দু'দিন কেটে গেল হিটলার কোন যোগাযোগ করল না। জামাল জাহিদের সিমকার্ডটা মোবাইল সেট-এ সংযোজন করে কয়েকবার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু হিটলারের মোবাইল বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। জামাল লক্ষ্য করেছে পুলিশ তাকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ না করলেও সাদা পোশাকে তাকে অনুসরণ করছে। জাহিদকে না পাওয়া পর্যন্ত বোধ হয় পুলিশ তার অফিসের আশে-পাশে তীক্ষ্ণ নজর রাখবে।
কাজেই হিটলারের কাছ থেকে কোন খবর না পাওয়া পর্যন্ত জামাল দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারছে না।
জামাল বাসায় ফিরল। তার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে অনন্যার বুক ফেটে কান্না এলো। জামালের আচরণে অনন্যা বরাবরই অসন্তোষ্ট তারপরও স্বামী তো! জামালের গম্ভীর কালো মুখ দেখলে অনন্যা তার প্রতি জামালের সমস্ত অবহেলা মুহূর্তেই ভুলে যায়। জামালের এলোমেলো চুল, কোটরাগত চোখ আর রুক্ষ্ণ মেজাজ যেন অনন্যাকে চিন্তিত করে তুলল কিন্তু জামালকে কিছু বলার সাহস পেল না।
জামাল পাশের রুমে গিয়ে জাহিদের নামে কেনা সিমকার্ডটা তার মোবাইলে সেট করতেই মোবাইলের রিং বেজে উঠল। জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হিটলার কী খবর?
বস্ অপারেশন সাকসেসফুল।
জামাল জিজ্ঞেস করল, কোন ঝামেলা হয় নি তো?
না বস্ এতো কাঁচা কাজ করিনি, আপনার চিন্তার কোন কারণ নেই, সুইসাইড কেইস।
আচ্ছা ঠিক আছে, বলে জামাল মোবাইল অফ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
জামালের চোখে তবুও ঘুম নেই কখনো জাহিদের মুখচ্ছবি বার বার করে তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে কখনো পুলিশ অফিসারের কথাগুলো কানের কাছে বেজে উঠছে।
কিন্তু জাহিদ আত্মহত্যা করেছে, তাই জামালের সমস্ত আশংকা যেন কেটে গেল। আবার কখনো যুথির লবান্যময় মুখচ্ছবি ভেসে উঠছে। এখন ওদের আপন বলতে আর পৃথিবীতে কেউ থাকল না, যুথির রুপ-লবন্যর অহংকার এবার কে রক্ষা করবে! এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে জামাল আপন মনে একবার হেসে উঠল।
অনন্যা জিজ্ঞেস করল, তোমার কী হয়েছে বল তো?
তুমি বুঝবে না অনন্যা, তুমি বুঝবে না, বলে জামাল মুখ ফিরিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করল।
পরদিন সকাল বেলা আবাসিক হোটেলে জাহিদের ফ্যান হুকের সঙ্গে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ঘটনাটা ট্যক অফ দি টাউনে পরিণত হলো।
কেউ কেউ জাহিদের আত্মহত্যাকে অপমৃত্যু না পরিকল্পিত খুন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করল। জামাল নিজ খরচে ঢাকা থেকে এনে জাহিদের লাশ নিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করল।
জাহিদের লাশ বাসায় পৌঁছামাত্র তাদের বাসায় কান্নার রোল পড়ে গেল। খবর পেয়ে জুঁই তাদের বাসায় এলো। জাহিদের লাশ দেখে তার মা অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।
কিছুক্ষণ পর তাঁর জ্ঞান ফিরল।
জামাল কান্না ভাঙ্গা গলায় বলল, আপনি কোন চিন্তা করবেন না খালা আম্মা, জাহিদ নেই আপনার এই ছেলে তো আছে। আমি থাকতে আপনাদের কোন চিন্তা নেই, আমাকে সবকিছু নিঃসংকোচে বলবেন। ইনশাল্লাহ আমি আপনার ছেলের অভাব পূরণ করবো।
জাহানারা, জুঁই, যুথি দু'জনের হাত একসঙ্গে করে জামালের হাতে তুলে দিয়ে বলল, তুমি একটু ওদের দিকে খেয়াল রেখো বাবা, বলে তিনি যুথির দিকে ইঙ্গিত করে বলল, আমার এই এতিম মেয়েটাকে এখন থেকে নিজের মনে করবে।
খালা আম্মা জুঁইয়ের বিয়েতে আমি সহযোগিতা করেছি, এবার যুথির লেখাপড়ার সমস্ত দায়িত্ব নিলাম। যুথিকে আমি এম.এ পাস করার পর যোগ্য পাত্রের সাথে বিয়ে দিব, বলে জামাল যুথির দিকে এগিয়ে যেতেই যুথি সরে গেল।
জামালের গন্ডদেশ বেয়ে তখন পানি গড়িয়ে পড়ছে আর তার মন বলছে, জাহিদ একদিন আমাকে পরোক্ষভাবে বাসায় আসতে এবং তোমাদের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করেছিল আজ তোমার ভাইও নেই আমার পথে কোন বাধাও নেই। জুঁইর বিয়ে হয়েছে এবার যুথি এখন থেকে তুমি শুধু আমার।
জাহানারা জামালকে ঘরে বসার জন্য বললে জামাল ঘরে বসল।
পাশা পাশি চেয়ারে জুঁইয়ের স্বামী এবং মুখোমুখি জুঁই ও যুথি বসল।
জামাল জুঁইকে জিজ্ঞেস করল, জুঁই তোমাদের দিনকাল কেমন চলছে?
জুঁই কিছু বলল না, তার স্বামী বলল, জি ভাইজান ভালো।
একদিন তোমার দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দোকানে মনে হয় আরো কিছু ক্যাশ হলে ব্যবসাটা আরো লাভজনক হতো।
জি ভাইজান।
তুমি এক কাজ করো, তোমার দোকানে আর কত টাকার মাল হলে দোকনটা আরো ভালো চলবে সেটা হিসেব করে দেখ তারপর একদিন অফিসে এসো আমি কিছু টাকা দিয়ে দিব।
জুঁইয়ের স্বামী বিনয়ের সঙ্গে বলল, জি ভাইজান।
জুঁই বুকে হঠাৎ করে একটা ধাক্কা খেল। জামাল তার স্বামীকে টাকা দিতে চাওয়ার অর্থ হলো তার প্রতি জামালের লোলুপ দৃষ্টি এখনো সরে যায়নি বরং এখন তার লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে যুথির উপর। যুথি তার বাসায় নিরাপদ নয় জুঁইয়ের একবার মনে হয় যুথিকে তার সঙ্গে নিয়ে যেতে আবার একবার মনে হয় যুথিকে নিয়ে গেলে মা একেবারে একা হয়ে পড়বে তার চেয়ে যুথিকে জামাল সম্পর্কে পূর্ব ধারণা দিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়াই ভালো।
যুথি কিছু বলল না। জামাল জাহানারাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, খালা আম্মা আমি আজকের মতো উঠি কাল আবার আসবো তখন সবকিছু খবর নিব জুঁই, যুথি তোমরা থাকো আবার দেখা হবে।
জামাল বের হয়ে গেলে জুঁই বলল, যুথি সাবধান বোন, তুই একবারে একা হয়ে গেলি। সাবধানে থাকিস্। জামাল ভাই'র সঙ্গে তোর মেলামেশা যত কম হয় ততই ভালো।
এতদিন ভাইয়া ছিল একরকম অভিভাবক ছিল এখন আর কেউ থাকলো নারে তুই নিজের ভালো মন্দ ভেবে চলিস্। বলতে বলতে জুঁই চোখ মুছলো।
যুথির মনে তখন জামালের সেদিনের হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য ভেসে উঠল, সেই সঙ্গে নিজেকে রক্ষা করার একটা দৃঢ় প্রত্যয়। সে গণ্ডদেশ বেয়ে পড়া চোখের পানি মুছে বলল, জি আপা।
জাহিদের মৃত্যুর পর কয়েকদিন কেটে গেল।
ইতোমধ্যে জামাল একদিন জাহিদের বাসায় গিয়ে জাহিদের পাওনা স্বরুপ কয়েক হাজার টাকা তার মায়ের হাতে দিয়ে এসেছে। টাকা পেয়ে জাহানারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। জামাল আবারো সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে, খালা আম্মা জাহিদ না থাকলেও আমি তো আছি, আমি আপনাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গে আছি। প্রয়োজনে আমাকে ডাকবেন আমি চলে আসবো।
জাহানারা কান্না ভাঙ্গা গলায় বলেছিল, তোমাকে ডাকার মতো তো কেউ নেই বাবা যখন ইচ্ছে চলে আসবে।
খালা আম্মার সঙ্গে কথা শেষ করে যুথির দিকে তাকাতেই জামালের ভিতরের পশুত্বটা জেগে উঠেছিল। শরীরটা শিউরে উঠেছিল।
সেদিনের পর থেকে মাঝে মাঝেই যুথির লাবন্যময় আকর্ষণীয় সুন্দর চেহারাটা জামালের চোখের সামনে ভাসছিল। তাই আজ বিকেল থেকেই এক রকম যুথির কথা বার বার করে ভাবছিল। সন্ধ্যায় অফিসে ঢুকে জামাল বেশিক্ষণ বসল না রশিদ সাহেবের সঙ্গে দু'য়েকটা কথা বলে রিক্সায় বসে যুথির বাসায় চলে গেল।
যুথিদের বাড়িতে জামালের যাতায়াত অনেকদিনের তাই জামালের কলিংবেল টিপ দেওয়ার ধরণ শুনেই যুথি জামালের আসার কথা বুঝতে পারল। জাহানারা তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিল। যুথি দরজা খুলে দিতে গিয়ে জামাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যুথির বুকের দিকে তাকিয়ে রইল।
যুথির বুক কেঁপে উঠল, সে মৃদু কণ্ঠে বলল, আসুন ভাইয়া।
জামাল যুথির গালে একটা টোকা মেরে বাসার ভিতরে ঢুকেই খালা আম্মা খালা আম্মা বলে ডাক দিল।
জাহানারা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো, কেমন আছ বাবা?
জামাল মৃদু হেসে বলল, ভালো কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে রাখবেন?
চলো বাবা ভিতরে চলো বলে জাহানারা জামালকে ঘরে নিয়ে গেল যুথিও তাদের সঙ্গে ঘরে ঢুকলো।
খালা আম্মা যুথিকে কি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছেন?
না বাবা।
জামাল যুথির দিকে তাকিলে বলল, তুমি কলেজে ভর্তি হবে না?
যুথি মাথা নেড়ে বলল সে কলেজে হবে না।
কেন?
পড়বো না।
পড়বো না মানে?
পড়বো না মানে আর লেখাপড়া করবো না।
জামাল কৃত্রিম রাগান্বিত স্বরে বলল, তুমি বললেই হলো, আমি আছি কী জন্য? তারপর জামাল জাহানারার দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে টাকা বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, খালা আম্মা এই টাকাগুলো রাখুন, যুথিকে কলেজে ভর্তি করে দেবেন।
জাহানারা টাকা নিতে অস্বীকার করল। জামাল কিছুটা অভিমানের সুরে বলল, তাহলে কিন্তু আমি রাগ করবো খালা আম্মা। আমি থাকতে টাকার অভাবে যুথির লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে এটা হয় না, বলে জামাল একরকম জোর করে জাহানারার হাতে টাকা গুঁজে দিল।
তুমি বসো বাবা, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
জামাল চেয়ারে বসল। যুথিও তার মা'র বেরিয়ে যাচ্ছিল। জামাল মৃদু কণ্ঠ ডাক দিল, যুথি।
যুথি এক পা দরজার ভিতরে আর এক পা বাইরে রেখে বলল, জি বলুন।
জামাল দেখল ততক্ষণে জাহানারা চলে গেছে।
সে চাপা স্বরে বলল, খুব দাম হয়েছে না?
যুথির বুক কেঁপে উঠল। সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল, আপনি বসুন ভাইয়া, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
চলবে...
গডফাদার-০১ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।