আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পথে প্রান্তরে-৯ দেখে এলাম হার্ডিঞ্জ ব্রিজ

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............ পথে প্রান্তরে-৯ দেখে এলাম হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কুষ্টিয়া ভ্রমনের ২য় দিন যাই হার্ডিঞ্জ ব্রীজ দেখতে। হার্ডিঞ্জ ব্রীজ সম্পর্কে খুটিনাটি জানি সেই স্কুল/কলেজ জীবন থেকেই। অনেকবার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে, দেশী বিদেশী বন্ধুদের নিয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ এপাড়-ওপাড় বেড়িয়েছি। আগে দেখেছি-উপরে নান্দনিক ব্রীজ আর নিচে প্রমত্ত নদী! এই ব্রীজের উপর দাড়ালেই ফেরদৌসী রহমানের কন্ঠে-"পদ্মার ঢেউরে মোর শুন্য হৃদয় পন্ম নিয়ে যা-যা-রে......"-গানটাকে স্বার্থক মনে হতো। এখন সব কিছু বদলে গিয়েছে।

এখনও নদীর উপরে নান্দনীক ব্রীজ যদিওবা আছে-কিন্তু ব্রীজের নিচে প্রমত্ত পদ্মা নদী নেই। নামে যদিওবা নদী আছে-কিন্তু নদীতে পানি নেই বললেই চলে। হার্ডিঞ্জ ব্রীজে ১৫টি স্প্যানের মধ্যে এখন মাত্র চারটি স্প্যানে পানির স্পর্শ আছে। যার মধ্যে দুই তীরের দুটি স্প্যানে হাঁটু পানি। নদীতে পানির পরিবর্তে এখন ধূ ধূ বালি আর বালি।

যেন মরুভূমি! নদীটা দেখে মনেপরে-“"আমাদের ছোট নদি চলে বাঁকে বাঁকে-বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে..."। “ সত্যি প্রমত্তা পদ্মা, গড়াই এখন হাঁটু জলের মরা নদি! এই নদির বুকে এখন মহিষের গাড়ি চলে! এই নদি নির্ভর মৎসজিবীরা বেকার, পেশা পরিবর্তন করে কৃষক হয়েও সমস্যার বেড়াজালথেকে বেড় হতে পারছেনা। যেখানে নদির দুই তীর জুড়ে ফসলী জমিতেই সেচ দেবার জন্য পানি পাওয়া দূষ্কর-সেখানে জেলেদের মাছ ধরার প্রশ্নই আসেনা! এশিয়ার বিস্ময় রেলসেতু ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সেতুবন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিহাসের সাক্ষী ঈশ্বরদীর পাকশীতে পদ্মা নদীরবুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই সেতুর বয়স শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার প্রান্তে। একশ’ বছর আগে পরাধীন উপমহাদেশে পূর্ব বাংলার সাথে কলকাতা এবং অন্যান্য স্থানের যোগাযোগের মূল লক্ষ্যই ছিল বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি।

সময়ের গতিধারায় ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য-যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বৃটিশ-ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের উন্নয়নে আজও উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে চলেছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ব্রিটিশ শাসনামলেরও আগে থেকে কলকাতার সাথে পূর্ব বাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থার মূল মাধ্যম ছিল জলপথ। নৌপথে নারায়ণগঞ্জ ঘাট থেকে জাহাজ ছেড়ে ঈশ্বরদীর সাঁড়া ঘাট,রায়টা ঘাট হয়ে কলকাতা বন্দরে পৌঁছাতো। পদ্মার সুস্বাদু ইলিশ মাছ থেকে শুরু করে শাক-সবজিসহ বিভিন্ন পণ্য পূর্ববাংলা থেকে জাহাজে করেই কলকাতায় চালান হতো।

এভাবেই কলকাতার সাথে পূর্ববাংলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে আঞ্চলিক অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি লাভ করে। তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার ব্যবসা-বাণিজ্য,পর্যটক তথা অবিভক্ত ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরা,আসাম, নাগাল্যান্ড ও উত্তরবঙ্গের সাথে কলকাতা ও দিল্লির যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে ১৮৮৯ সালে পদ্মা নদীর উপর এই সেতু তৈরির প্রস্তাব করে। এবার দেখা যাক-হার্ডিঞ্জ ব্রীজের বিস্তারিত তথ্যাবলীঃ- ১৯০৮ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের বরাদ্ধ মঞ্জুর হয় এবং ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট ইউলিয়ামের নেতৃত্বে ব্রিজের নকশা প্রণয়ন ও অনূমোদন করাহয়। প্রধান প্রকৌশলীঃ ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেইলস ব্রিজের প্রথম প্রকল্প পরিচালকঃ স্যার এস এম রেলডলস। ব্রিজ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানঃ রেইথ ওয়ালটি এন্ড ক্রিক(ইউকে)।

ব্রিজের নির্মাণ কাজ শুরুঃ ১৯০৮ সন(নকশা ও নদি শাসন) ও মূল ব্রিজ নির্মাণ শুরু ১৯১০ সনে। ১৯১২ সালে ব্রিজের গাইড ব্যাংক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ৪ থেকে ৫ মাইল উজান থেকে ব্রিজের গাইড ব্যাংক বেঁধে আনা হয়। একই বছর গার্ডার নির্মাণের জন্য পর্যায়ক্রমে ১২টি কূপ খনন করা হয়। নির্মাণ কাজ সমাপ্তঃ ১৯১৫ সালের এপ্রিল মাস ব্রিজের কারিগরি বিনির্দেশনাঃ মূল স্প্যান ১৫টি।

প্রতিটি বিয়ারিং-এর মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৩৪৫ ফুট এবং উচ্চতা ৫২ ফুট। একেকটি স্প্যানের ওজন ১ হাজার ২’শ ৫০ টন(নির্স্ট যায়গার রেল লাইনসহ মোট ওজন ১ হাজার ৩’শ টন)। ব্রিজে ১৫টি স্প্যান ছাড়াও দু’পাশে রয়েছে ৩টি করে অতিরিক্ত ল্যান্ড স্প্যান। এছাড়াও দু’টি বিয়ারিং-এর মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট। অর্থাত্ ব্রিজের মোট দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৮’শ ৯৪ ফুট,এক মাইলেরও বেশি।

ব্রিজ নির্মাণ ও রক্ষা বাঁধের জন্য ১.৬ কোটি ঘনফুট মাটি এবং নদী শাসনে প্রয়োজন হয় ৩ কোটি ৮৬ লাখ ঘনফুট মাটি। ৩ কোটি ৮ লাখ ঘনফুট পাথর ব্যবহারের পাশাপাশি ২ লাখ ৯৯ হাজার টন ইটের গাঁথুনির কাজ হয়। মোট সিমেন্ট ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার ড্রাম ফিল্ড। সেই সময়ের হিসাব অনুযায়ী মূল স্প্যানের জন্য ব্যয় হয় ১ কোটি ৮০ লাখ ৫৪ হাজার ৭৯৬ টাকা। স্থাপনের জন্য ৫ লাখ ১০ হাজার ৮৪৯ টাকা, নদী শাসনের জন্য ৯৪ লাখ ৮ হাজার ৩৪৬ টাকা এবং দু’পাশের রেল লাইনের জন্য ৭১ লাখ ৫৫ হাজার ১৭৩ টাকা।

অর্থাত্ একশ বছর আগেই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণে মোট ব্যয় হয় ৩ কোটি ৫১ লাখ ২৯ হাজার ১৬৪ টাকা। ব্রিজ নির্মাণে ২৪ হাজার ৪’শ শ্রমিক-কর্মচারী ৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে। ১৯১৫ সনের জানুয়ারী মাসের ১ তারিখ প্রথম পরীক্ষামূলক ট্রেন এবং ২৫ ফেব্রুয়ারী ২য় পরীক্ষামূলক ট্রেন চালু করা হয়। ১৯১৫ সনের ৪ মার্চ লর্ড হার্ডিঞ্জ আনূষ্ঠানিক ভাবে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ উদবোধন করলেও বানিজ্যিক ভাবে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালুহয় ১৯১৫সনের ১ এপ্রিল থেকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে খুলনা,যশোরে পাকবাহিনীর পতনের পর ১৩ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর সম্ভাব্য সংগঠিত হওয়া প্রতিরোধ কল্পে মিত্র বাহিনী বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যানটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

স্বাধীনতার পর ব্রিজটিকে মেরামত করে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজকে ঘিরে ঈশ্বরদীর পাকশী দেশের একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবেও পরিচিত। * হার্ডিঞ্জ ব্রিজের যাবতীয় তথ্য নিয়েছি-হার্ডিঞ্জ ব্রিজ উইকীপিডিয়া থেকে। * হার্ডিঞ্জ ব্রীজের দুটি ছবি যখন পদ্মায় পানি থাকে তখনকার, দুটো ছবি বর্তমানের পানি শুন্য পদ্মার ছবি! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।