আমি একজন ভাবুক, আগ্রহী পাঠক, আর স্বপ্ন মাথায় নিয়ে বাস্তবকে মাড়াই । বাংলাদেশ কবি- ভাবুকের দেশ। এদেশে যেমন লালন-হাসন রাজাসহ অসংখ্য বাউল সাধক জন্ম নিয়েছে , তেমনি জন্ম নিয়েছে মধুসুধন, রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ এর মত প্রথিতযশা কবি । তাই বলা যায় আবহমান বাঙ্গালির যে ভাব চেতনা তা একান্তই কবির চেতনা। বাঙ্গালির ভাবনা মূলত কবিদের ভাবনা।
বাঙ্গালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল কাব্য আশ্রিত । কবির চোখেই বাঙালি জগত দেখে। বাঙ্গালির স্নায়ুতন্ত্র কবির মন্ত্রে দীক্ষিত। এমনি এক কবিপ্রজ মাটির সন্তান আসিফ নূর। স্থান-কালের কোয়ানটাম প্রভাব কবিতা নামক পদার্থের আকার-প্রকার গড়ে।
আধুনিক বাংলা কবিতার বাঁক- কাল-আদল বদলের একটি যাত্রা বিজ্ঞজনেরা লক্ষ্য করে থাকেন। এই যাত্রায় নতুন নতুন কবি যোগ দেয়। বলতে পারি নতুন নতুন কবি পয়দা হয়। নতুন কবির নতুন ভাষা, নতুন চিন্তা, নতুন শৈলী সৃষ্টি করে নতুন কোন অনুভূতি। নিয়ে আসে নতুন এক উপলব্দি।
দশক রীতিতে কবিতার কালিক পর্ব বিভাজন চলে,আরও চলে শিল্প- প্রকরণের ব্যবচ্ছেদ। কবিতার শিল্প-সৌন্দর্য বিচারের অনেক তরিকা আছে। কিন্তু, পণ্ডিতি ঘরানার স্থির কোন মাপকাঠি দিয়ে মাপতে গেলে কবিতার স্বাধীন শিল্প স্বত্তার প্রতি অবিচার করা হয়। তবু বলব, কবিতার সৌন্দর্য কবিতা-স্বত্তার মধ্যেই নিহিত। এদিক বিবেচনা করলে বলতে দোষ নেই যে আসিফ নূরের কবিতা শিল্প সৌকর্যে অনিন্দ্য।
অবিরত দার্শনিক প্রচেষ্টার মতই আসিফ নূরের কবিতায় সীমানা বিদারী যুগ চেতনা, চিরায়ত মানবিক সংকট ও শেকড় অন্বেষার কাব্যিক কারুকাজ লক্ষণীয়। দরিয়া নগরের বিশাল ক্যানভাসে লোকজ অনুষঙ্গ ও মোটিফে আঁকা ইমপ্রেশনিস্ট চিত্র কল্পের অপর নাম “আসিফ নূরের কবিতা”।
কয়েকছত্র উপস্থাপন করা যাক।
“সামনে পেছনে নয়, মন ছোঁড় সুদূরের অচিন সুন্দরে;
মগ্ন ধ্যানে অপলক দিগন্তের চোখে রাখো চোখ-
দেখো লাল-কাল –হলুদ-বেগুনি সব শুষে নিয়ে
কেমন প্রশান্ত নীলে মেখেছে সে দীঘল কাজল!
(দিগন্তের চোখে রাখো চোখ)
যাপিত জীবনের ক্ষণিক সংরাগ বাড়িয়ে দেয় পিছুটান। মানবিক সম্পর্কের রকমফের যোগ করে রকমারি বিড়ম্বনা।
অনাদি কালের স্রোতে তাই,বন্ধুকে কাছে না তাকানোর বারণ। বরং সুদূরের হাতছানি অপার সুন্দর। দুঃখ- গ্লানি সহ্য করে ঋষির মত জীবনই হবে শেষ পরিণতি, তা হবে প্রশান্ত নীলে দীঘল কাজল মাখা আকাশের মত সুন্দর। জীবনের দুঃখ -গরল হয়ে উঠে নিবিড় নীল। আকাশের দিকে তাকিয়ে এক প্রচ্ছন্ন জীবনের ছবি এঁকেছেন কবি।
এই অন্তরবয়ানের বাইরে কবি যে দৃশ্য এঁকেছে তা পাঠকের কাছে একেবারেই নতুন। এই কবিতাটি পাঠ না করলে আমরা হয়ত আকাশকে এভাবে অনুভব করতাম না। এরকম নতুন ভাব, নান্দনিক শৈলীতে, হৃদয় ছুঁয়া বর্ণনায় তুলে ধরতে সক্ষম আসিফ নূর ।
“বছর বছর যায়, চণ্ডী দশা ঠোঁটের ডগায়
আজও তো পাইনি কোন রজকিনী মীনের পরশ।
…………………………………………………………………………
যদি পাই, যদি পেয়ে যাই সোনালী মাছের পোনা
প্রেম ভোজে পুরে নেবো হৃদয় – উদরে”।
(মোরাকাবা )
এখানে কাঙ্খিত কোন প্রেমিকার জন্য প্রতীক্ষিত প্রেমিক। তার হৃদয় কপাট খোলা । আছে তারুণ্যসুলভ অনুরাগ ও প্রেম । সেই অনুরাগের ভাষা,উপমা ও চিত্রকল্পে রয়েছে সহজাত সংহতি। আবার সুফির ধ্যানের মত নিষ্ঠতা থেকে যেন উৎসারিত হয়েছে এক গভীর বোধ।
এ বোধ গভীর প্রেমের, কিছুটা দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের ও প্রতীক্ষণের অনড় ধৈর্য দ্বারা পরিশীলিত। কিন্তু খাঁটি প্রেমের মতই গভীর দরদি মন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ও না পাওয়ার বেদনায় উচাটন করে। তবে বিশ্বজয়ী বীরের পরাজয়ের মতই এখানে আত্মসমর্পণ আছে। তাই ধ্যানী যুবক আদর্শ প্রেমিকার স্বপ্ন ভুলে গিয়ে তুলে নেয় আটপৌরে সংসারী ললনার হাত।
আসিফ নূরের কবিতা আবেগিকভাবে জীবন্ত।
তার কবিতা আমাদের মনে আনন্দ- বেদনার অনুভূতি তৈরি করে। শিশুর হাসি যেমন আমাদের আনন্দে আন্দোলিত করে, তেমনি তার কবিতার গুঢ় আবেগ আমাদের অন্তর প্লাবিত করে। এই অন্তরপ্লাবী কবিতাগুলো স্থান-কালের নিজস্ব ভাবচেতনায় স্বার্থক শিল্পে রূপায়িত হয়েছে। যেমন-
“মুক্তিযোদ্ধা ? কে বলেছে শুধু এটুকুই আজ তোমার প্রধান পরিচয় ?
তার চেয়ে বড় কথা তুমি এক দেশ দর্শকের ভালবাসার নায়ক ;
জানো, পঙ্গু চরিত্রে তোমাকে এত বেশি মানায় যে সবারই দারুণ লাগে । “
( নন্দিত নাট্যকার )
বাংলা সাহিত্যে অনেক কবি আছে যাদের সচেতন দ্রোহ ও অবচেতন আকাঙ্খা থেকে, রক্ত গংঘায় সিক্ত হওয়া খাণ্ডব দাহন থেকে স্বাধীনতা এসেছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ইতিহাসের এক বর্ণাঢ্য অধ্যায় হয়েই আছে। কিন্তু যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন ভঙ্গের, অপ্রাপ্তির অন্তরদহন এবং করুণ সামাজিক পরিণতি ইতিহাসের এক নির্মম পরিহাস। এটি এমন একটি বাস্তবতা যা যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মকে পীড়িত করেছে গ্লানিময় রুদ্ধশ্বাসের মতই অসহ্য যন্ত্রণায়। এমন এক ঐতিহাসিক পরিহাস, নির্বিকার প্রজন্মের প্রতি অভিমানী দোষারোপ, আমাদের নৃতাত্ত্বিক ঔদাসিন্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কারণ যে নন্দিত বীরদের প্রযোজনায় মুক্তি যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছিল এবং স্বাধীনতা এসেছিল।
কবি ক্ষোভের সাথে লক্ষ্য করেছে সমাজ তাদেরকে নিয়ে কী করুণ তামাশা করেছে।
আসিফ নূরের কবিতায় গ্রামীণ মানুষের সংগ্রামী জীবন, ছিন্নমূল রূপজীবীর সংগ্রাম, প্রেম সন্ধানী ভাবুক প্রেমিক, মানুষের মুল্যবোধহীন মূর্খ জীবন অথবা নিছক প্রকৃতি – নিসর্গ কবিতার আঙ্গিকে রূপায়িত হয়েছে শৈল্পিক ছোঁয়ায়। তার কবিতায় ইম্প্রেশনিস্ট ছবির মতই বড় ক্যানভাসে আঁকা দৃশ্য চোখে পড়ে। কবি অতি সাধারণ উপাদানকেও তার বর্ণনার ও দৃশ্য তৈরির এক অনিবার্য অনুষঙ্গ করে নিয়েছেন। দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে এক ধরণের কূটাভাস তৈরিতেও পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন।
লক্ষ্য করা যাক-
“ ঢেউ ফণাদের আড়া- আড়ি আর দীঘল চরের সমান্তরাল
টলোমলো এই যাত্রায় তার ঘাম পিচ্ছিল পিঠ থেকে বারবার
অস্থির বিড়ালের মতো ছিটকে পড়ছে আসমানি টর্চের দ্যুতি।
.......................................................................................।
সূর্য ঘুরছে প্রতিদিন তবু ফিরছেনা তার ভাগ্য। “
(যাত্রা )
অথবা,
“ছিঁচকে ইঁদুরের মতো চোরের উৎপাতে
হঠাৎ সংকেতে বেজে উঠে হুইশেল,
পুলিশ ভ্যানের চোখে জ্বলজ্বলে তালাশের ক্ষুধা;
রুদ্ধশ্বাসে পতিতাটি হা-মুখ গলির পেটে ছুট।
( ভোরের পেন্সিল )
দরিয়া পাড়ের বিশাল ক্যানভাসে ইনানী পাহাড়ের বাঁশ শ্রমিকের পুরুষানুক্রমিক জীবিকা অর্জনের সংগ্রাম, ঘর্মাক্ত যুবকের পিঠে রোদের ঝিলিক, বাঁশের ভেলা সাগরে-নদীতে বয়ে মরিচ্যা বাজারে নেয়ার যে পথদৃশ্য তা অনেক দূর থেকেও যেন সুস্পষ্ট।
কবিতাটি পাঠ করেই পাঠক মনের আয়নায় দৃশ্যটি দেখতে পায়। এদিকে নগরীতে, রাতের অন্ধকারে রূপজীবীর উপর চোর- পুলিশের উৎপাত এবং তার গলির ভেতর পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যও জীবন্তভাবে বাঙময়।
জীবনানন্দ দাশের সাথে তুলনা করলে আসিফ নূরের কবিতায় সূক্ষ্ম কাব্য ভাষার বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ‘’হাওয়ার রাত’’ কবিতায় জীবনানন্দ বলেছেন- দিগন্ত প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে—আর “যাত্রা’’ কবিতায় আসিফ নূর লিখেছেন, --জোয়ান রোদের আড়দরিয়ায় যুবক ভাসায় ভেলা; স্পষ্টত “ বলীয়ান রৌদ্রের’’ চেয়ে “জোয়ান রোদের’’ কালিক ভাষা শৈলী অনেক সমৃদ্ধ।
মার্ক্সিস্ট ঘরানার সমালোচনাকারীদের মতে শিল্পের একটি বাস্তব দায়বোধ আছে।
এই দায়বোধ পুরুষ আধিপত্য, নৃতাত্ত্বিক কুসংস্কার ও তৃতীয় বিশ্বের বঞ্চনা মোকাবিলা করার জন্য। আসিফ নূরের কবিতায় এরকম দায়বদ্ধতা চোখে পড়ে। তাই তার কবিতা নান্দনিকভাবে স্বার্থক ও আদর্শগতভাবে দায়বদ্ধ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।