আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘আমি ভগবান বলছি’

লেখা তিথি দিন দিন কেমন যেন হয় যাচ্ছে। সুন্দর মিষ্টি স্বভাবের মেয়েটা হঠাৎ করেই সুমনের সঙ্গে প্রতিদিন ঝগড়া শুরু করলো। ‘তরকারীতে একটু ঝাল বেশী হয়েছে’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঝামটে উঠলো তিথি, ‘আমি তোমার বাঁধা দাসী না। যা রেঁধেছি পারলে খাও নইলে আর কাউকে নিয়ে আসো। কোন বাঁধা দিবো না।

‘ তিথি এমন ছিল না। যেমন সুন্দরী তেমনই মিষ্টি স্বভাবের ছিল। সুমনের সঙ্গে প্রায় পাঁচ বছরের প্রেম শেষে বিয়ে। সংসারও বেশ ভালোই করছিল। দুবছরের মাথায় মনে পড়লো, একজন অতিথি চাই।

চেষ্টাও শুরু হল। একবছর গড়াল। একদিন মাথা নিচু করে তিথি বলল, ডাক্তার দেখালে হয় না? সুমনের ও মায়া লাগলো। মা হওয়ার জন্য রীতিমত অস্থির হয়ে গেছে মেয়েটা। রাজী হল সুমন।

কিছু টেস্ট, কিছু ওষুধ, আবার চেষ্টা। এবার সুমন নিজেও ঘাবড়ে গেল। তাহলে কি নিঃসন্তান থাকতে হবে? আরও বড় ডাক্তার দেখাবে? এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করলো। ‘সিঙ্গাপুর থেকে ঘুরে আয়। তেমন সমস্যা হলে টেস্ট টিউব বেবি নিবি।

তোর তো আর টাকা সমস্যা না। ‘ কি করবে ভাবছে, এমন সময় একদিন ঘটলো অ্যাকসিডেন্ট টা। দুইজন গাড়ী করে ফিরছিল। ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা। দুজনেই বেশ ভালো রকম আহত হল।

তিথি বেশী। ওর তলপেটের আঘাতটা বেশ গুরুতর ছিল। জীবন বাঁচাতে ওর গর্ভাশয় কেটে ফেলতে হল। কিভাবে কথাটা বলবে তা ঠিক করতেই সুমনের মাস খানেক লাগলো। এরপর আর লুকানো গেল না।

প্রশ্নের পর প্রশ্ন। ‘আমার কি হয়েছে? কি অপারেশান করেছে?’ সব বলতে হল। এরপর থেকে তিথি একদম স্তব্ধ হয়ে গেল। কথা খুবই কম। একেবারে না বললেই না এমন সব কথা।

‘খেতে এসো’ ‘লাইট বন্ধ কর’ ‘বই পড়তে চাইলে ঐ ঘরে যাও’ সারা দিনে বড়জোর আট দশটা কথা হত। সুমন অপেক্ষা করতে থাকলো, শুরুর ধাক্কাটা কাটিয় উঠুক। তাঁর কোন লক্ষণ নাই। একবার সিঙ্গাপুর ঘুরতে যেতেও চাইলো। তিথি কেবল কড়া চোখে তাকাল।

ব্যাপারটা থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। এখন তো কথাই বলা যায় না তিথির সঙ্গে। ‘তোমার ডিমের কোরমা টা খুব মজার হয়। খুব খেতে ইচ্ছে করছে।

‘ ‘ভুলে গেছি। ‘ এভাবে কতদিন চলবে? সুমন একবার ভেবেছিল সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছ নিয়ে যাবে। কিভাবে বলবে তাই ভেবে পাচ্ছিল না। একদিন সাহস করে বলল, একটু ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবে? কিসের ডাক্তার? তুমি তো সারাক্ষণ খুব ডিপ্রেসড থাকো। তাই ভাবছিলাম যদি...।

কথা আর শেষ করতে পারে নি। ‘ডিভোর্স চাই?’ ডিভোর্সের কথা আসছে কেন? পাগল বউ নিয়ে আর সংসার করা যাচ্ছে না, এই তো? প্লিজ, আমার পয়েন্ট টা বোঝার চেষ্টা কর। তোমার নিজের কি অবস্থা হয়েছে একবার তাকিয়ে দেখেছো? ও, এখন চেহারাও আর ভালো লাগছে না? কবে চাই? আর কথা বাড়ানো যাবে না। যে কোন মুহূর্তে বিস্ফোরণ হবে। ক্ষান্ত দেয়ার চেষ্টা করলো।

‘পরে কথা বলব। ‘ বলে অন্য ঘরে গেল। আজকে এই ঘরেই শোবে ঠিক করল। রাতে খাবারের জন্যও কোন ডাক এলো না। খিদে খুব একটা নাই ও।

এমনি ঘুম আসবে বলে মনে হচ্ছে না। ঘুমের ওষুধ বাসায় ছিল। একটা খেয়ে নিল। ‘চল। ’ ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভাঙল।

প্রথমটায় বুঝতে পারলো না কি ঘটছে। একটু পরে বুঝলো, তিথি এসেছে তাঁর ঘরে। কি ব্যাপার? রেডি হও। কেন? আমি সব ঠিক করে ফেলেছি। কি ঠিক করে ফেলেছো? রেডি হও।

তা হচ্ছি। কিন্তু কোথায় যাব? তিথি কড়া চোখে তাকাল। সুন্দর করে সেজেছে। অনেকদিন পরে ভালো করে তিথির দিকে তাকাল সুমন। বেশ দেখাচ্ছে।

তৈরি হতে শুরু করলো। হালকা কিছু পড়ি? মানে পাঞ্জাবি আর প্যান্ট? কোন উত্তর দিল না তিথি। বোধ হয় আপত্তি নেই। থাকলে কড়া দৃষ্টি দিত। ‘চল।

কোথায় যাচ্ছি?‘ ‘মতিঝিলে। ‘ ‘ওরে বাবা। ওখানে বিশাল সমাবেশ চলছে। গাড়ী নিয়ে যাওয়া যাবে না। ‘ ‘হেঁটেই যাব।

‘ ‘এতো রাতে মতিঝিলে?’ ‘আমি এগোচ্ছি। ‘ আর কোন উপায় নেই। যেতেই হবে। বাসা পল্টনে। খুব বেশী দূরে না।

হেঁটেই যাওয়া যাবে। এখন আর খারাপ লাগছে না সুমনের। একটা রোমান্টিক রাত্রি ভ্রমণ হবে। রাস্তাঘাটের অবস্থা বিশেষ সুবিধার না। জায়গায় জায়গায় ইট আর ছাই।

গাছের গুড়ি, লাঠি এদিক ওদিকে পড়ে আছে। তবে সব শান্ত। সন্ধার সময় যে অবস্থা ছিল তা থেকে একদম ভিন্ন চিত্র। রাতে হয়তো আর কিছু হবে না। আবার সকালে যদি কিছু ঘটে।

তিথি বেশ দ্রুত হাঁটছে। ওর সঙ্গে তাল মেলাতে সুমনও হাঁটার গতি বাড়াল। পাশাপাশি এসে জানতে চাইলো। ‘আর কতদুর?’ ‘এসে গেছি’ বিবাহ রেজিস্ট্রার অফিসের দরজা খোলা দেখে অবাক হল। এতো রাতে আবার কে বিয়ে করতে এসেছে? তাও আবার এই সমাবেশের দিনে।

তিথি গটগট করে রেজিস্ট্রার অফিসে ঢুকে গেল। এবার সুমন টের পেল কি হতে যাচ্ছে। কি করবে এক মুহূর্ত ভাবল। তিথির সঙ্গে এখন কোন আর্গুমেন্ট করতে গেলেই সিন ক্রিয়েট করবে। ফেরত যাবে? তিথিকে এখানে একা ফেলে? সেটাতেও মন সায় দিচ্ছে না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে ঢুকল। রেজিসট্রার সাহেব কে সুমন চেনে। সুমনদের আত্মীয়। একটু দুঃসম্পর্কের তবে প্রায়ই সুমনের কাছে সাহায্য চাইতে আসতো। সুমন যতটা সম্ভব করতো।

সেকারণেই হয়তো তিথির ফোন পেয়ে এতো রাতে অফিস খুলেছে। ‘সই কর। আমি করে ফেলেছি। ‘ ২ গল্পটা কেমন লাগছে? বিয়েটা কি ভেঙ্গে দিব? কেন যেন মন চাইছে না। ট্রাজেডি স্ক্রিপ্ট একেবারেই যে লিখিনি, তা তো না।

অনেক প্রেমিক মেরেছি, প্রেমিকা মেরেছি। সদ্যপ্রসূত নবজাতক মেরেছি। প্রথম বারের মত মা হচ্ছে এমন মা কেও মেরেছি। কখনও মায়া দয়া করিনি। যখন যা ইচ্ছে হয়েছে করেছি।

ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গুলোকে অনাথ, এতিম করেছি। বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ ঘটিয়ে শত শত লোক মেরেছি। কখনও হাত কাঁপে নি, দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় নি। আজকে মনটা কেমন যেন করছে। কেমন একটা মিরাকল ঘটাতে মন চাইছে।

এমন কিছু যা খুব স্বাভাবিক ভাবে ঘটবে কিন্তু পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দিবে। কিছু প্ল্যান মাথায় আসছে না। বাংলা ছবির মত মাথায় আঘাত এরপরে স্মৃতি ভ্রংশ? না বড্ড সেকেলে হয়ে যায়। ঐরকম স্ক্রিপ্ট ও কিছু লিখেছি। তবে এখন আর ওসব লিখতে ভালো লাগে না।

আমাকেও কেমন আধুনিকতা পেয়ে বসেছে। ইন্টারনেটের যুগ তো। এখন তাই আর প্রেম করাতে অত সময় নিই না। দুই একবার চ্যাট করেই প্রেম করিয়ে দিই। এদের কি করা যায়? শুধু সন্তান হবে না দেখে এমন সুখের সংসার ভেঙ্গে দিব? সুমন কি খুশী হবে? সন্তান না হওয়ার কষ্ট ওর ভেতরেও আছে।

তারপরও ও মেনে নিয়েছে। আসলে ও কষ্ট পাওয়ার সুযোগই পায় নি। ওর একমাত্র চিন্তা এখন তিথির ঠিক হওয়া। একটু স্বাভাবিক হয়ে এলে হয়তো ওর কষ্ট শুরু হবে। তখন হয়তো অন্য স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে।

কষ্ট ভুলতে হয়তো সারাক্ষণ কাজ নিয়ে থাকবে, নয়তো বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে রাত করে ফিরবে। সরি। বারবার অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি। এদের কি করা যায়? খুব বেশী সময় হাতে নেই। সুমন সই করতে দেরী করলেই তিথির তর্জন গর্জন শুরু হবে।

একটা বিচ্ছিরী পরিস্থিতি শুরু হবে। ওদিকে তো আবার আরেকটা স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে। পাশেই তো আরও একটা ঘটনা ঘটছে। আরে তাইতো। এটা তো মাথায় আসে নি।

তাই করি বরং। দারুণ হ্যাপি একটা এন্ডিং হবে। আচ্ছা পরে কথা হবে। স্ক্রিপ্ট টা আগে লিখে নিই। ৩ আমার কোন দোষ নাই স্যার।

ম্যাডাম জরুরী তলব দিলেন। আমি ভাবলাম পরিচিত কারো হয়তো জরুরী বিয়ে করাতে হবে। সুমনের ভ্যাবাচাকা ভাব তখনও যায় নি। মাথার ভিতর তখন চিন্তার ঝড় বইছে। প্রসঙ্গ পাল্টানো জরুরী।

অন্য কোন গল্প। আচ্ছা রেজিস্ট্রারের হালচাল জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? কি খবর তোমার? অনেকদিন আসো না। বিগলিত হাসি দিয়ে বলল, আপনাদের দোয়ায় একরকম আছি। এখন থাকো কোথায়? ফ্ল্যাটে উঠেছো শুনলাম? একটা জমি ছিল। ডেভেলাপার কে দিয়ে দিয়েছি, পাঁচটা ফ্ল্যাট পেয়েছি।

আচ্ছা। বাসায় সবাই ভালো? মাথা একটু চুলকে, লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বলল, একটা কথা আপনাদের বলা হয় নাই ভাইজান, একটা ছেলে হইসে। চার মেয়ে তো তাই খুব শখ ছিল একটা ছেলের। প্রমাদ গুনল সুমন। এবার তিথি কড়া কিছু বলবে।

কিছু বলছে না দেখে ভয়ে ভয়ে সুমন তিথির দিকে ফিরল। তিথি একদৃষ্টিতে সামনে কি যেন দেখছে। অন্ধকার জায়গাটা। ইলেক্ট্রিসিটি নাই। আই পি এস এ শুধু দুটা লাইট এর একটা ফ্যান চলছে।

অন্ধকারের জন্য বোঝা যাচ্ছে না। কিছু নড়াচড়া করছে এতটুকু বোঝা যাচ্ছে। মোবাইলের আলোতে দেখার চেষ্টা করলো সুমন। মনে হচ্ছে বাচ্চা একটা ছেলে। মোবাইলের আলো জ্বেলে এগিয়ে গেল।

বাচ্চা একটা ছেলে। মায়াভরা একটা চেহারা। চোখে মুখে ভয়। মনে হচ্ছে সামনে মৃত্যু দেখছে। হাত জোর করে মাফ চাইছে।

‘আমারে মাফ কইরা দেন স্যার। ভুল কইরা আসছি। ‘ এবার ভালো মত দেখতে পেল ছেলেটাকে। বছর আটেক এর একটা ছেলে। পায়জামা পাঞ্জাবি পড়া।

পায়ে কিছু নেই। এখানে কিভাবে এলো? আর মাফ চাইছেই বা কেন? কি নাম তোমার? এখানে কেন? স্যার আমার কোন দোষ নাই। হুজুরে বলছিল ঢাকায় বড় মাহফিল আছে। সেটা শুনতে আইছিলাম। এবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হল।

এই সমাবেশে এসেছিল। কোন মাদ্রাসা বা এতিম খানার ছাত্র হবে। সমাবেশে লোক চাই। বয়স যতই হোক আপত্তি নাই। আর ওদের উপায় ও নাই।

হুজুরের কথা না শুনলে হয়তো তিন দিন খেতে দিবে না। এমন সময় সুমনের মনে পড়ল, আরে তাই তো, সমাবেশে লোকজন দেখছি না। কি হল? সবাই কোথায়? সব পালাইসে। হেসে ফেলল সুমন। পুলিশের ধাওয়া বলে কথা।

আর এই বেচারা কোন ফাঁক গলে এই অফিসে এসে ঢুকেছে। এমন সময় তিথি কথা বলে উঠলো। তোমার বাবা মা? আশ্চর্য মোলায়েম স্বরে কথা বলছে তিথি। অনেকদিন পরে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে বাচ্চাটাকে দেখছে।

বাবা মা নাই। আমি এতিম খানায় থাকি। আর যেতে হবে না। মন্দ হয় না। এই বাচ্চাকে তো কালকে নিখোঁজের লিস্টে দিয়ে দেয়া হবে।

হয়তো কিছু রাজনীতি হবে। ওদের সংখ্যা দরকার, লাশ দরকার। জীবন্ত মানুষ এই মুহূর্তে খুব বেশী উপকারী পদার্থ না। আমারে জেলে দিয়েন না। আমার কোন দোষ নাই।

তোমার যে দোষ নাই তা তো সবাই জানে। কেন, কিভাবে নিয়ে আসা হয়েছে তা অনেকেই আঁচ করছে, তবে তারপরও তোমাদের ব্যবহারে কেউ বাঁধা দিবে না। আসলে ধর্ম নিয়ে কথা বলার এক্তিয়ার কেবল একটা দলেরই আছে। বেশ জেলে দিব না। আমার কথা মত চলতে হবে।

রাজী? সুমন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তিথিকে দেখছে। ঠিক আগের মত, মিষ্টি করে কথা বলা। সব কি ঠিক হয়ে গেল? মাথা কাত করে বাচ্চাটা জানালো সে রাজী। আমাকে এখন থেকে মা বলে ডাকতে হবে। মনে থাকবে? বল মা।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।