আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১৩ দিন গার্মেন্টসে কাজ করেছিলাম।। রেজা ঘটক

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা... পোষাক শিল্পের সুতা থেকে যন্ত্রপাতি-মেশিনারি ইত্যাদি আমাদানি ব্যয়টা সাধারণ মানুষের জানা প্রয়োজন। কোনো টক শো বা সরকারের কোনো মন্ত্রীর মুখে এই আমদানি ব্যয়ের হিসেবের কথা শোনা যায় না। পোষাক শিল্পের রপ্তানি থেকে দেশের যে আয় হয়, তা থেকে এই আমদানি ব্যয় বাদ দিলেই সত্যিকারের বৈদেশিক মুদ্রায় আয়ের চেহারা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু আমরা কেবল সবখানেই শুনি, হাজার হাজার বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের কথা। পোষাক শিল্পের আমদানি ব্যয়ের কথা কালেভদ্রেও শোনা যায় না কেন? কারণ তখন আর মালিকরা আয়ের সংখ্যাটা বড় বলে দাবি করতে পারবে না।

আসল কথা হল, দেশের শ্রমিকদের সকল মালিকশ্রেণীরাই শোষণ করে। আর তৈরি পোষাক শিল্পে সেই শোষণের কোনো মা-বাপ নেই। সেখানে প্রত্যেক মালিকের অধিনে যে ৫/৬/৭ হাজার শ্রমিক কাজ করেন, তারা সবাই গিনিপিগ। শ্রমের যথাযথ মূল্য না দিয়ে সস্তায় তারা কাজ করিয়ে নেয়। আর শ্রমিক শোষণের পাশাপাশি এইসব কথিত মালিকরা আবার নির্যাতনও চালায়।

সেই নির্যাতন চাকরি বাঁচাতে গরিব শ্রমিকরা নিরবে মেনে নিয়ে কাজ করেন। শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ ঠিক করার দিকে তাদের কোনো নজর নেই। শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তাদের কোনো উৎসাহ নেই। কারখানায় আগুন লাগলে গেইটে তালা লাগিয়ে দেয় মালিক নামের শুয়োররা। গার্মেন্টসে আমার তেরো দিন কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

সেই অভিজ্ঞতায় সেখানকার চিত্র দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। ২০১০ সালে আমি একটি তৈরি পোষাক শিল্পে প্লানিং বিভাগে কাজ করেছিলাম। আমাদের জাতীয় ফুটবল দল, জাতীয় ক্রিকেট দল, এবং স্থানীয় সকল ফুটবল ও ক্রিকেট দলের জার্সি বানায় এরা। তো মালিক জানতে চাইলেন, আমার বেতন কতো দিতে হবে? আমি বললাম, বয়স যেহেতু ৪০ হয়েছে, তাই বয়সের হিসেবে হলেও ৪০ হাজার দিতে হয়। মালিক বললেন, এই পোষ্টে আগে যে ছেলেটি ছিল সে ১৫ হাজার টাকা বেতন নিতো।

ছেলেটি অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। তাই আপনাকে নিতে চাই। প্রথমে আমার বেতন নিয়ে দরকষাকষির এক পর্যায়ে আমি বললাম, ঠিক আছে ৩৫ হাজার দিয়েন। বলে আমি চলে আসি। আমি তখন মগবাজারে পালাকারের গ্রুপে থাকি।

বাংলা মটর ওভার ব্রিজ যখন ক্রোস করছি তথন আবার সেই মালিকের ফোন। বললেন, আরেকটু কম দিতে চাই। আপনি আমার সাথে কাজ করেন। আমি বললাম, ৩৫ হাজারের নিচে আমি করব না। সন্ধ্যায় তিনি আবার ফোন দিলেন।

সেই একই ক্যাচাল। আরেকটু কমান। আমি সরাসরি বলে দিলাম ৩০ হাজারের নিচে আমার পক্ষে সম্ভব না। তিনি রাজি হলেন। পরদিন সকাল থেকে আমাকে অফিস করতে বললেন।

আমি পরদিন সকালে অফিসে গেলাম। মালিকের রুমেই আমার বসার ব্যবস্থা করলেন। আমাকে ওনার বায়ার লিস্ট দিয়ে বললেন, সবার সঙ্গে ফোন করে পরিচয় হবেন। আর নতুন কোনো বায়ার পাওয়ার চেষ্টা করেন। যে ছেলেটি আমার এসিসট্যান্ট হিসেবে কাজ করবে সে বললো, রহিম আফরোজের সঙ্গে আমি কথা বলেছি।

ওনাদের একটা বড় কাজ হবে। আপনি একটু কথা বলেন। আমি কথা বলে পরদিন মিটিংয়ের সিডিউল করলাম। রহিম আফরোজের ফ্যাক্টরি অফিস সাভারে। বিকেএসপি'র ঠিক উল্টো পাশে।

ওই ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে আমি পরদিন গেলাম। রহিম আফরোজের ইভেন্টটি খুব নিকটে থাকায় তাদের বিকল্প গার্মেন্টস খোঁজার সময় নেই। আমাদের স্যামপল আর কোয়ালিটি দেখে তারা ৪৪ লাখ টাকার ওয়ার্ক অর্ডার দিয়ে দিলেন। ছেলেটি আমাকে বললো, আপনি খুব লাকি। স্যার খুব খুশি হবেন।

চাকরির তৃতীয় দিনেই ৪৪ লাখ টাকার ওয়ার্ক অর্ডার বাগিয়ে আমিও খুশি। পরদিন আমাকে পাঠানো হল গুলশান। সেভরনের সঙ্গে মিটিং করতে। আমি ছেলেটিকে সঙ্গে নিলাম। কারণ সে অফিস চেনে।

সেভরনে নিয়মিত কাজের আরো কিছু অর্ডার নিয়ে আমরা গেলাম গ্রামীন ফোনে। তাদের একটি ইভেন্টে তারাও কিছু টি-শার্টের অর্ডার দিল। সেখান থেকে বনানী। আমোরা নামে একটি প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড কাপ ত্রিকেটের জার্সি বানানো নিয়ে আর একটি ইভেন্ট নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললো। সন্ধ্যায় জিগাতলার অফিসে ফিরে মালিককে বললাম, মার্কেটিংয়ের কাজ কিন্তু আমি করব না।

তিনি বললেন, আগে সবার সঙ্গে পরিচিত হন। আর ফাঁকে ফাঁকে প্লানিং করবেন। চালাকিটা আমি ধরে ফেলেছি। পরদিন আমাকে পাঠালো হোটেল শেরাটনে। তারা কিছু টি-শার্টের অর্ডার দিলেন।

শেরাটনের পিআরও আবার মালিকের বন্ধু। আমার সঙ্গে রাত নয়টায় ধানমন্ডি খেলার মাঠে আরেকটা মিটিং করবেন। এবার মালিকও আমার সঙ্গে চললেন। আমার মিটিং শেষে তারা দুই বন্ধু সেখানে আড্ডা মারেন। আমার যিনি তখন মালিক তিনি বিসিবি'র একজন প্রাক্তন পরিচালক এবং আবাহনী ক্রিকেট দলের প্রাক্তন ক্যাপ্তেন।

কথা বার্তায় বেশ আমুদে লোক। তারা একটা পিকনিক করবেন। আমাকে ইভেন্টের দায়িত্ব দিলেন। পরিদন আমি সেই প্লান করলাম। আর ধানমন্ডি ও এলিফ্যান্ট রোডে মালিকের তিনটি ব্যাংক একাউন্টের চলতি হিসাব আপডেট করে সার্টিফিকেট নিলাম।

এলিফ্যান্ট রোডের উত্তরা ব্যাংক শাখা দুপুরে সার্টিফিকেট দিলেন। শংকর বাসস্ট্যান্ডের ব্র্যাক ব্যাংক শাখা বিকালে দিলেন। আর চার্টার্ড স্ট্যান্ডার্ট ব্যাংকে মালিকের মেয়ের বান্ধবীর কাছে সব জমা দিলাম মালিকের ইচ্ছায়। সেটি সেদিন পাওয়া গেল না। সেটা হাতে পেতে বৃধবার পেরিয়ে রবিবারে চলে গেল।

মালিকের মূসক সার্টিফিকেটের জন্য ব্যাংক আপডেট সার্টিফিকেট লাগবে। আমি মালিককে বললাম, আপনার পরিচিত লোকই ঠেকিয়ে দিল। নইলে ওটাও আজ পেতাম। মালিক আবার অবসরে একটু লেখালেখি করেন। রাত আটটার পর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত জিগাতলায় ওনা বাসায় আবার আমি ওনার সেই লেখার এডিটর।

কাজের বহর দেখে আমি বললাম, শোনেন, আপনার সঙ্গে আমার কথা ছিল সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত আমার ফরমাল অফিস। এর বাইরে আমাকে কাজ করাতে চাইলে আবার বেতন নিয়ে আমাদের বসতে হবে। মালিক খুব চালাক। আমাকে বললেন, হ্যা সেজন্য তোমাকে আলাদা টাকা দেব। ইতোমধ্যে আমাকে তিনি তুমি বলা শুরু করেছেন তার বাসায় এক রাতে সাড়ে দশটা পর্যন্ত এডিটরের কাজের কারণে।

ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের জার্সির কাজটা ডাওয়ার জন্য তিনি তার বন্ধু মোস্তফা কামাল (বিসিবির সভাপতি) কে ফোন দিলেন। তাদের তুই তুই সম্পর্ক। পরদিন আমাকে কামাল সাহেবের কাছে পাঠাবেন। কিন্তু পরদিন সকালে বললেন, আজ অফিসে বসেন। কামাল দেশে নাই।

দুপুরে দুবাই যাচ্ছে। সেদিন আমাদের অফিসের একটি ছেলে নারায়নগঞ্জে গেছিল সুতা রঙ করাতে। সুতা নিয়ে ফেরার সময় সে একসিডেন্ট করেছে ফতুল্লায়। আমরা সবাই সেই ছেলেটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। সেদিন আমি দেখলাম মালিক কিভাবে শ্রমিকদের সঙ্গে মিসবিহাব করে।

সবাইকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছিলেন। ঘটনা থামার পর আমাকে গরম মেজাজ নিয়ে জানতে চাইলেন, তুমি সারাদিন কি করেছো? জবাবে আমি বললাম, শোনেন, আমার সঙ্গে ওই টোনে কথা বলে যাবে না। আগে আপনার টোন নামান। তারপর কথা বলি। তিনি স্বাভাবিক হয়ে আমাকে বললেন, চলেন আমার বাসায়।

ওনার বাসায় গিয়ে আবার সেই এডিটিং। আমি বললাম, এসব করার আগে আমার একটা কথা আছে। আমি আপনার এখানে জয়েন করার সময় দুটো শর্ত ছিল। এক বেতন দুই কাজের সময়। আপনি দু্টো শর্তই ভঙ্গ করেছেন এই বারো দিনে।

অলরেডি আমার বেতন ২৭ হাজার ৫০০ তে ফাইনাল হয়েছে। আর কাজের টাইম সন্ধ্যা ছয়টা পেরিয়ে রাত দশটা সাড়ে দশটায় চলে যায়। আমি বললাম, শোনেন, আপনি আমার সঙ্গে দুটো শর্তই ভঙ্গ করেছেন। আমি আপনার অফিসে সন্ধ্যা ছয়টার পর এক মিনিট থাকবো না। নইলে আমি নাই।

আর আপনার লেখার বিষয়ে আলাদা শর্তে কাজ করব। চুক্তিভিত্তিকও হতে পারে। আমাকে সব বুঝিয়ে দেবেন। আমি আমার অবসরে বাসায় করবো ওটা। আপনার বাসায় করতে পারব না।

পরদিন আমি অফিসে গেলাম। উনি অফিসে না এসে আমাকে বাসায় যাবার জন্যে বললেন। উনি নাকি অসুস্থ। আমি যাবার পর বললেন, আমি তো হজে যাবো। তার আগে আপনাকে কিছু বাড়তি কাজের দায়িত্ব দিতে চাই।

হজ্ব শেষে উনি আবার আমেরিকায় মেয়ের কাছে বেড়াতে যাবেন। ফিরতে প্রায় তিন মাস লাগবে। নতুন কাজ কি? সেটা বলঅর আগে বললেন, আমি আসার পর আপনি বেতন ৩০ হাজার করেই পাবেন। এই তিন মাস আপনার প্রবেশনারি পিরিয়ড। এই তিন মাসে আমার অনুপস্থিতে মাসে ১৫ হাজার করে পাবেন।

আমি বললাম, তার আর দরকার নেই। আমি চললাম। আসার আগে বললাম , আপনি হজ্বে যাচ্ছেন ভালো কথা। কিন্তু আপনার হজ্ব হবে না। কারণ আপনার মাথায় মানুষ ঠকানোর বুদ্ধি কাজ করে।

বলেই আমি সোজা চলে আসি। পরে উনি অন্তঃত ১৫ বার ফোন দিয়েছেন। আমি আর রাজি হইনি। হজ্বে যাবার আগে আমাকে ফোন করেছেন। দোয়া চেয়েছেন।

হজ্ব করে আমেরিকা লন্ডন ঘুরে ফিরে আসলেন প্রায় চার মাস পর। এসেই আবার আমাকে ফোন করলেন। প্রথম বক্তব্য, মক্কায় বসে ওনার বারবার নাকি আমার কথাটি কানে বেজেছে। যে আপনার হজ্ব হবে না। কারণ আপনার মাথায় মানুষ ঠকানোর বুদ্ধি কাজ করে।

তার দুই তিন মাস পরে তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। লোকটি ব্যক্তি জীবনে খেলোয়ার ছিলেন। তাই মুখের কথাবার্তা ভালো। লোক হাসাতে জানতেন। বেশ আমুদে আর পেটুক।

কিন্তু গার্মেন্টস মালিক হিসেবে তার আচরণ আমি তেরো দিন দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। হজ্ব শেষে ফিরে এসে তিনি আমাকে তেরো দিনের বেতন নেবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। আমি যাই নি। আমি বলেছিলাম, আমার তেরো দিনের বেতনের শিক্ষা থেকে যদি আপনি কিছু শেখেন, তাহলে বাকি জীবনে আপনি শ্রমিকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবেন। লোকটির সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি।

আমি মাত্র তোরো দিন গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করে শ্রমিক শোষণের গোটা ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিলাম। আমার তবু মালিকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ ছিল। কিন্তু যেখানে মালিক নয়, মালিকের পোষ্য উচ্চ বেতনের কিছু চামচাকে দিয়ে শ্রমিক শাসনের ঠিকা কাজ দেওয়া হয়, সেই চিত্র যে কতো ভয়াবহ হতে পারে তা আমি অনুভব করতে পারি। তাই শ্রমিকের কর্ম পরিবেশ এবং নিরাপত্তার বিষয়টি যতোদিন গার্মেন্টস শিল্পে প্রতিষ্ঠা না পাবে ততোদিন এই দুরাবস্থা শেষ হবে না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।