আমার প্রপিতামহ নাকি বড্ড জেদী ছিলেন। তার বাবা যখন ভাগ বাটোয়ারা করেন তখন তার ভাগে পেয়াজের জমি পড়েনি দেখে তিনি পেয়াজ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তার বক্তব্য ছিল আমি নিজে একটা ভাল পেয়াজের জমি কিনব, সেই ক্ষেতে পেয়াজ লাগিয়ে তারপর আমি পেয়াজ খাব। তার সামান্য চাষের জমি থেকে অর্থ জমিয়ে ভাল একটা জমি কিনতে সময় লেগেছিল তা পাচ বছর। সেই সময়টা তিনি নাকি সত্যি কোন পেয়াজ কেনেন নাই।
।
তার পরের গল্পগুলো আরও চমকপ্রদ। একদিন তিনি এতটাই প্রভাবশালী হয়েছিলেন যে আইয়ুব খানের আমলে তাকে বেসিক ডেমোক্রেসির একজন করা হয়েছিল। তার এই বড় হবার নানা গল্প শোনা যায়। তার ছিল সাত ছেলে যাদের প্রত্যেককেই তিনি আদেশ দিলেন মোটা টাকা যৌতুক নিয়ে বিয়ে করতে।
সেদিক থেকে বিবেচনা করলে তার সেজছেলে বিয়ে করে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিলেন। তিনি সেই আমলে শ্বশুর বাড়ি থেকে ১২০০ টাকার একটা মোটা অঙ্ক কড়ায় গন্ডায় হিসেব করে এনে বাবার হাতে সগৌরবে তুলে দিয়েছিলেন। বাবা নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছিলেন। । (বউএর কথায় পরে আবার আসছি)
তাছাড়া আমার প্রপিতামহ তার ছেলের বউদের সেই কাকডাকা ভোরে ডেকে দিতেন ধান ভানতে।
তারা ঢেকিতে ধান ভেনে তারপর তাই দিয়ে সকালের ভাত চড়াত উনুনে। আর ছেলেরা তাই দিয়ে ভাত খেয়ে সূর্য ওঠার আগে কাধে লাঙ্গল ফেলে যেতেন দূর গায়ে জমি চাষ করতে। তারা আবার ফিরে আসত সন্ধ্যা লাগার আগেই। কারণ প্রদীপের তেল ফুরানোর ভয়ে সূর্যের আলোতেই তাদের সম্পন্ন করতে হত তাদের রাতের খাবার। রাতে প্রদীপ জ্বালানো ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
। সবই আমার মায়ের কাছে শোনা। তবে আমার প্রপিতামহ ১৩০ বছর বয়সে মারা যাবার পর দেখা গেল তিনি প্রায় ৫২০ বিঘা জমি রেখে গিয়েছেন তার সন্তানদের জন্যে। ।
ছোটবেলায় আমি গ্রামে যেতে খুব ভালবাসতাম।
তবে সেটা দিনের আলোয়। কিন্তু বিদ্যুতহীন রাতের গ্রামের বাড়ির কথা মনে হলেই আমার গায়ে কাটা দিত। তাই মা বাবা গ্রামে যাওয়ার কথা বললেই আমি খাটের নীচে গিয়ে লুকাতাম,যেন আমাকে কেউ খুজে না পায়। কিন্তু দেখা যেত আমাকে তারা ঠিক খুজে পেত আর অমনি কোলে করে বাড়ির পথে রওয়ানা হত। তবে আমি যে বাড়ি যেতে ভয় পেতাম তার আরেকটা কারণ ছিল।
সে ওই সেজদাদার ভয়ঙ্কর মিশমিশে কালো বউটা। দীর্ঘদেহী এই মানুষটার চোখগুলিকে আমার কাছে মনে হত বাজপখির মত তীক্ষন আর ধূসর। (যদিও আমি কোনদিন বাজপাখিকে আমার নিজের চোখে দেখিনাই)। তাকে দেখলেই কি এক অশনি সঙ্কেত কু কু রবে গান গাইতে শুরু করত। আমার সেই ছোট্ট মনে বারে বারে এক প্রশ্ন দোলা দিত।
আমার সেজদাদা কি প্রদীপহীন রাতের আধারে তার বউকে খুজে পেতেন???
পরে বড় হলে যখন বুঝতে শিখলাম তখন দেখলাম আমার সেজদাদা শুধু বউকে খুজেই পেতেননা বরং ভালভাবেই পেতেন তাইত তার ঔরসজাত সন্তানের সংখ্যা ছিল ১৮। যাদের মধ্যে জীবিতের সংখ্যা ১৪। এবং এর ভিতর আবার মেয়ের ছিল সমান সমান। প্রতিটা সন্তানই ছিলেন মায়ের জেরক্স কপি। প্রটিটা মেয়েকে পার করতে হত তাদের স্বামীকে খুশি করার মাধ্যমে মানে যৌতুক সুদে আসলে শোধ করার মাধ্যমে।
আমার এই দাদাকে তাই প্রায়ই আফসোস করতে শুনতাম,
ইশ!! ১২০০ টাকার জন্যে কি লোভই না করেছিলাম। ।
আমার দাদা ভুল করেছিলেন কিনা আমি জানিনা। তবে আমার প্রপিতামহ যে ভুল করেন নাই তা আমি নিশ্চিত। তার জিদ ছিল বলেইনা তিনি মরিবার কালে নাই থেকেও এত সম্পত্তি ছেলেমেয়েদের জন্যে রেখে যেতে পেরেছিলেন।
২। । আজ তিনদিন পাড়াতে বিদ্যুত নেই। বিদ্যুত নেই বলে পানি নেই। জমানো পানিও ফুরিয়ে আসছে ক্রমশ।
গত রাত থেকে গ্যাসও আর আসছেনা। চার্জ দেওয়া ফ্যান,লাইট তাদের জীবন প্রদীপ নিঃশ্বেস করে একে একে বন্ধ হতে শুরু করেছে। টিভি চলছেনা বলে বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। মোবাইলটাও বারে বারে "ব্যাটারি লো" অপশন দেখাচ্ছে। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে।
সব আগের মত ঠিক ঠাক হয়ে যাবেত??ফিরে আসবেত বিদ্যুত? আমাদের ঠিক স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে যাবেত??
এখন গভীর রাত। আসলে কি রাত গভীর হয়েছে?বড়জোর রাত দশটা বাজে। অথচ চারদিকে কি শুনশান নীরবতা। আমার ঘর অন্ধকার। জানালায় দাঁড়িয়ে আমি।
গাঢ় অন্ধকারে মাখামাখি হয়ে দালানগুলো সব আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক দূরে দূরে দু একটা বাতি মিট মিট করে জ্বলছে। এ এক অন্য শহর,অন্য জীবন। ।
আজ আমার প্রপিতামহকে বড্ড মনে পড়ছে।
তার জিদের কথা মনে পড়ছে। তার ঊঠে আসার গল্প মনে পড়ছে। আমরাও কি পারিনা জিদ ধরতে। শুধু সরকারকে দোষ চাপিয়ে নিশ্চিন্তে বিদ্যুতের অপব্যয় করি। আজ আমার নতুন করে বাচতে ইচ্ছে করছে সূর্যের সাথে ঘর বেধে।
। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।