আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অন্তর্জালের কিছু মানুষেরা এবং এবারের বই মেলা

হাউকাউ পার্টি বই মেলায় প্রতি বছরই যাই একাধিকবার তবে এবারের বই মেলাটা ছিল আমার জন্য এক নতুন অনুভূতির মেলা। কারণ এবারই প্রথম আমার সাথে বাস্তবে দেখা হলো অন্তর্জালের তিন বছর ধরে পরিচিত সব সুহৃদের। আমি সত্যিই খুব বেশি আনন্দিত হয়েছি প্রথম দিন মেলায় গেলাম সাপ্তাহিক ছুটির দিন, ১২ই ফেব্রুয়ারী, শুক্রবার। উপচে পরা ভীর সেদিন, আমরা গেলাম জুমার নামাজে কিছু পরে। তাই কিছুটা সময় ফাঁকা পেলাম মেলা প্রাঙ্গন।

নজরুল মঞ্চের কাছে টইটুম্বুরের স্টলের সামনে দাড়িয়ে কথা বলছিলাম স্টলের এক লেখক আপার সাথে, আমার সোহা মনিকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। সে সোহাকে তার একটা বই গিফট করলেন, সাথে স্টিকার আরও কি সব!! আমরা একটু হতচকিত হয়ে গেলাম এই হঠাৎ ভালবাসায়! এমন সময়ে পেছন থেকে মেয়েলি কন্ঠের নরম ডাক "এক্সকিউজ মি, আপনি কি রেজোওয়ানা আপু?"......ঘুরে দেখি ভীষন মিষ্টি একটা মেয়ে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে! সে হলো ব্লগার অপরিনীতা! আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, সে কিভাবে আমাকে চিনে ফেললো! অপরিনিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এগুলাম মেলার ভেতরে, ততক্ষন মানুষ হয়ে গেছে তিন গুণ। সোহামনি মাঝে মাঝে "সুইট বেবী" বলে এগিয়ে আসা খালামনিদের গাল টানাটানিতে মোটামুটি বিরক্ত! এর মাঝেরই মনে পরলো, সেদিন হাসান মাহবুবের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, ভাবলাম যাই একবার ঢু দিয়ে আসি লিটল ম্যাগে! সেখানে দেখা হলো হামা এবং তার মিষ্টি বউ সমুদ্রকণ্যার সাথে। এরপরে কৌশিক ভাই, অন্যমনস্ক শরৎ, রেজোয়ান তানিমের সাথে দেখা হলো। তানিম বললো আরো অনেকে নাকি আছে, সেদিকে এগুতোই হঠাৎ এক পিচকি দৌড়ে এসে সালাম করলো! আমাকে হকচকিয়ে দিয়ে সে নিজের পরিচয় দিল.....ফ্রাকেস্টাইন"! ফ্রাকেস্টাইন পরে পরিচয় করিয়ে দিল নিশাচর ভবঘুরে, আরজু পনি আপু, নষ্টকবি, ধুসর ধ্রুব, নীরব দর্শক ভাইয়ের সাথে।

ইচ্ছা ছিল একটু গল্প করার, তবে ততক্ষনে আমার সোহার ধৈর্য্যের সব সীমা শেষ, সে তারাস্বরে চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করায় আমাদের প্রথমদিনের মেলা ভ্রমন মাত্র ৬০ মিনিটে শেষ করে বাসায় ফিরতে হলো। এরপরে আবার গেলাম অপর বাস্তবের মোড়ক উন্মোচনের দিন! সেদিন সোহা বাদ মেলায় এবার নতুন করে দেখা হলো আসিফ মহিউদ্দীন, শিপু, নীরব, শশি হিমু, নাজমুস সাকিব অনু, নোমান নামি, দূর্বা জাহান, পাহাড়ের কান্না, সুদীপ্ত, সাজিদ ঢাকা এবং হানিফ রাশেদিনের সাথে। তবে সেদিনও ব্লগারদের সাথে কথাবার্তা পরিচয় পর্বেই শেষ, আড্ডা দেবার সুযোগ পেলাম না অবশ্য এইদিন আমরা মনের আশ মিটিয়ে কিছু বই কিনতে পারলাম এবারে মেলায় প্রথমা' থেকে বের হয়েছে হবিবুল্লাহ পাঠান আর সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের বই "ওয়ারী -বটেশ্বর, শেকড়ের সন্ধানে"। প্রচুর রঙ্গিন ইলাস্ট্রেশন আর তথ্যবহুল লেখায় সমৃদ্ধ এই বইটা ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘর থেকে প্রকাশিত নকশি কাঁথার উপরে লেখা পারভিন আহমেদের বইটাও খুব চমৎকার আর ব্যাতিক্রমী।

বাচ্চাদের জন্য এবার মজার মজার চমৎকার সব ছবিওয়ালা সব গল্প নিয়ে এসেছে ব্রাক। দামও সাশ্রয়ী। আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় গল্প, সেই সাথে বিদেশী বিখ্যাত গল্প গুলোও দেশীয় ধাঁচে, নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ করেছে তারা! এছাড়া সিসিমপুর আর মিনার গল্পের সেটও রয়েছে। সোহার জন্য অনেক গুলো বই কেনা হলো এখান থেকে। সাহিত্য প্রকাশের হান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্দারসনের "কাহিনী পঞ্চাশৎ" আর বাংলা প্রকাশের "আলোক লতা" বই দুটোও দারুন হয়েছে, এ দুটো বই কিশোর বয়সীদের জণ্য খুব চমৎকার পাঠ্য হবে বলে মনে হয়েছে।

সোহামনি বই নিয়ে গভীর পড়াশুনায় ব্যাস্ত! সেদিন আবার ফরিদা পারভিনের গানের আয়োজন ছিল, আমাদের জন্য উপরি পাওনা। রাত ন'টা পর্যন্ত গান শুনে বাড়ি ফিরলাম তৃপ্ত মনে তবে একটা অপূর্ণতা ছিল, সেটা হলো খোদ বাংলা একাডেমীর স্টলেই যাওয়া হয়নি, অথচ এটা আমরা কোন বারই মিস করি না। সেই অপূর্ণতা পূরণের জন্য শেষবারের মতো ২০১২ বই মেলায় গেলাম গতকাল। অফিস ফেরতা জ্যাম ঠেলে মেলায় যেতে যেতে বেজে গেলো রাত সাড়ে সাতটা। বাংলা একাডেমির স্টল আবার সাড়ে আটটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়, তাই হুরমুড়িয়ে আগে ঢুকে পড়লাম সেই স্বর্ণের খনিতে।

প্রথমেই নিলাম একুশের স্মারক গ্রন্থ। প্রতি বছর এটার কয়েকটা করে পর্ব সংগ্রহ করি আমরা। আশাকরি একদিন সব কটা পর্বই সংগ্রহে চলে আসবে। মুনতাসীর মামুন স্যারের এই কাজ গুলো দূর্দান্ত হয়েছে। পঞ্চতন্ত্র আর গাজির গান নিয়ে বই অনেক দিন ধরে খুঁজছিলাম, এবার পেয়ে গেলাম।

আরও যে সব বই নিলাম, তার মধ্যে শঙ্খ শিল্প বইটা বেশ ভাল হয়েছে। জারি গান নিয়ে একটা বই ছিল, এক মাত্র কপি, আমি হাত বাড়ানোর আগেই আরেক ভদ্রলোক চোখের সামনে দিয়ে খপ করে সেটা নিয়ে গেলো! যাই হোক, বাংলা একাডেমির সব চাইতে বিরক্তিকর অংশ কোনটা বলুন তো? একবাক্যে বইয়ের মূল্য পরিশোধ! সেই সনাতন পদ্ধতিতে, মেমোতে প্রতিটি বইয়ের নাম লেখা, পাশে বইয়ের দাম। এরপর ক্যালকুলেটা চেপে যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ করতে করতে মিনিট পনোরো সময় খরচ হয়ে গেলো বাংলা একাডেমি থেকে বইয়ের বস্তা হাতে নিয়ে বার হয়ে এবার নির্ভার চিত্তে ঘুরোঘুরি। একফাঁকে আবার লিটল ম্যাগে ঢু দিয়ে আসলাম। সেখানে আমার জন্য একটা সারপ্রাইজ ছিল! আমার প্রিয় কবি ব্লগার ফাহাদ চৌধুরী, নষ্টালজিক ভাই, অমিত চক্রবর্তী আর মেলায় প্রতিদিনের অংশ রেজোয়ান তানিমের সাথে দেখা হয়ে গেলো।

তানিম ছাড়া বাকি তিন জন মৌন প্রায় নষ্টালজিক ভাইকে দেখলাম ক্রমাগত চিউইং চিবোচ্ছে, আবার মাঝে মাঝে সেটা বেলুনের মতো ফুলাচ্ছেও!! আর ফাহাদ!! পরে মেঘ বলেছে যাবো যাবো আপুর কাছে শুনলাম, সে নাকি খুব লাজুক ভাল ছেলে নির্বাক কবিত্রয়কে দেখে আবার শুরু হলো হাটাহাটি। মেলার গেটে নারকেলের ফুল বিক্রি হয়, আমার খুব পছন্দের। আমরা দু'জনে দুটি মোটাসোটা নারকেলের ফুল খেতে খেতে মানুষের তেরছা দৃষ্টি উপেক্ষা করে হাটতে লাগলাম ঘুরতে ঘুরতে একাডেমির ক্যাফের কোনায় একপাশে পেয়ে গেলাম চমৎকার একটা প্রকাশনি, নিম্ফিয়া পাবলিকেশন। এদের প্রকাশনা গুলো সব পিক্টোরিয়াল, চমৎকার সব সংগ্রহ, যদিও সংখ্যায় কম আর একটু কস্টলি! আমরা এবার নিলাম দুটো বই, দুটোই সি এম তারেক রেজার, "একুশে ভাষা আন্দোলনের সচিত্র ইতিহাস" এবং "বিজয়ের সেই ক্ষন"। বাই ল্যাঙ্গুয়াল এই বই গুলোতে রয়েছে দু:স্প্রাপ্য সব ছবির ভান্ডার, সংগ্রহে রাখার মত বই।

মাঝে সেবা প্রকাশনি থেকে তিন গোয়েন্দার ভলিউম আর অন্যপ্রকাশ থেকে হুমায়ুন আহমেদের 'হিমু এবং হাভার্ড পি এইচ ডি বল্টু ভাই " কিনলাম। এরপর বাড়ি ফেরার পালা, মেলার লোটাকম্বল গুটানো শুরু হয়ে গেছে। দু'হাতে অনেক বই নিয়ে মেলায় হাটার আনন্দ অনুভব করতে অপেক্ষা করতে হবে আরও একটি বছর। ততদিন ভাল থাকুক বইপাড়া ..... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।