আপডেট। আপগ্রেড। লাভ হোয়াট ইউ ডু। ডু হোয়াট ইউ লাভ।
আমার মাথার ভেতর চারপাশের একেকটা জিনিসকে বিচিত্র সব নাম দিয়েদিয়ে অভ্যাস; স্কুল থাকতে সবচাইতে উঁচু ছেলে যে তার নাম দিয়ে দেই আইফেল টাওয়ার; স্কুলের ছাদের পানির ট্যাংকির পাশে বড় ক্লাসের ছেলেমেয়েদের দেখি প্রেম করতেঃ এটির নাম তাই রাখা হল তাজমহল; স্কুলের চারপাশ দেয়াল দিয়ে ঘেরা- এটির নাম রেখে দিই ‘গ্রেট ওয়াল অফ চায়না’; ক্লাস ফাঁকি দিয়ে টিফিন পিরিয়ডে ছেলেপুলেরা গ্রেট ওয়াল অফ চায়না টপকে টপকে পালিয়ে যায়! এই অভ্যাস বড় বেলাতেও থেকে গেছে, একবার বাথরুম গেছি পকেটের মোবাইল প্যান্ট থেকে কমোডে গেল পড়ে; সেটি নিশ্চয়ই এমন কিছু সুখের ব্যাপার না আমি মুখ শুকনা করে আম্মার কাছে যাই- আম্মা-আব্বা একসাথ হয়ে টিভি দেখছেন; আমি মোবাইলের নাম রেখেছি ‘টাইটানিক’, শুকনামুখে আম্মাকে বলি টাইটানিক কমোডে পড়ে ডুবে গেছে! আম্মা নামের বিষয়টা জানেন আব্বার জানা নাই, তিনি সরুসরু সন্দেহের চোখে তাকান, বোঝা যায় ছেলের চিন্তা-জগৎ নিয়ে তার একটু একটু সন্দেহ হতে শুরু করেছে এবং ছেলের বিষয়ে আরো আগেআগেই খেয়াল কেন রাখেন নাই সেটি নিয়ে একরকম হতাশা বুকের ভিতর জায়গা করে নিতে শুরু করেছেন!
ছেলেবেলার বন্ধু ওয়াসিমের এইরকম একটা নাম বাহির করতে বেশি মাথা খরচা করা লাগে নাই; সে দিনরাত কম্পিউটারের সামনে বসে থাকে; তার কম্পিউটারের জান নাই থাকলে সেটির জন্যে ওয়াসিমের এই টান ভালবাসা দেখেদেখে সেটি নিশ্চয়ই ওয়াসিমের প্রেমে পড়ে যেত- কোন সন্দেহ নাই! কি একটা দিন তাদের বাসায় গেছি তাকে সোফার উপর পাওয়া গেল, তার উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম কোথাও কম্পিউটারের নিশানা পর্যন্ত নাই; বিষয়টি আমার জন্য নূতন তাই আমি একটু অবাক হয়ে তার পাশে বসে বলি, তোমার কি জ্বর?
ওয়াসিম গাঢ়স্বরে বলে, না।
আমি বললাম, পেট ব্যথা করছে?
ওয়াসিম একই আওয়াজে বলল, না।
আমি বললাম, তাহলে ক্ষুধা লেগেছে?
সে একটু গরম হয়ে বলল, আমার ক্ষুধা লাগে নাই পেট ব্যথা নাই জ্বর নাই কিছু নাই। তোমার সমস্যাটা কি?
আমি শুকনা গলায় বললাম, তোমার সামনে কম্পিউটার নাই তুমি একটা কিছু করছো না চুপ হয়ে বসে আছো এইটা জন্য নূতন তাই জিজ্ঞাস করছি।
ওয়াসিম বলল, কে বলল আমি কিছু করছি না। আমি নিজের ভিতর বাতাস থেকে অক্সিজেন নিচ্ছি তারপর কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাহির করে দিচ্ছি।
পরের কয়টা সেকেন্ড আমরা দু’জনেই চুপ হয়ে থাকি। আমি বিষয়টা মাথার ভিতর ওলট পালট করে দেখি ওয়াসিম আসলেও ঠিক।
আলোচনার ভিতর দিয়ে জানা গেল ওয়াসিমের আম্মা বলেছেন ওয়াসিম একটা পুরো দিন কম্পিউটার ছাড়া থাকতে পারবে না; ওয়াসিম গরম হয়ে বলেছে অবশ্যই পাড়বে এবং দশ মিনিটের মাথায় আবিস্কার করেছে এর চাইতে কঠিন কাজ তার জন্য আর দু’টা নাই; কিন্তু দুনিয়ায় করা যায় না এমন কিছু নাই এই রকম মহৎ বাণীতে উদ্দীপ্ত সে হাতে কিল মেরে আমাকে বলেছে সে কথা দিচ্ছে আগামী ২৪ ঘন্টা সে কম্পিউটারের ধারকাছ দিয়েও যাবে না গেলে যেন তার মাথা কেঁটে ফেলা হয়, একটু থেমে তাড়াতাড়ি যোগ করেছে মাথা কাঁটার দরকার নাই কিন্তু কথা যখন দিয়েছে- কথা সে অবশ্যই রাখবে! ওয়াসিম কথা রাখতে পারে নাই ৪ ঘন্টার মাথায় কম্পিউটারের সামনে আবিস্কার করা যায় এই রকম একটা কথা আমি পরে শুনতে পাই; মজার বিষয় হল আমাদের দেশ চালনা কর্তৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের বড় একটি অংশের বেলায় বিষয়টি প্রায় এক; কথা দেয়া হয়, কথা দেয়ার সময় তাদের মাথা এবং বুকে এই বিশ্বাসটি পুরোপুরি থাকে যেটি বলছেন সেটি আসলেও করে দেখাতে পারবেন এবং সময় পর হয়ে গেলে দেখা যায় সেটি অবশ্যই করা হয়নি। পুরো দোষ টুকু তাদের ঘাড় বরাবর চাপিয়ে দেয়া অনুচিত; এটি হলিউডের নামকরা সাই-ফাই সিনেমা নয় যে সুইচ চাপা হবে- এক রাস্তা চার ভাগ হয়ে নূতন চারটি ভাসমান রাস্তা দাড়া হয়ে যাবে- ট্রাফিক জ্যামের অসুবিধা আর নাই; কিংবা নূতন একটাকিছু মৌল আবিস্কার হয়ে গেল সেটি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ এখন পানির মত সোজাঃ দেশে বিদ্যুৎ সমস্যা আর নাই কিংবা একটি আইন নূতন চালু করা হয়েছে, জনসাধারণ সবার চিন্তাজগৎ কেন্দ্রীয় কম্পিউটার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়- প্রত্যেকের ম্যানুয়াল সেটিংসে নূতন আইনটি রেখে দেয়া হবে- সবাই সেটি মেনে চলবে! ট্রাফিক জ্যাম এড়াতে আমাদের নিজেদের ভূমিকাই সবচাইতে বেশি; বিদ্যুতের অপচয় রোধ বিষয়টিও বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে; একটি আইন সরকার কেবল প্রণয়নই করতে পারে- সেটি মেনে চলার দায় শেষ পর্যন্ত যার যার নিজের নিজের। গরু যেই ভাবে গরুর গাড়ি টেনেটেনে নিয়ে যায়, দেশ চালানোর ভার যাদের হাতে তারাও দেশটিকে সেইভাবে টেনেটেনে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন; তাদের দেয়া কথাগুলো বাস্তবায়িত করতে হলে আগে আমাদের নিজের নিজের কিছু কথা দেয়া লাগবে।
সেইগুলি কি?
বাংলা নূতন বছর এসেছে। আবার ভোর করে উঠুন, কাঁধের উপর আশি কেজি চালের বস্তা এই ভঙ্গিতে হেঁটেহেঁটে বাথরুম ঢুকুন, পান্তা খেতে খেতে চোখের কানি দিয়ে বৈশাখী শাড়ি পড়া মেয়েরা সারি বেঁধে হেঁটেহেঁটে যাচ্ছে নিজেদের ভিতর হেসেহেসে গল্প করছে, দুপুর বেলায় গোটা হয়ে বৎসরে প্রথম বারের মত বাংলা চ্যানেল দেখুন- সাথে গোশত-পোলাও তো অবশ্যই থাকবেঃ আপনার ভাই না হয় ছেলে বয়সী একজনের বৎসরের শুরুটুকু হয়তো কাঁটছে শুধু পানি খেয়ে- সেটি নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও চলবে; সারাদিন পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরুন দিন শেষে সেইটা আলমিরার সেই জায়গায় ভর্তি করে রাখুন যেই জায়গা টুকুতে বড় একটি সময় আপনার হাত পড়ার সুযোগ কম; সবই ঠিক আছে, অসুবিধা নাই- কেবল দিন শেষে একটি কথা নিজের কাছে নিজে রাখুন। সেটি কি?
পরের বার যখন শপিং মল, কিংবা বাড়ির পাশের দোকানটি থেকে এক বোতল পানীয় কিংবা জ্যুস কিনে নিয়ে আসবেন তখন খেয়াল করে দেখবেন- বোতলের গায়ে সেটির ভেতরের জিনিস কি কি দিয়ে তৈরি সেটি লিখা এবং কত তারিখ পর্যন্ত এটির মেয়াদ, মূল্যমান কত এই সব লিখে রাখা। খুব সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে এই বোতলটির সাথে আমাদের মানুষদের বেশিকিছু তফাত নেই; আমাদের নিজেদেরও দুনিয়াতে থাকার মেয়াদ নির্দিষ্ট, আমরাও নির্দিষ্ট কয়েকটি উপাদান দিয়ে তৈরি আমরাও দেশের জন্যে একেকজন মূল্যবান নাগরিক। চিন্তাটুকু প্রথম যখন আমার মাথায় এসছে তখন আমি বাসায় সোফার উপর বসা; একটা জ্যুসের বোতল হাতে ধরে রেখেছি- জ্যুস জিনিসটা খেয়ে ফেলার কথা আমি সেটি না করে এটি মুখের সামনে সোজা ধরে রেখে গভীর চিন্তার ভিতর ডুবে আছি এবং আমার চাচাতো ছোটভাই হাঁটুর সমান বয়স সে বোতলটুকু পাওয়ার জন্য এলোপাথারি ঘুষি-লাথ মেরে যাচ্ছে- কিন্তু চিন্তাটুকুকে একবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না!
তফাতটুকু হল, বোতলের মূল্যমান নির্দিষ্ট, সেটির মূল্য বাড়িয়ে না হয় কমিয়ে নেয়া যায় না, কিন্তু প্রতিটা মানুষ তার নিজের নিজের কাজের ভিতর দিয়ে নিজের মূল্য বাড়িয়ে না হয় কমিয়ে ফেলতে পারে।
একজন সুনাগরিক হওয়ার জন্য যে যে গুণগুলি দরকার সেগুলি নিজের ভেতর ধারন করার মধ্য দিয়ে মূল্য বাড়ানোর কাজটুকু অনেকখানি সহজ হয়ে যায়। বছর শুরুর এই দিনটি শেষে রাতে যখন ঘুমুতে যাচ্ছেন- তখন নিজের কাছে নিজে এই কথাটি দিতেই পারেন- এই নূতন বছরটি আপনি একজন সুনাগরিক হিসেবে, একজন মূল্যবান মানুষ হিসেবে নিজের কাছে নিজেকে প্রমানিত করবেন।
এই রকম ষোল কোটি প্রতিজ্ঞা দেশ চালানোর দায় যাদের হাতে তাদের কথা রাখার বিষয়টুকু অনেকটাই সহজ করে দিতে পারে! হোক না আপনাকে দিয়েই শুরু?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।