আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

৫ই ফেব্রুয়ারি এবং তারপর...

"জল যে পথে যায় রক্ত সে পথে যায় না, কেননা রক্ত জলের চাইতে গাঢ় এবং ঘন। " [আহমদ ছফা] উৎসর্গ রণেশ দাশগুপ্ত ২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। বাংলাদেশে আমরা যে ‘রাজনীতি’ দেখতে পাই, তা মূলত বিদেশী দূতাবাসে ধর্ণা দেওয়ায়, সাম্রাজ্যবাদী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে বৈঠকে আর পাঁচ বছর অন্তর অন্তর প্রায় নিরর্থক নির্বাচনী আয়োজনে ‘চর্চিত’ হয়। এর সাথে চলে রাষ্ট্রক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নির্লজ্জ লুটপাট আর সন্ত্রাস, জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল ও অক্ষম করে নিও-লিবারেল আইডলজির (সাম্রাজ্যবাদী) স্বার্থে একের পর এক প্রতিষ্ঠানের বেসরকারিকরণ। আর বছরভর রাজপথে চলে নৈরাজ্যিক সহিংসতা, যার কোনো বৈপ্লবিক উদ্দেশ্য নেই, যেই সহিংসতা শাসকশ্রেণীর ক্ষমতার লড়াইয়ের বহিঃপ্রকাশ এবং জনগণ যার অসহায় শিকার ও কখনো কখনো হাতিয়ার।

৫ই ফেব্রুয়ারি সেই রাজনীতি জনগণের ইচ্ছায় রাজপথে এলো। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধী ও ‘মিরপুরের কসাই’ খ্যাত কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সারা বাংলাদেশ। এই রায়ের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ ও অসন্তোষ থেকে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবীতে ব্লগার ও অনলাইন একটিভিস্টদের দুটি সংগঠন শাহবাগ জাতীয় যাদুঘরের সামনে অবস্থান নেবার আহবান জানায় দেশবাসীকে। সেই ডাকে মেলে অভূতপূর্ব সাড়া, সেদিন রাতেই শাহবাগে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। পরদিন সকালে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে ঢল নামল লাখো মানুষের।

তারপর তো ইতিহাস!!! গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। অসংখ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন সারা দেশ থেকে এসে অবস্থান নেয় শাহবাগে। সাংগঠনিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার, তাদের সকল আর্থিক উৎস নিষিদ্ধ করার, তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়ার এবং দলনির্বিশেষে সব রাজাকারের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবী ওঠে শাহবাগে। ঐতিহাসিক ছয় দফার স্মরণে ঘোষিত হয় ছয় দফা। আওয়ামী লীগের দলীয় শ্লোগানে পরিণত হওয়া জয় বাংলা আবার ফিরে পায় তার মুক্তিযুদ্ধকালীন সার্বজনীনতার মহিমা।

শাহবাগ আন্দোলন চলতে থাকে। ছড়িয়ে পড়তে থাকে প্রথমে দেশের বিভিন্ন জায়গায়, তারপর দুনিয়ার যেখানেই আছে বাংলাদেশের মানুষ সেখানে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভাইবোনেরাও শাহবাগের সাথে সংহতি প্রকাশ করল। কবীর সুমন একটির পর একটি গান লিখতে থাকলেন। শাহবাগে জড়ো হওয়া জনতার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ধারণা করেছিলেন, আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতে ইসলামীর গোপন সমঝোতা হয়েছে বলেই কাদের মোল্লার ব্যাপারে এসেছে এই অবিশ্বাস্য রায়।

এটা মাথায় রাখা জরুরী। এরপরে শুরু হল একদিকে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খাকে বুকে নিয়ে শাহবাগে ছুটে আসা জনতার দীর্ঘ এক আন্দোলন, অন্যদিকে মসনদের মোহে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা বর্তমান শাসকশ্রেণীর ক্ষমতাসীন ও বিরোধি অংশের এক জটিল পাওয়ার পলিটিকস। আওয়ামী লীগ শুরুতেই শাহবাগে অনুপ্রবেশ ঘটালো তার ছাত্রসংগঠনের। গণজাগরণ মঞ্চকে ছাত্রলীগ এককভাবে দখল করতে পারলো না বটে, তবে এটা অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই যে ছাত্রলীগ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থাকলো অনেকদিন। আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা সব নেতানেত্রীরা শাহবাগে আসলেন ‘সংহতি’ জানাতে, ফিরে গেলেন কেউ পানির বোতল খেয়ে আর কেউ জুতা দেখে।

আওয়ামী লীগ বুঝলঃ এভাবে নয়, এভাবে ঠিক হয় না। এবার আওয়ামী লীগ স্ট্র্যাটেজি চেঞ্জ করলো। আওয়ামী রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত বা আওয়ামী সমর্থক বলে সর্বজনস্বীকৃত ‘বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব’-রা শাহবাগে আসা শুরু করলেন, আওয়ামী লীগ ‘বাকের ভাই’-দের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে চাইল রাজনৈতিকভাবে। এবং এতে কাজ হল, দারুণ কাজ হল। এদিকে বিএনপি এই গণজোয়ার দেখে হতবুদ্ধি হয়ে গেল।

বিএনপির নেতারা একেকজন একেকরকম কথা বলতে লাগলেন, কারো সাথে কারো কথার কোনো মিল পাওয়া গেল না। কেউ বললেন শাহবাগে নাকি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। কেউ বললেন শাহবাগে আওয়ামী লীগ নাটক করছে। কেউ আবার ইচ্ছামত দাবী তুলতে লাগলেন যে শাহবাগে অমুক ইস্যু তমুক ইস্যুর জন্য আন্দোলন হতে হবে। যেসব ইস্যু নিয়ে মহাজোট সরকারের শাসনামলে তাঁরা কেবল গলাবাজিই করেছেন, জনগণকে সাথে নিয়ে কোনো গণআন্দোলন গড়ে তোলেন নি।

মিডিয়া শুরু করল তার নিজের পলিটিকস। আমার দেশ বলল তারা শাহবাগে ‘ফ্যাসিবাদের’ পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। সংগ্রাম শুরু করল শাহবাগের বিরুদ্ধে এক নির্লজ্জ সংগ্রাম, সেই পাকিস্তান আমলের ‘ইসলাম বিপন্ন’ শ্লোগান দিতে দিতে (তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে সাম্যের গান!) দিগন্ত থেকে নয়া দিগন্তে দ্যাখা যেতে লাগলো শাহবাগের বিরুদ্ধে বিচিত্র সব প্রোপাগাণ্ডা। ‘শাহবাগীরা’ গাঁজাখোর। বেশ্যা।

শাহবাগে নাচ গান হয়। বেগানা নারী পুরুষ রাস্তার ওপর ঘন হয়ে রাত কাটায়। আরও কত কিছু। বাঁশের কেল্লাও তৈরি হয়ে গেল ফেসবুকে। আর কি লাগে? এ তো গেল জামাতি মিডিয়ার কথা।

নন-জামাতি মিডিয়াগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে সক্রিয় সমর্থন দিল শাহবাগ । প্রথম আলো মুড়ি পাঠালো। কালের কণ্ঠ বিরিয়ানির প্যাকেট। আর শাহবাগ থেকে লাইভ টেলিকাস্ট তো আছেই, জামাতি চ্যানেলগুলো বাদে অন্যান্য ইলেকট্রনিক মিডিয়ার। বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা ইত্যাদি ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়াও শাহবাগে আন্দোলনের কথা সারা দুনিয়ার মানুষকে জানালো।

ইকোনমিস্ট থেকে নিউইয়র্ক টাইমস সব জায়গায় এ আন্দোলনের কথা এলো। যাহোক, সে-এক ভিন্ন আলোচনা, এখানে করার প্রয়োজন নেই। ব্লগার ও তরুণ প্রকৌশলী রাজীব হায়দার তাঁর বাসার সামনে নৃশংসভাবে খুন হলেন। রাজীবের জানাজা হল প্রজন্ম চত্বরে, তাঁকে দেওয়া হল শহিদের মর্যাদা। এবার শুরু হল, আসলে তৈরি করা হল, বিতর্ক।

জামাতি পত্রিকা-চ্যানেল-ফেসবুক পেইজ তো জান দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে লাগলো রাজীব কত বড় ইসলামবিদ্বেষী ছিলেন। যাঁরা জামাতি না, সাধারণ বিশ্বাসী মুসলমান, তাঁরাও ধন্দে পড়লেন। রাজীব যদি ‘নাস্তিক’ হন, তাহলে তাঁকে কি শহিদ বলা যায়? একাত্তরের যে তিরিশ লাখ শহিদের কথা আমরা বলি, তাঁদের সবাই মুসলমান ছিলেন না, হিন্দু বৌদ্ধ ক্রিশ্চান ছিলেন অনেকেই, আর দুই একজন নাস্তিক যে ছিলেন না তাঁর কোনো প্রমাণ আছে? এই সহজ কথাটা অনেকের মাথায় এলো না। নারায়ণগঞ্জে খুন হল নারায়ণগঞ্জের সকল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী এবং দেশের জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা রফিউর রাব্বীর সতেরো বছরের ছেলে ত্বকী। রাব্বি নিজে দায়ী করলেন নারায়ণগঞ্জের গডফাদার শামীম ওসমানকে, এনসিসির মেয়র সেলিনা হায়াত আইভি সেটা সমর্থন করলেন।

নারায়ণগঞ্জে সূচনা ঘটল জনতার আরেক প্রতিরোধ পর্বের। বিএনপি এরই মধ্যে তার প্রাথমিক হতবুদ্ধি ভাব কাটিয়ে উঠে বেশ গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। রাজীব ‘নাস্তিক’ ছিলেন, রাজীব শাহবাগ আন্দোলনের লাখো মানুষের একজন ছিলেন, অতএব শাহবাগ ‘নাস্তিকদের আন্দোলন’, এই অপূর্ব সূত্র জামাতের সাথে গলায় গলা মিলিয়ে প্রচার করতে লাগল। জামাত দেশের কোথাও জাতীয় পতাকা ছিঁড়ল, কোথাও শহিদ মিনার ভাঙল। তাদের ঘাঁটি বলে পরিচিত কাঁটাবন মসজিদ থেকে জুমার নামাজের পর বের হয়ে শাহবাগে আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করল, তবে সফল হল না।

জাতীয় মসজিদের গালিচায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে তারা ইসলাম ‘রক্ষা’ করতে লাগল। এর মধ্যেই সারা দেশে শুরু হয়ে গেল হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক নির্যাতন। হিন্দুদের বাড়ি ভাঙা হল, মন্দির ভাঙা হল, কোথাও কোথাও ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের কুপিয়ে টুকরো টুকরো করা হল। স্বঘোষিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের’ সরকার কোথাও হিন্দুদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসল না। প্রশাসন বসে বসে মুড়ি খেতে লাগলো।

সাতকানিয়া আর বাঁশখালিতে জামাত যে তাণ্ডব চালালো, তাতে সেগুলো আদৌ বাংলাদেশের অংশ কিনা সেটা নিয়ে জনগণের মনে প্রশ্ন তৈরি হল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকারের সাথে সংঘর্ষ হল জামাতের। জামাত সমানে মানুষ মারতে লাগলো। সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মানিকগঞ্জসহ আরো অনেক জায়গায় জামাত ঠেকাতে গিয়ে অনেক সময় কিছু সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলল। বিএনপি চিল্লাতে লাগলোঃ শাহবাগের ‘নষ্ট তরুনদের’ কারণে নাকি দেশে গণহত্যা চলছে, তারা জনতার মঞ্চ করবে, ক্ষমতায় গিয়ে সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে, ব্লা ব্লা ব্লা।

জামাতের সন্ত্রাস কিন্তু তাদের চোখে পড়ল না, অবশ্য না পড়ারই কথা। এর মধ্যেই শাহবাগ আন্দোলনের কিছু সাফল্য আসতে লাগলো। গণ দাবীর মুখে বাধ্য হয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আইন সংশোধন করে রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার সুযোগ তৈরি করা হল। সাঈদীর ফাঁসির রায়ে আবারো উচ্ছ্বসিত জনতার ঢল নামলো শাহবাগে। জামাতি প্রোপাগাণ্ডা সিস্টেম আবার চালু হল।

ফটোশপের উছিলায় সাঈদীর ছবি চাঁদে শোভা পেতে লাগলো। রাষ্ট্রযন্ত্রের চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আর অবহেলার কারণে আধুনিক শিক্ষার অধিকার থেকে সুপরিকল্পিতভাবে বঞ্চিত-করে-রাখা বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশ বাস করেন জ্ঞানবিজ্ঞানহীন অন্ধকারে, ধর্মের লেবাস গায়ে চাপিয়ে নানান ভাবে সম্পর্ক তৈরি করে জামাত কিছুটা হলেও এঁদের মধ্যে এক ধরণের প্রভাব তৈরি করতে পেরেছে, সেই প্রভাব খাটিয়ে জামাত তাঁদেরকে বোঝাল ‘আল্লামা সাঈদী’ যেহেতু আল্লার অলি তাই তাকে চাঁদে দেখা গেছে। বিভ্রান্ত হয়ে তাঁদের অনেকে রাস্তায় নেমেছেন সাঈদীর পক্ষে, অনেক জায়গায় নির্লজ্জ জামাত এমনকি ছোট শিশুদের পর্যন্ত রাস্তায় নামিয়েছে। এইসব দেখেশুনে অ(তি)শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার ফতোয়া দিলেন, সাঈদী আসলে মেহনতি মানুষের প্রতিনিধি!!! জর্মন দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি-দেরকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তাই আজ তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ হওয়া সত্ত্বেও জর্মন বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাস থেকে বাতিল হয়ে গেছেন। বাংলাদেশে ফরহাদ মজহারের পরিণতিও শেষ পর্যন্ত তাই হবে।

এর মধ্যে মাঠে নেমে গেছে ‘হেফাজতে ইসলাম। ’ নামিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। হেফাজতের নেতারা ‘নাস্তিক ব্লগার’-দের ফাঁসি চান, ‘শাহবাগী বেলেল্লাপনা’-র অবসান চান। এরপর কোত্থেকে কি হল, একের পর এক ‘ইসলামী সংগঠন’ উঠে আসতে লাগল যেন আণ্ডারগ্রাউণ্ড থেকে। জামাত প্রতিরোধের নামে আওয়ামী লীগের সক্রিয় সমর্থনে বাংলাদেশের স্ক্যাটার্ড হয়ে থাকা এসব ‘ইসলামী সংগঠন’ সংগঠিত হতে লাগলো।

‘জয় জয় করিয়া বাড়ে রাজার ব্রাহ্মণ। ’ এঁদের আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের সাথে দ্যাখা যেতে লাগল বিভিন্ন চ্যানেলের পর্দায়। আর তাদের নিজেদের নানা সমাবেশে তো বটেই। হাসি হাসি মুখে তাঁরা মানুষকে বোঝাতে লাগলেন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করতে হবে কারণ জামাত হচ্ছে ‘মওদূদীবাদী’ ও ‘বাতিলপন্থী। ’ ১৯৭১এ জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়েছিল এবং পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের সহায়তা করেছিল, সর্বোপরি বাংলাদেশের জন্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, এবং সেই কারণেই যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে, এই কথাটা এসব ‘ইসলামী সংগঠন’-এর নেতাদের মুখে শোনা গেল না।

একটা কথা এখানে বলা দরকার, ১৯৭১এ জামাতের যে ভূমিকা তার জন্য জামাত কোনোদিনই এই দেশে নিষিদ্ধ হয় নাই। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার জামাতকে নিষিদ্ধ করেছিল বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির একটি যে সেক্যুলারিজম তার সাথে জামাতের গঠনতন্ত্রের বিরোধিতা থাকার কারণে। সে-কারণেই পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের পক্ষে এতো সহজে জামাতকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করা এতো সহজ হয়েছিল। তাই, জামাতকে তার একাত্তরকালীন ভূমিকার জন্য নিষিদ্ধ না করে অন্য কোনো কারণে নিষিদ্ধ করলে পরবর্তীতে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া খুব সহজেই সম্ভব। আর ঠিক সেই কারণেই, জামাতকে নিষিদ্ধ করতে হবে তার একাত্তরকালীন ভূমিকার জন্য।

জামাত নিষিদ্ধের ব্যাপারে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ২১এ ফেব্রুয়ারির মহাসমাবেশে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছিল যদি ২৬এ মার্চের মধ্যে জামাত নিষিদ্ধের প্রক্রিয়ার সূচনা না ঘটে তাহলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। সরকার এর মধ্যে মুখে বড় বড় কথা বলল বটে জামাতের বিরুদ্ধে, কিন্তু কার্যত কিছুই করল না। শাহবাগ আন্দোলনে শুরু থেকেই অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে থাকা শহীদ রুমি স্কোয়াড, যাঁরা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বিশাল ছবিটা প্রজন্ম চত্বরের ঠিক মাঝখানে স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন আন্দোলনের একেবারে শুরুতেই, এবং ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে এই আন্দোলনে আমাদের ইমাম জাহানারা ইমাম ভিন্ন অন্য কেউ নয়, তাঁরা এবার এগিয়ে এলেন। এই বীর যোদ্ধারা শুরু করলেন আমরণ অনশন। শাহবাগ জাতীয় যাদুঘরের সামনে।

সারা দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ ও শত শত সংগঠন সংহতি জানালো শহীদ রুমি স্কোয়াডের সাথে। অনশনকারীর সংখ্যা ছয় থেকে বিশে পৌঁছল। সারা বিশ্বে যেখানেই বাংলাদেশের মানুষ আছে সেখানেই শহীদ রুমি স্কোয়াডের সাথে সংহতি জানিয়ে শুরু হল প্রতীকী অনশন। বোঝা গেল, শাহবাগ মরে নাই। শাহবাগ মরে না।

শহীদ রুমী স্কোয়াডের বিরুদ্ধে আক্রমণটা এলো দুই দিক থেকে। নয়া দিগন্ত গং প্রচার করা শুরু করল যে অনশনের নামে নাটক করা হচ্ছে। অনশনকারীদের রাতের বেলা ঢাকার ভালো ভালো হোটেলে নিয়ে ব্যাপক খানাপিনা করানো হয়। অনশনের নামে নারী পুরুষ পাশাপাশি ঘন হয়ে শুয়ে থাকে সারা রাত। ইসলাম ‘বিপন্ন।

’ নয়া দিগন্ত গং ‘গোপন সূত্রে’ এসব খবর পাচ্ছে। সেইসব ‘গোপন সূত্র’ মনে হয় মানুষের গোপনাঙ্গের চেয়েও গোপন, তাই সেগুলো সম্পর্কে জনগণকে কিছু জানানোর ক্ষমতা নাই নয়া দিগন্ত গং-এর। আওয়ামী লীগ শহীদ রুমি স্কোয়াডের ব্যাপারে দ্যাখানো শুরু করল এক আশ্চর্য উদাসীনতা। আওয়ামী পেইড ব্লগার ও মুক্তিযুদ্ধের ঠিকাদারি-গবেষক হিশেবে যে অনলাইন একটিভিস্ট ‘বিখ্যাত’, তিনি প্রথমে বললেন শহীদ রুমি স্কোয়াডের অনশন নাকি ‘বঙ্গবন্ধুর খুনী বজলুল হুদার ছেলে’ কর্তৃক আহবায়িত। তারপর বললেন বামদের কি সব করার নাকি টাইম নাই তাঁর।

তাঁর শিষ্যরাও মাথা নাড়তে লাগল গুরুর বাক্যের সাথে তালে তালে। যখন বুঝলেন ভুল করে ফেলেছেন, দৌড়ে গেলেন নির্লজ্জের মত শহীদ রুমি স্কোয়াডের কাছে এবং ‘ভুল বোঝাবুঝির’ জন্য ‘অপেন সরি’ জানালেন। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের একজন মন্ত্রী গিয়ে অনশন ভাঙালেন। এই প্রতিশ্রুতিতে যে জামাত যদি নিষিদ্ধ না হয় তবে তিনি মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেবেন। শহীদ রুমি স্কোয়াড অনশন ভাঙল, গণজাগরণ মঞ্চের সাথে যাতে কোনো বিভেদ তৈরি না হয় সেটা মাথায় রেখে।

চৌঠা এপ্রিল জামাত নিষিদ্ধের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি জমা দিতে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে গেল গণজাগরণ মঞ্চ। পথিমধ্যে পুলিশ ব্যারিকেড দিল। ব্যাপক ধাক্কাধাক্কি হল পুলিশের সাথে একটা অংশের। তাঁরা ব্যারিকেড ভেঙে কিছুটা সামনেও এগিয়ে গেল আনন্দ সিনেমা হলের কাছে। এর মধ্যে আবার ঘটে গেছে আরেক আজিব ঘটনা।

আগেই লিখেছি, জামাত প্রতিরোধের নামে আওয়ামী লীগের সক্রিয় সমর্থনে বিভিন্ন ‘ইসলামী সংগঠন’ স্ক্যাটার্ড অবস্থা থেকে সংগঠিত হচ্ছে। এঁদের এবং হেফাজতে ইসলামের দাবীর মধ্যে যে কমন অংশ, ‘নাস্তিক ব্লগার’-দের ফাঁসি, সেটার দিকে আংশিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ হিশেবে সরকারি উদ্যোগে ১৮৬ জন ‘নাস্তিক ব্লগারের’ একটা তালিকা তৈরি করা হল। ফলশ্রুতিতে, প্রথমে তিনজন ও পরে আরো একজন ব্লগারকে গ্রেফতার করা হল। মিডিয়াতে তাঁদেরকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হল যেন তাঁরা নিউক্লিয়ার মিসাইল ছুঁড়ে বাংলাদেশ উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাকারী। খেলাটা সেইরকম! নিরীহ কয়েকজন ব্লগারকে ধরে বিভিন্ন ‘ইসলামী সংগঠন’ ও হেফাজতে ইসলামকে বুঝ দেওয়া, একই সাথে শাহবাগ আন্দোলনের মূল ফোকাস এর মূল দাবী যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামাত নিষিদ্ধ ও রাজাকারের ফাঁসি থেকে সরিয়ে বাকস্বাধীনতার অধিকারের উপরের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদের দিকে নিয়ে যাওয়া।

হেফাজতে ইসলামের নেতারা বললেন, অখ্যাত ব্লগারদের ধরলে হবে না। তেরো দফা দাবী নিয়ে তাঁরা ঘোষণা করলেন লংমার্চ করে ঢাকায় আসবেন। তেরো দফায় যা আছে, তা বাস্তবায়ন করার সবচেয়ে সহজ উপায় বাংলাদেশকে পাকিস্তান ঘোষণা করা। কিন্তু বাংলাদেশ কোনোদিন পাকিস্তান হবে না, এই তেরো দফাও কোনোদিন বাস্তবায়িত হবে না। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম কি আর এসব বুঝবে! তাই তাঁরা লংমার্চের দুই দিন আগেই নানা ধরণের যানবাহনে চেপে ঢাকায় এসে বসে থাকলেন।

লংমার্চ যে পায়ে হেঁটে করতে হয়, তাঁরা সেটাই জানেন না। হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা সবাই কওমী মাদ্রাসার ছাত্র। সেখানে তাঁরা বিজ্ঞান শেখে সাতশ বছর আগের, সাহিত্য শেখে নয়শ বছর আগের। তাঁদের ভুবন আটকে আছে হাজার বছর আগের পৃথিবীতে। তাঁরা প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান।

রাষ্ট্র আধুনিক শিক্ষাকে সার্বজনীন না করে টিকিয়ে রেখেছে অবৈজ্ঞানিক অনাধুনিক নারীবিদ্বেষী মাদ্রাসাশিক্ষাকে, একটার পর একটা সরকার এইদেশে এসেছে আর কে কার চেয়ে বেশি মাদ্রাসা বানিয়ে নিজেকে 'সাচ্চা মুসলমান' প্রমাণ করতে পারে নেমেছে তাঁর প্রতিযোগিতায়। মধ্যবিত্ত নিজের সন্তানের ক্যারিয়ার নিয়ে বড়োই ব্যস্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা মাদ্রাসায় কি শিখছে আর যা শিখছে তা দুনিয়াবি কোনো কাজে আসবে কিনা সেটা নিয়ে মধ্যবিত্তের কোনো চিন্তা নাই। আর লুটেরা উচ্চবিত্তের তো শুধু শরীরটা থাকে বাংলাদেশে, তাও সবসময় না মাঝে মাঝে, রুহ তো তাদের থাকে আমেরিকা-ইউরোপ-জাপান আর দুবাইয়ে। আজকে হেফাজতের এই বিভ্রান্ত কর্মীরা তাঁদের ভণ্ড নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে 'লং মার্চ' করতে এসেছে ঢাকায়, কাল যদি তাঁদের অন্ধকারভরা মগজ নিয়ে তাঁরা ঢাকা শহরের সুখী সুখী ‘ভদ্রলোকদের’ উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, খুন করে, গাড়ি ভাঙে, তবে এর দায়ভার কি শুধুই তাঁদের? সত্য, যে তাঁদেরকে ভুল জিহাদের ভুল ময়দানে ঠেলে দিচ্ছে জামায়াতের কুলাঙ্গাররা। কিন্তু এই রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণী, এর লুটেরা উচ্চবিত্ত আর স্বার্থান্ধ মধ্যবিত্তকে কিছুটা হলেও এর দায়ভার নিতে হবে।

হেফাজতে ইসলাম সাংবাদিক পেটাচ্ছে, নাদিয়া শারমিনের প্রতি দেখিয়েছি প্রচণ্ড সামন্তবাদী পুরুষতান্ত্রিক আক্রোশ, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে চেয়েছিল সম্ভবত রাজু ভাস্কর্য অপরাজেয় বাংলা ইত্যাদি ‘মূর্তি’ ভাঙার জন্য, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে পারেনি, তারা বিভিন্ন জায়গায় নৃশংস মানুষ খুন করছে। বেয়াল্লিশ বছরের বিষবাষ্প তো এভাবেই উদগিরীত হওয়ার কথা!!! এই লেখাটি যখন লিখছি তখন হেফাজতে ইসলামের হরতাল চলছে। এরপর টানা দুই দিন হরতাল ডেকেছে বিএনপি। জানি না কোথায় চলেছে বাংলাদেশ। তবে, একটা কথা জোর দিয়ে লিখতে পারি, ৫ই ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খার রাষ্ট্র গঠনের প্রথম শর্ত, যারা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তাদেরকে খতম করা, এটাকে সামনে নিয়ে এসেছে।

বেয়াল্লিশ বছরের দুঃশাসন, রাজাকার-পাহারাদারি আর প্রতারণার কারণে আমাদের বুকে যে আগুন জ্বলে উঠেছে শাহবাগে সেটাও আর নিভবে না। তাই খুব শিগগিরই জনগণ লুটেরা রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খার রাষ্ট্র কায়েম করবে, স্বীয় অস্তিত্বের স্বার্থেই!!! ০৮ই এপ্রিল, ২০১৩ ধানমণ্ডি, ঢাকা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।