আমার চোখে ঠোটে গালে তুমি লেগে আছো !! মাইক্র বাসটা বেশ দ্রুতই চলসে । সামনে সিটে বসে আছি । মাইলেজের কাটা বেশ ভাল করে দেখা যাচ্ছে । সত্তর ছুই ছুই করছে । আমি আর পিছন ফিরে তাকালাম ।
পিছনের সিটে জামান সাহেব চুপচাপ বসে আছেন । সকাল থেকে উনিই সব থেকে চুপচাপ আছেন । কিভাবে আছেন কে জানে । এরকম অবস্তায় চুপচাপ থাকাটা সহজ না ।
আমি আর একবার রাশিনের দিকে তাকালাম ।
আগের মতই শুয়ে আছে । নিরবে । এখন অবশ্য ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না । সাদা কাপড়টা দিয়ে ঢাকা । ওর পাশে ওর মা বসে একভাবে কেঁদে যাচ্ছে ।
এই মহিলা এতো কাঁদতে পারে ! সকাল থেকে ননস্টপ কেঁদেই যাচ্ছেন । ছি ! কি রকম কথা বলছি আমি ! ওনার কাঁদাটা তো স্বাভাবিক । কাঁদবেই তো ।
আমি আবার সামনের দিকে তাকালাম । দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে ।
একটু দেরি হয়ে গেছে রওনা দিতে । সব ঝামেলা বেশ দেরি হয়ে গেল । বিশেষ করে পুলিশি ঝামেলা শেষ করতেই যত দেরি হল । বেশ কিছু টাকাও খরচ করতে হল পোষ্টমার্টাম না করানোর জন্য । ভাগ্যভাল যে আব্বার পরিচিত লোক ছিল পুলিশে তা না হলে আরো টাকা যেত ।
আমি একটু চোখ বুজলাম । আমার এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা ঘটছে । কাল আর আজ কের ঘটনা গুলো আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না । বার বার মনে হচ্ছে এটা হতে পারে না । আমার পরীটা এরকম একটা কাজ করতে পারে না ।
কিছুতেই পারে না । সবে তো আমাদের গল্প টা শুরু হচ্ছিল । এম্ন সময় ও কিভাবে চলে যেতে পারে ।
আমার পরীটা আমার পাশেই থাকতো । পাশে মানে আমার পাশের ফ্লাটে ।
পরীর মতই দেখতে মেয়েটা । আহা । প্রতিবার যখন মেয়েটাকে দেখি বুকের মাঝে কেমন যেন একটা হাহাকার তৈরি হয় । মনে হত, ইস ! ইস! এই মেয়েটা আমার বউ হত । কিংবা গালফ্রেন্ড ।
কিন্তু আমার সে কপাল নাই । ওর মত মেয়ের বয়ফ্রেন্ড কিংবা স্বামী হবার জন্য যা যা থাকা দরকার তার খুব কমই আমার মধ্যে বিদ্যমান । তাই কেবল দুর থেকেই দির্ঘ্য শ্বাস ফেলতাম । পরীটার নাম রাশিন । যে এখন আমার পাশেই আছে ।
আমরা একই মাইক্র বাসে করে ওদের গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি ।
আমার খুব ভাল করে মনে আছে প্রথম ওর সাথে যেদিন আমার কথা হয় কি বিরক্তই না হয়ে ছিল আমার উপর ! কথা হয়ে ছিল আমাদের দার্য়ারনের কল্যানে । আমাদেয় বাড়ির গেটটা সব সময় বন্ধ থাকত । দারয়ান থাকলে তো কথা নাই । কিন্তু দারয়ান না থাকলে বাড়ির লোকজন বেশ বিপদেই পরত ।
দুপুরের দিকে দারয়ান সাধারন থাকে না । সেদিনও ছিল না । ভাগ্যিস ছিল না । ছিল না বলেই রাশিনের সাথে দেখা হয়েছিল । রাশিন আমার পাশের ফ্লাটে থাকে ।
অল্প কথায় বলতে গেলে রাশিন দেখতে ভয়াভহ রকমের সুন্দর । আর সুন্দর বলেই সব সময় খুব মুডে থাকে । মুডে থাকে বলতে সবসময় মুখে একটা বিরক্তির ছাপ । যেন সব কিছুর উপর , সবার উপর সে বিরক্ত । আমি আজ পর্যন্ত রাশিন কে হাসতে দেখি নি ।
জানি না দেখবো কিনা ।
ক্যাম্পাস থেকে ফিরেছিলাম । বাড়ির সামনে এসে দেখি রাশিন দাড়িয়ে আছে গেটের সামনে । এজইউজাল বিরক্ত মুখে । পাশে এক রিক্সা ওয়ালা তার রিক্সা নিয়ে অপেক্ষা করছে ।
তবে রাশিন কে আজ অন্য দিনের থেকে যেন বেশি বিরক্ত লাগছে । বারবার কলিংবেল চাপছিল । আমি চুপচাপ দাড়িয়ে আছি একটু দুরে ।
“আফামনি আমার ভাড়াটা দিয়া দেন । চইলা যাই” ।
“আরে আশ্চর্য ভাড়া দেব কোথ্থেকে ? আপনাকে বলিনি আমার ব্যাগ ছিনতাই হয়ে গেছে । বাসা থেকে টাকা দিতে হবে” ।
“কিন্তুক গেট তো কেউ খুলে না । সারা দিন কি বইসা থাকবার পারি” ।
“বসে থাকেন ।
আপনার ভাড়া আপনি পেয়ে যাবেন” । রাশিন এবার আমার দিকে তাকাল । বলল “আমি অনেকক্ষন ধরে বেল বাজাচ্ছি । কেউ আসছে না । আপনি কি একটু দেখবেন আপনার বাসা থেকে কেউ আসে কি না” !
“মনে হয় কারেন্ট নাই” ।
“তাহলে” ? রাশিনকে আবার অস্থির মনে হল ।
“আর একটা উপায় কি আছে” ? আমি বলি ।
“ কি “?
“আপনি একটু সরে আসেন আমার কাছে চাবি আছে” ।
“আপনার কাছে চাবি আছে” ? রাশিন কে আমার উপর বিরক্ত মনে হল । “চাবি ছিল তো এতোক্ষন দাড়িয়ে ছিলেন কেন ? প্রথমে ফলা যেত না” ?
“আসলে আমি সুযোগই পাই নি ।
আপনি যেভাবে বিরক্ত মুখে কলিংবেল টিপ ছিলেন বলতে সাহস হয় নি” ।
আমার কথা মনে হল রাশিনের পছন্দ হল না । বলল “ঠিক আছে দরজা খুলুন” । খানিকটা হুকুমের মত শোনাল ।
আচ্ছা এখন যদি গেট না খুলি ।
একবার মনে হল বলি যে আমার চাবি আমি খুলব না । কিন্তু বলা হল না । গেট খুলে দিলাম । রাশিন ভিতরে চলে গেল ।
আমি রিক্সা ওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে দিলাম ।
সিড়ি ঠেলে উপরে উঠল । দেখলাম রাশিন এখানেও ওদের ঘরের গেটের সামনে দাড়িয়ে বেল টিপছে । বিরক্ত মুখে ।
রাশিন আমাদের পাশের ফ্লাটেই থাকে । আমি দরজা খুলতে খুলতে ওর দিকে তাকালাম ।
দেখলাম রাশিন আমার দিকে কেমন বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছে । আমি তাড়াতাড়ি বললাম “দেখুন আপনার ঘরের চাবি কিন্তু আমার কাছে নাই । আগে থেকে বলে দিলাম” ।
রাশিন মনে ঠাট্টাটা পছন্দ করল না । সুন্দরীরা খুব একটা ঠাট্টা পছন্দ করে না ।
কিছু বলার আগেই আমি ঘরে ঢুকে পড়লাম । কিছুক্ষন পর দরজায় কড়া নড়ল । দরজা খুলে দেখি রাশিন ।
আমার দিকে ৫০ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলল “আপনি রিক্সা ভাড়াটা দিয়েছেন । এই নিন” ।
আমি খানিকটা অবাক হলাম । ভান করলাম আর কি । বললাম “কই না তো । আমি দেইনি” ।
“দেখুন আমি জানি ভাড়াটা আপনিই দিয়েছেন ।
নিন । আমি কারো কাছে ঋনি থাকতে পছন্দ করি না” ।
আমি টাকা টা নিলাম । রাশিন ঘুরে যাচ্ছিল এমন সময় আমি ডাকলাম ওকে ।
“শুনুন” ।
রাশিন ঘুরে দাড়াল । “বলেন” !
“আপনি মানুষের কাছে ঋনি থাকেন না” ?
“না” ।
“তারমানে কেউ আপনাকে কিছু দিলে তা আপনি ফেরত্ দিয়ে দেন” ?
“জি” ।
“কিন্তু আমাকে তো দেন নি” ।
“মানে ? আপনি আমাকে কি দিয়েছেন যা আমি ফেরত্ দেই নি” ?
“কিছুতো একটা অবশ্যই আমি আপনাকে দিয়েছি ।
তা না হলে আমি এমনি এমনি বলতাম না” ।
রাশিনকে আবার বিরক্ত মনে হল । “দেখুন আমি হেয়ালি পছন্দ করি না । কি দিয়েছেন বলেন” ।
“ দেখুন রিক্সা ভাড়াটা যে আমি দিয়েছি তা আমি কিন্তু আপনাকে বলি নি ।
বলেছি বলেন ? তারপরও কিন্তু ভাড়াটা দিয়ে গেলেন” ।
রাশিন কিছু বলল না । ঘরের ভিতর চলে গেল ।
ঘরের ভিতর এসে মনে হল এমন কথা কেন বললাম ?
ও কি কিছু বুঝতে পেরেছে ?
নাকি বুঝবে ?
জানি না ।
বুঝলে বুঝবে ।
কত দিন আর চুপ করে থাকবো । এটা দিয়েই না হয় এক ধাপ এগিয়ে যাবো । আমার মনে ক্ষন আশা ছিল হয়তো রাশিনের মনে আমি কৌতুহল ঢোকাতে সক্ষম হয়েছি । এবার যখন দেখা হবে ও নিশ্চই আমার সাথে কথা বলবে । একবার হলেও জানতে চাইবে আমি আসলে ওকে কি দিয়ে ছিলাম ।
কিন্তু সেরকম কিছুই হল না ।
পরদিন যখন দেখা হল ওর চোখ মুখে সেই চিরো চেনা বিরক্তির ছাপ । আমাকে দেখে এমন একটা ভাব করল যেন আমাকে চিনেই না । খানিকটা খারাপই লাগল । একটু চেষ্টা করেছিলাম ।
কাজ হল না ।
নিজের মন কে বোঝালাম এ মেয়ে তোমার জন্য না । অন্য দিকে হাটো । কিন্তু মন থেকে সাপোর্ট পেলাম না ।
থাক না হয় ।
হয়তো কোন রাশিনকে কাছে পাওয়া হবে না । না হোক । চোখের সামনে সে আছে । এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল । তারপর আবার একদিন রাশিনের সাথে কথা বলার সুযোগ এল ।
রাতের বেলা । সেদিন রাতের বেলা কারেন্ট চলে গেছিল । গরম কাল । কারেন্ট গেলে ঘরে টেকা দায় । তাই ছাদে এসেছিলাম হাওয়া খেতে ।
কিন্তু হাওয়া খেতে এসে যে হাওয়া টাইট হয়ে যাবে বুঝতে পারি নি । যখনই ছাদে পা দিলাম ছাদের একেবারে কোনায় একটা .... । এই বিজ্ঞানের যুগে বলতে লজ্জা লাগছে । কিন্তু নিজের চোখ কে কিভাবে অবিশ্বাস করি । সাদা পোশাক পরে দাড়িয়ে আছে ।
আমি ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম । ঘুরে পিছনে যাবো তারও পারছি না । পা টা যেন ছাদের সাথে লেগে গেছে । কি করবো ভাবছি এমন সময় লক্ষ্য করলাম সাদা আয়োবয়টা এদিকে এগিয়ে আসতেছে । আকাশে চাঁদ নেই ।
চারিদিকে আলোর ছিটে ফোটা নাই । তবুও বোঝা যাচ্ছে ওটা এদিকেই এগিয়ে আসছে । আর একটু এগিয়ে আসলে বুঝতে পারলাম আয়বয়টা একটা মেয়ের ।
তারমানে পেত্নী !চিৎকার করতে যাবো এমন সময় পেত্নীটা বলে উঠল “ভয় পেয়েছেন” ?
চিৎকার গলাতেই আটকে গেল । এটা তো পেত্নী না ।
রাশিনের গলা ।
‘’না’’ ! কোন মতে বললাম ।
‘’ভয় পায় নি” ? কিন্তু নিজের আওয়াজটা নিজের কাছেই অদ্ভুদ শোনাল ।
রাশিন খিল খিল করে হেসে উঠল । ওর হাসির শব্দে রাতেই নিরবতা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল ।
আশ্চর্য এই গম্ভীর মেয়েটা কে এর আগে কোন দিন এভাবে হাসতে দেখিনি ।
“ভয় পান নি’’ ? কোন মতে হাসতে হাসতে বলল ।
“আসলে সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম’’ । এবার স্বীকার করেই ফেললাম । “এভাবে আপনাকে এখানে আশা করি নি ।
তার উপর আবার এতো রাতে” ।
রাশিন বলল “ঘুম আসছিল না । তাই এখানে এসেছি । রাতেই এই নিরবতা আমার অনেক ভাল লাগে । তাছাড়া আমার মনটা খানিকটা অস্থির” ।
“কেন অস্থির ?
“একটা গাধার জন্য অস্থির” ।
গাধা মানে ! নিজের কাছেই প্রশ্ন করলাম । গাধা মানে নিশ্চই কোন ছেলে । কোন ছেলের জন্য রাশিনের মন অস্থির । কেন জানি মনটা খারাপ হল ।
মনে হল ঐ গাধা যদি আমি হতাম ! যদি আমার জন্য ওর মনটা অস্থির হত !
রাশিন হঠাৎ বলল “অপু সাহেব’’ ।
“বলুন” ।
“এই গভীর অন্ধকার দেখে আপনার কিছু মনে হয়” ?
“কিছু মনে হয় মানে ? ঠিক বুঝলাম না” ।
রাশিন বলল “আমার কি মনে হয় জানেন ? আমার মনে হয় খুব শীঘ্রই আমি অন্ধকারের সাথে মিলিয়ে যাবো । এমন এক গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাবো যেখান থেকে আর কোন দিন ফিরে আসবো না” ।
আমি খানিকটা বিভ্রান্ত হই । এই মেয়েটা এসব কি বলছে !
“অপু জানেন আমি প্রতিদিন এই সময়টা ছাদে আসি” ।
“তাই নাকি ? প্রতিদিন” ?
“হুম । প্রতিদিন । প্রতিদিন কেন আসি জানেন” ? আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই বলল “আমি প্রতিদিন আসি একটা কাজ করার জন্য ।
কিছুক্ষন নিজের সাথে যুদ্ধ করি তারপর বিফল হয়ে ফেরত্ চলে যাই” ।
আমি আবারও ওর কথা কিছু বুঝতে পারি না । বললাম “আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না । একটু সহজ করে বলবেন” ?
“ আজ অনেক রাত হয়েছে । আজও কাজটা করতে পারলাম না ।
তবে একদিন পারবো নিশ্চই । আজ আসি” ।
আমাকে আর কোন সুযোগ না দিয়ে রাশিন নিচে চলে গেল । আমি বোকার মত দাড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষন ।
ও কি বলতে চেয়েছিল কিছুই বুঝিনি সেদিন ।
ইস যদি তখন বুঝতে পারতাম ! তাহলে হয়ত আজ এমন একটা ঘটনা ঘটত না ।
তারপর থেকে প্রায় দিনে রাশিনের সাথে আমার কথা হতে থাকে । রাতের বেলা । প্রতিদিন রাতে যখন ছাদে পা রাখতাম দেখতাম ও একই ভাবে ছাদের ঐ কোনার দিকটাতে দাড়িয়ে আছে । নিচের দিকে তাকিয়ে আছে ।
কি দেখতো কে জানে । আমার সাড়া পেলে এদিকে আসতো । কথা বলত । মাঝে মাঝে হাসতো । কিন্তু দঃখের বিষয় আমি ওর হাসি দেখতে পেতাম ।
অন্ধকার রাত, কিভাবে দেখবো । রাশিন আমার সাথে রাতেই যা কথা বলত ।
দিনের বেলা দেখা হলে এমন একটা ভাব করতো যেন আমাকে চিনেই না । আর মুখেতো সেই চিরোচেনা বিরক্তির ছাপ লেগেই থাকতো । আমি খানিকটা অবাক না হয়ে পারতাম না ।
রাতের অন্ধকারে রাশিন আমার যতখানিই পরিচিত ছিল দিনের আলোতে যেন ততখানিই অপরিচিত ।
কিন্তু সেদিন এর ব্যতীক্রম হল । আমি নিলক্ষত গেছিলাম কিছু বইটই কিনতে । বই কিনে নিলক্ষতে মোড়ে দাড়িয়ে আছি বাসের জন্য এমন সময় রাশিন কে দেখলাম রাস্তার ও পারে । আমি নিশ্চিত জানি রাশিন রাস্তা পার হবে ।
আমার কাছ দিয়ে চলে যাবে । একবার আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না । আমি মোটামুটি সেরকম প্রস্তুতি নিয়েই আছি ।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে রাশিন আমার কাছে এসে বলল
“এখানে’’ ? আমি সত্যিই অবাক হলাম । বেশ খানিকটা অবাক হলাম ।
“এইতো বই কিনতে এসেছিলাম’’ ।
‘’ক্লাসের বই’’ ?
‘’কিছু ক্লাসের কিছু গল্পের’’ ।
‘’বাসায় যাবেন এখনই’’ ?
“হ্যা । বাসাতেই যাবো” ।
“চলুন একসাথে যাওয়া যাক” !
রাশিনের কাছ থেকে এমন প্রস্তাম পেয়ে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম ।
ওর সাথে যখন রিক্সাতে চেপেছিলাম মনে হচ্ছিল আমি এ পৃথিবীর সব থেকে সুখি একজন মানুষ । বাসার সামনে নামার পর ও বলল “রাতে আজ ছাদে আসবেন । কিছু কথা বলব আপনাকে” ।
সত্যি দিন টা আমার জন্য অন্য রকম ছিল । অন্য রকম আনন্দের দিন ।
রাতে ছাদে গিয়ে দেখলাম রাশিন ছাদের মাঝ খানে পাটি পেড়ে বসে আছে । আকাশে পূর্ণিমা ছিল তাই ওকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল । আমার পরীটা এই চাঁদের আলোতে কি অপূর্ব সুন্দরই না লাগছিল । মনে হচ্ছিল এই সৌন্দর্য এই পৃথিবীর না । এর জন্ম অন্য কোথাও ।
আমি অনেক্ষন আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম । এক ভাবেই । মনে হল এই মুখের দিকে আমি অনন্ত কাল ধরে তাকিয়ে থাকতে পারবো ।
“কি দেখছেন” ?
ওর কথায় একটু ধাতস্থ হলাম । একটু সাহস করে বললাম “তোমাকে দেখছি ।
এই পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর আর পবিত্র মুখটাকে দেখছি” ।
রাশিনের মুখটা কেমন জানি হয়ে উঠল । বললাম “কি হল ? আমিতো ভুল কিছু বলি নি” ।
“পবিত্র” ? শব্দটা ও একবার উচ্চারন করল । “আমি পবিত্র না অপু ।
মোটেই পবিত্র না । আমার এই দেহটা বড় অপবিত্র কুলষিত” ।
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম ওর কথা শুনে ।
“কি বলছ এসব ? এমন কথা বল না প্লিজ” ।
“আমি তোমাকে এই কথা গুলো বলার জন্যই ডেকেছি ।
আজ যদি না বলতে পারি তাহলে আর কোন দিন বলা হবে না” । রাশিন বলেই চলল “আমি এরকম টা ছিলাম না । ছোট বেলা থেকে আমি খুব চঞ্চল ছিলাম । ঘুড়ে বেড়াম । খেলতাম ।
সারাক্ষন চিত্কার চেচামেচির মধ্যেই আমার দিন কাটতো । আমার দিনের বেশির ভাগ সময় কাটতো আমাদের ছাদে ।
সময় পেলেই আমি ছাদে চলে যেতাম । কথনও একা অথবা অন্য ছেলে মেয়ে দের সাথে । আমাদের ছাদের চিলেকোথায় এক লোক থাকতো ।
বাবার বন্ধু । একই অফিসে চাকরি করতো । আমি ওনাকে জামিল চাচা বলে ডাকতাম । জামিল চাচা আমাকে খুব আদর করতেন ।
কিন্তু একদিন তার আসল চেহারা আমার সামনে এল ।
আমি তখন সবে সেভেনে পড়ি । একদিন ছাদে খেলা করছি । একাই । দুপুরের কিছু পরে হবে সময়টা । বাবা মা ঘুমিয়েই ছিলো ।
হঠাত্ জামিল চাচা আমাকে ডাক দিল ওনার ঘরে । আমি কিছু না ভেবেই ওনার ঘরে চলে গেলাম ।
জামিল চাচা কি করলেন জানো ? আমার ঘরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিল । তারপর ...” রাশিন আর কিছু বলতে পারছিল না । কেবল দেখছিলাম চাঁদের আলোতে ওর চোখ জলটা চিকচিক করছে ।
আমি বললাম “থাক আর বলতে হবে না” ।
“না বলতে হবে । না হলে কথা গুলো আর কোন দিন বলা হবে না” । কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ও আবার বলতে শুরু করল । “প্রথম কিছুক্ষন কি হচ্ছিল আমি বুঝতেই পারি নি ।
তারপর আমার আর হুশ ছিল না । ঐ ছোট দেহটা ঐ পৌচাশিক অত্যাচার বেশিক্ষন সহ্য করতে পারে নি । যখন আমার জ্ঞান ফেরে দেখি ছাদের এক কোনায় আমি পড়ে আছি । লজ্জা আর ভয়ে কাউকে কিছু বলতেও পারি নি তখন । ঐ ছোট বেলাতেই পুরুষ মানুষের প্রতি আমার যে কি ঘৃণা জন্ম নিল” ।
রাশিন থামল কিছুক্ষন । আমি কি বলব কিছুই বুঝতে পারি না ।
“তারপর আবারও ঐ একই ঘটল যখন আমি হায়ার সেকেন্ডারীতে পড়ি । এবার কোচিংয়ের এক শিক্ষক । তারপর .. “
“রাশিন থাক ।
প্লিজ চুপ কর” ।
“কেন? কেন চুপ করবো? খুব খারাপ লাগছে শুনতে”?
আমি কোন কথা বলতে পারি না ।
“এখনও কি তোমার মনে হচ্ছে আমি খুব পবিত্র ? আমি যত ছেলে আমার দিকে তাকাতে দেখেছি ততবারই সেই শিয়ালের চোখ গুলো দেখি” ।
আমি বললাম “আমাকেও কি ঐ দলেরই মনে হয়”?
রাশিন এই প্রশ্নটার জবাব দিল না । কিছুক্ষন পর বলল “তোমাকে এতো গুলো কথা কেন বললাম” ?
“আমি জানি না ।
কেন” ? আমি জানতে চাইলাম ।
“আমি নিজেও জানি না” ।
তারপর রাশিন একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বলল “এটা কালকে পড় । আজকে না । মনে থাকবে তো” ?
“আচ্ছা” ।
আসার পথে রাশিন বলল “তুমি খুব ভাল ছেলে অপু । ভাল থেকো সব সময় । আর আমার কথা মনে রেখো” ।
আমি নিচে চলে আসি । এখন যদি বুঝতে পারতাম ও কেন আমাকে এমন কথা বলেছিল ।
আমি কথনও ওকে ছেড়ে আসতাম না ।
সারাদিন অনেক ধকল গেছে । রাশিনকে ওর গ্রামের বাড়িতে রেখে আসতে আসতে রাত হয়ে গেল । ওর বাবা খুব করে থাকতে বলেছিল । আমার কেন জানি থাকতে মন চাইল না ।
মনে হল আর কিছুই নেই এখানে । রাশিন কে রেখে যাচ্ছি । মনে হচ্ছে আমার সবকিছুই এখানে রেখে যাচ্ছি । তবুও এখানে আর একদম থাকতে ইচ্ছা করছে না ।
মাইক্রবাসটাতে করে ফেরার পথে হঠাৎ বুক পকেটে হাত গেল ।
রাশিনের চিঠিটা এখনও পড়া হয় নি । আস্তে করে চিঠিটা বের করলাম । মাইক্রোর রিডিং লাইটটা জ্বালিয়ে দিলাম । অল্প কয়েকটা লাইন ।
যখন তুমি এটা পড়বে তখন আমি এমন এক জায়জাতে চলে গেছি যেখান থেকে আর ফিরে আসব না ।
অপু তোমাকে খুব মিস করবো । জানি তুমিও খুব মিস করবে আমাকে । জানো খুব চেষ্টা করেছি তোমাকে ঐ হায়নার দলে ফেলতে । কিন্তু পারি নি । আর পারি নি এই অপবিত্র দেহটাকে তোমার যোগ্য ভাবতে ।
আমি আর এই কষ্ট সহ্য করতে পারছিলাম না । তাই চলে গেলাম । তুমি ভাল থেকো । আমাকে মনে রেখো । আর তোমার কাছে ঋণি রয়েই গেলাম ।
তোমার মনটা নিয়ে চলে যাচ্ছি ।
চিঠিটা আমি ভাজ করে রেখে দিই । বুক পকেটে ।
বি:দ্র: একই শিরোনামে গত পরশু দিন একটা গল্প লিখেছিলাম । সেটা ছিল আনন্দের গল্প ।
আজ একই গল্প আবার লিখলাম । তবে একটু অন্য রকম করে । আর গল্পটা শায়মা আপুর জন্য । ওনার লেখার একজন অন্ধ ভক্ত আমি । ওনার মন্তব্যের জন্যই গল্পটা আমি আবার লিখেছি ।
আগের গল্পের লিংক ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।