‘’আমার সন্তান শুধু ভালো ছাত্র হলেই চলবে। ওর ভালো মানুষ হবার দরকার নেই। ভালো ছাত্র হলে কিছু করে খেতে পারবে। এই দুনিয়ায় ভালো মানুষ হলেই বিপদ। ‘’—বলছিলেন অভিভাবক আইয়ুব আলী।
মুখে যাই বলুন না কেন, ভেতরে ভেতরে আইয়ুব আলীও চান তাঁর সন্তান যেন ভালো একজন মানুষই হয়। অভিভাবক তাইমুন্নেসা সবার আগে গুরুত্ব দেন সন্তানের সুস্থতাকে। লুৎফা বেগম চান তারঁ সন্তান যেন শৃংখলা মেনে চলে, যেমন খাবার সময় খাওয়া, গোসলের সময় গোসল করা ইত্যাদি। তিনি আরো চান, সন্তান যেন সৎ হয়, বন্ধুদের সাথে কোথাও গেলে যেন অবশ্যই তাঁকে জানিয়ে যায়। তরিকুল ইসলাম চান তাঁর কিশোরী মেয়েটি যেন তার বয়ঃসন্ধিকাল সুন্দর ও সুস্থভাবে পার করে যেতে পারে।
এছাড়াও অভিভাবকেরা প্রত্যাশা করেন সন্তানের ভাল একটি ফলাফল, ভালো ক্যারিয়ার, সুন্দর ভবিষ্যৎ।
১১/১২ থেকে ১৬ বছরের প্রায় ১৫০ ছেলেমেয়ের সাথে কথা বলে বাবা-মায়ের কাছে ওরা কী চায় সেগুলো জানার চেষ্টা করে কিছু তথ্য পাওয়া গেল। তার মধ্যে থেকে কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হলোঃ
পকেট খরচঃ বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের পকেট খরচ নানা কারণে বাড়তে পারে। এসময় ওরা নিজেকে নিয়ে সচেতন হয়ে উঠে। নিজেকে নানাভাবে সাজাতে চায় ওরা।
বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াতে, বন্ধুর জন্মদিনে উপহার কিনতে বা কোথাও থেকে খেয়ে আসতে চাইলেও পকেট খরচ ওদের চাই। সন্তান কোন খাতে টাকা পয়সা খরচ করছে তার জন্য জবাবদিহিতা ওদের করতে হবে। আর সেটা করতে গেলেই অভিভাবক হয়ে যাবেন(সন্তানের চোখে) খুব খারাপ । তাই আপনার আয়-ব্যয় সম্পর্কে একটা ধারণা সন্তানের কাছে দিয়ে রাখা ভাল। সন্তান নিজেও তবে বুঝতে পারবে, সে অভিভাবকের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে কিনা।
চাইলেই টাকা না দিয়ে বরং সন্তানকে আয় করা শেখাতে পারেন। আপনার বিভিন্ন কাজে (যেমন ব্যাংকে বিল দিয়ে আসা, রান্নার কাজে সাহায্য করা, বাজার করা ইত্যাদি) আপনাকে সাহায্য করার জন্য টাকা দিতে পারেন। এতে ওরা যেমন কিছু কাজ শিখতে পারবে, তেমনি ওদের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি হবে, মিতব্যয়ীও হয়ে উঠবে। টাকা কীভাবে খরচ করা যায়, তা নিয়ে ওদের ধারণা দিতে পারেন। কেননা, টাকা খরচ করেই যে শুধু আনন্দ পাওয়া যায় তা তো নয়।
‘’টাকা দিয়ে টাকাকে উপভোগ করা যায় না‘’ (-আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ)। আনন্দকে উপভোগ করার জন্য যে একটা সুন্দর মন আর রুচি দরকার, সেটা আগে ওদের তৈরি করা শেখাতে হবে। তবে শুধু টাকা খরচ করা নয়, সঞ্চয় করাটাও ওদের শেখাতে হবে। মাদকে আসক্ত হয়ে পড়লে সন্তানের পকেট খরচ হঠাৎ করে বেশি বেড়ে যেতে পারে। তবে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া কখনোই সন্দেহের বশে সন্তানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করবেন না।
কোন বিশেষ জিনিস (যেমনঃ মোবাইল, ল্যাপটপ) ঃ কোন বিশেষ জিনিসের প্রতি সন্তানের দূর্বলতা তৈরি হতে পারে। কিন্তু ঐ জিনিসটা তার কী গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগবে বা আদৌ কোন কাজে লাগবে কিনা সেটা নিয়ে সন্তানের সাথে সময় নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। সন্তানের যদি সত্যিই খুব দরকার হয় তবে আপনার নিজের জিনিসটি তাকে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে দিন। একান্তই যদি সন্তানের জন্য নতুন আরেকটি কিনে দিতে হয়, তবে অবশ্যই শর্ত দিয়ে দিতে হবে। সন্তানকে কোন লক্ষ্য দিয়ে পারেন যা অর্জন করতে পারলে ঐ জিনিস তাকে দেওয়া হবে।
আপনি যদি এমন কোন কথা দিয়ে থাকেন তবে অবশ্যই তা পূরণ করতে হবে। তা না হলে আপনার প্রতি সন্তান বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। এছাড়াও এসব জিনিস কতটুকু সময় ব্যবহার করবে, তার জন্যও মৌখিক বা প্রয়োজনে লিখিত চুক্তি করে নিতে পারেন।
বাবা-মায়ের সময় দেওয়া ঃ এই ব্যস্ত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে বাবা-মায়েরা যে কাজটা করতে সবচেয়ে বেশি উদাসীন থাকেন, তা হলো সন্তানকে সময় দেওয়া। এমন কি অনেক গৃহিনী মায়েদের দেখা যায় সন্তানকে সময় দেবার ব্যাপারে তারা সচেতন নয়।
সময় দেওয়া মানে এই নয়, সারাদিন সন্তানের সাথে থাকা, তার জন্য খাবার তৈরি করা, পড়া দেখিয়ে দেওয়া। বরং এমন একটি সময় যা সন্তানের কাছে আনন্দময় ও অর্থবহ হয়ে উঠবে। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় বেছে নিন, যে সময়টা আপনি সন্তানকে দেবেন, হোক না সেটা মাত্র একটি ঘণ্টা। সন্তানের সাথে কথা বলে ঠিক করে নিতে পারেন কখন ও কীভাবে সময়টা সুন্দরভাবে কাটাতে পারেন। মাঝে মাঝে কোথাও থেকে আপনারা ঘুরেও আসতে পারেন।
বাবা-মা যেন ওদের কথা শোনেঃ সারাদিনে স্কুলে, স্যারের বাসায়, পথে যা যা ঘটে, মনে যত নতুন প্রশ্ন আসে, সেগুলো বাসায় এসে বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার করার জন্য সন্তানেরা উন্মুখ হয়ে থাকে। কিন্তু অনেক বাবা-মা সেগুলো মন দিয়ে শোনার কোন প্রয়োজন মনে করেন না। ফলে একসময় সন্তানেরা বাবা-মায়ের সাথে কথা শেয়ার করার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ওরা তখন বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মনের কথা শেয়ার করতে, সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে মনোযোগ না পেয়ে অনেকক্ষেত্রে ক্ষতিকর বা অসৎ কারো সংগে ওদের বন্ধুত্ব হয়ে যেতে পারে।
এজন্য সন্তানকে অভিযোগ না করে, তার সাথে সহজ সুন্দর বন্ধুত্বটা বজায় রাখতে হবে। সন্তানের সাথে সাথে তাদের বন্ধুদের সাথেও সুন্দর বন্ধুত্ব তৈরি করে নিতে হবে। সন্তানের বন্ধু হলেও তার গোপনীয়তাকে সম্মান ও রক্ষা করতে হবে। সন্তানের সব ব্যাপারে নাক গলাতে বা জেরা করতে যাবেন না। এতে সন্তানের সাথে আপনার দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে।
তেমন ভালো বন্ধু যদি হতে পারেন, সন্তানই আপনার সাথে সব কিছু শেয়ার করবে। আর তখন আপনি অবশ্যই তা মন দিয়ে শুনবেন।
বাবা-মা যেন ওদের ভালবাসেঃ সন্তানকে ভালবাসেন না এমন বাবা-মা কি এ পৃথিবীতে আছে? তবু, সন্তানদের একটি বড় অভিযোগ হলো, বাবা-মা তাদের ভালবাসে না। এই রকম তাদের কেন মনে হয়? বাবা-মা যে সন্তানকে ভালবাসেন, সেটা তাঁরা সচরাচর মুখে বলেন না, এমন কি তাদের অভিব্যক্তিতেও তা প্রকাশ করেন না। অনেক বাবা-মা সন্তানের কাছে ভালবাসার কথা প্রকাশ করাকে নিজের দূর্বলতা ভেবে থাকেন।
সন্তানের সাথে বন্ধুত্ব তো দূরের কথা, বেশির ভাগ সময় নিজেদের প্রত্যাশাগুলো চাপিয়ে দিয়ে কর্তৃত্বমূলক আচরণ করে থাকেন। স্বভাবতই সন্তানের কাছে অজানা থেকে যায় বাবা-মা তাকে কতটা ভালবাসে। বড় হতে থাকে বাবা-মায়ের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ (অনেক সময় ঘৃণাও) নিয়ে। এই সন্তানটির কাছ থেকে বাবা/মা হিসেবে আপনি ভালবাসা আশা করতে পারেন কি? সন্তানের সাফল্য বা অর্জনে খুশি হলে তা সরাসরি সন্তানের কাছে প্রকাশ করুন। বলুন, ‘’তোমার এই কাজটিতে আমি অনেক খুশি হয়েছি।
‘’ তাকে অভিনন্দন জানাতে পারেন কোন উপহার দিয়ে। সন্তানের আবেগ অনুভূতিগুলো এড়িয়ে না গিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন। তার খারাপ সময়টিতে সমালোচনা না করে, তার পাশে থাকুন, তাকে জড়িয়ে ধরুন, সাহস যোগান। সন্তানকে ভালবাসুন নিঃশর্তভাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।