অরুণালোক দেশনেতাদের সংসদীয় বচন
তৈয়ব খান
ছেলেবেলায় দু’জন মৌলবিকে নিয়ে গল্প শুনেছিলাম। গল্পটা এরকমÑ এক গৃহস্থ বাড়িতে নিমন্ত্রণে এসেছেন দু’জন মৌলবি। গৃহকর্তা খুব তাজিমের সাথে দু’জনকে বসালেন। আনুসাঙ্গিক আলাপ আলোচনার পর খাবারের সময় হলে তিনি ব্যবস্থা করতে ছুটলেন। এদিকে খাবারের আয়োজন দেখে প্রথম মৌলবি হাত ধুবার জন্য বাইরে এলেন।
এই ফাঁকে গৃহকর্তা দ্বিতীয় মৌলবিকে প্রশ্ন করলেন, 'আচ্ছা হুজুর, ঐ যে মৌলবী সাহেব বাইরে গেলেন, উনি লোক হিসেবে কেমন'? দ্বিতীয় মৌলবি ফিক ফিক করে হেসে বললেন, 'আর বলবেন না, উনি তো একটা ছাগল। উনি কিছু জানেন নাকি?' মনের ক্ষোভে কথাগুলো বলতে না বলতেই প্রথম মৌলবি ঘরে ঢুকলেন। তা দেখে দ্বিতীয় মৌলবির মুখ শুকিয়ে আমশি হয়ে গেলো। নিজেকে খানিকটা সামলে উনি হাত ধুতে বাইরে গেলেন। এবার গৃহস্বামী প্রথম মৌলবিকে বললেন, 'আচ্ছা হুজুর, এই মৌলবি সাহেবকে আপনার কেমন মনে হয়? প্রথম মৌলবি খিক খিক করে এক পক্কর হেসে বললেন, আর বলবেন না, উনি কিচ্ছু জানেন না।
উনি তো একটা গাধা'। হাত ধুয়ার পর দ্বিতীয় মৌলবি ফিরে এলেন এবং যথারীতি খাবারের জন্য প্রস্তুত হলেন। গৃহস্বামী উনাদের বসিয়ে রেখে ভেতর থেকে ঢাকনা দেওয়া দু’টি রেকাবি এনে উনাদের সামনে রাখলেন। মৌলবি সাহেবগণ তখন জিহ্বা চেটে নিয়ে ঢাকনা দেয়া রেকাবি দু'টো খুলে আৎকে উঠলেন। কেননা, ঢাকনা দেওয়া রেকাবী দু’টির একটিতে ভুষি ও অন্যটিতে ছিলো খড়।
সংবিত ফিরে পেতেই মৌলবি দু'জন তখন একাট্টা হয়ে গৃহস্বামীর উপর চরাও হলেন। রেগে গিয়ে অনেকক্ষণ খিস্তি খেউর করে গৃহস্বামীকে তাদের সাথে এমন রসিকতা করার কারণ জানতে চাইলেন। গৃহস্বামী তখন অম্লান বদনে বললেন, কেন, আপনাদের জন্য ভুষি আর খড়ের ব্যবস্থা করেছি জানেন? করেছি এজন্য যে, আপনারা একজন আরেকজনকে ছাগল আর গাধা বলেছেন। তাই যখন দেখলাম, আপনারা আপনাদের পরিচয় এভাবে দিলেন, তখন আমাকে এরকম খাবার পরিবেশন করতে হলো। এতে আপনারা আমার দোষ ধরছেন কেন? আপনারা এক মৌলবি আরেক মৌলবিকে দেখতে পারেন না।
যারা সমাজকে আদর্শ, শালিনতার শিক্ষা দেবেন, তারাই যদি নিজেরা নিজেদের এভাবে নিজেরা নিজেদের অপদস্ত করেন তো, সমাজ আপনাদের কাছ থেকে কী আশা করবে? গৃহস্বামীর এ কথায় মৌলবি দু'জন চেতনা ফিরে পেয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
সম্মানিত পাঠক, এ গল্প অনেক পুরোনো। মাঝে মাঝে পুরোনো গল্প থেকে উদ্ধৃতি দিতে হয় এজন্য যে, গত ২০ মার্চ পত্রিকার পাতায় সংসদে অশালীন বক্তব্য সম্পর্কিত যে সংবাদ বিশ্বের বাংলাভাষাভাষী পাঠ করেছে, তাতে ব্যাপারটাকে ষাড়ের লড়াই বলা ছাড়া কিছুই বলা যায় না। আমরা আগেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় পড়েছি, টেলিভিশনে দেখেছি যে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে কথা বলেন নি। সবসময়ই তারা একে অপরকে আক্রমণাত্মক কথা বার্তা দিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু তাদের এ বালখিল্যতা কেন? রাজনীতিবিদরা কেন একটি পক্ষ আরেকটি পক্ষকে এভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন, এটা বোধগম্য নয়। ব্যক্তিগত আক্রমণের জায়গা সংসদ নয়।
একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, জাতীয় সংসদে অনগ্রসর নারীদের পক্ষে কথা বলার পক্ষে প্রথমত: ৩০ আসন সংরক্ষণ করা হলেও পরবর্তীতে তা বাড়িয়ে ৪৫ করা হয়েছে। সাধারণত: যারা সরকার পরিচালনা করেন, তারাই এ আসনগুলোর সদস্য মনোনীত করেন। এসব আসনের সম্মানিত মহিলা সদস্যগণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন।
জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হলেও জাতির প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা কম নয়। কিন্তু তাদের কথাবার্তায় এটি কখনো পরিষ্কার হয় নি যে, তাঁরা জাতির কাছে দায়বদ্ধ আছেন। বরং সবসময়ই মনে হয়েছে তাঁরা শুধুই তাদের দলের পক্ষে। কিন্তু যেসব সম্মানিত মহিলা সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন তাঁরা তাদের কর্মকা- ও কথাবার্তার জন্য অবশ্যই জাতির কাছে দায়বদ্ধ। বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনসহ নারী সদস্যের সংখ্যা ৬৪জন এবং পুরুষ সদস্যের সংখ্যা ২৮১জন।
যার শতকরা হার ১৮.৫৫। এমন একদিন আসবে নারী সংসদ সদস্যের সংখ্যা আনুপাতিক হারে আরও বাড়বে। নারী প্রতিনিধির সংখ্যা আরও বাড়–ক, দেশমাতৃকার জন্য তাঁরা পুরুষের পাশাপাশি হাতে হাত,কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করুন, এটি সবাইরই কাম্য। কবি নজরুল বলে গেছেনÑ, ‘সেদিন সুদূরে নয়/যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়’। আমরা তা বিশ্বাস করি।
আর বিশ্বাস করি বলেই নারী প্রতিনিধির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ারই পক্ষপাতি। কিন্তু সেইসব মাতৃমতি নারী সংসদ সদস্যদের কেউ কেউ এমন আপত্তি জনক কথা বলেন যে, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জাগে না। কোন কোন নারী সংসদ সদস্য যখন তাঁরই সমমানের আরেকজন পুরুষ সংসদ সদস্যের পোশাক খোলে দিগম্বর করে ফেলতে চান, তখন খুব কষ্ট হয়। যখন একজন সম্মানিত নারী সংসদ সদস্য অন্য একজন নারীকে ‘নিষিদ্ধ পল্লী’র বলে মন্তব্য করেন, তখন ভাবতে অবাক লাগে একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীকে কেমন করে বেইজ্জতি করতে পারে? তাও আবার মহান সংসদে দাঁড়িয়ে?
সংসদ একটি দেশের প্রাণকেন্দ্র। এ প্রাণকেন্দ্রে তাঁরাই যেতে পারেন, যারা সত্যিকারার্থেই জ্ঞানী-গুণী।
তাঁরা জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত হয়েই এ প্রাণকেন্দ্রে গিয়ে দেশবাসীর সুখ-সুবিধার কথা বলেন, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যে সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করেই দেশ পরিচালিত হয়। আল্লাহর বিশেষ রহমত ছাড়া কেউ দেশ ও দশের নেতা হতে পারেন না। অথচ সেই বিশেষ রহমতের ছায়া পেয়ে যারা তার অপব্যবহার করেন, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন যে, ভুল করছেন! সংসদের চেচামেচি থামাতে সম্মানিত স্পিকারকে বলতে হয়, স্পিকার যখন কথা বলেন, তখন অন্যদের কথা বলার অধিকার নেই'। এ কথাটি আমাদের শিক্ষিত, জ্ঞানী ও বিচক্ষণ সংসদ সদস্যরাও জানেন। কিন্তু তারা তা পালন করেন না।
এটি সত্যিই লজ্জাজনক। পবিত্র সংসদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো নাগরিক কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে। তাই ওখানে যদি গঠনমূলক বক্তব্যের পরিবর্তে বিশ্রী কথা-বার্তা চলে তো, মহান সংসদের প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধা থাকে, তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না।
সংসদে গঠনমূলক ও ইতিবাচক বিতর্ক হতেই পারে। যে বিতর্ক দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়, তাইতো সকলের কাম্য।
কিন্তু তা না হয়ে দেশের জ্ঞানী-গুণী সংসদ সদস্যগণ যেভাবে একে অপরকে দোষারোপ করেন, তা কখনোই ইতিবাচক ও গঠনমূলক নয়। আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর (আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি) আগে পরে দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং প্রতেকের সময়েই দেশে উন্নয়নমূলক কর্মকা- হয়েছে, এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। সে উন্নয়ন কতোটুকু হয়েছে, আর কী কী পদক্ষেপ নিলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, সেসব নিয়েই আলাপ আলোচনা হওয়া উচিত। দেশ নেতাদের মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা না থাকলে সমর্থকরা তো গোলযোগ করবেই। প্রতিপক্ষের সাথে মারামারি-কাটাকাটি, অপহরণ, গুম ইত্যাদি থামাতে হলে কেবল মাত্র প্রশাসনই যথেষ্ট নয়।
এক্ষেত্রে নেতাদের ভূমিকাটাই আসল। দেশের মানুষ নেতাদের আদর্শকে অনুসরণ করতে চায়, করেও। অথচ সেই দেশ নেতাদের মাঝে জনসাধারণ যখন সহিষ্ণুতার পরিবর্তে উগ্রতা, সত্যের পরিবর্তে মিথ্যা, আদর্শের পরিবর্তে অনাদর্শ দেখতে পায়, তখন তাঁদের প্রতি আর শ্রদ্ধা রাখতে পারে না। তাই বিনীত অনুরোধ, পরস্পরের প্রতি ঘৃণা না ছড়িয়ে, গীবত, পরচর্চা, অপপ্রচার বন্ধ করুন। সত্যিকারের গঠনমূলক কাজে আপনারা দেশের মানুষের সহযোগিতা সবসময়ই পেয়েছেন, পাবেনও।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।