আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নজরুল-আব্বাসউদ্দীন স্মৃতিময় অ্যালবাম

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তন, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে কোহিনূর প্রকাশন প্রকাশিত ও মুস্তাফা জামান আব্বাসী সম্পাদিত ‘নজরুল-আব্বাসউদ্দীন স্মৃতিময় অ্যালবাম’-এর প্রকাশনা উত্সব অনুষ্ঠিত হয়। প্রকাশনা উত্সবে আলোচক ছিলেন আব্বাসউদ্দীনের গুণী ছেলে মরমী শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী, প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান, প্রফেসর আসমা আব্বাসী, কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি খিলখিল কাজী, কবি ময়ূখ চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মুহম্মদ শামসুল আলম ও দৈনিক আজাদীর সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল মালেক। সংস্কৃতি প্রতিবেদক চট্টগ্রাম কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ বাংলা সঙ্গীত ভুবনের এক অনন্য যুগলবন্দির নাম। দু’জনই সুরের সাধক—একজন লিখেছেন ও সুর করেছেন; আরেকজন সুলিলত কণ্ঠে গেয়েছেন। এই দু’জনের অপূর্ব মেলবন্ধন সঙ্গীতপিপাসুদের মনে প্রাণের জোয়ার এনেছে।

সঙ্গীতই দু’জনের মধ্যে নিবিড় সখ্য ভাব গড়ে দিয়েছিল। আল্লাহ ও রাসুল (সা.) প্রেমকে দু’জনই সুরের সাধনার উপজীব্য করেছেন। ছড়িয়ে দিয়েছেন গণমানুষের হৃদয়ে। শেকড় ও মৃত্তিকাজাত গানের জন্য এই দুই কিংবদন্তি পুরুষ ব্রাত্যজনের প্রাণের মানুষ হয়ে উঠেছেন। আর আব্বাসউদ্দীন ছাড়া নজরুলের ইসলামী গানের এমন মাতোয়ারা প্রসার ও প্রচার কখনও সম্ভব হতো না।

নজরুল-আব্বাসউদ্দীন স্মৃতিময় অ্যালবামের সম্পাদক মুস্তাফা জামান আব্বাসীর সহধর্মিণী আসমা আব্বাসী বলেন, তিনি তার শ্বশুর আব্বাসউদ্দীনকে পাননি, কিন্তু সাহচর্য পেয়েছেন কাজী নজরুলের। মৌলভীবাজার জেলায় তার গ্রামে যখন কেউ তেমন গান-বাজনা করত না তখন আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া নজরুলের হামদ্-নাত, কবিতা-গান শুনেই তিনি বড় হয়েছেন। নজরুল-আব্বাসউদ্দীন অ্যালবামের প্রকাশনাকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা অনেক জীবনী পড়েছি এ দুই মনীষীর। কিন্তু ছবি যে এত কথা বলে সেটা জানা গেল এ স্মৃতিময় অ্যালবাম থেকে। কোহিনূরকে দেখে এসেছি লন্ডন মিউজিয়ামে, এরপর দেখলাম এখানে।

কোহিনূর যে মুক্তো তা যেন অনুভব করতে পারলাম আরও একবার। আসমা আব্বাসী কোহিনূর প্রকাশনা, আজাদী সম্পাদক এমএ মালেকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আবার যখন আমাদের ডাকবেন আমরা অবশ্যই আসব। কারণ আমার প্রথম হোম হলো সিলেট আর দ্বিতীয় হোম চট্টগ্রামের মানুষের আতিথেয়তা, ভালোবাসা আমাকে বারবার সিলেটের কথাই মনে করিয়ে দেয়। প্রফেসর শামসুল আলম বলেন, বয়সের দিক থেকে তারা কাছাকাছি কিন্তু মন-মানসিকতার দিক থেকে মনি কাঞ্চন বলা যায় নজরুল-আব্বাসউদ্দীনকে। বাংলা ভাষায় বিচিত্র সুরের, ধ্রুপদী সঙ্গীতের স্রষ্টা নজরুল ইসলাম।

ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়কে ধারণ করেছিলেন নজরুল। আর আব্বাসউদ্দীন বাংলার লোকজ সুরে ধর্মীয় ভাবাদর্শের গানকে পৌঁছে দিয়েছেন বাংলার ঘরে ঘরে। তারা দু’জন মিলে শুধু বাংলায় রেনেসাঁই সৃষ্টি করেননি, বাঙালি মুসলমানদের মাধ্যমে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছেন। নজরুলের গান যদি সৃষ্টি না হতো আর আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে যদি গীত না হতো, তাহলে বাঙালি মুসলমান সমাজে গান এখনও চুপই রয়ে যেত। আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে বাংলার নদী, গ্রাম প্রাকৃত হয়েছে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম কোহিনূর প্রকাশন বাণিজ্যিক ধারায় গা না ভাসিয়ে শুধু শিল্পের প্রতি ভালোবাসার কারণে যে অ্যালবাম প্রকাশ করেছে, তা জাতীয় কবির প্রতি শ্রদ্ধারই বহিঃপ্রকাশ। কোনো ফাউন্ডেশন, কোনো রাজকোষ বা বহুজাতিক কোম্পানির ব্যানারে এ অ্যালবাম প্রকাশিত হয়নি। জাতীয় কবির প্রতি ভালোবাসা এ চিত্রমালা। শামসুল আলম বলেন, একুশের প্রথম কবিতা প্রকাশ করে ধন্য হয়েছিল কোহিনূর প্রকাশন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাসে এ অ্যালবাম প্রকাশ এ সময়টাকে উচ্চতর মর্যাদা প্রদান করেছে বলে আমার বিশ্বাস।

কবি ময়ূখ চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, যে দু’জন স্মরণীয় ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে এ অনুষ্ঠান, তার একজন গীতিকার ও সঙ্গীতজ্ঞ এবং অন্যজন শিল্পী। সর্বাঙ্গীণ বিচারে এ অ্যালবামের বিচারের কোনো সুযোগ নেই, তার প্রকাশের জন্য অ্যালবাম নিজেই যথেষ্ট। স্বনামধন্য পত্রিকা সম্পাদকের এমন প্রকাশনা নৈতিক উন্নতির লক্ষণ। কেননা বাণিজ্যিক না হয়েও নজরুল-আব্বাসউদ্দীন একই মলাটের আওতায় এলেন, কিন্তু এক ক্যামেরায় একবারও এলেন না—এটি বিস্ময়ের। তিনি বলেন, নজরুল আমাদের দিয়েছেন উত্তেজনার কণ্ঠ।

নজরুল তার সৃষ্টিশীল জীবনের প্রথম দশ বছর সাংবাদিকতা কবিতা সৃষ্টিতেই মগ্ন ছিলেন। পরের দশ বছর তিনি গানে ব্রতী হন। নজরুলের গান আমাদের অন্যরকম একটা ভাবের জগতে নিয়ে যায়, এখানেই তার সার্থকতা। নজরুলের গানগুলো সব সংরক্ষণ করা হয়নি। আজ তার অনেকগুলোই হারিয়ে গেছে।

নজরুলের অনেক গান চুরি হয়ে গেছে। বাংলা গানের শুরু চর্যাপদ আদলে। সে গানে বিচিত্রতা সৃষ্টি করেছেন নজরুল। আমরা এখনও সে ধারায় চলছি। আব্বাস উদ্দিন প্রসঙ্গে কবি ময়ূখ চৌধুরী বলেন, ছোটবেলায় আমার মা-খালারা গান শুনিয়ে আমাকে ভাত খাওয়াতেন, ঘুম পাড়াতেন।

পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের গান শুনে আমার শৈশব কেটেছে। একদিন আমার বাবা বললেন, তোমরা কয়েকজন শিল্পীকে এড়িয়ে যাচ্ছ। তিনি চারজনের নাম বললেন। তাদের মধ্যে ছিল আব্বাসউদ্দীনের নাম, তার গাওয়া ‘কোন মুমিন মুসলমান’ কিংবা ‘ও মন ওই রমজানের ও রোজার শেষে’ গান বাংলার মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে ভেসে বেড়াত। নাগরিক গানের যুগে, রেডিও কলের গানের যুগে যখন আধুনিক গানের রাজত্ব; তখন ভাওয়াইয়া গানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছেন আব্বাসউদ্দীন।

আর এতে তিনি সফল। উত্তরবঙ্গের গানকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বত্র। নজরুল গবেষক প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান বলেন, সুরের সাধনার যুগে নজরুল-আব্বাসউদ্দীন যুগলবন্দি নন। তারা দু’জনে এক হয়েছেন রাসুল প্রেমের দিক থেকে, ইসলামী সঙ্গীত লেখা ও গাওয়ার মধ্য দিয়ে। এ প্রকাশনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রাজধানীকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে আসা হয়েছে।

আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সবকিছুই রাজধানীকেন্দ্রিক—এ প্রকাশনার মধ্য দিয়ে রাজধানীর কূপমণ্ডূক থেকে বেরিয়ে আসা হয়েছে। আব্বাস উদ্দিন নজরুলকে প্রেরণা দিয়েছেন। বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলেছেন। আমরা বরাবরই নজরুলকে গ্রহণ করেছি খণ্ডিতভাবে। কিন্তু এ অ্যালবামের মধ্য দিয়ে নজরুল আবার প্রথম থেকে পাওয়া গেছে।

নজরুল-আব্বাসউদ্দীনের মধ্যে যে জাগরণ চিন্তার মিল খুঁজে পাওয়া যায় তাতেই তারা দু’জন যুগলবন্দি, যেমনভাবে হলেন এ অ্যালবামে। আজ এক মলাটে দু’জনকে এক করে প্রকাশ করল কোহিনূর প্রকাশন। সেটি কেন সরকার করল না। আব্বাসউদ্দীনের সব গান সংগ্রহ করা হোক, তালিকাবদ্ধ করা হোক। আব্বাসউদ্দীনের সব স্মৃতি নিয়ে মিউজিয়াম করা হোক, নতুন প্রজন্মের জন্য এটি খুব দরকারি।

মুস্তফা জামান আব্বাসী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আজ আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন। নজরুল-আব্বাসউদ্দীনকে নিয়ে আমার যে স্বপ্ন, আজ তা বাস্তবায়িত হলো। গত এক বছর আমার সময় কেটেছে নজরুলের সঙ্গে। নজরুল এমন একজন মানুষ যার মধ্যে ছিল না কোনো সাম্প্রদায়িকতা। নজরুল চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য।

এ ঐক্য তিনি চেয়েছেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য। তিনি একাধারে ইসলামী গান-সঙ্গীত রচনায়ও অভূতপূর্ব ক্ষমতা দেখিয়েছেন। আজ যে অ্যালবাম প্রকাশ করেছে কোহিনূর প্রকাশন, তাতে ১২৫টি ছবি সঙ্কলন করা হয়েছে। যদি এ ছবিগুলো পাঠকের মনকে প্রশান্তি দেয়, তাহলে হয়তো আগামীতে আরও একটি অ্যালবাম প্রকাশ করা হবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।