[এই লেখাটি jamiatulasad.com এ প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকদের জানার প্রয়োজনে এখানে পোষ্ট করলাম]
প্রসঙ্গঃ ডাঃ জাকির নায়েক
[দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া]
সমস্যাঃ
সম্মানিত মুফতি সাহেবান, (আল্লাহ আপনাদেরকে দীর্ঘজীবি করুন)
জানার বিষয় হল ডা. জাকির নায়ক ব্যক্তিটি কেমন? তার আকিদা-বিশ্বাস কি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা-বিশ্বাসের সাথে সামাঞ্জস্যশীল? হাদিসের ব্যাখ্যা ও কুরআনের তাফসীরের ক্ষেত্রে তার মতামত কতটুকু গ্রহণ যোগ্য? এবং ফিকহ সাস্ত্রে তার মাযহাব কি? তিনি কোন ইমামের অনুসারী? আমরা তার আলোচনা শুনে তার উপর আমল করতে পারব কি না? দয়া করে সন্তুষজনক উত্তর দিয়ে ধন্য করবেন।
নিবেদক
রিয়াজ আহমদ খাঁন
আলিয়া প্রিন্টার্স, উত্তর সুইয়া, ইলাহবাদ, ভারত।
দৃষ্টি আর্কষণ
ডাঃ জাকির নায়েক সর্ম্পকে প্রতিনিয়ত ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন আসছেই, এই প্রশ্নটিও ঐ ধারবাহিকতার অংশ বিশেষ। এখানে তার আকিদা-বিশ্বাস ও মাযহাব এবং কুরআন-হাদিস সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মূল্যায়ন, বিস্তারিত আলোচনার আবেদন করা হয়েছে।
তাই, ডাঃ জাকির নায়কের আলোচনা ও রচনাকে সামনে রেখে একটি সবিস্তার সমাধান পেশ করা হল।
সমাধান
আল্লাহ তা‘য়ালাই তাওফীক দাতা ও তিনিই পদস্খলন থেকে রক্ষাকর্তা।
ডাঃ জাকির নায়ক সাহেবের বক্তব্য ও আলোচনায় বিশুদ্ধ আকিদা-বিশ্বাসের বিকৃতি, পবিত্র কুরআনের মনগড়া অপব্যাখ্যা, বিজ্ঞানের চুলচেরা বিশ্লেষণের আতঙ্ক, ইসলাম বিদ্ধেষী পশ্চিমা বিশ্বের চেতনা এবং ফিক্হি মাসায়িল সমূহে সালফে সালেহীন ও উম্মতের অধিকাংশ ওলামায়ে কিরামগণের মত ও পথ থেকে বিচ্যুতির মত ভ্রষ্টতা অনুভূত হয়।
এবং তিনি মুসলিম জাতিকে মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসরণ থেকে বিরত, দ্বীনি মাদরাসা সমূহ থেকে মানুষকে বিমুখ এবং হক্বানী ওলামায়ে কিরামদেরকে জনসাধরণের কাছে সন্দেহান্বিত ও হেয় প্রতিপন্ন করার অপ-প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। নিম্নে তার অসামানঞ্জস্যপূর্ণ কিছু আলোচনার উদাহরণ দেয়া হলো।
[এক] আকিদা সর্ম্পকে ডাঃ জাকির নায়ক সাহেবের কয়েকটি মন্তব্যঃ
আকিদা- অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়! তাতে সমান্য পদস্খলন অনেক সময় ঈমানের জন্য আশঙ্কাজনক হয়ে দাঁড়ায়। এই আকিদা সর্ম্পকে ডাঃ জাকির নায়ক সাহেবের মন্তব্য-
(ক)
‘বিষ্ণু’ ও ‘ব্রাহ্মম’ বলে আল্লাহ তা‘য়ালাকে ডাকা বৈধ।
ডাক্তার সাহেব এক প্রোগ্রামে আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন, “আল্লাহ তা‘য়ালাকে হিন্দুদের উপাস্যদের নামে ডাকা বৈধ, যেমন ‘বিষ্ণু অর্থ প্রভু এবং ‘ব্রাহ্মণ’ অর্থ সৃষ্টিকর্তা। তবে শর্ত হল এই বিশ্বাস রাখা যাবে না যে, বিষ্ণুর চারটি হাত রয়েছে এবং পাখির উপর আরোহিত” অথচ অনারবী ঐ সকল শব্দ দ্বারাই এক মাত্র আল্লাহ তা‘য়ালাকে ডাকা যায় যা কেবল মাত্র আল্লাহ তা‘য়ালার জন্যই নির্দিষ্ট। তা ব্যতীত অন্য কোন শব্দ যেমন বিষ্ণু, ব্রাহ্মণ [যা হিন্দুদের প্রতীক] তা দ্বারা আল্লাহকে ডাকা কোনভাবেই বৈধ নয়।
(খ)
আল্লাহ তা‘য়ালার কালাম (কুরআন শরিফ) বিজ্ঞান ও টেকনোলজী দ্বারা প্রমাণ
করা জরুরি।
ডাক্তর সাহেব এক প্রোগ্রামে বলেন, মানুষ মনে করে পবিত্র কুরআন মজিদ আল্লাহ তা‘য়ালার কালাম (বাণী)। কিন্তু কোনটি প্রকৃত আল্লাহর কিতাব তা জানতে হলে আপনাকে সর্বশেষ পরীক্ষা ‘আধুনিক বিজ্ঞান ও টেকনোলজী’ দ্বারা তা প্রমাণ করাতে হবে। যদি তা আধুনিক বিজ্ঞান সমর্থন করে তাহলে ধরে নিতে হবে তা আল্লাহর কিতাব । এ কথা দ্বারা ডাক্তার সাহেবের পবিত্র কুরআন সর্ম্পকে নির্ভীকতা ও চিন্তার বিপথগামীতা এবং অধুনিক বিজ্ঞানের প্রতি অতিভক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়।
তিনি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল অধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণাকে আসমানী কিতাব বিশেষত আল্লাহ তা‘য়ালার পবিত্র কালাম ‘কুরআন’ মজিদের সততা প্রমাণের মানদণ্ড সাব্যস্ত করেছেন। অথচ কুরআন মজিদ আল্লাহ তা‘য়ালার কালাম বা বাণী হওয়ার বড় প্রমাণ তার ‘ই‘জাজ’ বা তার মত রচনা থেকে মানুষকে অক্ষম করে দেয়া। এটা দিয়ে আল্লাহ তা‘য়ালা বিভিন্ন স্থানে চ্যাল্যাঞ্জ ঘোষণা করেছেন।
(গ)
ফতোয়া দেয়ার অধিকার সকলের রয়েছে
অন্যত্র ডঃ. জাকির নায়ক সাহেব বলেন, ‘যে কোন মানুষের ফতোয়া দেয়ার অধিকার রয়েছে’ কারণ ফতোয়া দেয়া মানে অভিমত ব্যক্ত করা ।
ফতোয়া মূলতঃ এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহঃ-এর ভাষ্যমতে, মুফতি আল্লাহ তা‘য়ালার বিধান বর্ণনায় তাঁরই ভাষ্যকার ও স্থলাভিষিক্ত হয়ে স্বাক্ষরের যিম্মাদার হয়ে থাকেন।
لم تصلح مرتبة التبليغ بالرواية والفتيا إلا لمن اتصف بالعلم والصدق………..وإذا كان منصب التوقيع عن الملوك بالمحل الذي لا يُنكر فضله ، ولا يُجهل قدره ، وهو أعلى المراتب السنيّات ، فكيف بمنصب التوقيع عن رب الأرض والسموات ؟ فحقيق بمن أُقيم في هذا المنصب أن يعد له عدته ، وان يتأهب له أهبته ، وأن يعلم قدر المقام الذي أُقيم فيه .
অর্থঃ আলিম ও সত্যবাদীরা ছাড়া অন্য কেউ হাদিস বর্ণনা ও ফতোয়ার যোগ্য নই_____। যখন পৃথিবীর রাজা-বাদশাহদের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পদমর্যদা অস্বীকার ও ভুলে যাওয়ার মত নয়, বরং তা সর্বোচ্চ সম্মান ও পদ হিসেবে বিবেচিত, তাহলে নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলের প্রভুর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মর্যদা কতইনা বড় হবে? প্রকৃত বিষয় হল, যাকে এই দায়িত্ব দেয়া হবে তাকে এব্যাপারে অভিজ্ঞ ও দক্ষ এবং এই পদমর্যদার তাৎপর্য অনুধাবনকারী হতে হবে।
ডাক্তার সাহেব ফতোয়াকে ‘অভিমত’ বলে একটি সাধারণ শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার মাধ্যমে শুধু নিজের জন্য নয় বরং অভিজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ সকলের জন্য ফতোয়ার দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন। এবং তিনি পবিত্র কুরআনের এই আয়াত-
فسئلوا اهل الذكر ان كنتم لاتعلمون
(অর্থ: যদি তোমরা না জেনে থাক তাহলে জ্ঞানীদের কাছ থেকে জেনে নাও) এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নের হাদিসটি সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেলেন;
من افتى بغيرعلم كان إثمه على من أفتاه
(অর্থাৎ যে ব্যক্তি পূর্ণ জ্ঞানী হওয়া ছাড়া (অশুদ্ধ) ফতোয়া দেয় ঐ (অশুদ্ধ) ফতোয়ার গুনাহ ফতোয়া প্রদানকারীর উপরই বর্তাবে।
[দুই] তাফসীরের মনগড়া ব্যাখ্যা তথা অর্থ বিকৃতি:
কুরআন মজিদের তাফসীরের বিষয়টি খুবই সুক্ষ্ম।
কেননা মুফাস্সির আয়াত থেকে আল্লাহ তা‘য়ালার উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট করেন যে, আল্লাহ তা‘য়ালা এই অর্থই বুঝিয়েছেন। তাই অযোগ্য লোকদের এ বিষয়ে পা রাখা অত্যন্ত বিপদজনক।
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে-
من قال في القرآن برأيه فليتبوأمقعده من النار
অর্থঃ যে ব্যক্তি মনগড়া কুরআনের তাফসীর করল সে জাহান্নামে আপন স্থান বানিয়ে নিল, (তিরমিযি শরিফ-২৯৫১)
তাই মুফাস্সিরের জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে। যেমন,
১. কুরআনের সকল আয়াতের উপর দৃষ্টি থাকতে হবে।
২. হাদীসের ভান্ডার থেকে সংশ্লিষ্ট প্রচুর হাদীসের জ্ঞান থাকতে হবে।
৩. আরবী ভাষা ও ব্যকরণ তথা নাহু, ছরফ, ইশতিক্বাক্ব, এবং অলঙ্কার শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য রাখতে হবে।
ডাক্তার সাহেবের মধ্যে এ সকল শর্তের একটিও যথাযথ ভাবে পাওয়া যায় না। তিনি আরবী ভাষা ও আরবী ব্যকরণ সর্ম্পকে যথাযথ পারঙ্গম নন। এবং হাদিস ভাণ্ডারের উপরও তার কোন গভীর পড়াশোনা নেই। আর আরবী সাহিত্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রেও তেমন পন্ডিত নন।
(নিম্নের উদাহরণ দ্বারা তা স্পষ্ট হয়ে যাবে)
অপরদিকে তাফসীরের ক্ষেত্রে বিপদগামী হওয়ার যত উপকরণ হতে পারে, সবকটিই তার মধ্যে বিদ্যমান, যেমন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়ীন থেকে বর্ণিত তাফসীর থেকে বিমুখিতা, অস্বাবাভিক আধুনিকতা এবং পবিত্র কুরআনের বিষয়বস্তুকে যথাযত অনুধাবনে অক্ষমতা ইত্যাদি। তাই অজ্ঞতার কারণে তিনি দশাদিক আয়াতকে শক্তিচর্চার ক্ষেত্র বানিয়েছেন। নিম্নে তার কিছু উদাহরণ দেয়া গেল।
প্রথম আয়াত:
الرجال قوامون على النساء
(অর্থ: পুরুষরা নারীদের উপর কৃর্তত্বশীল)
এর তাফসীর করতে গিয়ে বলেন, অনেকে বলেন ‘ক্বাওয়্যাম’ অর্থ এক স্তর উর্ধে হওয়া। কিন্তু বাস্তবে ‘ক্বাওয়্যাম’ শব্দটি ইক্বামাতুন শব্দ থেকে নির্গত।
‘ইক্বামাতুন’ অর্থ দাঁড়ানো। তাই ‘ইক্বামাতুন’-এর মর্ম হল যিম্মাদারিতে একস্তর উর্ধে হওয়া, সম্মান ও মর্যদায় উর্ধে হওয়া নয়।
ডাক্তার সাহেব পশ্চিমা বিশ্বের ‘সমানাধিকার’ নীতির সমর্থনে উক্ত আয়াতের মনগড়া তাফসীর করতে গিয়ে সম্মান ও মর্যদায় পুরুষের এক স্তর উর্ধে হওয়াকে অস্বীকার করেছেন। অথচ উম্মতের বড় বড় মুফাস্সিরগণ ‘সম্মান ও মর্যদায়’ শ্রেষ্ঠ হওয়ার কথা বলেন।
যেমন আল্লামা ইবনে কাসীর রহ.
الرجال قوامون على النساء
আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বলেন,
أي الرجل قيم على المرأة أي هورئيسها وكبيرها والمحاكم عليها،مؤدبها إذااعوجت
অর্থ: স্ত্রীর কাছে স্বামীর অবস্থান শাসনকর্তা ও সরদারের ন্যায়।
প্রয়োজনে স্বামী স্ত্রীকে উপযুক্ত সংশোধনও করতে পারবেন। এবং
وللرجال عليهن درجة
এর তাফসীরে লিখেন-
وللرجال عليهن درجة أي في الفضيلة في الخلق والمنزلة وطاعة الأمروالإنفاق والقيام بالمصالح والفضل في الدنيا والآخرة
অর্থঃ স্বামী স্ত্রী থেকে সম্মান, মর্যদা, অনুকরণ ইত্যাদিতে এক স্তর উর্ধে। এবং ডাক্তার সাহেবের এই তাফসীর রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নের হাদিসটির সম্পুর্ণ বিপরীত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لوكنت آمرأحداأن يسجد لأحد،لأمرت النساء أن يسجدن لأزوجهن
অর্থঃ যদি আল্লাহ তা‘য়ালা ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করার নির্দেশ দিতাম, তাহলে আমি মহিলদেরকে আপন আপন স্বামীকে সিজদা করার আদেশ দিতাম। (আবু দাউদ)
যদি স্বামী-স্ত্রী উভয় জন সাম্মান ও মর্যদায় সমান এবং স্বামীর মর্যদা স্ত্রীর উর্ধে না হতো তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদেরকে সিজদা (যা সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতীক) করার কেন আদেশ দিয়েছিলেন?
দ্বিতীয় আয়াত
ويعلم ما في الارحام
ডাক্তার সাহেবের কাছে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে যে মাতৃগর্ভে নবজাত শিশুর লিঙ্গ কেবল মাত্র আল্লাহ তা‘য়ালাই জানেন। কিন্তু এখন বিজ্ঞান অনেক উন্নতি করেছে, আমরা আল্ট্রাসনুগ্রাফীর মাধ্যমে নবজাতকের লিঙ্গ নির্ধারণ করে থাকি।
কুরআনের এই আয়াত কি মেডিকেল সাইন্সের বিপরীত নয়?
তার উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি সত্য যে, অনেকেই এই আয়াতের তরজমা ও ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে, “কেবল আল্লাহ তা‘য়ালাই জানেন মাতৃগর্ভে নবজাতকের লিঙ্গের কথা”। কিন্তু এই আয়াতের বর্ণনা ভঙ্গির প্রতি গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এখানে ইংরেজী শব্দ (ংবী) এর অর্থ প্রদানকারী কোন শব্দ নেই। মূলতঃ কুরআন যা বলতে চাই তা এই যে, মাতৃগর্ভে কি আছে তা আল্লাহ জানেন। বহু সংখ্যক মুফাস্সিগণ এখানে ভুলের শিকার হয়েছেন। তারা বলেছেন ‘মাতৃগর্ভে নবজাতকের লিঙ্গ আল্লাহই জানেন’ এটি অশুদ্ধ।
এই আয়াতটি নবজাতকের লিঙ্গের দিকে ইঙ্গিত করে না। বরং তা থেকে উদ্দেশ্য হল এই নবজাতকের স্বভাব কেমন হবে, সে ছেলেটি মাতা-পিতার জন্য রহমত হবে না অভিশাপ? ইত্যাদি। ডাক্তার সাহেব অধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তার একটি অভিযোগের উত্তর দেয়ার জন্য কুরআনের অন্য আয়াত ও সাহাবী-তাবেয়ী থেকে বর্ণিত তাফসীরকে পশ্চাপদ রেখে একটি সু-প্রশিদ্ধ অর্থকে অস্বীকার করে দিলেন। এবং বড় বড় মুফাসসিরীনদের উপর অভিযোগ করে তাদেরকে ভ্রান্তিতে নিক্ষেপ করলেন।
ডাক্তার সাহেব যে ব্যাখ্যা করেছেন তা ما موصوله’-এর ব্যাপকতায় আসতে পারে।
আনেক মুফাস্সিরগণ সম্ভাবনা হিসাবে প্রথম অর্থের সাথে এটিকেও যোগ করেছেন। কিন্তু অন্য অর্থকে বিলকুল অশুদ্ধ বলা, ডাক্তার সাহেবের গবেষণায় ঘাটতি ও অমনযোগিতা এবং তাফসীরের ক্ষেত্রে সাহাবা-তাবেয়ীদের মতামতকে অবমূল্যায়নের বড় প্রমাণ। কেননা ডাক্তার সাহেব যে অর্থকে অস্বীকার করছেন তার প্রতি সুরায়ে রা‘দের আট নাম্বার আয়াত ইঙ্গিত করছে।
الله يعلم ما تحمل كل أنثى وما تغيض الارحام وما تزداد
অর্থঃ আল্লাহ তা‘য়ালা সবকিছুর খবর রাখেন; যা মাতৃগর্ভে থাকে তার, এবং যাকিছু মায়ের পেটে কম-বেশী হয় তার ।
এবং প্রশিদ্ধ তা‘বেয়ী, তাফসীর শাস্ত্রের ইমাম হযরত কাতাদাহ রহ. থেকেও এই অর্থই বর্ণিত।
যেমন তিনি বলেন,
فلاتعلم مافي الارحام أذكر أم أنثي الخ
অর্থঃ মাতৃগর্ভে ছেলে না মেয়ে তার বাস্তব জ্ঞান আল্লাহ তা‘য়ালা ব্যতীত অন্য কারো কাছে নেই। তেমনি আল্লামা ইবনে কাসীর রহঃ রূহুল মা‘য়ানীর ষষ্ট খন্ডের ৩৫৫ পৃষ্টায় এবং আল্লামা নাসাফী রহঃ তাফসীরে মাদারিকের তৃতীয় খন্ডের ১১৬ নং পৃষ্টায় এবং আল্লামা শাওকানী রহ. তাফসীরে ফাতহুল কাদীরের পঞ্চম খন্ডের ৪৯৮ নং পৃষ্টায় উপরোক্ত আয়াতের এই অর্থই বলেছেন।
কিন্তু ডাক্তার সাহেব এই সকল শীর্ষ মুফাসসিরগণের অর্থকে অশুদ্ধ বলে নিজের পক্ষ থেকে বর্ণনাকৃত অর্থকেই একান্ত— বিশুদ্ধ মনে করে তার উপরই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
উল্লেখিত প্রশ্নের বিশুদ্ধ জবাবঃ
আয়াতের উদ্দেশ্য আল্লাহ তা‘য়ালার জন্য ‘ইলমে গায়ব’ বা অদৃশ্যের জ্ঞান সাব্যস্ত করা। বস্তুত ‘ইলমে গায়ব’ বলা হয় ঐ দৃঢ় ও নিশ্চিত জ্ঞানকে যা কোন বাহ্যিক উপকরণ ছাড়া, যন্ত্র ব্যতীত সরাসরি অর্জিত হয়।
মেডিকেল সাইন্সের যন্ত্র দ্বারা ডাক্তারদের অর্জিত জ্ঞান দৃঢ়-নিশ্চিত জ্ঞানও নয় আবার উপকরণ ছাড়াও নয়; বরং তা একটি ধারণা প্রসূত জ্ঞান মাত্র; যা যন্ত্র দ্বারা অর্জিত হয়। অতএব আল্ট্রাসোনুগ্রাফী দ্বারা অর্জিত এই ধারণা প্রসূত জ্ঞান দ্বারা পবিত্র কুরআনের আয়াতের উপর কোন ধরণের অভিযোগ উত্থাপন করা যাবে না।
তৃতীয় আয়াত
ياايها النبي اذاجاءك المومنات يبايعنك على أن لايشركن بالله شيئا
অর্থঃ হে নবী আপনার নিকট মু‘মিন নারীরা এসে আনুগত্যের শপথ করে যে, তারা আল্লাহ তা‘য়ালার সাথে অংশিদার সাব্যস্ত করবে না,_________ তখন তাদের আনুগত্য গ্রহণ করুন।
ডাক্তার সাহেব এই আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বলেন, এখানে ‘বায়আত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তাই ‘বায়আত’ শব্দে বর্তমানে আমাদের ইলেক্শনের অর্থও অন্তর্ভুক্ত।
কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিকে আল্লাহ তা‘য়ালার রাসুল ছিলেন, অপরদিকে রাষ্ট্র প্রধানও ছিলেন। এখানে ‘বায়াআত’ থেকে ঐ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অনুমোদন উদ্দেশ্য। ইসলাম ঐ যুগে নারীদেরকে ভোটাধিকার প্রদান করেছিল ।
এখানে ডাক্তার সাহেব আয়াতের অপ-ব্যাখ্যার মাধ্যমে মহিলাদের ভোটাধিকার প্রমাণ করতে চাচ্ছেন; তিনি বলেন, মহিলারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে ‘বায়আত’ গ্রহণ করা; মূলত বর্তমান গণতন্ত্রের নির্বাচন পদ্ধতির প্রাচীন পদ্ধতি।
অথচ গণতন্ত্র সর্ম্পকে যারা অবগত তারা ভালভাবেই জানেন যে, ডাক্তার সাহেবের এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবতা বিরোধী, এবং তাফসীরের ক্ষেত্রে যুক্তির অপ-প্রয়োগ মাত্র।
কেননা বর্তমান গণতন্ত্রে রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচন করার জন্য আপন আপন ভোটাধিকার প্রয়োগ করার অধিকার সকলের রয়েছে ঠিক তবে যদি কোন ব্যক্তি সংখ্যাগরিষ্ট লোকের ভোট না পায় তাহলে তিনি রাষ্ট্র প্রধান হতে পারবেন না। কিন্তু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে এটা অসম্ভব যে, তিনি সংখ্যাগরিষ্ট লোকদের ভোট না পেলে রাষ্ট্র প্রধান হতে পারবেন না। ‘বায়আত’ গ্রহণ যদি ভোট নেয়া হতো তা হলে ঐ মহিলা সাহাবীয়্যাদের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাষ্ট্র প্রধান মেনে নেওয়া ও না নেওয়া উভয়টির অধিকার থাকা উচিত ছিল। অথচ ঐ মহিলাদের না মানার কোন সুযোগ ছিলনা। (তাহলে তা দ্বারা মহিলাদের ভোটাধিকার প্রমাণ হয় কেমনে?)
চুতুর্থ আয়াতঃ
সুরায়ে মারয়ামের আটাশ নাম্বার আয়াত-
ياأخت هارون ما كان ابوك إمرأسوء وما كانت أمك بغيا
উক্ত আয়াতের উপর প্রশিদ্ধ প্রশ্ন; “হযরত মারয়াম আঃ হযরত হারুন আঃ-এর বোন ছিলেন না, উভয় জনের যুগের মধ্যে প্রায় এক হাজার বছরের ব্যবধান রয়েছে”।
এর অজ্ঞতাবশত উত্তর দিতে গিয়ে বলেন, ‘‘ খৃষ্টান মিশনারীরা বলেন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যীশুখৃষ্টের মাতা মেরী (সধৎু-মারয়াম) ও হারুনের বোন মারয়ামের মধ্যে প্রার্থক্য জানা ছিল না”
অথচ আরবী ভাষায় ‘উখত’ বলতে সন্তানকেও বুঝায়। এ জন্য লোকেরা তাকে বলেছিল হে হারুনের সন্তান, বাস্তবেও তা থেকে হারুন আঃ-এর সন্তান উদ্দেশ্য।
ডাক্তার সাহেবর হাদিস ও ভাষা সর্ম্পকে অজ্ঞতা ও অনিভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল এই বক্তব্যের সমালোচনার জন্য মুসলিম শরীফের নিম্নের হাদিসটি যথেষ্ট।
سألته عن ذلك، فقال: إنهم كانوا يسمّون بأنبيائهم والصالحين عن المغيرة بن شعبة؛ قال: لما قدمت نجران سألوني فقال: إنكمقبلهم تقرؤون “يا أخت هارون” وموسى قبل عيسى بكذا وكذا، فلما قدمت على رسول الله
অর্থঃ হযরত মুগিরা ইবনে শু‘বা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি যখন নাজরানে গেলাম তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তোমরা পড় ‘‘ইয়া উখতা হারুন’’ ‘‘হে হারুনের বোন’’ অথচ মুসা আঃ এর যুগ ঈসা আঃ-এর যুগের অনেক পূর্বের। অতপর আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে তার ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করলাম।
তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারা (তখনকার লোকেরা) নবীগণ ও যোগ্য উত্তরসুরীদের নামে নিজেদের নাম করণ করতেন। (মুসলিম শরিফ)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত আয়াতের স্পষ্ট ব্যাখ্যা আজ থেকে চৌদ্দশত বছর পূর্বে দিয়েছেন। তার সারাংশ হল হযরত ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাতা হযরত মারয়াম আলাইহাস্ সালাম হযরত মুছা আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভাই হারুন আলাইহিস্ সালাম-এর বোন ছিলেন না; বরং হযরত ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাতার ভায়ের নামও হারুন ছিল। এবং তারা নবীগণ ও নির্বাচিত জ্ঞানতাপসদের নামে নিজেদের নামকরণ করতেন। অতএব একথা স্পষ্ট যে, এ কোন নতুন অভিযোগ নয়; যার উত্তর নিজের পক্ষ থেকে তৈরী করে দিতে হবে।
তাফসীর সর্ম্পকিত হাদিস ভাণ্ডার থেকে ডাক্তার সাহেব এতটুকু অবগত নন যে, হাদিস দ্বারা তার প্রকৃত সমাধান বের করার চেষ্টা না করে নিজের পক্ষ থেকে মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করেছেন।
পঞ্চম আয়াতঃ
والارض بعد ذلك دحاها
ডাঃ জাকির নায়ক সাহেব সুরায়ে নাযি‘আতের ত্রিশ নাম্বার আয়াত সর্ম্পকে বলেন, এখানে ডিমের জন্য ব্যবহৃত শব্দ ‘দাহা’-এর অর্থ উটপাখির ডিম। উটপাখির ডিম জমিনের সাদৃশ্য। তাই পবিত্র কুরআন বিশুদ্ধভাবে পৃথিবীর আকৃতির ব্যাখ্যা করছে। অথচ কুরআন নাযিলের সময় পৃথিবীকে (ঋষধঃ) সমতল মনে করা হতো ।
এখানে ডাক্তার সাহেব বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এবং পবিত্র কুরআনের আলোচ্য বিষয় (তাওহীদ ও রিসালত, প্রাকৃতিক বিষয়াদির আলোচনা প্রাসঙ্গিক মাত্র) প্রতি দৃষ্টিপাত না করে পৃথিবীর আকৃতির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আয়াতের অপ-ব্যাখ্যার মাধ্যমে মনগড়া তাফসীর পেশ করেছেন।
কেননা, আরবী ভাষায়-دحـــو শব্দটির ধাতুতে বিস্তৃত ও বিস্তীর্ণ করার অর্থ বিদ্ধমান। এই অর্থে ‘দাহাহা’-এর অনুবাদ ও তাফসীর হল ‘পৃথিবীকে বিস্তৃত করা ও তাতে বিদ্ধমান বস্তু সমূহকে সৃষ্টি করা’। (তাফসীরে ইবনে কাসীর) এই শব্দটি ‘ডিমের’ অর্থে নয়।
[তিন] হাদীসে নববীতে অজ্ঞতা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশাল হাদিস ভাণ্ডার সম্পর্কে ডাক্তার সাহেবের অজ্ঞতার কারণে অনেক জায়গায় তিনি বিশুদ্ধ হাদিসের বিপরীত মাস্আলা বলে থাকেন।
এবং বহু মাস্আলা সর্ম্পকে অনেক হাদিস বিদ্যমান থাকা সত্তেও তিনি বলে দেন ‘এই বিষয়ে কোন ‘হাদিস’ দলিল নেই’। নিম্নে কয়েকটি চুড়ান্ত মাসআলার উদাহরণ দেয়া গেল, যে মাসআলা সম্পর্কে ডাক্তার সাহেব হাদিস না জেনে, বা জানার পরও অজ্ঞতার ভান করে অনেক শীতলতা প্রর্দশন করেছেন ।
(ক)
হায়েয অবস্থায় মহিলাদের কুরআন পড়ার অনুমতি
এক প্রোগ্রামে ডাক্তার সাহেব মহিলাদের বিশেষ দিন (হায়য চলাকালীন সময়) সম্পর্কে বলেন, ‘কুরআন হাদিসে নামায মাফ হওয়ার কথা আছে; কিন্তু (মহিলারা হায়য অবস্থায়) কুরআন পড়তে পারবে না’ এই মর্মে কোন হাদিস নেই।
অথচ তিরমিযি শরিফে স্পষ্ট আছে-
لاتقرأ الحائض ولاالجنب شيئا من القرآن
অর্থঃ জুনুবী ব্যক্তি ও হায়য অবস্থায় মহিলারা কুরআন মজিদ পড়বে না।
বিশুদ্ধ ও স্পষ্ট হাদিস বিদ্যমান থাকা সত্তেও সর্বজ্ঞ দাবী করে তা অস্বীকার করা খুবই ভাবার বিষয়।
(খ)
রক্ত বের হলে অজু ভাঙ্গার ব্যাপারে ‘হানাফী মাজহাবের’ কোন দলিল নেই
ডাক্তার সাহেব এক অনুষ্ঠানে রক্ত বের হলে অজু ভাঙ্গা-না ভাঙ্গার ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘কতিপয় ওলামায়ে কিরাম বিশেষত হানাফী মাযহাবের অনুসারী ওলামায়ে কিরামের মতে রক্ত বের হলে অজু ভেঙ্গে যায়। নামাযের মধ্যখানে রক্ত বের হলে কি করতে হবে, এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, তার ফতোয়া (হানাফীদের ফতোয়া) এক প্রকারের বাড়াবাড়ি, অথচ এই মাযহাবের স্বপক্ষে স্পষ্ট কোন দলিল নেই’
এখানে ডাক্তার সাহেব ফিকহে হানাফীর সংশ্লিষ্ট ওলমায়ে কিরামের বিরোদ্ধে অভিযোগ করলেন যে, তারা বিনা দলিলে অজু ভাঙ্গার কথা বলেন। অথচ রক্ত বের হলে অজু ভাঙ্গার স্বপক্ষে অসংখ্য হাদিস রয়েছে, এবং সাহাবায়ে কিরামের আমলও তার উপর ছিল। নিম্নে তার কিছু বর্ণনা তুলে ধরা হল।
(১)
أخرج البخاري عن عائشة رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا , حَدَّثَتهُ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ أَبِي حُبَيْشٍ جَاءَتْ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَكَانَتْ تُسْتَحَاضُ ، فَقَالَتْ : يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي أُسْتَحَاضُ فَلا أَطْهُرُ ، أَفَأَدَعُ الصَّلاةَ أَبَدًا ؟ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” إِنَّمَا ذَلِكَ عِرْقٌ ، وَلَيْسَتْ بِالْحَيْضَةِ ، فَإِذَا أَقْبَلَتِ الْحَيْضَةُ فَاتْرُكِي الصَّلاةَ ، وَإِذَا أَدْبَرَتْ فَاغْسِلِي عَنْكِ الدَّمَ وَصَلِّي. قال هشام : قال أبي ثم توضئي لكل صلاة حتي يجيئ ذلك الوقت.
অর্থঃ হযরত আয়শা রা. বলেন, হযরত ফাতেমা বিনতে আবি হুবাইশ রা. হায়য অবস্থায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমি হায়য হলে (দশ দিনের পরও) পবিত্র হই না।
(দশ দিনের পরও) কি নামায ছেড়ে দিব? উত্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইহা তো শরীরের ঘাম, হায়য নয়। হায়য হলে নামায পড়বে না। আর হায়য বন্ধ হয়ে গেলে রক্ত ধুয়ে নামায পড়বে। হিসাম বলেন, আমার পিতা বলেন, অতপর প্রত্যেক নামাযের জন্য অজু করবে, আর এই অজু ওয়াক্ত বাকি থাকা পর্যন্ত অব্যহত থাকবে। ( বুখারি শরিফ)
(২)
اذارغف احدكم في صلاته فلينصرف فليغتسل عنه الدم ثم ليعدوضوءه ويستقبل صلاته أخرجه الدارقطني.
অর্থঃ নামাযের মধ্যে যদি কারো নাক থেকে রক্ত বের হয় তখন সে রক্ত ধুয়ে পুনরায় অজু করবে।
(৩)
عن زيدبن ثابت –رضي الله عنه- الوضوء من كل دم سائل. أخرجه ابن عدي في الكامل
অর্থ: প্রবাহিত রক্তের কারণে অজু করতে হয়।
এছাড়া আরো অনেক হাদিস থাকা সত্তেও ডাক্তার সাহেব আপন অজ্ঞতাকে গোপন করে মুজতাহিদ সেজে বলে দিলেন, ‘রক্ত দ্বারা অজু ভাঙ্গার ব্যাপারে কোন দলিল নেই’।
(গ)
নারী-পুরুষের নামাযে পার্থক্য অবৈধ
অন্য এক জায়গায় ডাঃ জাকির নায়ক সাহেব নারী-পুরুষের নামাযে পার্থক্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘কোথাও একটি সনদবিশিষ্ট বিশুদ্ধ হাদিস পাওয়া যায় না যেখানে নারীদেরকে পুরুষ থেকে পৃথক নামায আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তার পরির্বতে বুখারী শরিফে বর্ণিত যে, হযরত উম্মে দারদা রাঃ বলেন, আত্তাহিয়্যাতের বৈঠকে মহিলারা পুরুষের ন্যায় বসবে’’।
এখানে ডাক্তার সাহেব সরাসরি দুইটি ভুলের শিকার হয়েছেন:
(ক) নারী-পুরুষের নামাযে কোন পার্থক্য নেই।
(খ) হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদেরকে পুরুষের ন্যায় বসতে বলেছেন।
ডাক্তার সাহেব প্রথম কথা বলে ঐ সকল হাদিস অস্বীকার করে বসল যার মধ্যে নারী-পুরুষের নামাযে পার্থক্যের কথা রয়েছে। নিম্নে তার কিছু উল্লেখ করা হয়েছে।
(১)
أخرج البخاري عن النبي – عليه السلام- أنه قال: يا أيها الناس ما لكم حين نابكم شيء في الصلاة أخذتم في التصفيق إنما التصفيق للنساء
অর্থঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হে লোক সকল, তোমাদের কি হল? নামাযে কোন অসুবিধা দেখলে করতালি দাও; করতালি তো একমাত্র মহিলাদের জন্যই। (বুখারি শরিফ)
(২)
عن وائل بن حجر قال لي رسول الله صلى الله عليه وسلم يا وائل بن حجر! إذا صليت فاجعل يديك حذاء أذنيك والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها.
অর্থঃ হযরত ওয়ায়েল ইবনে হাজার রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেন, হে ওয়ায়েল, নামায পড়ার সময় হাত কান পর্যন্ত উঠাও আর মহিলারা সিনা পর্যন্ত উঠাবে।
(তাবরানী )
(৩)
عن يزيد بن أبي حبيب أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر على امرأتين تصليان فقال : إذا سجدتما فضما بعض اللحم إلى الأرض ، فإن المرأة ليست في ذلك كالرجل
অর্থঃ হযরত ইয়াযিদ ইবনে আবি হাবীব রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযরত দুই মহিলার পাশ্ব দিয়ে গমন করছিলেন, তখন (তাদেরকে উদ্দেশ্য করে) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সিজদা অবস্থায় শরীরের কিছু অংশ মাটির সাথে মিলিয়ে দাও। কেননা, এই ক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষের মত নয়। (আবু দাউদ শরিফ)
(৪)
سئل ابن عمر كيف كن النساء يصلين على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : كن يتربعن ثم أمرن أن يتحفزن
অর্থঃ হযরত ইবনে উমর রা. থেকে জিজ্ঞাসা করা হল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মহিলারা কিভাবে নামায পড়তেন? তিনি বলেন, তারা এক পায়ের উপর বসে আরেক পা খাড়া করে আড়াআড়িভাবে বসতেন, পরে উভয় পা বিছিয়ে নামায পড়ার আদেশ দেয়া হয়। (জামিউল মাসানিদ)
এ সকল বর্ণনায় নারী-পুরুষের নামাযে বিভিন্ন ধরণের পার্থক্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও আরো অনেক হাদিস রয়েছে, এই বিষয়ে রচিত কিতাবাদীতে দেখা যেতে পারে।
এবং দ্বিতীয় বিষয় অর্থাৎ বুখারী শরিফে মহিলাদেরকে পুরুষের ন্যায় নামায আদায় করার কথাটি একটি অশুদ্ধ কথার সংযোজন মাত্র। ডাক্তার সাহেব হযরত উম্মে দারদা রাঃ এর যে হাদিসটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন তা মূলতঃ এভাবে বর্ণিত-
وكانت أم الدرداء تجلس في صلاتها جلسة الرجل وكانت فقيهة
অর্থঃ এবং উম্মে দারদা রাঃ নামাযে পুরুষের ন্যায় বসতেন, এবং তিনি ‘ফকীহা’ ছিলেন।
এখানে কোথাও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী বা আমলের কথা উল্লেখ নেই; বরং এক মহিলা সাহাবীর আমল মাত্র। যা উল্লেখ করে ইমাম বুখারী রহঃ ইঙ্গিতও করেছেন যে, তিনি ফকীহা ছিলেন, আপন ইজতিহাদ দ্বারা এমন করতেন। এবং ইমাম বুখারী রহঃ ‘তা‘লীকাতে’ (অধ্যায়ের সূচনাতে) সনদ বিহীন উল্লেখ করেছেন।
[চার] ডাক্তার সাহেবের মাযহাব
ডাক্তার সাহেবের বক্তব্য ও রচনায় মুজতাহিদ ইমামগণের অবাধ্যতা ও ফিকহী মাসাআলা সমূহে সংখ্যাগরিষ্ট দল থেকে উল্লেখযোগ্য বিরোধীতার কারণে তিনি যে কোনো ইমামের অনুসারী, তা মনে হয় না। বরং তিনি মুক্তচিন্তা, অধুনিকতা ও প্রগতিবাদী চেতনায় উজ্জেবিত, ‘লা মাযহাবী’ ‘গায়রে মুকাল্লিদের’ (মাযহাব অমান্যকারীদের) অন্তর্ভুক্ত, তাই ফুটে উঠে। শুধু এতটুকু যতেষ্ট নই যে, ডাক্তার সাহেব কোন মাযহাবের অনুসারী নন; বরং তিনি অনেক ক্ষেত্রে ইমামদের অনুসরণ না করার জন্য সাধরণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। তিনি মাসআলার বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেক সময় এক ইমামের কথা বা ঐ ইমামের গবেষণালব্দ সিদ্ধান্ত নিজের গবেষণা ও সিদ্ধান্ত বলে চালিয়ে দেন। কখনো কখনো মুজতাহিদ সেজে নিজেই মাসআলার বিবরণ দেন।
অথচ ডাক্তার সাহেবের উচিৎ ছিল যিনি কষ্ট করে এই মাসআলার সমাধান বের করেছেন ঐ নির্দিষ্ট ইমামের নাম উল্লেখ করা।
মূলতঃ তিনি এর মাধ্যমে মানুষকে প্রতারিত করতে চান; কুরআন-হাদিস থেকে কেবল এতটুকুই প্রমাণিত। এ ব্যতীত যার উপর মানুষ আমল করে তা অশুদ্ধ; যদিও ইমামদের সিদ্ধান্তই হোক না কেন। নিম্নের আলোচনা দ্বারা উল্লেখিত বিষয়গুলো প্রস্ফুটিত হবে।
(ক) বিনা অজুতে কুরআন শরিফ স্পর্শ করা
ডাক্তার সাহেব এক স্থানে বলেন, বিনা অজু কুরআন মজিদ র্স্পশ করা জায়েয।
অথচ ডাক্তার সাহেবের এই সিদ্ধান্তটি কুরআনের আয়াত ও ইমামগণের সিদ্ধন্তের সাথে সাংঘর্ষিক।
لايمسه الاالمطهرون
[অর্থঃ (অজু বা গোসল দ্বারা ) পবিত্র হওয়া ছাড়া কুরআন মজিদ স্পর্শ করো না। ]
(খ) জুমার খুতবা স্থানীয় ভাষায় হওয়া চাই
তিনি অন্যত্র বলেন, ‘আমাদের দেশে জুমার খুতবা স্থানীয় ও মাতৃভাষায় হওয়া উচিত মনে করি’।
অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত জুমার খুতবা আরবী ভাষাই চলে আসছে। আর এখন ডাক্তার সাহেব জুমার খুতবা স্থানীয় ভাষায় দেয়ার দাওয়াত দিচ্ছেন; যেন মানুষ খুতবা বুঝতে সক্ষম হয়।
অথচ এই যুক্তি (অনারবরা খুতবা বুঝা) রাসুলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগেও বিদ্যমান ছিল। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুতবায় অনারবরাও উপস্থিত থাকতেন, তা সত্তেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদা আরবী ভাষায় খুতবা দিতেন; অন্য কোন ভাষায় নয়। এবং পরবর্তীতে অনুবাদও করাতেন না। অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ী, তবে তাবেয়ী ও তাদের অনুসারীগণ আরব থেকে বের হয়ে ‘আজম’ অনারব রাষ্ট্রে বসবাস করেছেন, প্রাশ্চ্য ও প্রাশ্চাত্যে ইসলামের আলো বিতরণ করেছেন, কিন্তু সবর্ত্রে খুতবা হত আরবী ভাষায়। অথচ ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য আজকের তুলনায় তারা এর অনেক বেশী মুখাপেক্ষী ছিল।
তখন সাহাবী ও তাবেয়ীগণ অনারবী ভাষা খুব ভালভাবে জানতেন। তা সত্তেও তারা আরবী ভাষায় খুতবা দিতেন।
সারকথা
খুলাফায়ে রাশেদীন সাহাবায়ে কিরাম ও বড় বড় তাবেয়ীনগণের ধারবাহিক আমল এবং গোটা উম্মতের উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা আমলের মাধ্যমে একথা স্পষ্ট যে, খুতবা আরবী ভাষাই দিতে হবে। এমনকি ‘আরবী ভাষায় খুতবা দেয়া’ ইমাম মালেক রহঃ-এর মতে জুমা বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত। যদি সমবেত সকল লোক অনারবী হয়, কেউ আরবী জানেনা, আরবীতে খুতবা দেয়ার কোন লোক না থাকে, তখন তারা যোহরের নামায আদায় করবে, জুমার নামায নয়।
জুমার নামায তাদের যিম্মায় বর্তাবে না।
ولو كان الجماعة عجما لا يعرفون العربية ، فلو كان ليس فيهم من يحسن الإتيان بالخطبة عربية لم يلزمهم جمعة .
অর্থঃ যদি গোটা জামাত অনারবী হয়, কেউ আরবী ভাষা জানেনা, এবং তাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি সুন্দর আরবীতে খুতবা দিতে পারে না তখন তাদের উপর জুমা ওয়াজিব হবে না।
এবং হযরত শাহ্ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী রহঃ বলেন, খতুবা শুধুমাত্র আরবী ভাষাই হতে হবে। পুরো বিশ্বে সদা এটার উপরই আমল চলে আসছে ।
(গ) তিন তালাকে এক তালাক হওয়া চাই
ডাঃ জাকির নায়ক বলেন, তিন তালাকের জন্য এতগুলো শর্ত রয়েছে যে, সবকটি এক সাথে পাওয়া যাওয়া দুষ্কর ও অসম্ভব।
এ সর্ম্পকে সৌদি আরবের তিনশ ফতোয়া বিদ্যমান। বর্।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।