বৃদ্ধার নাম জানা নেই। কিন্তু তাঁর কান্না এখনো চোখে লেগে আছে। ১১ ফেব্রুয়ারি, হাটহাজারী জগন্নাথ দেবের মন্দির। ছাইয়ে ডুবা প্রতিমার ভগ্নাংশ দেখার সাধ তার কখনোই ছিলোনা। এই ধবংসস্তুপ দেখে তিনি কি ভাবছিলেন কিংবা তার অনুভূতি হয়তো জানা হয়নি সম্পূর্ণ।
কিন্তু এই অনুভূতির কুঠারাঘাতে আমি তাড়িত, বিচলিতও।
গত দু’দিন (৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি) হাটহাজারী ও নন্দীরহাটে ছিলো বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। যার শিকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরগুলো। ঘটনার পরদিন অকুস্থল পরিদর্শনে মনে হলো যুদ্ধাক্রান্ত কোন ধবংসস্তুপ যেন। প্রথমে হাটহাজারী কালী মায়ের মন্দির।
যাতে আহত দেয়াল ছাড়া কোনকিছুই অবশিষ্ট নেই। নেই দু’দিন আগের আড়ম্বর কোন। ছাই আর ছাই। কলাপসিবল গেট ভাঙা, ফ্যান ভাঙা, কাঁচ ভাঙা, টিনের ছাউনি পর্যন্ত ভাঙা, প্রতিমা, পুজোর ঘর, তহবিল বাক্স সব তছনছ-ভাঙা আর ছাই। দুর্বৃত্তরা প্রথমে হামলা চালায় কালী মন্দিরে।
কেবল মন্দিরের অভ্যন্তরেই নয় মন্দিরের সামনের স্বর্ণের দোকানগুলোতেও লুটপাট চালিয়েছে ব্যাপক। কালী মন্দিরে ভাঙচুর-লুটপাট-অগ্নিসংযোগ শেষে যায় জগন্নাথ দেবের মন্দিরে। অরাজকতা থেকে রেহাই পায়নি এই মন্দিরটিও। ভাঙচুর, লুটপাট তারপর অগ্নিসংযোগ করে। ঘটনার পরদিন গিয়ে দেখলাম কালী মন্দির পাহারারত ডজনখানেক পুলিশ।
যার একশো গজের(অনুমান) মধ্যেই আছে হাটহাজারী মডেল থানা। তার একশো গজের(অনুমান) মধ্যে জগন্নাথ দেবের মন্দির। বহিরাগতরা লুটপাট-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে এলাকাবাসী জানায়। একটা মিছিল নিয়ে আসে শহরের দক্ষিণ রাস্তা ধরে। অন্তত দু’ঘন্টা ধরে চলে হামলা।
হামলা চলাকালে চারজন পুলিশ কালী মন্দিরের সামনেই অবস্থান করছিল বলে এলাকাবাসীর ভাষ্য। কিন্তু তারা প্রতিরোধ করেনি। এদেশে পুলিশ কাদের সেবক, কাদের ঢাল বলার আগে উপস্থাপন করা যাক নন্দীরহাটের ঘটনা।
ঘটনার সূত্রপাত মূলত নন্দীরহাট থেকেই। লোকনাথ সেবাশ্রমের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত শোভাযাত্রা যাচ্ছিল হাজীপাড়া মসজিদের পাশ দিয়ে।
মসজিদের ইমাম হাবিবুর রহমানের কথায়, ৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার জোহরের নামাযের সময় বাদ্যযন্ত্রসহ শোভাযাত্রা যাওয়ার মুহূর্তে কয়েকজন মুসল্লি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে নিষেধ করায় দুই পক্ষের মধ্যে সামান্য বাগ্বিতণ্ডা হয়। বাগ্বিতণ্ডার এক পর্যায়ে শোভাযাত্রার পেছন থেকে একটা ঢিল এসে পড়ে মসজিদের জানালায়। ফলে স্টিলের জানালার একটা কপাট খুলে যায়। এ নিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করে। পরদিন ফজরের আজান দিতে আসলে মসজিদের সামনের দেয়ালের ভাঙা অংশ তার নজরে আসে।
তাই এলাকাবাসীকে অবগত করতে তিনি মাইকে ঘোষণা দেন। ফোনে ওলামা পরিষদসহ বিভিন্ন জায়গায় জানানো হয়। দুপুরে জুম্বার নামায পড়তে আসা মুসল্লিরা নামায শেষে বৈঠক করে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক অবরোধ করে। পরে মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। যদিও হিন্দু নেতারা বারবার ঢিল ছোড়ার ব্যাপারটি বানোয়াট বলে দাবি করে।
কিন্তু ঢিল ছোড়া হলেও স্টিলের জানালার নিচের অংশে একটা ঢিল লাগার পর কপাট খোলার ঘটনা বানোয়াটই বলে মনে হচ্ছে।
আগে জানা থাকলেও ঐদিন পরিদর্শনে দেখতে পাই এখানকার হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি। মন্দির ভাঙার ফলে অধিকাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকই ব্যথিত। অর্থাৎ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় মুগ্ধ না হওয়াই যথার্থ। নন্দীরহাটে মোট ছয়টি মন্দিরে ভাঙচুর-লুটপাট-অগ্নিসংযোগ করে বেশকিছু বাড়ি-ঘরও জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
লোকনাথ সেবাশ্রমে হামলা-ভাঙচুর হয় সবার প্রথম, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। দুপুরে শোভাযাত্রার সময়কার বাগ্বিতণ্ডার পর সেবাশ্রমে বর্ষপূর্তি উদ্যাপন কমিটি নিজ উদ্যোগে মসজিদ কমিটির সাথে বৈঠকে বসে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে। কিন্তু হাজীপাড়া মসজিদ চত্ত্বরে উক্ত বৈঠক চলাকালেই লোকনাথ মন্দিরে হামলা শুরু হয়। আবার বৈঠকে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী একাধিক ব্যক্তির সন্তান সেই হামলা কার্যক্রমে অংশ নেয়। একদিকে সমঝোতা বৈঠক অপরদিকে হামলা-ভাঙচুর।
এই সমঝোতা বৈঠকে পুলিশ ও প্রশাসনের প্রতিনিধিও ছিল। রাতে লোকনাথ মন্দির থেকে হাজীপাড়া হয়ে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক পর্যন্ত টহলে ছিলো পুলিশ। এর মধ্যে রাস্তার পাশে মসজিদ ভাঙচুরে কারা লিপ্ত হতে পারে!
হাজীপাড়া মসজিদটি সর্বোচ্চ ছয়শো বর্গফুটের অত্যন্ত সাদামাটা একটি ভবন। যার সামনের দেয়াল গ্রিল আকৃতি করে কয়েকটি পিলার দেয়া আছে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ধর্মালয় বলেই হয়তো বায়ু চলাচলের জন্য এমন ব্যবস্থা রাখা।
ভাঙচুর বলতে সেই পিলারের পলেস্তারা উঠিয়ে সামান্য ইট বের করে ফেলা হয়েছে। ভাঙা অংশ যে কেউ দেখলেই বলবে, হাতুড়ি ছাড়া এমন শৈল্পিক(!) ভাঙন সম্ভব নয়। জসিম নামের এক রাজমিস্ত্রী পুলিশি জবানবন্দীতে বলছে, এমদাদ ও লোকমানের চাপাচাপিতে ৫০ টাকার বিনিময়ে সে মসজিদের দেয়াল ভাঙে। পুলিশ বলছে-এমদাদ বিএনপি সমর্থক আর লোকমান মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু কথা হলো টহলদার পুলিশ তখন কি করছিলো? মধ্যরাতে ভাঙার শব্দ কি আশপাশের বসবাসকারীরা কেউ শুনেনি? সেদিন ঘটনাস্থলে যাবার আগে শুনেছিলাম জমি সংক্রান্ত একটা বিরোধের কথা।
রফিক নামে এলাকার এক লোক মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু জমি দখল করতে নাকি প্রধান উস্কানিদাতা হিসেবে কাজ করে। ফোনে-ফোনে সেই মসজিদ ভাঙচুরের ঘটনা ছড়ায়। রফিক ‘প্রথম আলো’র সাংবাদিক পরিচয়ে বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজির সাথে জড়িত। পুলিশের সহযোগেই সে এই হয়রানি চালায় বলে এলাকায় জানতে পারি। কিন্তু হাটহাজারী-নন্দীরহাট জুড়ে এতো বড় অরাজকতা সৃষ্টি কি এই লোকের পক্ষে করা সম্ভব!
১০ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার জুম্বার নামাজ শেষেই তাণ্ডবলীলা শুরু হয়ে যায়।
নন্দীরহাটে জগন্নাথ বিগ্রহ মন্দির ভাঙচুর, মগদেশ্বরী মায়ের মন্দির পুরো জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সুরকার সত্য সাহার বাড়িতে মন্দির ভাঙচুর করে আগুন দেয়ার চেষ্টা করে এবং কালী মন্দির থেকে লুট করা হয় ৫০০ বছরের পুরোনো একটি দুর্লভ কষ্টিপাথরের মূর্তি। এখানেও হামলাকারীরা বহিরাগত। তবে ফতেয়াবাদ রেল স্টেশনের অদূরে পুড়িয়ে দেয়া বাড়ি-ঘরে সকালের দিকেই নাকি একদল লোক এসে শাসিয়ে যায়।
নন্দীরহাটে হামলার সূচনা, তারপর হাটহাজারী শহরে।
দু’টি স্থানের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। দু’টি জায়গার হামলাকারীই বহিরাগত। এখান থেকেই সন্দেহের উদ্রেক। ঘটনাটি কি তাহলে পূর্ব পরিকল্পিত! এতো বড় ঘটনা কিন্তু প্রচার মাধ্যমে এসেছে খুবই সামান্য। বিডিআর বিদ্রোহের প্রথম দু’দিন যা পারেনি সরকার এবার প্রথম থেকেই তা দেখিয়েছে।
ভয়ানক কঠোরতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করেছে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম। যেকোন ঘটনায় সরকার যেভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্তের ভূত দেখতে পায় তেমনটিও ঘটেনি এখানে। তবে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি দেখাতে সরকারের উচ্ছিষ্টভোগীরা এ ভূত সামান্য দেখতেই পারে। যথারীতি একটি মহল অস্থিরতা সৃষ্টি করতে ঘটনাটি ঘটায় বলে প্রশাসনের অভিমত। কিন্তু কোন মহল? সরকার সবসময় বিরোধী দলকে দায়ভার দিলেও খতিয়ে দেখতে গিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে উপদলীয় সংঘাতই এর মূল কারণ বলে বিবেচনা করতে হচ্ছে।
বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানতে পারি, কেন্দ্রীয় কমিটিতে সুবিধা বঞ্চিত আওয়ামী যুবলীগ নেতা আ.জ.ম নাসির উদ্দিনের সম্পৃক্ততার কথা। বিরোধী দল ও তার শরিকরাও যে ঘটনা থেকে সুবিধা লুটতে চায়নি তা বলা যাবে না। কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের নির্লজ্জ নিশ্চুপতা সন্দেহের তীর আসলে সরকারের দিকেই যায়। থলের বিড়াল যাতে বেড়িয়ে না যায় এবং সরকারের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতেই হয়তো এই ধামাচাপা দেবার চেষ্টা চলমান। প্রথম দিনের সমঝোতা বৈঠকের সময় ভাঙচুরকারীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোন ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।
ছাত্র-শ্রমিকরা ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনে নামলে তা দমনে মুহূর্তের মধ্যে হাজারো পুলিশ মাঠে নেমে যায়। কিন্তু জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে এরা ঠিক বিপরীত পরিমান উদাসীন হলো, কোটি-কোটি টাকা লুট হয়ে গেলো। তাহলে তাদের প্রয়োজন কি কেবল ভুয়া ক্রসফায়ার আর এনকাউন্টারের মাধ্যমে বিপ্লবী দমনের নাটক তৈরির জন্য!
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’দলেই উপদলীয় কোন্দল মারাত্মক। ফলে পদ হাসিল করতে এবং শক্তি প্রদর্শনে তারা বিভিন্ন মহড়ার আশ্রয় নেয়। তাদের জন্য মহড়া হলেও সাধারণ জনগণের জন্য তা মরার উপর খাঁড়ার ঘা।
নেতারা লাভবান হলেও জনসাধারণের থাকে সর্বস্ব হারাবার শঙ্কা। আর পুলিশ প্রশাসন মানেই আজ সরকারি দলের সামরিক কর্মী ছাড়া কিছু নয়। হাটহাজারী-নন্দীরহাটের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলে যে কেউ বলবে সরকারি দল ও পুলিশের মদদ ছাড়া কোন মতেই এমনতরো লুটপাট সম্ভব হয়নি। পুলিশ প্রশাসন তো আর বিরোধী দলকে মদদ দেয়না, দেয় সরকারি দলকেই। তাই দায়ভারও এক অর্থে সরকার ও সরকারি দলের উপরই বর্তায়।
যেকোন স্বার্থসিদ্ধিতে সরকার খুব হাইকোর্ট দেখায় কিন্তু এখন যখন একটি স্বতঃপ্রণোদিত রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ক্ষতিগ্রস্থ মন্দির-ঘরবাড়ি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে প্রশাসনের বিরুদ্ধে রুল জারি করলো তখন এর ব্যবস্থা কতটুকু?
আধা উপনিবেশিক-আধা সামন্তবাদী চরিত্রের রাষ্ট্র বলেই এমনটি সম্ভব হচ্ছে। একদিকে সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের প্রকাশ্য অপতৎপরতা, অন্যদিকে তার ভৃত্যদের উপদলীয় সংঘাতের ফলে বারবার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে অস্থির হতে হচ্ছে আমাদের। কথিত ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার, খুন-গুম, সীমান্তে নিপীড়ন, ট্রানজিট-করিডোর, বাঁধ-অসম পানি চুক্তি, জাতীয় সম্পদ পাচার, যৌথ মহড়া, মার্কিন-ভারতীয় বাহিনীর অনুপ্রবেশ ইত্যাদি ইস্যুগুলোতে যখন জনগণ প্রতিবাদের ভাষা খুঁজছে এমন সময়েই ঘটলো হাটহাজারী-নন্দীরহাট ট্র্যাজেডি। ঘটনাটির সঠিক মূল্যায়নের অভাবে স্বার্থান্বেষীরাও হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব বলে ঠিকঠিক চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু তা যাতে না হয় তাই আরো গভীর মূল্যায়নের মধ্যদিয়ে কর্তব্য সম্পাদনের আহ্বান রইলো প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক শক্তি তথা সকলের প্রতি।
১১.০৩.২০১২ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।