ বছরের ছেলে স্কুলে না যেতে পেরে মা-বাবাকে জানিয়েছে যে সে জানে বাইরে গেলে বড় লাঠি দিয়ে মানুষ পেটানো হয়, গাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। তাই স্কুল বন্ধ।

শুনে আমার বিষ্ময়ের ঘোর কাটছে না। আমরা, বড়রা কি ভয়ঙ্কর আতঙ্কের বীজ বুনে দিচ্ছি আমাদের এই শিশুদের কোমল মনে। কিন্তু আমরা কেন এবং কিভাবে আমাদের সন্তানদের জানবার আগ্রহ এবং সঠিক তথ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখবো? তা যদি করি তবে এই দায়ভার প্রকৃতপক্ষে কে নেবে? বড়রা? এই 'বড়'রা কারা? আমি, আপনি, আপনার বাবা, সে, তার মা, উনি, ওনার ভাই, একটি/দুটি দশটি পরিবার। এইতো? আমাদের চিন্তাশীল সুস্থ মানসিকতার এই 'বড়দের' বিশাল অংশই সাধারণ, সাপের লেজে ইচ্ছাক্ৃত পা না দেয়া নিরীহ মানুষ। বিড়ালের গলায় ঘন্টা বেঁধে নিজের গলায় আজীবনের জন্য 'গলগন্ড' (অবসম্ভাবী) বাধাবার সাহস, শক্তি এবং প্রস্তুতি তাঁদের নেই।

নৈতিকতার 'চলতি' রূপের সাথে অপোষ কর‌্তে গিয়ে মনের সাথে যুঝে চলেছেন প্রতিদিন। দিনতো চলে যাচ্ছে, যেভাবেই হোক!! আমাদের এইসব নিরীহ বড়দের উপরেও 'ঘুড়ি'র সুতো-নাটাই হাতে নিয়ে অনেক 'বড়'রা (তথাকথিত) রয়েছেন। তাঁরা যেমনটা চাইছেন, তেমনই চলছে। অলক্ষ্যে যে ভয়াবহ শক্তিশালী চোখ রয়েছে জ্বাজল্যমান, সেই চোখে চোখ দেয়ার কি দরকার তাঁদের! দিনতো ছুটে চলেছে কন্টকহীন। আমরা যারা দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে 'ভেবে আকুল' হয়ে যাই, দেশ 'গেল গেল' বলে 'আহা মরে যাই' হই, সেই আমাদের সত্যিকারের কতজন কতটুকু শিখেছি এবং কি শিখছি? আসলে আদৌ কিছু কি শিখছি জীবন থেকে, জীবন যাপন এবং পারিপার্শিকতা থেকে? অথবা সেই আমাদের ক'জন আমাদের শেখাশিখি, জানাজানির কতটুকু বাস্তবে প্রয়োগ করি/কাজে লাগাই? কতখানি শেখাই আমাদের অনুজদের, আমাদের সন্তানদের? আমরা সামগ্রিকভাবে কতটুকু নিজেকে ইতিবাচকভাবে সমাজের কাছে, ঘরের ও বাইরের অনুজের কাছে সর্বোপরি সন্তানের কাছে অনুকরণীয় করে তুলতে পেরেছি? কতটুকু সুস্থ, গঠনমূলক আর আনন্দময় সময় রেখেছি প্রিয় সন্তানটির জন্য? আমাদের কতজন লজ্জাবোধ করি যোগ্যতার বাইরে অর্জিত অবস্থান এবং পয়সার যথেচ্ছ ব্যবহার করে মেকি, আরোপিত জীবন যাপন করতে যা আমাদের 'ভবিষ্যত'কেও ভুল নির্দেশনা দেয়, অপরাধ প্রবণ করে তুলতে মোক্ষম ভূমিকা নেয়? 'মূল্যবোধ' 'নৈতিকতা' ইত্যাদি নামের যে শব্দগুলি আছে তা আমরা 'কেতাব' এ পড়ি, অনেকেই দেশের বা বিশ্বের নানান 'বিশ্বমান' বিদ্যাপিঠের পিঠে চড়ার গৌরব (!) অর্জন করেছি, নামের তলায় অসংখ্য অক্ষর সম্বলিত 'ডিগ্রী' নামক তকমা লাগাবার 'যোগ্যতা' প্রতিষ্ঠা করেছি।

দেশে-বিদেশে নানান যায়গায় নানারকম স্থায়ী-অস্থায়ী ঠিকানা তৈরী করে নিয়েছি, বিদেশের হাওয়া-জলে সন্তানদের মানুষ(!) করেছি, কতকত সভা-সেমিনারে বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যত নিয়ে জ্বালাময়ী ভাষন দিয়ে যাচ্ছি, সেসব কি কম কথা! এই সবই আমরা। আলু-পটলের মূল্যের সাথে আমাদের সর্বসাধারণের 'মূল্যবোধ' নাকানি-চুবানি খেয়ে সেই নাকের ডগায় ঝুলে থাকা 'মুলো'য় এসে ঠেকে বারবার। আবার ঠকে যাবার ঠকঠকানি হাতুড়ির আঘাত হয়ে আমাদের মস্তিষ্কে আর তেমন করে হানাও দেয় না। কালের কালে কালে আমাদের 'বোধ' এর দরজায় বিশাল সব 'গজাল' এঁটে গেছে। আমরা সেই ন্যাড়া, যারা বারবার বেলতলায় যায়।

আমরা সেই নন্দঘোষ, সব দোষ যাদের আজন্ম দায়। আমাদের প্রত্যাশার নাম একটি 'বেল' আর আমাদের প্রাপ্তির নাম একটি 'সরষে' দানা। আমাদের প্রতিটি দিনের নাম, মাসের নাম, বছরের নাম 'ঠেলাগাড়ি'। আজ আমাদের সন্তানেরা স্কুলে যেতে না পারার প্রতিবন্ধকতাকে 'বড় লাঠি দিয়ে মানুষ পেটানো আর বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়া' বলে জানে। কি ভিষণ ভয়ের, কি মর্মান্তিক ! কি ভিষণ লজ্জার! খুব বেশী দূরে নয়, একদিন আমাদের হাজারো ক্ষমতা -অক্ষমতা তোয়াক্কা না করে ওদের এই সহনশীলতা শক্তশালী আগ্নেয়গিরী হবে।

নিয়ন্ত্রণের অসাধ্য অগ্নূ্যৎপাত ঘটাবে ওরা, সকল মঙ্গলের জন্য, শান্তির জন্য, আলোর জন্য, ভালবাসার জন্য। আমি আস্থা রাখি, আমি বিশ্বাস করি মনে-প্রাণে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।