Never argue with idiots. They bring you down to their level and then beat you with experience
"‘আনারসের হাসি’ নামে বশীর আল হেলালের একটি শিশুতোষ বই আছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে মো. জাহাঙ্গীর আলমের চোখের জলে সরে দাঁড়ানো আমাকে প্রায়-বিস্মৃত সেই বইটির নাম মনে করিয়ে দিয়েছে। দলের চাপে বা দলের কাছ থেকে কোনও বড় সুযোগ পাওয়ার প্রত্যাশায় দ্রোহী জাহাঙ্গীর মহাজোটসমর্থিত মেয়রপ্রার্থী আজমত উল্লা খানের কাছে বশ্যতা স্বীকার করলেও ব্যালট পেপারে তিনি আনারস প্রতীকসহই আছেন। মানে, তার সরে দাঁড়ানো অনেকটা রবীন্দ্রপ্রদত্ত ছোটগল্পের সংজ্ঞার মতো— ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। এই সরে দাঁড়ানোকে ব্যঙ্গ করে ব্যালট পেপারে হাসছে আনারস।
আনারসের ওই হাসিই জনমন।
দুই.
হাসছে গাজীপুর। শুধু গাজীপুর কেন, সারা বাংলাদেশেই এখন আনারসের হাসি। ৪ সিটি নির্বাচনে পছন্দের মেয়রপ্রার্থীদের ভরাডুবির পর গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে মহাজোট সরকার। শাপলা চত্বর থেকে বিতাড়িত হেফাজতে ইসলাম ছাড়াও এ নির্বাচনে ফ্যাক্টর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
সিঙ্গাপুরে এরশাদের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বৈঠক হয়েছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। বৈঠক যদি না-ও হয়, টেলিফোনে কথোপকথন যে হয়েছে, সে-ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। দেশে বসে ওইসব সিক্রেট কথা চলে না। গোয়েন্দাচালিত ট্র্যাকিং-ফ্র্যাকিংয়ের ভয় আছে। শোনা যাচ্ছে, খালেদা-এরশাদ বৈঠকে বা কথোপকথনে গুরুত্ব পেয়েছে গাজীপুর সিটি নির্বাচন।
এ নির্বাচন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের জন্যও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুঞ্জনগত কারণেই এরশাদকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে মহাজোট। এ দুশ্চিন্তার মধ্যেই জুটেছে আনারসের হাসি। কেন? সময় থাকতে জাহাঙ্গীরকে কব্জা করতে না-পারায় প্রতীকসহই রয়ে গেছে তার প্রার্থিতা। এদিকে খবরে প্রকাশ, গাজীপুরে পছন্দের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে ৫৭ এমপির একটি টিম গঠন করেছে মহাজোট।
হায় টিম, বিধ্বস্ত ডানার টিম (প্রিয় কবি জীবননান্দ দাশ, আপনার কালজয়ী ‘হায় চিল সোনালি ডানার চিল’ পঙিক্তটির প্যারোডি করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী)। কত দুর্যোগ এল-গেল, কোনও দুর্যোগেই জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ওই রকম কোনও টিম গঠন করতে দেখা যায়নি কোনও রাজনৈতিক দলকে। সব দেখে-শুনে হাসছে আনারস। হাসতে-হাসতেই ভোটারদের বলছে— জাহাঙ্গীর কেঁদে-কেঁদে আজমতকে সমর্থন দিয়েছে তো কী, আমি আছি ব্যালট পেপারে। যারা মহাজোট সরকারের দম্ভে বিরক্ত, তারা আমার গায়ে নির্দ্বিধায় সিল মারতে পারো।
যারা ১৮ দলীয় জোটের হরতাল-অবরোধে অতিষ্ঠ, তাদেরও সিল মারতে বাধা নেই। যারা বড় দুই দলের ‘চুদুরবুদুর’মুক্ত যথার্থ সংসদ ও সংসদীয় গণতন্ত্র চাও, আমি আনারস তাদের জন্যও আছি। ব্যালট পেপারে যারা ‘না’ ভোটের ঘর খুঁজছ, তারাও আমার গায়ে সিল মারতে পারো। পাস করি আর না-ই করি, আমি আনারসই জনমন।
তিন.
দলীয় সরকারের অধীনেও যে স্বচ্ছ নির্বাচন হয়, তার প্রমাণ হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা ইদানীং ৪ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কথা বলছেন।
কথাটি বলার সময় মহাজোট সমর্থিত মেয়রপ্রার্থীদের ভরাডুবির জন্য তারা লজ্জাবোধ করেন না। এ পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের এক এমপিকে দুদিন আগে প্রশ্ন করেছিলাম— আওয়ামী লীগ কি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আবারও সরকারগঠনে ইচ্ছুক নাকি নির্বাচন কমিশনগঠন করাই আপনাদের পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত সাধ? গাজীপুরে দলের সমর্থনপুষ্ট মেয়রপ্রার্থী আজমত উল্লাকে পাস করিয়ে আনতে যে ৫৭ এমপিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি তাদেরই একজন। আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর দেননি। কথায়-কথায় আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়েও কথা বলেছি সেই এমপির সঙ্গে। জনমন উপেক্ষা করায় সম্প্রতি আওয়ামী লীগের যে ভয়াবহ দরপতন ঘটেছে— উঠেছে সেই প্রসঙ্গও।
আমার কথায় তাকে কিছুটা বিমর্ষ মনে হয়েছে। তার সঙ্গে-থাকা আওয়ামীঅন্তপ্রাণ মানুষগুলোকে শুধু বিমর্ষই নয়, উদ্বিগ্নও হতে দেখেছি। বিমর্ষতা ও উদ্বেগ কাটিয়ে দলটি যে এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারে, ইচ্ছে ছিল সে বিষয়েও দু-একটি কথা বলার। কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের কাউকেই খুব বেশি আগ্রহী মনে হল না। তাদের ধ্যান-জ্ঞান এখন গাজীপুর।
চার.
সম্প্রতি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে ঠেকেছে। পুরোটা না-হলেও কথাটা আংশিক সত্য। রবীন্দ্রনাথের ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম’ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আওয়ামী লীগ যদি সামনের দিনগুলোয় গত সাড়ে চার বছরের ভুলগুলোকে একটু শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করত, দলের জন্য বোধকরি সেটা মঙ্গলজনকই হত। কিন্তু কথা এই যে, সময় খুবই কম এবং ভুল শোধরানো দূরে থাক, দলটি এখনও ভুলের পুনরাবৃত্তিই করে চলেছে।
কী সেই ভুল?— গত সাড়ে চার বছরে আপন অনেককে পর করেছে আওয়ামী লীগ।
ড. ইউনূসকে শায়েস্তা করতে গিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকে কর্মরত অনেক নারীকে দূরে ঠেলেছে দলটি। পুঁজিবাজার নিয়ে উল্টোপাল্টা বকে অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে অহেতুক পর করেছে। আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর পিপার স্প্রে ছুড়ে তাদের মধ্যে থাকা অনেক স্বজনেরও বিরাগভাজন হয়েছে দলটি। হেফাজতি দাবিতে ব্লগার-গ্রেপ্তারে নেমে পর করেছে গণজাগরণ মঞ্চের অনেক তরুণকেও। অন্যদিকে বিএনপি এখন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলছে।
জামায়াত-শিবির কাঁটা আর হেফাজতি কাঁটা ছাড়াও বিএনপির বড় অস্ত্র এখন আওয়ামী লীগের পর হওয়া আপনরা। শেষোক্ত অস্ত্রটি ছাড়া জামায়াতনির্ভর বিএনপির পক্ষে ছন্দে ফিরে আসা কঠিন ছিল। প্রকৃতি বড় নির্মম। সে মুক্তিযুদ্ধ বোঝে না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও না। আস্তিক-নাস্তিক নিয়েও তার মাথাব্যথা নেই।
চিরকালের প্রকৃতি চিরদিনই ভারসাম্যপ্রিয়। ক্ষমতা যখন দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে, প্রকৃতি তাকে নিজ হাতে দমন করতে আসে। প্রাকৃতিক নিয়মেই মামলা-গ্রেপ্তার জর্জরিত বিএনপি ফর্মে ফিরেছে। গত ১৫ জুন অনুষ্ঠিত ৪ সিটি নির্বাচন দলটিকে তার ফর্ম ফিরিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক আবহাওয়া বলছে, আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপির সহায়ক হতে পারে প্রকৃতি।
পাঁচ.
৪ সিটি নির্বাচনে মহাজোটের সমর্থনপুষ্ট প্রার্থীদের ভরাডুবির কারণ হিসেবে অনেকে হেফাজতে ইসলামের প্রচার-অপপ্রচারকে বড় করে দেখছেন। এটা আংশিক সত্য। কেননা ধর্মভিত্তিক এ সংগঠনের ব্যানারে জড়ো হওয়া কওমি মাদ্রাসাগুলো কখনোই আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক ছিল না। ৪ সিটিতে মহাজোটসমর্থিত প্রার্থীরা হেরেছেন আওয়ামী লীগের স্বভাবদোষে। ক্ষমতায় গেলে মিত্রকে শত্রু এবং আপনকে পর করাই দলটির স্বভাব।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ব্যাপক সমর্থন দিয়েছিল তরুণ ভোটাররা। তাদের প্রত্যাশা ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। সেই বিচার তরুণদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া মাত্র শাহবাগ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। গণজাগরণের তরুণরা এখন শাহবাগে না থাকলেও ঘরে-ঘরে জেগে আছে। হেফাজতি ভোট দলে টানতে গিয়ে আওয়ামী লীগ শাহবাগের তরুণদের পর করেছে।
নইলে ৪ সিটি নির্বাচনে মহাজোটসমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে ওই তরুণদের প্রচারণায় নামতে দেখা যেত। যেমনটি তারা নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে করেছিল। এছাড়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অহঙ্কারী আচরণ, লাগামহীন বাচালতা ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের স্বেচ্ছাচারিতা দলটিকে আরও-আরও স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ক্ষমতায় গেলে আত্মসমালোচনা দূরে থাক, সুহূদ-শুভানুধ্যায়ীদের সত্-সমালোচনাও সহ্য করতে পারে না আওয়ামী লীগ। আবার এ কথাও সত্য যে, বায়ান্নো, ঊনসত্তর, একাত্তর থেকে শুরু করে বাঙালির যা কিছু ঐতিহাসিক অর্জন, সব কিছুরই নেতৃত্ব দিয়েছে এই দলটি।
পাদটীকা
আওয়ামী লীগের নির্বাচনি প্রতীক নৌকা এবং বিএনপির ধানের শীষ। আগামী সংসদ নির্বাচন সময়মতো হবে কিনা এবং তাতে সব দল অংশগ্রহণ করবে কিনা, জানি না। তবে আশা করি, আগামী নির্বাচনে বড় দুটি দলই নিজ-নিজ প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করবে। সেই সুবাদে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ মৈমনসিংহ গীতিকায় বর্ণিত দুটি নদীর কথা মনে পড়ছে— ফুলেশ্বরী ও ভাটেশ্বরী। অনেকদিন হল, ফুলেশ্বরী নদীটি মজে গিয়ে ক্ষীণকায় নর্দমায় পরিণত হয়েছে।
সেখানে নৌকা দূরে থাক, কলার ভেলাও চরে না। আর ভাটেশ্বরী? যে-নদীতে একসময় বড়-বড় মহাজনি নৌকা চলাচল করত, সেখানে এখন মাঠ-মাঠ ধানক্ষেত। মানে এই যে, নদী মজে গেলে নৌকা অচল। মানে এই যে, নদী মজে গেলে নৌকার পরিবর্তে মাঠ-মাঠ ধানের শীষ।
ওই নদীই জনমন এবং ভাঙাগড়াই নদীর স্বভাব।
"
নদী মজে গেলে নৌকা অচল
| আবু হাসান শাহরিয়ার
নদী মজে গেলে নৌকা অচল ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।