আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আল-কুরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদক : মাওলানা আমীর উদ্দিন বসুনিয়া, গিরিশচন্দ্র সেন নয়।

I'll make you an offer you can't refuse বর্তমানে আল-কুরআনের অজস্র তাফসির ও বঙ্গানুবাদ বের হয়েছে। কিন্তু আজ থেকে দুই শত বছর আগে সে ধারণা ছিল কল্পনাতীত। তখন আল-কুরআনের তাফসির ও তরজমা ছিল মূলত উর্দু ও ফার্সিতে। বাংলাতে তখন পুঁথির প্রতাপ। গল্প, কবিতা, ঘটনা ও ইসলামী বিষয়ও পুঁথির ভাষায় লিখিত ছিল।

নবী কাহিনী, রাসূল বিজয়সহ অজস্র ধর্মীয় বিষয় পুঁথির ভাষাতেই বিবৃত ছিল। খায়রুল হাশর, পান্দেনামা, মেজবাহুল ইসলামসহ শত-সহস্র পুঁথি-পুস্তক বাংলা ভাষাতে বাংলা সাহিত্যের পসরা নিয়ে বাংলার ঘরে ঘরে জ্ঞান ও আনন্দ বিলিয়েছে। ধর্মীয় গ্রন্থ তরজমা-তাফসির ছিল উর্দু ও ফার্সির মাধ্যমে। তৎকালীন ভারত বিখ্যাত মুজাদ্দিদ ইসলামী চিন্তাবিদ ও সমাজ সংস্কারক শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (১৭০৩-১৭৬৬) ও তৎবংশের সন্তানরা ভারতবর্ষে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপায়ণের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তৎপ্রপৌত্র শাহ ইসমাইল শহীদসহ (১৭৭৮-১৮৩১) তার সঙ্গীত সহচররা ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রদীপ প্রজ্বলিত করেছিলেন।

তারা একাধারে অসি ও মসির সাহায্যে তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করে গেছেন। আমাদের মাওলানা আমীরউদ্দিন বসুনিয়া সেকালের নিকটবর্তী লোক ছিলেন বলেই অনুমিত হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাওলানা আমীরউদ্দিন বসুনিয়া ১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ বাংলা ১২১৫ অব্দে তিনি প্রথম আমপারার তরজমা প্রকাশ করেন। যার আকার ছিল ডিমাই ১২ পেইজ ১৬৮ পৃষ্ঠা। অথচ আমাদের দেশে এই তথ্য আবিষ্কারের অভাবে গিরিশচন্দ্র সেনকে (১৮৩৫-১৯১০) কুরআনের প্রথম অনুবাদক বলা হয়।

কিন্তু গিরিশচন্দ্র সেনের আগে রাজেন্দ্রনাথ মিত্র কুরআনের অনুবাদ করেন ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মার্চ। গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে এবং সমাপ্ত হয় ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। রাজেন্দ্রনাথ মিত্রের অনুবাদ পূর্ণাঙ্গ ছিল না। তার অনুবাদ ছিল কয়েক খণ্ড। ১৮৮৩ সালে টাঙ্গাইলের করটিয়া থেকে মৌলভি নঈমুদ্দিন (১৮৩২-১৯০৮) আকবারে ইসলামিয়া নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন, আর এই পত্রিকার মাধ্যমে সমাজের কুসংস্কার দূর ও আল-কুরআনের অনুবাদ প্রকাশ করতে থাকেন।

তার অনূদিত কুরআন শরীফের ১০ পারা পর্যন্ত অনুবাদ সমাপ্ত করে তিনি ইন্তেকাল করেন ১৯০৮ সালের ২৩ নভেম্বর। আকবারে ইসলামিয়া ১৮৮৩ সাল থেকে ১৮৯৩ পর্যন্ত চলছিল। বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সম্পাদক শেখ আবদুর রহীম (১৮৫৯-১৮৩১) তৎকালে টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত আকবারে ইসলামিয়া ও মৌলভি নঈমুদ্দিনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কবি আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) তার সুশীল সাহিত্য ও সংস্কৃতি গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সর্বপ্রথম মৌলভি নঈমুদ্দিন কুরআন মজীদের বঙ্গানুবাদ করেন। তিনি ১০ পারা পর্যন্ত অনুবাদ করেন এবং মুদ্রণ শেষ হওয়ার আগেই ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ নভেম্বর লোকান্তরিত হন।

কবি আবদুল কাদির তার গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে লেখেন ‘সমগ্র কুরআনের বঙ্গানুবাদ করেন মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম মাওলানা মোহাম্মদ আব্বাস আলী (১৮৫৯-১৯৩২) কলকাতা ৩৩ নম্বর বেনেপুকুর রোড, আলতাফি প্রেসে মুন্সি করিম বকসের দ্বারা মুদ্রিত ১৩১৬ বাংলা সন। আমপারা পর্যন্ত ৩০ পারার অনুবাদ। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৯৭৬। মূল আরবি পাঠের নিচে উর্দু তরজমা এবং তার নিচে বাংলা অনুবাদ। বর্ডারের দুই পাশে উর্দু তাফসির ও বাংলা টীকা দেয়া হয়েছে।

অত:পর ওই তাফসিরের শেষে অনুবাদক যা বলেছেন তার উদ্ধৃতি ‘ইসলামের মূল ধর্মগ্রন্থ অমৃতময় কুরআন… আলেমরা ফার্সি, উর্দু ইত্যাদি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। কিন্তু বাংলার মুসলমানদের বোধগম্য সরল বাংলা ভাষায় কোনো অনুবাদ অদ্যাবধি পরিদৃষ্ট হয়নি। তাদের শ্রুতিমধুর কুরআনের বাক্য সুধাপানে বঞ্চিত ছিল। তাদের সেই অভাব বিমোচনের জন্য এই অনুবাদ প্রকাশিত হলো। অত:পর পঞ্চম অধ্যায়ে এনেছেন খান বাহাদুর মৌলভি তসলীমউদ্দিন আহমদের (১৮৫২-১৯২৭) অনূদিত তাফসিরের কথা।

তার অনূদিত কুরআনের প্রথম খণ্ড (প্রথম ১০ পারা) প্রকাশিত হয় ১৩২৯ বঙ্গাব্দে তথা ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে এবং দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৩৩০ বঙ্গাব্দে বা ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে (দ্বিতীয় ১০ পারা) এবং তৃতীয় খণ্ড বা শেষ খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে। প্রথম খণ্ড ছিল ৪৫৮ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় খণ্ড ৪৫৮ পৃষ্ঠা এবং তৃতীয় খণ্ড ৫২১ পৃষ্ঠা। এই অনুবাদে মূল আরবি দেয়া ছিল না, কিন্তু আয়াত ও রুকু নম্বর দেয়া ছিল। ষষ্ঠ অধ্যায়ে তিনি তাদের সবার নামোল্লেখ করেছেন যারা আল-কুরআনের পরবর্তী অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন। মৌলভি আবদুল হাকিম ও আলী হাছান ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ণাঙ্গ কুরআনের অনুবাদ করেন।

মৌলভি নকীবুদ্দিন খাঁর (১৮৯০-১৯৭৮) অনুবাদ ৩০ পারা ৩০ খণ্ডে ছিল। মাওলানা মো: রুহুল আমীন, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মৌলভি এয়ার আহমদ, মৌলভি মো: তৈমুর, ফজলুর রহিম চৌধুরী, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর কুদরত-এ-খুদা, অধ্যাপক আবুল ফজল প্রমুখ কুরআনের অংশ বিশেষের অনুবাদ করেন। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে কবি নজরুল কাব্যে আমপারা প্রণয়ন করেন। কুরআনের বহুবিধ অনুবাদ ও তাফসির সম্বন্ধে বিশেষ আলোচনা-পর্যালোচনা ও গবেষণা সাহিত্য যিনি প্রকাশ করেন তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক ডিন ড. মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান। তার অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা’ এই গ্রন্থে তার গবেষণালব্ধ তথ্যে তিনি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছেন ‘বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের পথিকৃৎ বসুনিয়া’ বাক্যটি থেকেই অনুমিত হয় যে তিনিও তার প্রাপ্ত তথ্যে মাওলানা আমীরউদ্দিন বসুনিয়ার প্রথম বঙ্গানুবাদের তথ্য পেয়েছেন।

আল-কুরআনের অনুবাদকদের সন্ধানে কবি আবদুল কাদির, (১৯০৬-১৯৮৪) অধ্যাপক আবুল কাশিম মুহাম্মদ আদম উদ্দিন (১৯০০-১৯৭২) ও ড. মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান যে তথ্য উদঘাটন করেছেন তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গবেষণার পথনির্দেশক হবে। আদম উদ্দিনের পুঁথি সাহিত্যের ইতিহাস ও সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ এবং মুজিবুর রহমানের মুসলমানদের সাহিত্য সাধনা ও আল-কুরআনের চিরন্তন মোজেজা, উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। কুরআন গবেষণা, তরজমা ও তাফসিরে আরো যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তন্মধ্যে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী মাওলানা আবদুর রহীম (১৯১৫-১৯৮৭) আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ তাফসির তাফহিমুল কুরআনের বঙ্গানুবাদক। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান মুফতি মো: শফির ‘মারেফুল কুরআন’-এর অনুবাদক এবং মধ্যযুগ থেকে বর্তমান কাল অবধি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী কালজয়ী তাফসির তাফসিরে ইবনে কাসির বঙ্গানুবাদ করেছেন ড. মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান। এই তাফসির বর্তমানে বাংলা ভাষায় বিশেষ করে বাংলাদেশে ব্যাপক পঠন-পাঠন ও সংরক্ষণে সমাদৃত।

এ ছাড়া মাওলানা আলা উদ্দিন আল আজহারি (১৯৩২-১৯৭৮) ‘তাফসিরে আজহারি’ নামে একটি তাফসির লিখে গেছেন। নিবন্ধের আল-কুরআন অনুবাদের পথিকৎ মাওলানা আমীরউদ্দীন বসুনিয়া মটুকপুরী যে যুগে অনুবাদ করেন এবং তখন অত্যন্ত বিপজ্জনক যুগ ছিল, কারণ সে যুগের মানুষের ধারণা ছিল কুরআন-হাদিস থাকবে উর্দু ও ফার্সিতে। কবি আবদুল কাদির তার সম্বìেধ যা লিখেছেন তা নিুরূপ : “রংপুর জেলার মটুকপুরের আমীরউদ্দিন বসুনিয়া বাংলা ভাষায় আমপারা শরীফের প্রথম অনুবাদ করেন। তাঁহার বইখানি সম্বন্ধে ১৩১৫ সালে রংপুর সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার তৃতীয় ভাগ ১২০ পৃষ্ঠায় বলা হয়, এই বইখানি সেকালের কোনো লিথো প্রেসে মুদ্রিত। আকার ডিমাই ১২ পেজি- ১৬৮ পৃষ্ঠা।

ইহা এখন দুষ্প্রাপ্য। ‘বাসনা’ সম্পাদক কাকিনা নিবাসী ফজলল করিম (১৮৮০-১৯৩৮) সাহেব একখণ্ড অনেক চেষ্টায় সংগ্রহ করিয়াছেন। অনেকের ধারণা যে গিরিশচন্দ্র সেনের অনেক আগে আমীর উদ্দীন বসুনিয়ার অনুবাদ প্রকাশিত হয়ে ছিল। উহা সংগ্রহ করা অত্যাবশ্যক; তাহা হইলে উহার প্রকাশকাল সঠিকভাবে নির্ধারণ সম্ভব হইবে। ” এই ছিল কবি আবদুল কাদিরের মন্তব্য।

অতি সম্প্রতি আল-কুরআন একাডেমি পরিচালক হাফেজ মুনির উদ্দিন আমীরউদ্দিন বসুনিয়ার ‘আমপারা’ অনুবাদের প্রকাশকাল উদ্ধার করেছেন, আর তা হলো ১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দ। বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের এই তারিখই সর্বপ্রাচীন। আরো অনুসìধানে আমীরউদ্দিন বসুনিয়ার জীবনী ও তার লিখিত আর কোনো গ্রন্থ ছিল কি না তা জানা যাবে। (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।