সঠিক পথ খোজে বেড়াই কাজী জহিরুল ইসলাম
ভদ্রলোক তার নাম প্রকাশ করতে নিষেধ করায় নামটা লিখতে পারছি না: কিন্তু ঘটনাটা কিছুতেই না লিখে পারছি না। তিনি আমার স্ত্রীর খুব নিকটাত্মীয়। ২০০০ সালে দেশ ছেড়ে চলে আসেন আমেরিকায়। তখন তিনি বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কোনো এক অভিমান থেকে গত বারো বছর আর দেশে যাননি।
বর্তমানে নিউজার্সিতে বসবাস করছেন।
গত শনিবার সকালে সপরিবারে নিউইয়র্ক থেকে ড্রাইভ করে পৌঁছে যাই ভদ্রলোকের নিউজার্সির বাড়িতে। আটলান্টিক এখানে অনেকখানি ঢুকে গেছে লোকালয়ের বুক চিরে। জানালায় চোখ রাখলেই আটলান্টিকের নীল জলরাশি। গাছে গাছে বসন্তের ছোঁয়া, কচি সবুজ পাতারা পিট পিট করে চোখ মেলে তাকাতে শুরু করেছে।
ওদের সঙ্গে আমিও চোখ মেলে তাকাই, দেখার চেষ্টা করি পরাজিত শীতের রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্ন, যা এখনও লেগে আছে দু’একটি গাছের ন্যাড়া ডাল-পালায়।
ডাইনিং টেবিলে বসে যখন মেয়েরা আড্ডায় ব্যস্ত, আমি তখন ভদ্রলোকের মুখোমুখি ড্রয়িং রুমের সোফায়। আমি তার কিছুটা অতীত জানি, জানি তার পরিবারের ইতিহাসও। বায়ান্ন থেকে একাত্তর। এই ১৯ বছরের মহাকাব্যের অবধারিত অংশ তিনি নিজে এবং তার পরিবার।
তোমার জানার যখন এতই আগ্রহ তা হলে এক দিনের একটি ঘটনা তোমাকে বলি। এভাবেই তিনি বলতে শুরু করেন। ১৯৬২-৬৩ সালের কথা। আমি তখন ফজলুল হক হলের ছাত্র, কমিউনিস্ট পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি করি। মণি সিংয়ের নামে ওয়ারেন্ট।
তাকে অ্যারেস্ট করার জন্য পুলিশ দিনরাত খুঁজছে। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল মণি সিংহকে মোহাম্মদপুর থেকে নিয়ে শান্তিনগরে, মানিক মিয়ার কোনো এক আত্মীয়ের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার। সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান এবং মানিক মিয়া মণি সিংহের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। তখন সকাল এগারোটা বাজে। আমি মণি সিংহকে নিয়ে রিকশায় করে শান্তিনগরের পথে।
আমার দায়িত্ব হলো তাকে ওই বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে হলে চলে যাব, অথবা আশপাশে কোথাও ঘোরাফেরা করব। তিন ঘণ্টা পর আবার এসে তাকে ওখান থেকে তুলে মোহাম্মদপুরে পৌঁছে দেব। মণি সিংহ আমাকে বলেন, তোমার ফিরে যাওয়ার দরকার নেই; আমি তো ওদের চিনি, ওদের সঙ্গে আমার বনবে না। পাঁচ-দশ মিনিটেই আলোচনা শেষ হয়ে যাবে। তুমি আমার সঙ্গেই থাক, একেবারে আমাকে পৌঁছে দিয়েই হলে ফিরে যেও।
মণি সিংহকে মাঝখানে রেখে মানিক মিয়া এবং শেখ মুজিব দুই পাশে বসেছেন। আমি খানিকটা দূরে অন্য একটি সোফায়। মানিক মিয়া বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। মণি সিংহ বললেন, অসুবিধা নেই, ও আমার সঙ্গে এসেছে, ওর সামনেই আলোচনা চলতে পারে। আলোচনার শুরুতেই মানিক মিয়া বলেন, দাদা, সারা জীবন রাজনীতি করে তো কিছুই করতে পারেননি (আমার দিকে আঙুল তুলে), খালি এরকম দুই-চাইরটা কর্মী তৈরি করা ছাড়া।
আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। আসেন আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন গড়ে তুলি। ও (শেখ মুজিবকে দেখিয়ে) প্রাইম মিনিস্টার হোক। মণি সিংহ তখন একটা হাসি দিয়ে বলেন, উনি প্রাইম মিনিস্টার হলে তো প্রথমেই আমাকে অ্যারেস্ট করবেন। শেখ মুজিব তখন বলেন, এইটা আপনে কী কন দাদা, তাইলে তো আপনের সঙ্গে আলোচনায় বসতাম না।
মণি সিংহ খানিকটা হেঁয়ালির মতো করেই বলেন, পাকিস্তানিরা আপনাকে কখনোই প্রাইম মিনিস্টার হতে দেবে না। ওরা ফিউডালিজমের রাজনীতি করে, আর আপনি করেন মধ্যবিত্তের রাজনীতি। আপনাকে দিয়ে ওদের স্বার্থরক্ষা হবে না। শেখ মুজিব বলেন, তাইলে এখন কী করা যায়। মণি সিংহ মুহূর্তের মধ্যেই জবাব দেন, বাংলাদেশ স্বাধীন করেন।
একবারে তো আর স্বাধীন করা যাবে না। প্রথমে স্বায়ত্তশাসন, তারপর স্বাধীনতা—এভাবেই এগোতে হবে। মানিক মিয়া এবং শেখ মুজিব দু’জনই বলেন, তাইলে আমরা পার্টির নেতাদের সঙ্গে কথা বলি, পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর্মসূচি ঠিক করব।
এরই ধারাবাহিকতায় ছয় দফা কর্মসূচি আসে। ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টি তাতে সমর্থন দেয়।
আজকে যখন শেখ হাসিনা কথায় কথায় বলেন তার বাপই সব করেছে, আর কারও কোনো অবদান নেই, তখন খুব দুঃখ লাগে।
সুদূর আমেরিকায়, নীল আটলান্টিকের পাড়ে অভিজ্ঞতার আলোয় স্নাত একজোড়া চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের এমনি কত চরিত্র সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। জাতীয়ভাবে তাদের সম্মান জানাতে না পারলেও অন্তত আমি একটা স্যালুট ঠুকে নিজের ভার কিছুটা লাঘব করি।
নিউইয়র্ক : ১১.০৪.২০১২
লেখক : কবি, কলাম লেখক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।