পৃথিবীর কাছে তুমি হয়তো কিছুই নও, কিন্তু কারও কাছে তুমিই তার পৃথিবী"
এইচএসসি’র প্রস্তুতি শেষ, বিশেষ ব্যবস্থায় দিবেন পরীক্ষা
বর্বর ও শিক্ষাবিমুখ স্বামী ডান হাতের পাঁচ আঙ্গুল কেটে নিলেও হাওয়া আক্তার জুঁইয়ের (২০) মনোবল কেড়ে নিতে পারেননি। শারীরিকভাবে এখন কিছুটা সুস্থ জুঁই; কষ্ট একটাই লিখতে পারেন না। কিন্তু তাতে কী ? দমে যাবার পাত্রী সে নয়। রাত-দিন শুধুই পড়ছেন। চলতি বছরই এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবেন।
নরসিংদী সরকারি কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন জুঁই। তার জন্য জেলা প্রশাসনের সহায়তায় বিকল্প লেখক ঠিক করা হয়েছে। প্রশ্ন দেখে তিনি যা বলবেন সহায়তাকারী লেখক তাই লিখে দিবেন পরীক্ষার খাতায়। নিজে না লিখেই পরীক্ষা দিবেন- এটা কখনো ভাবেন নি জুঁই। তাই সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি সে কৃতজ্ঞ ।
লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার অপরাধে (!) গত বছরের ৪ ডিসেম্বর বিদেশফেরত স্বামী রফিকুল ইসলাম চাপাতির কোপে জুঁইয়ের হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলেন। পরে ক্যান্টনমেন্ট থানার পুলিশ রফিককে গ্রেফতার এবং চাপাতিটি উদ্ধার করে। স্ত্রীর আঙ্গুল কাটার ঘটনায় পাষণ্ড রফিক ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ মামলায় শিগগিরই চার্জশীট দেয়া হবে বলে থানা সূত্রে জানা গেছে।
গতকাল মঙ্গলবার নরসিংদী শহরের ভেলা নগরের বাসায় ইত্তেফাক প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় জুঁইয়ের।
এ সময় ইত্তেফাকেই প্রথম সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার একপর্যায়ে জুঁই কেঁদে ফেলেন। বলেন, ‘ভাইয়া যদি ইত্তেফাক এই ঘটনাটি প্রকাশ না করতো তাহলে আমাদের মত দিনমজুর ও অসহায় পরিবারের এই বর্বরোচিত ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যেতো। ’ জুঁই জানান, তার এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি প্রায় শেষ। চিকিত্সার পাশাপাশি পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রস্তুতি খুবই ভাল।
পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল করবে বলে সে আশাবাদী। সম্প্রতি জুঁইকে সাভার পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে থেরাপি চিকিত্সা দেয়া হয়েছে। পরীক্ষার ১০ দিন আগে তার ডান হাতে পাঁচটি কৃত্রিম আঙ্গুল সংযোজন করা হবে বলে জানালেন জুঁই ।
তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে : স্মরণকালের এই পৈশাচিক ঘটনার মামলাটি বর্তমানে উইমেন্স সাপোর্ট বিভাগে তদন্তাধীন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ কমিশনার জেরীন সুলতানা বলেন, জুঁইয়ের উদ্ধারকৃত আঙ্গুলের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়েছে। এ রিপোর্ট পাওয়ার পর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হবে। তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে তিনি জানান। বর্তমানে জুঁইয়ের স্বামী রফিকুল ইসলাম জেল হাজতে রয়েছেন।
যা ঘটেছিল : তিন বছর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার নূরজাহানপুর গ্রামের বাসিন্দা বাতেন মিয়ার ছেলে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে জুঁইয়ের বিয়ে হয়।
তখন জুঁই এসএসসি পাস করেছে। অশিক্ষিত স্বামী রফিক বিয়ের পর পর স্ত্রী জুঁইকে সাফ জানিয়ে দেয়, আর লেখাপড়া করা যাবে না। কিছুদিন পর স্বামী রফিক বিদেশে চলে যায়। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে জুঁইয়ের ছেলে বেলা থেকে লেখাপড়া করার স্বপ্ন। তাঁত শ্রমিক পিতা ইউসুফ মিয়ার কন্যা জুঁইয়ের লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহের কথা জানতেন।
তাই আর্থিক চরম অনটনের মধ্যেও মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যেতেন। স্বামীর সংসারে এসে জুঁই নরসিংদী সরকারি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন। অশিক্ষিত স্বামী স্ত্রী কলেজে পড়ছে একথা শুনে ক্ষিপ্ত হন। টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলে রফিক তার শাশুড়ি পারভীন বেগমকে জানিয়ে দেন, জুঁইকে পুড়িয়ে হত্যা করবে। এতো বাধা সত্ত্বেও জুঁই টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।
এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে রফিক পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বর্ণালংকার ও কসমেটিকস নেয়ার জন্য জুঁইকে ঢাকায় তার বোনের বাসায় ডেকে আনেন। গত ৪ ডিসেম্বর ভোরে রফিক বিদেশ থেকে ক্যান্টনমেন্টের ওই বাসায় আসেন। পরে নানা ছলনার একপর্যায়ে চাপাতি দিয়ে কোপ দিয়ে জুঁইয়ের ডান হাতের পাঁচটি আঙ্গুল কেটে ফেলেন। তাকে উত্তরার একটি বেসরকারি ও পরে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েকদিন চিকিত্সা শেষে নরসিংদী ভেলানগরের বাসায় চলে আসেন জুঁই।
অতীতের সেই ঘটনা :
হাওয়া আক্তার ওরফে জুঁইয়ের (২০) ‘অপরাধ’ স্বামীর নিষেধ স্বত্তেও পড়াশোনা করা। বিয়ের পরপরই অশিক্ষিত স্বামী তাকে জানিয়ে দেয় আর পড়াশোনা করা যাবে না। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি অদম্য টানে জুঁই নরসিংদী সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়। নির্বাচনী পরীক্ষায়ও ভাল ফল করে সে।
স্বামীর নিসেধ স্বত্তেও পড়াশোনা করার খেসারত দিতে হলো জুঁইকে ডান হাতের কব্জি দিয়ে।
সে যাতে আর লিখতে না পারে সে জন্য ডান হাতের কব্জি কেটে নেয় ঈর্ষান্বিত আবুধাবি প্রবাসী স্বামী রফিকুল ইসলাম। গত ৪ ডিসেম্বর সকালে ক্যান্টনমেন্ট থানার জিয়া কলোনীতে রফিকের দুলাভাইয়ের বাসায় এ পৈশাচিক ঘটনা ঘটে। ডান হাতের আঙ্গুলগুলো হারিয়ে জুঁই নরসিংদী পৌর এলাকার ভেলানগরের বাসায় কষ্টকর দিন কাটাচ্ছে। সকাল-সন্ধ্যা সহপাঠীরা এসে তাকে সান্তনা দিচ্ছে। গত সোমবার ইত্তেফাকের প্রতিনিধি জুঁইয়ের ভেলানগর বাসায় গিয়ে দেখতে পান বুকের উপর ব্যান্ডেজ বাধা ডান হাতটি রেখে শুয়ে আছে সে।
অসহায় শিশুর মতো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল এই প্রতিনিধিকে।
ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গেই কেঁদে ফেলে সে। বলতে থাকে স্বামীর সংসার, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ও স্বামীর নিষেধের কথা। হাত কেটে নেয়ার প্রসঙ্গ আসতেই হাউমাউ করে কেেঁদ ফেলে সে। বলে তার স্বামী মানুষ নামের একটা নরপশু।
জুঁই জানায়, রফিকের দুলাভাইয়ের বাসায় বিদেশ থেকে আনা স্বর্ণের নেকলেসও হাতের বালা পড়ানোর কথা বলে সে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটায়। আবুধাবি থেকে এসে সে আমার সঙ্গে ভালবাসা আর প্রেমের নানা ছন্দে কথা বলতে থাকে। যা হিন্দি সিনেমাকে হার মানিয়ে দেয়।
যেভাবে কব্জি কেটে নেয় রফিক
তিন বছর আগে জুঁইয়ের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার নুরজাহানপুর গ্রামের বাসিন্দা বাতেন মিয়ার ছেলে রফিকুল ইসলাম রফিকের সঙ্গে বিয়ে হয়। তখন জুই মাত্র এসএসসি পাশ করেছে।
বিয়ের পরপরই রফিক সাফ জানিয়ে দেয় আর লেখাপাড়া করা যাবে না । এর কিছুদিন পরই রফিক চলে যায় আবুধাবি। জুঁইয়ের বাবা ইউসুফ মিয়া একজন তাঁতশ্রমিক। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে জুঁইয়ের ছেলেবেলা থেকেই লেখা পড়ার করার স্বপ্ন। মেয়ের লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহের কথা জানতেন ইউসুফ মিয়া।
আর্থিক দৈন্যদশার মধ্যেও মেয়ের পড়াশোনার খরচ যুগিয়েছেন তিনি।
স্বামীর সংসারে এসে লেখাপড়ার নেশায় জুঁই নরসিংদী সরকারি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয় মানবিক বিভাগে। বর্তমানে সে শেষ বর্ষের ছাত্রী। অশিক্ষিত রফিক স্ত্রীর কলেজে ভর্তির সংবাদ শুনেই মারাত্মক ক্ষিপ্ত হয়। রফিকের আত্নীয় স্বজনও বিষয়টি ভালচোখে দেখেননি।
টেস্ট পরীক্ষার আগে রফিক তার শ্বাশুড়ি পারভীন বেগমকে জানিয়ে দেয় টেস্ট পরীক্ষা অংশ গ্রহণ করলে জুঁইকে পুড়িয়ে হত্যা করা হবে। এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও টেস্ট পরীক্ষায় অংশ নেয় জুঁই। স্বামী যখন তাকে মানা করতো আর পড়াশোনা করা যাবে না তখন জুই স্বামীকে বলতো, তুমি ভয় পেয়ো না। মেয়েদের স্বামী একজনই। আমি এইচএসসি পর্যন্ত পড়বো।
তবুও মন গলেনি পাষণ্ড রফিকের।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী জুঁইকে তার ননদ নাইমা জানায়, তোমার স্বামী বিদেশ থেকে মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকার ও কসমেটিকস পাঠিয়েছে। তুমি বাসায় এসে নিয়ে যাও। ননদের স্বামী সেনাবাহিনীর কর্পোরাল মো. শফিকুল ইসলামও অনুরূপ সংবাদ জুঁইকে দেয়।
১ ডিসেম্বর জুঁই নরসিংদী থেকে স্বামীর পাঠানো জিনিসপত্র নিতে জিয়া কলোনীর ননদের বাসায় যায়।
তিন দিন অতিবাহিত হলেও জুঁইকে কোন জিনিসপত্র দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে সে ননদের কাছে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, আর একদিন পরই তোমার জিনিসপত্র দিয়ে দিবো।
কান্না জড়িত কণ্ঠে জুঁই বলে ‘ ৪ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে দেখি বিছানার সামনে রফিক দাঁড়ানো। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কখন আসছো। উত্তরে রফিক বলে, এইতো কিছুক্ষণ আগে আবুধাবি থেকে আসলাম।
তোমার সঙ্গে একা কথা আছে বলে রফিক তাকে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। ’
অনেক দিন পর স্বামীকে দেখে আনন্দে ভরে উঠে জুঁইয়ের মন। চরম আবেগে পাশের কক্ষে দুইজনে গিয়ে বসে। এ সময় নাইমা ও তার স্বামী শফিকুল ইসলামসহ পরিবারের অন্য কক্ষে ছিল। রফিক কক্ষের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়।
রফিক জুঁইকে বলে তুমি তাহলে ঠিকই পরীক্ষা দিয়েছো। চোখ বন্ধ করো, তোমাকে এমন পুরস্কার দিবো, যা তুমি কখনো কল্পনা করতে পারবে না। স্বামীর এমন মধুর কথা শুনে আবেগে জুঁই চোখ বন্ধ করে ফেলে। এ সুযোগে ওড়না দিয়ে জুইয়ের দুই চোখ টাইট করে বেঁধে ফেলে রফিক। স্কচটেপ দিয়ে বন্ধ করে দেয় মুখ।
এরপর রফিক জুঁইকে বলে, তুমি ডান হাত লম্বা করো। জুই ডান হাত লম্বা করার সঙ্গে সঙ্গে ধারাল চাপাতি দিয়ে কোপ দেয় রফিক। এক কোপেই জুঁইয়ের কব্জি হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মুখে স্কচটেপ থাকায় জুঁই চিত্কার করতে পারেনি। মেঝে ভেসে যায় রক্তে।
রক্তাক্ত জুঁইকে ঐ কক্ষের বারান্দায় ফেলে রাখে রফিক। কিছুক্ষণ পর ননদ ও তার স্বামী এসে রক্ত পরিস্কার করে। জুঁইকে পরে উত্তরার একটি প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় তারা। সেখানে ডাক্তার ডান হাতে কবজি কিভাবে কেটেছে জুঁইয়ের কাছে জানতে চাইলে সে পুরো ঘটনা প্রকাশ করে। এ সময় ননদ ও তার স্বামী দ্রুত হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়।
জুইকে ডাক্তার দ্রুত পঙ্গু হাসপাতালে প্রেরণ করে।
৬ ঘণ্টার মধ্যে বিচ্ছিন্ন
আঙ্গুল পাওয়া গেলে
জোড়া লাগানো সম্ভব হতো
জুঁইকে পঙ্গু হাসপাতালের সার্জন জানান, ডান হাতের পাঁচটি আঙ্গুল ৬ ঘণ্টার মধ্যে পুনরায় ঐ স্থানে জোড়া লাগানো হলে আগের মত হয়ে যাবে। এই কথা শুনে জুঁইয়ের বাবা ও অভিভাবকরা ছুটে যান জিয়া কলোনীর ১০৭/৫ নম্বর ভবনের তৃতীয় তলায় শফিকের বাসায়। রফিকের হাতে পায়ে ধরে জুইয়ের বাবা বলেন, বাবা তুমি আমার মেয়ের আঙ্গুলগুলো দাও। উত্তরে রফিক শ্বশুরকে বলে আঙ্গুলগুলো উত্ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।