© এই ব্লগের কোন লেখা আংশিক বা সম্পূর্ণ আকারে লেখকের অনুমতি ব্যতীত অন্য কোথাও প্রকাশ করা যাবে না।
এই মানুষটির প্রতি আমার অদ্ভূত রকমের মুগ্ধতা রয়েছে। জানি না সেই মুগ্ধতার কতোটুকু রেশ আপনাদেরকে ছুঁতে পারবে, তবে এমন মানুষটির গল্প আপনাদের জানা দরকার।
জন ক্যাজেল:: হয়তো হতে পারতেন একজন অসাধারন লেভেলের অভিনেতা, হয়তো আজকের সময়ে একাডেমি তাকে অধিষ্ঠিত করতো একজন হলিউড লিজেন্ড হিসেবে, কিন্তু গল্পের শুরুটা এমন রূপকথার মতো হলেও তার জীবনের শেষটা একরাশ বিষাদে ঢাকা। চলচ্চিত্র ইতিহাসে তার পদচারনা মাত্র ছয় বছরের।
সেই ১৯৭২ সালের দ্যা গডফাদার দিয়ে শুরু আর ১৯৭৮ সালের দ্যা ডিয়ার হান্টার দিয়েই শেষ। এই ৬ বছরে মাত্র ৫টি মুভিতে অভিনয় করেছেন তিনি। মাত্র ৪২ বছর বয়সে সেই ১৯৭৮ সালেই তিনি ক্যান্সারে মারা যান।
আপনাদের হয়তো অবাক লাগতে পারে, যিনি কিনা মাত্র ৫টি মুভিতে অভিনয় করেছেন তাতে কীইবা এমন স্পেশালিটি রয়েছে যা তাকে বাকীদের থেকে আলাদা করেছে? সেই বিশেষ কারনগুলো নাহয় খানিক পরেই বলছি। আগে তার জীবনবৃত্তান্ত ও মুভি ক্যারিয়ার সংক্ষেপে একটু জেনে নেয়া যাক।
জন ক্যাজেল: ১৯৩৫ সালের ১২ই আগষ্ট আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের বোস্টনে জন্মগ্রহন করেন। তিনি ছিলেন এখজন ইতালিয়ান-আমেরিকান। বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে ড্রামা বিষয়ে তিনি গ্র্যাজুয়েশান পাস করেন। পড়াশোনা শেষ করে নি্উ ইয়র্কে স্থায়ী হন। সেখানে Standard Oil নামক একটি তেল কোম্পানিতে চাকুরী শুরু করেন।
সেখানে ঘটনাচক্রে পরিচয় হয় আল পাচিনোর সাথে। আল পাচিনো তখন একেবারেই উঠতি অভিনেতা। পরে ম্যাসাচুসেটসের প্রোভিন্সটাউনের একটি কমিউনাল বাসাতে একসাথে থাকা শুরু করেন আল পাচিনো আর জন ক্যাজেল। সেইসময় তারা দুইজনেই Israel Horovitz নির্মিত The Indian Wants the Bronx নাটকে একসাথে অভিনয় করেন এবং দুইজনেই Obie Awards জিতে নেন। এরপর থিয়েটার আর স্টেজে নিয়মিত হয়ে পড়েন জন ক্যাজেল।
ফিল্মে ডেব্যুর আগে তিনি ১৯৬২ সালে The American Way নামক একটি শর্ট ফিচার আর ১৯৬৮ সালে N.Y.P.D নামক একটি টিভি সিরিজে অভিনয় করেন। এরপর আসে সেই ১৯৭২ সাল। 'Line' নামক একটি স্টেজ নাটকে জন ক্যাজেলের অসাধারন পারফরম্যান্স দেখে প্রোডিউসার Albert S. Ruddy তাকে দ্যা গডফাদার মুভিতে ফ্রেডো কর্লিওনির চরিত্রে পছন্দ করেন। মুক্তির পরপরই বক্স অফিস রেকর্ড ভেঙ্গে হইচই ফেলে দেয় মুভিটি, আর সেই সাথে আল পাচিনো, জন ক্যাজেলের মতো কিছু নতুন অচেনা অভিনেতারাও বিখ্যাত বনে যান। পরিচালক ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার নিকট জন ক্যাজেলের পারফরম্যান্স এতোটাই ভালো লেগে যায় যে তিনি গদফাদার পার্ট টুতে ফ্রেডো কর্লিওনির চরিত্রটাকে আরো গুরুত্বসহকারে বড়ো আকারে লিখে ফেলেন।
ফ্রেডো কর্লিওনির চরিত্রে জন ক্যাজেল:
এরপর ১৯৭৪ সালে আরেক বিখ্যাত অভিনেতা জেনে হ্যাকম্যানের অ্যাসিস্ট্যান্টের চরিত্রে আরেকটি বিখ্যাত মুভি The Conversation এ অভিনয় করেন তিনি। উল্লেখ্য এইটিরও পরিচালক ছিলেন ফ্রান্সিস ফোর্স কপোলা।
The Conversation মুভিতে জেনে হ্যাকম্যানের পাশে জন ক্যাজেল:
এরপর আসে গদফাদার পার্ট টু। এই মুভিতে অসাধারন পারফরম্যান্স দেখান তিনি। বিশেষ করে যখন মাইকেল কর্লিওনির আদেশে তাকে মেরে ফেলা হয় সেই সিকোয়েন্সটা চলচ্চিত্র ইতিহাসে বেশ বিখ্যাত একটি দৃশ্য হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।
এরপর বন্ধু আল পাচিনোর অনুরোধে বিখ্যাত পরিচালক সিডনি লুমেটের Dog Day Afternoon মুভিতে সাল নামক একটি বড়ো চরিত্রে অডিশান দিতে যান,যেখানে লিডিং রোলে অভিনয় করবেন আল পাচিনো। তবে পরিচালক কিছুটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক ঝুঁকি নিয়ে তাকে সিলেক্ট করেন, কারন Dog Day Afternoon মুভিটির কাহিনী একটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিলো যেখানে সালের অরিজিনাল বয়স ছিলো আঠারো বছর, সেই তুলনায় জন ক্যাজেলের বয়স ছিলো প্রায় ৩৮ বছর। আল পাচিনোর অনেক অনুরোধের পর পরিচালক ক্যাজেলকে কাস্টিং করাতে বাধ্য হন। কিন্তু বন্ধু আল পাচিনো আর পরিচালক লুমেটকে হতাশ করেন নি জন, অনবদ্য পারফরম্যান্স দেখিয়ে নিজেকেও ছাড়িয়ে যান এই মুভিতে। ফলশ্রুতিতে পেয়ে যান গোল্ডেন গ্লোব নমিনেশান।
Dog Day Afternoon মুভির একটি দৃশ্যে আল পাচিনোর সাথে জন ক্যাজেল:
১৯৭৬ সালে Public Theater এ একসাথে একটি স্টেজপ্লেতে কাজ করার সময় পরিচয় হয় মেরিল স্ট্রীপের সাথে। এরপর তা ধীরে ধীরে রূপ নেয় প্রেমের সম্পর্কে। কিন্তু ক্যারিয়ারের এমন সময়ে সুখটা যেনো বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না। মরনঘাতি বোন ক্যান্সার ধরা পড়ে তার শরীরে। এই অসুস্থতা নিয়েও তিনি প্রেমিকা মেরিল স্ট্রীপের সাথে একসাথে অভিনয় করেন আরেকটি কালজয়ী সিনেমা The Deer Hunter তে, যেটি ১৯৭৮ সালে রিলিজ পায়।
এটিই ছিলো জন ক্যাজেলের সর্বশেষ ফিচারড ফিল্ম। অসুস্থতার জন্য তার দৃশ্যগুলোর শ্যুটিং আগেভাগেই শেষ করা হয়। মুভিটি মুক্তির আগে ১৯৭৮ সালের ১২ই মার্চ তিনি মৃত্যুবরন করেন।
১৯৭৬ সালের গোল্ডেন গ্লোব অনুষ্ঠানে প্রেমিকা মেরিল স্ট্রিপের সাথে:
তার জীবনী লিখতে গিয়ে আমার মনটা খুবই খারাপ হয়ে আছে। এতোটা দূর্ভাগ্যজনক পরিনতি একটা মানুষের কিভাবে হয়।
যাই হোক, এইবার আসি কী এমন বিশেষত্ব ছিলো তার মধ্যে যা তাকে সবার চেয়ে আলাদা করেছে। এক নাম্বার কারনটি হলো, তিনি যে কয়টি মুভিতে অভিনয় করেছেন তার প্রত্যেকটিই সেরা মুভিতে অস্কারের নমিনেশান পেয়েছে। তার প্রত্যেকটি মুভিই আইএমডিবি টপ ২৫০ তে বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে, যদিও দ্যা কনভার্সেশান মুভিটি টপ ২৫০ তে নেই তারপরেও প্রায় ৪০ হাজার ভোটে Ratings: 8.0/10 পেয়েছে মুভিটি। তার অভিনীত ৫টি মুভি সবমিলিয়ে ৪০ টি অস্কার নমিনেশান ও তার মধ্যে ১৫টিতে পুরষ্কার লাভ করেছে।
এইবার ক্যাজেলের সাথে কাজ করেছেন এমন কিছু মানুষের কিছু কথা শেয়ার করি, যখন আল পাচিনো আর ক্যাজেল প্রথম পরষ্পরের সাথে পরিচিত হন সেই সময়কার স্মৃতিচারন করে ক্যাজেল সম্পর্কে আল পাচিনো বলেছিলেন, "When I first saw John, I instantly thought he was so interesting,Everybody was always around him because he had a very congenial way of expressing himself."
Dog Day Afternoon মুভির কমেন্টারি ট্র্যাকে পরিচালক সিডনি লুমেট বলেছিলেন, "In the screenplay, Cazale's role was written to be a smart-ass street kid. But Al came to me and said, 'Sidney, please, I beg you, read John Cazale for it.' And when John came in I was so discouraged and thought 'Al must be out of his mind.' This guy looks thirty, thirty-two, and that’s the last thing I want in this part. But Al had great taste in actors, and I hadn’t yet seen him in The Godfather. And Cazale came in, and then he read, and my heart broke. . . .
"One of the things that I love about the casting of John Cazale ... was that he had a tremendous sadness about him. I don’t know where it came from; I don’t believe in invading the privacy of the actors that I work with, or getting into their heads. But my god - it’s there - in every shot of him. And not just in this movie, but in Godfather II also. It's great working with John because he has a way of getting involved - in the whole thing, in the characters. He asks so many questions - he was just brilliant. It was tough to sell Johnny, but once Sidney got to see him read, and work with me, it turned out great."
তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিউ ইয়র্কের একটি থিয়েটারের নাম তার নামে রাখা হয়েছে।
এছাড়া তার ক্যারিয়ার আর জীবনি নিয়ে I Knew It Was You নামের একটি ডকুমেন্টারী ফিল্মও বানানো হয়েছে যা ২০০৯ সালে সানডেন্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রিমিয়ার করা হয়।
কিছুদিন পরেই আসছে সেই ১২ মার্চ,আজ থেকে ৩৪ বছর আগে এইদিনে আমাদের ছেড়ে চলে যান জন ক্যাজেল, তার জীবনটা একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাসে ভরা কিন্তু সেই দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে রয়েছে একটা অসাধারন লাইফস্টোরি। সেইটাই আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। জন ক্যাজেলের অভিনীত প্রথম মুভিটি দেখিছিলাম দ্যা গডফাদার, তবে আল পাচিনো, মারলন ব্রান্ডো আর রবার্ট ডি নিরোর মায়াবী পারফরম্যান্সের ভীড়ে তাকে খুব একটা চোখে পড়েনি। তবে সত্যিকার অর্থে তাকে চোখে পড়ে ডগ ডে আফটারনুন মুভিতে।
অনবদ্য অভিনয় করে আল পাচিনোকেও ছাড়িয়ে যান তিনি। এরপর আইএমডিবিতে তার জীবনি পড়ে অন্যরকম একটা অনুভূতি জন্মায় তার প্রতি। একনাগাড়ে তার অভিনীত সকল মুভিগুলো দেখে ফেলি। সে প্রায় তিন-চার বছর আগের কথা। কিন্তু সেই মুগ্ধতার রেশ এখনো কাটেনি।
তাই আজকে ভাবলাম তাকে নিয়ে কিছু একটা লিখি। পরিশেষে জন ক্যাজেলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে পোস্টটি শেষ করছি।
----------------------------------------------------------------
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া আর আইএমডিবি
=========================================== ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।