কিছুটা আমার কিছুটা তোমার.. মেলেনা তো কিছু এখন আর!
কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে নুমা,ইশ...!বাসা পা্ল্টানো যে কি ঝামেলার কাজ তার উপর এতো বছর এক জায়গায় সব কিছু সাজিয়ে রাখার পর আবার সব কিছু এলোমেলো করে গুছানো সোজা কথা না। কিন্তু কি আর করা?...বাস্তবতা তো আর তা বুঝবেনা,তাই কষ্ট করতেই হচ্ছে।
কম সময় না,প্রায় ১২বছর। বলতে গেলে বুঝজ্ঞান হওয়ার পর থেকেই শাজাহানপুরের সেই বাসাতেই বড় হয়েছে নুমা। স্কুল,কলেজ,ভার্সিটি সব ওখান থেকেই শুরু ছিল।
বড় বোন ইমা আপুর বিয়ে,পাভেল ভাইয়ের বাইরে পড়তে যাওয়া,দাদীর মৃত্যু ওদের পরিবারের প্রায় উল্লেখযোগ্য অনেক ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে সেই বাড়ীটা।
তবে নতুন বাসাটা নুমার যে খুব অপছন্দ হয়েছে তাও না। বাসাটা বেশ সুন্দর,বলতে গেলে ওর মনের মতো,আকাশের কাছাকাছি একটা বাসা,বারান্দায় দাড়ালে খুব নিবিড় ভাবে আকাশ দেখা যায়। কিন্তু তারপরেও কিছুক্ষন পর পর কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগে,অস্বস্তি কাজ করে মনের ভেতর। বাসায় আম্মুকে সাহায্য করার মানুষ বলতে নুমাই আছে।
নতুন এসেছে তাই এখনো কাজের লোক রাখা হয়নি,অবশ্য বাসায় মানুষ বলতে মাত্র তিনজন। আপু মাঝে মাঝে আসে বাচ্চাকে নিয়ে,আর ভাইয়াতো কবে ফিরবে কে জানে...!
ভাইয়ার জন্য মনটা অনেক খারাপ লাগে নুমার। এত দূরে একা একা কেমন আছে কে জানে!এখানে তো এক গ্লাস পানিও নিজে ঢেলে খেতো না,চুলা কিভাবে জ্বালাতে হয় তাও জানতো না,আর সে বেচারা এখন কতো কিছু করছে একা একা। আগে তাকে সবাই উপদেশ দিতো আর এখন ফোন করে সারাক্ষন ছোট বোনকে উপদেশ দেয়!!
গত ২/৩ দিনে পুরো বাসাটা মোটামোটি গুছানো হয়ে গেছে বলা যায়,আজকে নুমা নিজের বারান্দাটা গুছাতে এসেছে,দরজাটা খুলে বেশ অবাক হলো নুমা!বেশ কিছু জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে বারান্দাতে...তার মানে এই ফ্ল্যাটে আগে যারা ছিল তারা এখানে বেশ কিছু জিনিস ফেলে গেছে,একটু বিরক্ত লাগল নুমার।
জিনিস গুলো ময়লার ঝুড়িতে রাখতে লাগল,তখনই চোখে পড়ল একটা লাল ডায়েরী।
ডায়েরীটা খুব পুরোনো বলা যায় না,তবে সব গুলো পাতাতেই লেখা আছে।
ডায়েরির টা খুলল নুমা,একদম প্রথম পাতায় লেখা,''নিজের কিছু অব্যাক্ত কথা জমিয়ে রাখি এই আশ্রয়ে''।
নুমা বঝলো এটা কারো ব্যাক্তিগত ডায়েরী,আবারো বিরক্ত হলো নুমা,নিজের ব্যাক্তিগত জিনিস কেউ এভাবে ফেলে রেখে যায়...!অদ্ভুদ!
ডায়েরীটা নিজের টেবিলে রেখে,আবার কাজে মনোযোগ দিল নুমা।
২দিন পর পাশের ফ্ল্যাটের রিমা আপু নুমা কে তার সাথে ছাদে যাওয়ার প্রস্তাব দিল,নুমা খুশী হয়ে আপুর সাথে ছাদে গেল।
ছাদে যেয়ে কিছুটা অবাক হলো,আসলে এতো উঁচু থেকে এই শহরকে সে কখনো দেখেনি,অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করল মনে।
গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে নুমা জিজ্ঞেস করল রিমা কে,
--আচ্ছা,আমাদের আগে এই ফ্ল্যাটে যারা থাকতো তাদের সাথে কি তোমাদের এখনো যোগাযোগ আছে আপু?
--নাহ তো!আসলে ওরা কোথায় গেছে তা ক্লিয়ার করে বলে যায়নি।
একটু অবাক হলো নুমা,
--তোমরা জিজ্ঞেস করনি?!আচ্ছা কে কে থাকতো সেই ফ্যামিলিতে বলতে পারো?
--হুম,করেছিলাম কিন্তু কিছু বলেনি,আর ফ্যামিলিতে তোমাদের মতোই তিনজন থাকতো, আঙ্কেল-আন্টি আর তাদের মেয়ে পায়েল,একটা ছেলে আছে পলাশ ভাই সে দেশের বাইরে স্যাটেল ছিল। আর পায়েল আপু একটা কোম্পানীতে জব করতো আর তোমার মতোই একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে এম.বি.এ করতো। বেশ হাসি-খুশী পরিবার ছিল ওরা। সবার সাথেই ভালো খাতির ছিল।
তবে আপু বিয়ে করেননি,কেন করেননি এ নিয়ে আমি অনেক খোঁচাতাম কিন্তু কারন বের করতে পারিনি।
--হুম। আসলে মানুষয়ের জীবন অনেক অদ্ভুদ,অনেক কিছু থেকেও কিছু নেই,আবার অনেক কিছু থাকার কথা থাকলেও নেই...
একটু অবাক হলো রিমা!
--বাপরে,কি কথা!সাহিত্য করছ নাকি?!!হাহাহা
কিছু না বলে হাসলো নুমা।
সন্ধ্যায় আব্বু-আম্মু কে চা-নাশতা দিয়ে এসে নিজের রুমে না বসে চা নিয়ে বারান্দায় যেয়ে বসল নুমা। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল নুমা,এমন মনের মতো একটা পরিবেশে দেয়ার জন্য।
টুলের উপর চায়ের কাপটা রাখতে যেয়ে খেয়াল করল,আজকে সে মগে চা এনেছে,নুমা সাধারনত মগে চা খায় না। হঠাৎ করেই কি যেন মনে পড়ে গেল নুমার.এই পরিবেশ,সাথে চা...কোথাও যেন শুনতে পেল... ..
'শোন, একটা স্বপ্ন বলি,বসন্তের কোন এক সন্ধ্যা বেলা,সাথে এক মগ চা,খোলা আকাশ না,আ্কাশের কাছাকাছি একটা বারান্দা...ইশ,ভাবতেই ভালো লাগছে,কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে এমন স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই রয়ে যাবে,হাহাহাহা'
সেদিন নুমাও শিমুলের এমন কথার সাথে হেসেছিল খুব। মনটা আনমনে হয়ে গেল নুমার, আজ সেই মূহুর্তটা ঠিকই এসেছে,তবে শিমুল সাথে নেই...হয়তো সে এখন সকাল সন্ধ্যা অফিস আর না হলে সারাক্ষন ব্যাবসার কোন প্রেশার নিয়ে স্বপ্ন গুলো ভুলে দিন পাড় করছে।
ধীরে ধীরে নিজের রুমে আসল নুমা,টেবিলের ভেতর থেকে লাল ডায়েরী টা বের করল
পাতা উ্ল্টাতে লাগল একের পর এক। অনেকটা অগোছালো আর বিক্ষিপ্ত কিছু লেখা।
''সম্পর্ক গুলো কেন এমন হয়?...এত ভালোবাসা দিয়ে ধরে রাখতে চাই কিন্তু পারিনা...ভালো লাগছে না কিছু...''
''অনিক কে কি আমি চিনতে ভুল করেছি?!এমন তো হবার কথা না। আজকাল কেন বারবার ও আমাকে ভুল বুঝে?আমি নিজেও ওকে বারবার ভুল বুঝছি!এমন কেন হচ্ছে...!''
'' আজ আমার জন্মদিন ছিল,সবাই উইশ করল,শুধু অনিক ছাড়া। সারাদিনে এত বার কথা হলো কিন্তু একবার ও বলল না। ও আসলে ভুলে গেছে যে আজ আমার জন্মদিন!!কেমন করে পারল ভুলে যেতে?আমি কি তাহলে ওকে এতোই কষ্ট দেই?''
''সব কিছু কেমন এলোমেলো হচ্ছে। আজকাল এত রাগ অনিক আমার উপর কেন করে?দোষ করবে অথচ স্যরি বলবে না।
কি এমন ক্ষতি হয় নিজের দোষ স্বীকার করলে?!!''
''আজ মনে হচ্ছে আমি অনেক বড় ভুল করেছি অনিককে ভালোবেসে। কিন্তু এত দেরীতে কেন বুঝলাম??অনিক আর আমার মাঝে বিশাল পার্থক্য,কোন কিছুই এখন আর ওর সাথে মিলে না। কথা,কাজ,স্বপ্ন কোন কিছুই মিলে না। ''
ডায়েরীটা বন্ধ করে দিল নুমা। একদমই ভালো লাগছেনা আর...কেমন জানি অস্থির লাগছে খুব।
আবার বারান্দায় এসে বসল।
রাতের অন্ধকারের দিকে তাকালো নুমা,কেন জানি আজ অনেক দিন পর শিমুলের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হয় নুমার।
অনেক বার ভেবেছে,শিমুলকে ফোন করবে,আরেকবার চেষ্টা করে দেখবে কিন্তু পারেনি।
আসলে চেষ্টা করেই বা কি লাভ?যা ভেঙ্গে ফেলেছে একবার তা আগের মতো আবার জোড়া লাগবে তার কি গ্যারান্টি?
নিজের সাথে পায়েলের অনেক মিল পেল নুমা।
সেও পায়েলের মতোই সারাক্ষন নিজের সাথে শিমুলের মিল খুঁজে বেড়াতো,ভালোবাসা পরিমাপ করে যেতো শুধু। কিন্তু আজো অনেক প্রশ্নের উত্তর নিজের কাছে খুঁজে পায়নি নুমা।
শিমুল চলে গেছে এতো দিন হলো কিন্তু আজো অনেক অনেক প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায়। ইচ্ছে হয় একবার শিমুলকে যেয়ে জিজ্ঞেস করতে,কিন্তু পারেনা। কারন সে জানে শিমুল কোন উত্তর দিবেনা বরং একগাদা দোষ ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিবে।
অথচ শুরুটা কত সুন্দর ভাবেই না হয়েছিল।
আবারো ডায়েরীটা হাতে নিল নুমা। পড়তে পড়তে শেষের দিকে চলে এলো...
''আজ এত গুলো দিন হয়ে গেল অনিক দেশের বাইরে গেছে ট্রেনিং এ। অবাক হচ্ছি আমি আমাকে দেখে!আমার ভেতর কোন অস্থিরতাই কাজ করছে না। আগের মতো কোন ব্যাকুলতা নেই মনে।
তাহলে কি অনিকের প্রতি আমার ভালোবাসা শুধুই কিছু দিনের আবেগ ছিল?না কি অনিকের বার বার দোষারপের কারনে ভালোবাসা ধীরে ধীরে কমে গেছে?''
''আজ অনিকের কাছ থেকে মুক্তি নিয়ে এলাম। ও একটু অবাক হলেও খুব একটা বাঁধা দেয়নি,ও বুঝতে পেরেছিল আমার আর ওর প্রতি তেমন কোন টান নেই।
অবাক লাগছে,জীবনে ভালোবাসা নিয়ে কম কাব্য পড়িনি,কত শত নীতি বাক্য,বান্ধবীদের কত টিপস দিতাম আর সেই আমি?আজ নিজের ভালোবাসা থেকে মুক্তি নিয়ে আসছি...!''
''দেখতে দেখতে অনেক গুলো বছর চলে গেল। কিন্তু কোন কিছুই আর বদলালো না। বলব না অনেক বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম,আবার এও বলতে পারিনা যা করেছি অনেক ভালো করেছি...কি অদ্ভুদ সমীকরন জীবনের।
!!''
''এই ডায়েরিটা আমি যখন কিনে ছিলাম,তখনই ভেবেছিলা,যদি কোন দিন কাউকে ভালোবাসি তাহলে এখানে শুধু তার আর আমার কথা লিখব। ডায়েরীটা শেষ করতে পারলাম না,কিন্তু ভালোবাসার গল্প ঠিকই শেষ হয়েছে...''
নুমা দেখল ডায়েরিটার শেষ পাতাটা খালি। আসলেই পায়েল শেষ করতে পারেনি।
নুমা পেনবক্স থেকে একটা পেন হাতে নিল। আপন মনেই লিখতে শুরু করল...
''বড্ড কষ্ট লাগে,চারপাশে এমন অপূর্ণ সম্পর্ক গুলো দেখে,সবই আছে কিন্তু বুকের ভেতর কোথায় যেন বিশাল একটা কষ্ট চেপে রাখা হয়েছে...আজকাল চারপাশে এমনই বেশী দেখতে পাচ্ছি।
যে স্বপ্ন নিয়ে দু'জন মানুষ পথ চলা শুরু করে তা আর পূর্ণ হয় না। পথ কি বড় থাকে নাকি পথ ভুলে যায় কে জানে...?আজকাল কোন সম্পর্ক নিয়েই কেউ আর ভাবতে চায় না,শুধু যে সময়টা পাড় করছে তা চলে যাওয়ার অপেক্ষা করে,যেমনটা আমিও করেছিলাম। কিন্তু পেরেছি কি পাড় করতে?নাহ,সব সময় শূন্যস্থান গুলো পূরন হয় না। কিছু শূন্যতা রয়েই যায়। হয়তো যুক্তি দিয়ে অনেক ভাবেই অনেক কিছু বলা যায়,অনেক কথার সমাধান করা যায়,কিন্তু তারপরেও কিছু কথা রয়েই যায়।
এই ডায়েরীটার শেষ পাতার লেখা গুলো এমন হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু হয়েছে...গল্প শেষ হয়েছে,ডায়েরীর মানুষ গুলোও যার যার মতো চলে গেছে কিন্তু সাথে নিয়ে গেছে এই জমানো কথা গুলো,যা সব সময়ই সাথে থাকবে। খুব ভালো লাগত যদি শেষ টা এমন না হতো...যদি শেষটা অন্যভাবে হতো...''
লেখা শেষ করে নুমা ডায়েরীটা যত্ন করে রাখল,তারপর আবারো বারান্দায় যেয়ে দাড়াল।
[উৎসর্গঃঅনেক দিন আগে কারো কাছে শুনেছিলাম,আমাদের সবার মনের কোন এক গহীন বনে শুকনোপাতার এক রাজ্য আছে,সেই রাজ্যের পাতাগুলো সব সময় শুকনো থাকে কখনো বিবর্ন হয়,কখনো রঙ্গীন হয়...যদি একটু চেষ্টা কর তাহলেই দেখতে পাবে সবুজে ঘেরা মন জুড়ে থাকা সেই জায়গাটা। ] ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।