শুচি সৈয়দ
শুচি সৈয়দ
আপাদমস্তক এক কবির নাম হেলাল হাফিজ। কবিতাই যার ঘর-সংসার আর নর্ম্য সহচরী। কবিতার রাজকুমার, চিরকুমার এই কবি সর্বক্ষণ নিমগ্ন সমর্পিত কবিতায়। কবিতার গভীর নির্জন পথে একাকী পর্যটক।
কবিতা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের বিষকে পরিণত করে মধু ও মুক্তোয়Ñ কবির কাজ তো তাই।
কয়লার খনি থেকে হীরা আহরণ।
রুশ কবি ভাদিমির মায়াকোভস্কি যেমন বলেছেনÑ
‘কবিতাকে আরও বলতে পারো
রেডিয়াম ধাতুর নিষ্কাশন
বহু বছরের মেহনতে
কয়েক রতি মাত্র নিকষিত
হাজার হাজার টন শব্দের ধাতব টং ভাঙতে
ছাঁকতে হয় আমাকে
ছেঁকে বের করে আনতে হয়
সেই প্রয়োজনীয় শব্দটিকে
(তহশীলদারের সঙ্গে আলাপ : ভাদিমির মায়াকোভস্কি / অনুবাদ রণেশ দাশগুপ্ত)
বাংলাদেশের কবিতাকে যে ক’জন কবি পাঠকদের হƒদয়ের গভীরে পৌঁছে দিয়েছেন তাদের অন্যতম কবি হেলাল হাফিজ। অল্প লিখে এমন আকাশচুম্বী পাঠকপ্রিয়তা খুব কম কবির ভাগ্যেই জুটেছে।
বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একটি কবিতার বইয়ের বিশের অধিক সংস্করণ এবং ষাটের অধিক পাইরেটেড মুদ্রণের দ্বিতীয় নজির নেই। যে রেকর্ড তৈরি হয়েছে তার একমাত্র কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র।
গত ছাব্বিশ বছরে বইটির এই রেকর্ড তৈরি হয়েছে। ছাব্বিশ বছর পর এই কবির দ্বিতীয় প্রকাশনা ‘কবিতা একাত্তর’ এ বছর বইমেলায় প্রকাশ পেলে তার পাঠকেরা একই রকমভাবে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছেন। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটির কবিতাগুলোসহ এবং এর সঙ্গে তার লেখা নতুন ১৫টি কবিতা নিয়ে ‘কবিতা একাত্তর’-এর প্রকাশনা। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় মলাটবন্দি ‘কবিতা একাত্তর’ এবারের মেলাতেও ‘বেস্ট সেলার’Ñ তার পাঠকেরা মেলা থেকে বই কিনে জাতীয় প্রেসক্লাবে এসে কবির অটোগ্রাফ নিয়ে গেছেন। মেলায় তার খোঁজে হন্যে হয়েছেন পাঠক, আলোকচিত্রী, মেলা কাভার করেন যেসব রিপোর্টার তারাও।
নিভৃতচারী এই কবি মেলায় যাননি একদিনও। জাতীয় প্রেসক্লাব তার সকাল-সন্ধ্যার ঠাঁইÑ যেখান থেকে পাঁচ-সাত মিনিটের হাঁটা দূরত্ব বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ তথা বইমেলার। এ তার বানানো চরিত্র নয়, দেখানো চরিত্র নয়Ñ তিনি এরকমই সাদামাটা নিস্পৃহ মৌনী, ধ্যানীÑ খ্যাতি-অখ্যাতির অনুভূতি সাড়া জাগায় না তার গভীরতর নির্জন সত্তায়Ñ কেবল যাপন করেন প্রবল কবি এবং কবির জীবন। সতের বছর লেখালেখির পর তার প্রথম কাব্য, তারও ২৬ বছর পর মাত্র ১৫টি কবিতাÑ অথচ এই দেশে বালখিল্যদের কবিতাসংগ্রহ, শ্রেষ্ঠকবিতা আর রচনাসমগ্র, রচনাবলী বেরিয়ে সয়লাব মেলা প্রাঙ্গণ।
না, তাকে কখনোই পাওয়া যায় না বালখিল্যদের ভিড়ে।
তার সঙ্গে কথোপকথনের ইচ্ছা প্রকাশ করায় ঘুরতে হল কয়েক দিন। যদিও সংসারী নন, তবুও জাগতিক অল্পস্বল্প দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি মেলে না কারোরই ব্যতিক্রম নন তিনিও সেই সাংসারিকতা থেকেÑ অসুস্থ বন্ধুকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়া, অসুস্থ ছোট বোনের জন্য ওষুধপত্র কিনে নেত্রকোনা পাঠানো এরকম কাজে তার ব্যস্ততা; আবার তারই ভেতর এশিয়া কাপ ক্রিকেটের ফাইনালÑ সবকিছু মিলেমিশে বলতে বলতে সপ্তাহ পার। আমি শুনতে চাই তার কথা আর তিনি বলেন, ‘এই ছবি দুটোর যে কোন একটা তোমরা কিন্তু ব্যবহার করবে তোমার লেখায়। মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে øেহভাজন আলোকচিত্রী শওকত জামিল খান প্রেসক্লাবে এসে আমার কিছু পোর্ট্রেট ছবি তোলে। ও অনুযোগ করে বলে, হেলাল ভাই, আপনাকে মেলার প্রাঙ্গণে ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ব্যর্থ হয়ে শেষে এখানেই এলাম ছবি তোলার জন্য আপনি একদিনও মেলায় গেলেন না।
তাকে দুটি ছবি পোস্টকার্ড সাইজে প্রিন্ট দিতে বলেছিলামÑ দু’দিন পর ওর দিয়ে যাওয়া সেই ছবিÑ ’
ছবিগুলোয় পরম যতেœ হাত বোলানÑ যেন অনুভব করতে চান আলোকচিত্রী শওকত জামিলের সপ্রাণ অস্তিত্বকে, সú্রাণ শূন্যতাকেও একই সঙ্গে। তার আলাপচারিতার ভেতর সদ্য অকালপ্রয়াত তরুণ আলোকচিত্রী শওকত জামিল খান, তার স্ত্রী সৌরভের মতো বিচরণ করেÑ এই হচ্ছেন কবি হেলাল হাফিজ। মানুষের সঙ্গে যার সম্পর্কÑ হার্দ্যকি, জীবনযাপন যার হার্দ্যকিÑ লৌকিক নয়, যে জীবন সবাই যাপন করে গতানুগতিক।
কথোপকথনের শুরুতেই তার কাছে জানতে চাই আপনার বিখ্যাত কবিতা নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতাটি কখন কিভাবে লিখেছিলেনÑকবিতাটির জš§সহ এটিকে ঘিরে অন্যান্য প্রতিক্রিয়া বিষয়ে বিস্তারিত বলুনÑ
হেলাল হাফিজ : ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় পুরনো ঢাকার রথখোলার দিক থেকে আমি একটা রিক্সায় করে ফুলবাড়িয়া পৌঁছে মিছিলের জ্যামে আটকে পড়ি। এসময় মিছিলের লোকজনের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।
তখন আমি যে রিক্সায় বসেছিলাম সেই রিক্সার পাশ দিয়ে যাওয়া আরেকটি রিক্সার চালক মিছিলের মানুষদের উৎসাহ দিতে চিৎকার করে বলে উঠলÑ‘মার মার, মাইরা ফ্যালাÑ কিছু কিছু পেরেম আছে, যেডার জন্য মার্ডার করাও জায়েজ। মার...!’ পাশের রিক্সাওয়ালার এই সাংঘাতিক কথাটি আমার মধ্যে প্রচণ্ড একটা অভিঘাত তৈরি করল। সেখান থেকেই কিন্তু ওই পংক্তির জš§ ‘কোনো কোনো প্রেম আছে, প্রেমিককে খুনী হতে হয়/যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান/তাই হয়ে যান/উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়। ’
অদূর ভবিষ্যতে যখন এ সময়ের কবিতা নিয়ে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন হবে তখন নিশ্চয়ই এটা আবিষ্কৃত হবে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে স্পষ্ট এবং সরাসরি আহ্বান জানিয়ে লেখা প্রথম এবং প্রধান কবিতাটি হচ্ছে নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়। এর আগে আর কারও লেখায় এ রকম সরাসরি যুদ্ধের আহ্বান ঘোষিত হয়নি।
এবং এই একটি কবিতা আমাকে রাতারাতি বিখ্যাত করে দেয়। সেদিনের সেই রিক্সাওয়ালার বাক্যটি আমার মন ও মগজে ক্রিয়া করতে থাকে। আমি লিখতে পারছিলাম নাÑ অস্থিরতার ভেতর দিন কাটাচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত ৩/৪ পৃষ্ঠা দীর্ঘ একটি কবিতা লিখে ফেললাম। কবিতাটি লেখার পর সেটি কবি হুমায়ুন কবিরকে দেখালাম।
তিনি সেটা পড়ে বললেন, এডিট করতে হবে। ৩/৪ পৃষ্ঠার কবিতাটিকে তিনি বললেন ১ পৃষ্ঠায় লিখতে। দুরূহতম সেই কাজটি আমার নিজেরই করতে হবেÑ কুসুমিত ইস্পাত-এর কবি আমার অতিরিক্ত আবেগ বিহ্বল কবিতাটিকে এডিট করে ১ পৃষ্ঠার পরিসরে আনবার তাগিদ দিয়েছিলেন। ক্রমাগত কাটাছেড়ার ভেতর হঠাৎ করেই নামটিও এসে গেলÑ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ অমানুষিক খেটে শেষ পর্যন্ত কবিতাটিকে বর্তমান অবয়বে দাঁড় করালাম।
নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
মিছিলের সব হাত
কণ্ঠ
পা এক নয়।
সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার।
শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে
অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে
অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,
কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে।
কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয়।
যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
ক্যাম্পাসে সম্পাদিত কবিতাটি পড়ে শোনালাম কবি হুমায়ুন কবির এবং লেখক আহমদ ছফাকে। শুনে দুজনেই প্রচণ্ড আবেগে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘হেলাল, জীবনে তোমার আর কোন কবিতা না লিখলেও চলবে। একটি কবিতাই তোমাকে অমরত্বের দরোজায় পৌঁছে দিয়েছে।
’ পরদিন তারা দুজনে আমাকে নিয়ে কবি আহসান হাবিবের কাছে গেলেন তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান অফিসে। কবি হুমায়ুন কবির আমাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘হেলাল, কবিতা লেখে, ও একটি কবিতা লিখেছে সেটা পড়ে দেখেন। ’ আমি তাঁর হাতে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি দিলাম। তিনি পড়লেন পড়ে বললেন, ‘বাবা, তোমাকে একটা কথা বলিÑতোমার এই কবিতাটি আমার এই পত্রিকায় ছাপা যাবে না, ছাপলে আমার চাকরিটা চলে যাবে। হুমায়ুন কবিরের দিকে ফিরে তাকে বললেন, কবির তুমি তো বোঝ, ও তো নতুন ও হয়তো অভিমান করবেÑ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তবে একটা কথা বলে দিইÑ তোমার অমরত্ব নিশ্চিত হয়ে গেছেÑ জীবনে তোমার আর কোনও কবিতা না লিখলেও চলবে।
’
পরে নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে প্রকাশিত কোনও একটা একুশের সংকলনে ছাপা হয়। এবং ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে সকলের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। এই কবিতা ছড়িয়ে পড়লো রণাঙ্গনে, সমগ্র বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। বাংলাদেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেয়ালে ঠাঁই করে নিয়েছেÑ তারুণ্যকে উদ্বুদ্ধ করেছে যুদ্ধে যেতে, আন্দোলনে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশেও বামপন্থী তরুণেরা তাদের আন্দোলনের কর্মসূচিকে বেগবান করতে মাঠে-ময়দানে, মঞ্চে জনসভায় কবিতাটি আবৃত্তি করে ছড়িয়ে দিয়েছে আপামর জনতার মাঝে।
অনেক পাঠক আমাকে বলেছেন, এই কবিতাটি দেশের কোথাও কোথাও জুম্মার নামাজের খোতবায়ও ইমাম সাহেবরা আবৃত্তি করেছেন। ’
জীবনের শুরুতে আপনি কার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেনÑ
হেলাল হাফিজ : জীবনে সবচেয়ে বেশি আমাকে প্রভাবিত করেছেন আমার আব্বা খোরশেদ আলী তালুকদার। যিনি আমার জনক এবং যিনি আমার অন্যতম প্রিয় শিক্ষকও ছিলেন। তিনি আক্ষরিক অর্থে যেমন আমার শিক্ষক ছিলেন তেমনই নিরাসক্ত যে জীবন আমি যাপন করি তারও শিক্ষা তার জীবন থেকেই আমি পেয়েছি। তিনি স্বেচ্ছায় কৃচ্ছ্রতার মধ্যে জীবন যাপন করতেন, যা তার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল না, তিনি আর্থিক ভাবে অস্বচ্ছল ছিলেন না, কৃপণও ছিলেন না।
কিন্তু ভীষণ সিম্পলিসিটির মধ্যে তিনি জীবন যাপন করতেন। যাকে বলা যেতে পারে সুফী স্বভাব, কবি সুলভ ঔদাসীন্যে তিনি তার জীবন কাটিয়েছেন।
তিনি ভাল আবৃত্তি করতে পারতেন, কবিতা লিখতেনÑ রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ এঁদের সঙ্গে তাঁর লেখা ছাপা হতো খালেকদাদ চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত সেকালের প্রতিনিধিত্বমূলক সাহিত্য পত্রিকা ‘উত্তর আকাশে’Ñছিলেন ভাল শিক্ষকও। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও সংস্কৃত, আরবী, উর্দু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। যে কারণে স্কুলে এসব বিষয়ের শিক্ষকদের কেউ না এলে সেদিন তার ওপর ভার পড়ত এসব ক্লাশ নেবার।
এভাবে তিনি অংক ও বিজ্ঞান টিচার না এলে তাদের ক্লাশও নিতেন। যাকে বলে স্বশিক্ষিত তিনি ছিলেন তাই। ফলে আমার জীবনে তিনিই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছেন। ’
কিভাবে কবি হয়ে উঠলেন এই কবি ? জানতে চাই তার নিজের জবানীতে। তিনি বলেনÑ
হেলাল হাফিজ : আমার একটি কবিতায় আছেÑ ‘কবির জীবন খেয়ে জীবনধারণ করে কবিতা এমন এক পিতৃঘাতী শব্দের শরীর/ কবি তবু সযতেœ কবিতাকে লালন করেন, যেমন যতেœ রাখে তীর/জেনেশুনে সব জল ভয়াল নদীর।
’ কবিতা আসলে এরকমইÑ আমিও আমার জীবন খরচ করেই কবিতা লিখেছি। জীবনে অন্য বহুকিছু করার বা পাওয়ার সুযোগ আমার ছিল কিন্তু আমাকে টেনেছে কবিতা। আমি জীবনের বাকি সবকিছু বিসর্জন দিয়ে শুধু এই কবিতার জন্য এ পর্যন্ত আমার পুরোটা জীবন খরচ করেছি। আমার কবি হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান নারীর। যখন ৩ বছর বয়স তখন মা মারা যান।
এই মাতৃহীনতার বেদনা তখন আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন বড় হয়ে উঠলাম তখন এই বেদনা আমাকে এমনভাবে গ্রাস করতে লাগল যে, আমার পুরোটা জীবন এই একটি ঘটনায় পাল্টে গেল কিংবা এলোমেলো হয়ে গেলোও বলতে পারো। আজকে আমি এই যে ঘরহীন ঘরে থাকি এই ঘরহীনতা কিন্তু আমার সেই শৈশব থেকে শুরু হয়েছে। তখন থেকেই আমি এলোমেলো। বাইরে থেকে আমাকে সুশৃঙ্খল মনে হয়, পরিপাটি মনে হয়, তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ কখনোই আমার চুল কেউ এলোমেলো দেখেনি, কখনোই আমার পোষাক পরিচ্ছদ অপরিচ্ছন্ন দেখেনিÑ সব চকচকে।
আমি খুব কমদামি জামাকাপড় পরি কিন্তু প্রোপারলি ড্রেসড। দামি পরিচ্ছেদ পরি না কিন্তু সুন্দরভাবে সুচারুভাবে সেসব পরিচ্ছেদ আমি ব্যবহার করার চেষ্টা করি। বাইরের এই পরিপাটি ভাবটার ঠিক উল্টো ঘটনাÑ ভেতরে। আমার পুরো ভেতর এত এলোমেলো যে, সেটা ঠিক বলেও বোঝানো যাবে না।
আমি যখন কৈশোরের মধ্যভাগে তখন আমার আব্বা আবার বিয়ে করেন।
সেই বিয়ে খুবই যৌক্তিক ছিল। আমি আমার কৈশোর বা প্রথম যৌবনে যেভাবে ভেবেছি বিষয়টিকে আজকে কিন্তু সেভাবে ভাবি না। আজকে ভাবি যে, আব্বার ওই বিয়ে খুবই যৌক্তিক ছিল, সেটা যেমন তার দিক থেকে তেমনই আমাদের দুই ভাইকে মানুষ করার জন্যও। নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল আমার মায়ের মতো। আব্বা সেখানে শিক্ষকতা করতেন।
আমার মনে পড়ে আব্বা আমাকে টেবিলের ওপর বসিয়ে রেখে ক্লাস নিতেন এবং স্কুলের সব ছাত্র-শিক্ষক আমার প্রতি বিশেষ নজর রাখতেনÑ আমি তাদের সবার ভালোবাসায় বড় হয়েছি। তাই নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল আমার কাছে মাতৃসম।
আমি কিন্তু লেখালেখি দিয়ে জীবন শুরু করিনি। আমার জীবনে বড় আকর্ষণ ছিল খেলাধুলা। ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, লন টেনিস প্রভৃতি।
আমাদের খেলার মাঠের পাশেই শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা লন টেনিস খেলতেন। সেখানে আমার মতো বয়সীদের খেলার সুযোগ ছিল না, কিন্তু শহরের এলিট ক্লাসের লোকেরা দেখা যেত একজন হয়তো এসেছেন অন্যরা এসে পৌঁছেননিÑ সেই অবসরে যিনি এসেছেন তার সঙ্গে প্রক্সি খেলোয়াড়ের ভূমিকায় ডাক পড়তÑ এভাবে আমি লন টেনিসে ভীষণ অভ্যস্ত হয়ে পড়ি।
খেলাধুলার পাশাপাশি আরেকটি উল্লেখ করার মতো বিষয় বলা যায়, ক্লাস ফাইভ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত স্কুল এবং কলেজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আমি এগিয়ে থাকতাম। প্রতি বছর অন্তত ১০-১৫টি বই আমি পুরস্কার পেতাম। বাংলা কবিতা আবৃত্তিতে, উপস্থিত বক্তৃতায়, গান, বিতর্কে প্রথম/দ্বিতীয় হতাম।
কোন রকম প্রাতিষ্ঠানিক তালিম ছাড়াও আমি খুব সুন্দর গান গাইতাম। নেত্রকোনার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকেই সম্ভবত আমি গান গাইবার উৎসাহটি পেয়েছিলাম। স্কুলে এবং কলেজের স্পোর্টসেও অংশ নিয়ে পুরস্কৃত হতাম। এভাবে বই জমতে জমতে আমার আলমারি ভরে যায়Ñ আমার পুরস্কার পাওয়া এক আলমারি বই নেত্রকোনা পাবলিক লাইব্রেরিতে ডোনেট করে আব্বাকে লাইব্রেরির আজীবন সদস্য করে দিই। এখনও নেত্রকোনা পাবলিক লাইব্রেরিতে গেলে আজীবন সদস্য হিসেবে আমার আব্বার নাম দেখতে পাবেন।
এই পর্বে লেখালেখিতে আমার তেমন টান ছিল না।
কৈশোর থেকে তারুণ্যে উত্তীর্ণ হওয়ার সময় মাতৃহীনতার বেদনা আমাকে বোহেমিয়ান করে তোলে। এক ধরনের অনিয়ম উচ্ছৃংখলতা, কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে হুটহাট এদিক-সেদিক চলে যাওয়াÑ এসবে আব্বা খুব পেরেশানি পোহাতেন, কিন্তু কোনও কিছুতেই যেন আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। এ সময় সংসারের বাস্তব প্রয়োজনে আব্বা আবার বিয়ে করেন। খুবই যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন, বাস্তবতার বিবেচনায়।
কিন্তু এ ঘটনা সেই কাঁচা বয়সে আমাকে দারুণ অভিমানী করে তোলে। অথচ আজ বুঝি আব্বার সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত সঠিক ছিল, কিন্তু আমার কাঁচা আবেগে আমি তখন তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছি; তার কষ্টের কারণ হয়েছি। এ সময়ে নিজেকে ভীষণ একাকী এবং নিঃসঙ্গ বোধ হতো। ক্লাস নাইনে ওঠার পর স্কুল থেকে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন শিক্ষকরা। আমি আমার লেখা কবিতা দিলাম।
দেয়াল পত্রিকা বের হলে দেখলাম সবার শীর্ষেÑ শুরুতেই আমার কবিতাÑ কী যে আনন্দ লাগল আমার! মনে হল পুরো পৃথিবীর অধীশ্বর আমি। এভাবেই লেখালেখির দিকে ঝুঁকতে শুরু করলাম। কলেজে উঠে সায়েন্স নিলাম, ডাক্তার হব ইচ্ছা ছিল এমন। কিন্তু পরে আর ডাক্তারি পড়া হয়নি। বাংলা বিভাগে ভর্তি হলাম।
আপনার কবিতায় উল্লেখিত সবিতা সেন, হেলেন, হিরণ বালা এদের নিয়ে পাঠকের কৌতূহল বিষয়ে কিছু বলবেনÑ
হেলাল হাফিজ : যেসব নারীর নাম আমার নানা কবিতায় উল্লেখ আছে তাদের মধ্যে সবিতা সেন, হেলেন, হিরণ বালার কথা আমার পাঠকদের জানা। কিন্তু এর বাইরেও একজন নারী আছেন যার নাম আমার কবিতায় সরাসরি উল্লেখ নেই কোথাওÑ কিন্তু তিনি আমাকে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করেছেন। তিনি আমার ফুপাতো বোন মেহেরুন্নেছা রেণু। তার কথা আগে কোথাও উল্লেখ করিনি। আজ মনে হচ্ছে উল্লেখ করা প্রয়োজন।
তার প্রতি আমার অন্তত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য হলেও। আমার মা ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়ীÑ আমি তাকে দেখেছি কিন্তু তার কোনও স্মৃতি নেই। আজীবন কোন সুন্দরী মহিলাকে দেখলেই আমার মনে হয়Ñ ইস্ ইনি যদি আমার মা হতেন! মনোবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড যাকে ইডিপাস কমপ্লেক্স বলে অভিহিত করেছেনÑ ঠিক সেই রকম নয়, এক ধরনের তৃষ্ণাবোধ, মায়ের অভাববোধ, শারীরিক উদ্দীপনার সঙ্গে যার কোন সম্পর্ক নেইÑ সবিতা সেন, রেণু আপা এরা বয়সে আমার চেয়ে প্রায় ১০-১২ বছরের বড় ছিলেন কিন্তু এদের অমিত লাবণ্যÑ আমাকে কল্পনায় অনুপ্রাণিত করত। এদের মধ্যে হেলেন ছিল প্রায় আমার সমবয়সী। আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম।
হেলেন কিন্তু আহামরি কোন সুন্দরী ছিল না, সুন্দরী ছিলেন হেলেনের মা। তাকে দেখে আমার ভেতরে মনে হতো আহা উনি যেন আমারই মা! মানুষ আসলে বিচিত্রÑ আমি সেই বৈচিত্র্যময়দেরই একজন।
রেণু আপা ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। আজ থেকে ৫০-৫৫ বছর আগে নেত্রকোনার মতো একটি মফস্বল শহরে আমাদের বেড়ে ওঠা। তখনকার শহর মানে এখনকার উপজেলা বা গ্রাম।
মেয়েদের বিচরণক্ষেত্রও সীমিত, সংকুচিত। তো সেকালের প্রেম মানে প্লেটোনিক প্রেম তো বটেই। তাই আমার কবিতায় উল্লেখিত বা অনুল্লেখিত নারী মানেই প্লেটোনিক প্রেমিকা। ফলে যাদের নিয়ে লিখেছি তারা অনেকেই তা জানেন, অনেকে জানেনও না।
রেণু আপা ছিলেন অনন্যসাধারণ রূপসী এবং বিদুষী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী।
আমি মগ্ন ছিলাম তার অবিমিশ্র প্রেমে। আর আমরা বাসিন্দা ছিলাম এক অব্যক্ত সমাজের। পঞ্চান্ন বছর আগের বাস্তবতা একুশ শতকের প্রজšে§র কাছে বোধগম্য করা কঠিন। রেণু আপাকে আমি ভালোবাসতাম মায়ের মতো, কখনও তাকে মনে হতো বড় বোনের মতো, আবার কখনও একান্ত প্রিয়জনের মতো। রেণু আপাকে ঘিরে এই ভালোবাসা আরও গাঢ় হয় যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও আব্বার ওপর অভিমান করে পড়াশোনা ছেড়ে মুন্সীগঞ্জের একটি স্কুলের চাকরিতে জয়েন করলাম।
রেণু আপার আব্বা অর্থাৎ আমার ফুপা তখন মুন্সীগঞ্জ হাসপাতালে চাকরি করতেন। তার তদবিরেই আমি মুন্সীগঞ্জে স্কুলের চাকরিটি পাই। রেণু আপা তখন এমএ পাস করে চাঁদপুর কলেজে অধ্যাপনার চাকরিতে জয়েন করেছেন। তখন সরকারি ছুটি ছিল রোববার। আমি প্রথমে মুন্সীগঞ্জে রেণু আপাদের বাসায়ই থাকতাম, পরে সেখানকার এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাসায় লজিং মাস্টার হিসেবে উঠি ওনার ছেলেদের গৃহশিক্ষকতার দায়িত্ব নিয়ে।
রেণু আপা প্রতি শনিবার বিকালে চাঁদপুর থেকে লঞ্চে মুন্সীগঞ্জ আসতেন, শনিবার রাত, রোববার সারা দিন থেকে সোমবার ভোরবেলার লঞ্চে চাঁদপুর চলে যেতেন। প্রতি সোমবারই ভোরে রেণু আপাকে লঞ্চে তুলে দিতে যেতাম আমি। ওনাকে নিয়ে যখন লঞ্চ ঘাট থেকে ছেড়ে যেত তখন পন্টুনে দাঁড়িয়ে আমি নির্নিমেষ নয়নে সেই লঞ্চের দিকে চেয়ে থাকতাম। যখন সেই লঞ্চ দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে যেত তখন আমার চোখ ঝাঁপসা হয়ে অশ্র“তে ভরে যেত। আমি অঝোরে কাঁদতে থাকতাম।
আমার কেবলই মনে হতো যেন আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, আমার বোন চলে যাচ্ছে, আমার একান্ত আপনজন চলে যাচ্ছে আমাকে ছেড়ে। আমি ভেসে যেতাম ধু ধু শূন্যতায়Ñ যেন এক দেবীপ্রতিমা ছেড়ে যাচ্ছেন তার ভক্ত পূজারীকে। রেণু আপাকে নিয়ে আমি যে কবিতা লিখেছি, সে কবিতার কথা রেণু আপাও জানেন না। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র এই কবিতাটি তাকে নিয়েই লেখাÑ
ইচ্ছে ছিলো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হƒদয়ে উড়াবো।
ইচ্ছে ছিলো সুনিপুণ মেকআপ-ম্যানের মতো
সূর্যালোকে কেবল সাজাবো, তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।
ইচ্ছে ছিলো নদীর বক্ষ থেকে জলে জলে শব্দ তুলে
রাখবো তোমার দুই লাজুক চঞ্চুতে,
জš§াবধি আমার শীতল চোখ
তাপ নেবে তোমার দু’চোখে।
ইচ্ছে ছিলো রাজা হবো
তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে,
শুধু তুমি অন্য ঘরে।
এই প্রেম প্লেটোনিক এবং এই প্রেম পরম পবিত্র। রেণু আপাকে বিদায় জানিয়ে ঘাটে এ রকম অশ্র“সজল আমাকে একদিন আবিষ্কার করে আমার ছাত্ররা। তারা ধারণা করে যে কেউ হয়তো আমাকে কিছু বলেছে।
আমি তাদের বলিÑ না, আমার বড় বোন চলে গেলেন তো তাই আমার কান্না আসছে।
মুন্সীগঞ্জ থেকে আসার পর আর দীর্ঘদিন রেণু আপার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি। এক অপ্রতিরোধ্য অভিমানে আমি তাকে যেন এক প্রকার এড়িয়েই চলেছি। এর ভেতর রেণু আপার বিয়ে হয়েছে। ওনার স্বামীর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরির সূত্রে বিভিন্ন দেশে ঘুরেছেন।
তাদের সন্তানরাও এখন প্রতিষ্ঠিত। প্রায় জীবনসায়াহ্নে এসে রেণু আপার প্রতি আমার সেই একতরফা প্রেমের কথা ব্যক্ত করছি। এই সাক্ষাৎকার পড়ে রেণু আপা হয়তো অবাক হবেন, তারও চেয়ে হয়তো অবাক হবেন এ কথা জেনে যে তিনিও আমার কবিতার নেপথ্য অনুপ্রেরণাদায়িনী অন্যতম একজন।
আসলে আমার ভেতরে এক নিরন্তর মাতৃতৃষ্ণা বয়ে চলেছে। এখনও যে কোন সুন্দরী নারী দেখলে আমার মনে হয়Ñ এই তো আমার মা, এই তো আমার বোন, এই তো আমার একান্ত আপনজন।
’
মূলত মাতৃহীনতার বেদনা, পিতার ওপর আবেগী অভিমান, ক’জন নারীকে ঘিরে আমার অনুভব-অনুভূতি, রাগ-অনুরাগের ব্যক্ততার ভেতর দিয়েই আমার কবি হয়ে ওঠা। ’
আপনার জীবনের স্মরণীয় বছর কোনটি?
হেলাল হাফিজ : মুন্সীগঞ্জ স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে এক বছর পর আবার ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা সিট হলো ইকবাল হলে। এ সময় পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে কবি আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ এদের সঙ্গে। এরা সবাই আমার চেয়ে বয়সে বড় কিন্তু অনেক আপন হয়ে গেলেন।
আমার পিতা খোরশেদ আলী তালুকদার, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ এঁরা সবাই নেত্রকোনা থেকে খালেকদাদ চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। এদের মধ্যে গুণ দা-র বাড়িও নেত্রকোনায় ফলে তার সান্নিধ্য আমি সবচেয়ে বেশি পেয়েছি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাক ডাউনের রাতে আমার বেঁচে যাওয়াটা ছিল এক অলৌকিক ঘটনা। ২৫ মার্চ রাতের খাবার খেয়ে ফজলুল হক হলে বন্ধুদের সঙ্গে আডডায় পড়ে রাতে সেখানেই থেকে যাই। বর্বর পাকহানাদার বাহিনী ইকবাল হলে যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ঘটায় সেই হত্যাযজ্ঞে লাশ হবার কথা ছিল আমারও।
গুণ দা তখন আজিমপুর থাকতেন। ইকবাল হলের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে এসেছিলেন-আমার কি পরিণতি ঘটেছে তা জানবার জন্য। ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেবার পর আমিও ইকবাল হলে গিয়েছি, চারিদিকে ধ্বংসস্তূপ, লাশ আর লাশ... হলের গেট দিয়ে বেরুতেই নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখাÑ আমাকে জীবিত দেখে উচ্ছ্বসিত আবেগে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন তিনি। দুজনে এক সঙ্গে কেরানিগঞ্জের দিকে আশ্রয়ের জন্যে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিলাম। ’
মুক্তিযুদ্ধের কাল ১৯৭১ আমার জীবনে স্মরণীয় বছর।
ফ্রানৎস কাফকার মতে, শিল্প তো শিল্পীর কাছে শুধু যন্ত্রণার যার মধ্যে দিয়ে তিনি মুক্ত করতে চান নিজেকে আরও বেশি যন্ত্রণা থেকেÑ আপনি দীর্ঘদিন লেখেননি কি সেই যন্ত্রণার অনুপস্থিতির জন্য?
হেলাল হাফিজ : আমি হয়তো লিখিনি কিন্তু আমি সারাক্ষণ কবিতার ভেতরেই বাস করেছি। ১৭ বছর লেখালেখির পর আমার প্রথম কাব্য বেরিয়েছে। আমি তাড়াহুড়ায় অভ্যস্ত নই। আমি দীর্ঘ অপেক্ষার পর ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশ করেছিÑ বইটা যেন বেনোজলে ভেসে না যায়Ñ বইটা হারিয়ে যাওয়ার জন্য বেরোয়নি। এটা প্রমাণ হয়ে গেছে।
এই দীর্ঘ নীরবতায় হয়তো আমার অনেক মূল্যবান পংক্তি হারিয়ে গেছে তবুও কবিতা ছাড়া আমি অন্য কাজে সময় ব্যয় করিনি। তাই হয়তো আমার ভক্তরা বলে থাকেনÑঅল্প লিখেও হেলাল হাফিজ গল্প হয়েছেন।
গত ২৬ বছর আমি নিজেকে গোপন রেখেÑউপভোগ করেছি পাঠকের ভালোবাসাÑ যা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমার সঙ্গে এমন পাঠক-পাঠিকা দম্পতির সাক্ষাৎ হয়েছে যারা আমাকে জানিয়েছেনÑ ‘আপনার কবিতা পড়ে আমাদের প্রেমের শুরুÑ আপনার কবিতা পড়ে আমাদের বাসরযাপনÑ আমাদের ঝগড়াঝাটি-বিরহ-মিলন। আপনি আমাদের কবি।
’ আর কি লাগে একটা মানুষের? পাঠকদের এই দুর্লভ ভালোবাসাÑআমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেÑ ‘‘এতো ভালোবাসা পেয়ে, ভিতরে ভীষণ লাজে / বেদনারা লাল হয়ে গেছে। ’’ পাঠকের অভূতপূর্ব ভালোবাসায় ভীষণ অভিভূত আমার একটা নির্মাণাধীন কবিতার লাইন এটি। কবিতাই আমার প্রথম প্রধান ও শেষ গন্তব্য। কবিতার সঙ্গে প্রেম ও বিরহ আমার অস্থিমজ্জায়। অক্সিজেন এবং শস্যদানার মতই আমার কাছে প্রেম ও কবিতা অত্যন্ত জরুরি।
জগতের অন্য কোন কিছুই আমাকে টানে না, আনন্দ দেয় নাÑবেদনাও দেয় না। আমার প্রিয় লেখক আলবেয়ার কাম্যুর আউডসাইডার উপন্যাসে কাম্যু লিখছেনÑ ‘গতকাল অথবা আজ সকালে মা মারা গেছেন’Ñ এই যে নিস্পৃহ চরিত্রÑ সেটা আমার মধ্যেও আছে। আলস্য, আÍপীড়ন, অপচয়- এগুলো আমার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।
এ বছর আমি প্রস্তুত হই, যে জ্বলে আগুন জ্বলের ৫৬টি কবিতার সঙ্গে নতুন আরও ১৫টি কবিতা যোগ করে কবিতা একাত্তর নামে কবিতার সংগ্রহটি প্রকাশের জন্য। বইটি দ্বিভাষিক বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি অনুবাদও ছাপা হয়েছে।
১৯৮৬ সালের পর, ২৬ বছর পরও সবাইকে বিস্মিত করে ‘কবিতা একাত্তর’ বইমেলার বেস্ট সেলার এবং মিডিয়ারও ব্যাপক প্রচারণা পেল। এ থেকেই বোঝা যায়Ñ এই কবির জনপ্রিয়তা অটুট রয়েছেÑ তিনি ২৫ বছর লেখেননি ঠিকইÑ কিন্তু পাঠকের হƒদয়ে তার আসন টলেনি। মানুষ তাকে স্মরণে রেখেছে। বহু লোকের ধারণা হয়ে গিয়েছিল বোধ হয় হেলাল হাফিজ মারা গিয়েছেন। বহুলোক মনে করত তিনি বোধ করি দেশে থাকেন না, বিদেশে থাকেন।
কিন্তু এবারের মেলায় ‘কবিতা একাত্তর’ হাতে পেয়ে সবাই যখন দেখল যে তিনি এখনো রীতিমতো দেশেই আছেনÑ তখন তারা ২৬ বছর আগের মতই অভূতপূর্ব সাড়া দিল। বহু ছেলে মেয়ে বইমেলা থেকে বই কিনে প্রেসক্লাবে এসে আমার অটোগ্রাফ নিয়ে গেছে। এত কাছে অথচ আমি একদিনও মেলায় যাইনি। এই বইটি যদিও সত্যিকার অর্থে একটা নতুন বই নয়Ñ যে জ্বলে আগুন জ্বলের সঙ্গে নতুন ১৫টি কবিতা যোগ হয়েছে এবং একাত্তরটি কবিতারই ইংরেজি অনুবাদ স্থান পেয়েছে- এই মাত্র।
এখন আমার একটাই লক্ষ্য- তা হচ্ছে আমার দ্বিতীয় মৌলিক কাব্যটি প্রকাশের ব্যবস্থা করা।
এই কাব্যের নামটিও মোটামুটি ঠিক করেছি তা হচ্ছেÑ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরি করাই এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য। এজন্য আমি আÍীয় পরিজন ছেড়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের ঠিক উল্টো দিকের কর্নফুলি হোটেলের ২০২ নম্বর রুমে এসে উঠেছি। ’
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে যত কবিতা লেখা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতা হচ্ছে হেলাল হাফিজের লেখা ‘নাম ভূমিকায়’। কবিতাটি প্রসঙ্গে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেনÑ
হেলাল হাফিজ : আমি এই কবিতাটি লিখেছি বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে মনে করে।
কিন্তু কোথায়ও তার নাম নেইÑ কবিতাটি পড়লে যে কোন সচেতন পাঠকই উপলব্ধি করতে পারবেন যে, এই কবিতায় একজন মহৎ মানুষের কথা বলা হচ্ছেÑ যিনি এবং তার দেশ পরস্পর অবিচ্ছিন্ন এক সত্তা!
নাম ভূমিকায়
তাকানোর মতো করে তাকালেই চিনবে আমাকে।
আমি মানুষের ব্যাকরণ
জীবনের পুস্পিত বিজ্ঞান
আমি সভ্যতার শুভ্রতার মৌল উপাদান,
আমাকে চিনতেই হবে
তাকানোর মতো করে তাকালেই চিনবে আমাকে।
আমাকে না চেনা মানে
মাটি আর মানুষের প্রেমের উপমা সেই
অনুপম যুদ্ধকে না চেনা।
আমাকে না চেনা মানে
সকালের শিশিরকে না চেনা,
ঘাসফুল, রাজহাঁস, উদ্ভিদ না চেনা।
গাভিন ক্ষেতের ঘ্রাণ, জলের কলস, কাক
পলিমাটি চেনা মানে আমাকেই চেনা।
আমাকে চেনো না?
আমি তোমাদের ডাকনাম, উজাড় যমুনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোটা বাঙালি জাতির নেতা, উনি শুধু একটি দলের নেতা নন। তার ৭ই মার্চের স্বাধীনতার ডাক কোন দলের পক্ষে নয়, গোটা জাতির জন্য ঘোষণা। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যর্থতা এখানেইÑ তাঁকে দলীয় বৃত্তে আবদ্ধ করতে চাওয়ায়। এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসার কোনও বিকল্প নেই।
’
সাহিত্য ও রাজনীতির সম্পর্ক পরস্পর বিরোধী না পরস্পর সম্পূরক?
হেলাল হাফিজ : সাহিত্যের সঙ্গে অবশ্যই রাজনীতির সম্পর্ক আছে। এরা পরস্পর ওতপ্রোত সত্তা। কিন্তু কোন বড় মাপের কবি, লেখক বা সাহিত্যিক যদি কোনও দলীয় রাজনীতির প্রচারক হন সেটা তার জন্য ক্ষতিকর। দলীয় বিধি নিষেধের নিগড়ে সত্যিকার সৃজনশীল সাহিত্য জš§ দেয়া কঠিন। তাই দলীয় সংকীর্ণতার উর্ধে থাকতে হবে লেখককে সব সময়, সব কালে।
আমাদের দেশের শাসকরা মোটেই সহনশীল নন। যেমন ধর ফ্রান্স যখন আলজেরিয়া আক্রমণ করে তখন বিখ্যাত লেখক জ্যাঁ পল সার্ত্রে তার তীব্র প্রতিবাদ জানান। জেনারেল দ্যগলের ক্যাবিনেটের মিটিঙে সমস্ত ক্যাবিনেট সদস্য বলল, সার্ত্রকে অ্যারেস্ট করতে হবে, সার্ত্রে দেশদ্রোহী! তখন দ্যগল বললেন, ‘হাউ ক্যান আই অ্যারেস্ট হিম? সার্ত্রে ইজ ফ্রান্স। Ñআমি তাকে কি করে অ্যারেস্ট করি। ’
দেখো, সামরিক বাহিনীর একজন লোক তিনি কিন্তু তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উচ্চমানের নমুনা এ ঘটনা।
দ্যগল সার্ত্রেকে অ্যারেস্ট করার আদেশ দেননি, বলেছেন সেটা দেশের আইন আদালতের বিষয়। এখানেই অন্যদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য।
আজকের পত্রিকাতেই দেখ বেরিয়েছে গুন্টার গ্রাসের লেখাÑ জার্মানির ইজরায়েল তোষণের বিরোধিতা করেÑসে লেখায় বিশ্বশান্তির বিরুদ্ধে প্রকৃত হুমকি বলেছেন তিনি ইজরায়েলকেÑপ্রকৃত লেখক দল এমনকি দেশেরও উর্ধে। সম্পূর্ণ মানব সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি।
তথাকথিত সভ্যতার এই অভব্যতা নিয়ে আমার একটি ছোট্ট কবিতায় লিখেছিলামÑ
‘নিউট্রন বোমা বোঝো/ মানুষ বোঝো না?’ (অশ্লীল সভ্যতা)
কবির কাজ মানুষকে বোঝা।
কবিরা প্রকৃতপক্ষে জনতার হƒদয়Ñআমাদের দেশের শাসকেরা সেটা বোঝেন না।
আমি আমার দেশের মানুষের যে স্বপ্ন, তাদের যে আকাক্সক্ষা, অভিপ্রায়, তারা যে পরিবর্তন চাচ্ছে- এই পুরো সামষ্টিক স্বপ্নটাকে আমার ভেতর ধারণ করে আমার বাকভঙ্গিতে আবার তা সকলের জন্যে প্রকাশ করেছিÑ মানুষ তার নিজের স্বর হিসেবে তাকে সনাক্ত করেছে বলেই আমি তাদের হƒদয়ে ঠাঁই পেয়েছি। স্বাধীনতা উত্তর স্বপ্নভঙ্গের বেদনারও ভাষা রূপ দিতে সক্ষম হয়েছি আমিÑ মানুষেরা তা গ্রহণ করেছেন বিপুলভাবে।
আমার বইয়ে অনেক ঊন কবিতা আছে যেগুলো মোটেই ঊন নয়Ñ বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের মতোই।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিষয়ে বলুনÑ
হেলাল হাফিজ : একেবারেই নষ্ট-ভ্রষ্ট রাজনীতি।
আমরা একটা নষ্ট সময়ের মধ্যে পড়ে গেছি। তুমি দেখ আমরা কেমন একটা সমাজে বসবাস করিÑ তুমি যদি প্রেমের কথা বল তোমাকে মানুষ অপছন্দ করবে- তুমি ঘৃণার কথা বল মানুষ তোমাকে বীর বলবে। তুমি সততার কথা বল, তুমি কর্নারড হয়ে পড়বে। তুমি অসৎদের সঙ্গে যোগ দাওÑ পাওয়ার ব্রোকার হয়ে উঠবে। এখন আমরা এমন একটা সমাজে বসবাস করি যে সমাজে শৈল্পিক দুঃখ দেবার লোকেরও অভাব, শৈল্পিক দুঃখ নেয়ারও লোকের অভাব।
আমরা দুঃখ দিতেও পারছি না, দুঃখ নিতেও পারছি নাÑ এমনই এক দুর্ভাগা দেশে, এমনই এক দুঃসময়ে আমাদের বসবাস।
আমাদের এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের সার্বিক বিকাশের জন্য সবচেয়ে বড় বাধাÑ ব্যক্তির মুক্তি, সমষ্টির অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। আমাদের সমাজে আলোকিত মানুষেরও বড় অভাবÑ সেটাও একটা অন্যতম অন্তরায়।
আপনার সাম্প্রতিক পাঠের বিষয়ে বলুনÑ
হেলাল হাফিজ : বর্তমানে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়ছি, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পড়ছি, গীত বিতান পড়ছি, আলবেয়ার কাম্যুর আউটসাইডার আবার পড়ছি, তলস্।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।