ব্যক্তিগত সহকারীর ‘অর্থ কেলেঙ্কারির’ দায় নিজের কাঁধে নিয়ে রেলমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
নানা নাটকীয়তার পর সোমবার রেলভবনে সংবাদ সম্মেলন করে ‘অব্যাহতি’ নেওয়ার এই ঘোষণা দেন মাত্র পাঁচ মাস আগে মন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়া সুরঞ্জিত।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “এই ঘটনায় আমার সম্পৃক্ততা না থাকার পরও আমি অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ”
পরে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেবেন বলেও সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এই সদস্য।
প্রায় ২০ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনের বেশিরভাগ সময় বিদায়ী রেলমন্ত্রীকে বিমর্ষ দেখা যায়।
তার স্বভাবসুলভ হাসিমুখ এদিন দেখা যায়নি।
সুরঞ্জিত হলেন বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন। এর আগে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ পদত্যাগ করেন।
গত ৯ এপ্রিল রাতে সুরঞ্জিতের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের গাড়িতে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাওয়ার ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর থেকে তা নিয়ে শোরগোল শুরু হয়। ফলে চাপের মুখে পড়েন রেলমন্ত্রী।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ওই রাতে ফারুকের সঙ্গে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া যায়। পূর্বাঞ্চল রেলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও তার কম্যান্ড্যান্ট এনামুল হকও সে সময় ওই গাড়িতে ছিলেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইউসুফ আলী মৃধাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়; চাকরিচ্যুত করা হয় ওমর ফারুক তালুকদারকে। এছাড়া কমান্ডেন্ট এনামুল হককেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ওমর ফারুক ও তার স্ত্রী মারজিয়া ফারহানার ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) জব্দ করার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিএনপিসহ বিভিন্ন দল থেকে সুরঞ্জিতের পদত্যাগের দাবি উঠলেও জবাবে সুরঞ্জিত বলেছিলেন, বিরোধী দল তাকে মন্ত্রীর পদ দেয়নি; তাই তাদের কথায় তিনি পদত্যাগ করবেন না।
তবে রোববার রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে আসার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। তখন থেকেই গুঞ্জন শুরু হয়- পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন রেলমন্ত্রী। সোমবার সকালে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে তার অনুপস্থিতিতে আরো জোড়ালো হয় সেই গুঞ্জন।
‘রেলমন্ত্রী’ পদত্যাগের ঘোষণা দিতে পারেন- এমন খবরে গণমাধ্যম কর্মীরা সকাল থেকেই রেল ভবনে জড়ো হতে থাকেন।
সংবাদ সম্মেলন বেলা ১২টায় শুরুর কথা থাকলেও সুরঞ্জিত রেলভবনে আসেন পৌনে ১টার পর। নিজের কক্ষে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর রেলের ডিজি আবু তাহের ও রেলসচিব ফজলে কবিরকে নিয়ে তিনি সম্মেলন কক্ষে পৌঁছান ১টা ১০এ।
“আজ আমি বেশি কথা বলতে পারব না। কোনো প্রশ্ন নেব না। প্রশ্নের উত্তরও দেব না”, এমন বক্তব্যেই রেলমন্ত্রীর বিদায়ী সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়।
জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে সুরঞ্জিত বলেন, সহকারীর অর্থ কেলেঙ্কারির দায় দায়িত্ব একান্তই তার, দল বা সরকারের নয়। ঘটনায় কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলেও গণতন্ত্রকে ‘আরো শক্তিশালী’ করতে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
“গত রোববার প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর আমি প্রায় ঘণ্টাকাল তার সাথে বৈঠক করেছি। বৈঠকে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার অব্যাহতির অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে তিনি তাতে সম্মতি দেন। ”
পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “গত ৯ই এপ্রিলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সর্বস্তরে একটি নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
নানা কথা হচ্ছে। যেহেতু এই ঘটনায় আমার এপিএস ও রেল মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তা নিয়োজিত ছিলো, তাই এই ঘটনার দায়দায়িত্ব আমার মন্ত্রণালয়ের ওপরই পড়ে। ”
৫০ বছরেরও বেশি সময় রাজনীতিতে জড়িত এই নেতা আফসোসের সুরে বলেন, “চল্লিশ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশে সবাই নানাভাবে উপকৃত হয়েছে। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, ৪০ বছরে কেউ আত্মত্যাগ করতে আসে নাই। ”
“আমি আমার জীবন সায়াহ্নে এসে এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছি”, যোগ করেন সুরঞ্জিত।
এই অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে নিজে কোনোভাবে জড়িত নন দাবি করে সুরঞ্জিত বলেন,
“দেশের বুদ্ধিজীবী ও আমার দলের ২/১ জন ছাড়া বেশিরভাগই প্রশ্ন করছেন- আমি দায়িত্বে থাকলে তদন্ত প্রভাবমুক্ত থাকবে কি না। ...গণতন্ত্রের মাত্রাকে আরো শক্তিশালী করতে এই ঘটনায় আমার দায়িত্ব নিতে হবে। ... এই ঘটনায় আমার সম্পৃক্ততা না থাকার পরও আমি অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ”
অবশ্য সুরঞ্জিতের ভাষায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা তার ‘যাত্রাবিরতি’।
“নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে রাজনীতিতে স্বচ্ছভাবে ফিরে আসব”, বলেন বিমর্ষ সুরঞ্জিত।
সংবাদ সম্মেলনের পর রেলভবনের ষষ্ঠ তলার সভাকক্ষে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বিদায়ী বৈঠক করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সেখানে তিনি গত কয়েক মাসে ‘অর্জিত’ রেলের গতি ধরে রাখার জন্য কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানান। অন্যদিকে কর্মকর্তরা বিদায় জানান তাদের পাঁচ মাসের মন্ত্রীকে।
বিকাল ৩টায় কালো রঙের একটি জিপে করে রেলভবন ত্যাগ করেন সুরঞ্জিত।
আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত গত ২৮ নভেম্বর রেলমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন।
স্বাধীনতার পর থেকে অধিকাংশ সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সুরঞ্জিতের এটাই প্রথম মন্ত্রিত্ব। শেখ হাসিনার গত সরকারে তিনি মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন।
দেড় দশক আগে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া সুরঞ্জিত দেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন। পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন কমিটির কো-চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।