আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেই দিনের ডানপিটে ছেলেটির হঠাৎ খুড়িয়ে চলা!

আমি চাই শক্তিশালী স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পিতার কাছে পুত্রের অনেক বায়না যে জিন্নার ঢাকায় সমাবেশ দেখতে যাবে। কিন্তু পিতা ছিলেন অত্যন্ত শক্ত মনের মানুষ। একবার যা সিদ্ধান্ত নিতেন তার আর বদল হত না। ছেলে যখন হতাশ মুখ ও মন তখন তার মায়ের আর যেন সহে না। হাজার হৌক মাতো, তাই ভাসুরের পুত্র তথা ছেলের বড় চাচাতো ভাইয়ের কাছে বলল "ভাতিজা ওকে নিয়ে যাও"।

কিন্তু ছেলেটি যে শখে ও আনন্দে জিন্নার সমাবেশে গিয়েছিল তার পরিবর্তে হতাশা ও ক্ষোভ নিয়ে বাসায় ফিরে এল। কারণ জিন্নাহ বলল Urdu must be the state language of Pakistan! ছেলেটি ঐ সময় ১৯৪৮ সালে পুরোনো ঢাকার নয়াবাজারের একটি স্কুলের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিল। পরের দিন স্কুল ও মহল্লার ছাত্র ও লোকজনের মাধ্যমে জানল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ছাত্র নেতারা এই নিয়ে তাদের আন্দোলন পরিষদ বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না হওয়া ডর্যন্ত তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। তা নিয়ে ঢাকা শহড়ের বিভিন্ন ও স্কুল কলেজের ছাত্রদের যেয়ে তাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ সহ সমর্থন, সহযোগীতা করতে হবে। এভাবেই ঢাবি ও এর আশে পাশের এলাকা সহ পুরোনো ঢাকার অনেক জায়গায় নিয়মিত মিছিল ও মিটিং হত।

ছেলেটি প্রায় প্রতিদিনই যেত। রাগী পিতা এই সবের কিছুই না জানলেও ছেলেটির মা ও ভাই-বোনেরা ঠিকই জানত। এভাবে করেই চলে এল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছাত্র সহ বহু জনতা খুবই উত্তেজিত যে সেই দিনের কর্মসূচীর জন্য খাজা নাজিমউদ্দিনের সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে। তাই বেশী সংখ্যক না গিয়ে ৩জন করে সমাবেত হলে মিছিল করে এগিয়ে যাবে। ছেলেটি তখন ৮ম শ্রেণীর ছাত্র এবং আরো বেশী ডানপিটে।

তবে মিছিলের বেশ পিছেই ছিল। কিন্তু আর সবার মতই প্রবল উত্তেজিত ও শ্লোগান "রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই"। তারপর আমরা জানি যে মেডিকেল কলেজের সামনে কি হল। গুলিতে সালাম, রফিক, জাব্বার উনারা শহীদ হন আর টিয়ার গ্যাস ও লাঠি চার্জে ছাত্র ও জনতার মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। যে যেভাবে পেরেছে আত্নরক্ষার্থে বিভিন্ন দিকে ছুটে পালিয়েছে।

এই ঘটনায় ছেলেটি একটি দেয়াল টপকাতে গিয়ে পড়ে হাটুতে ব্যাথা পায়। তারপরেও তারুণ্যর শক্তিতে দ্রুত খুড়িয়েও বাসায় পৌছল। ভাগ্যিস পিতা বাসায় ছিলেন না। তাই মা ও পরিবারের সবাই বলল যে তুমি জলদি খেয়ে দেয়ে বিছানায় শুয়ে পর। পিতা বাসায় এসে বললেন আজকে ঢাকার ঘটনা কিন্তু তারই ছেলে যে সেই মিছিলে ছিল তা ঐ দিন বুঝতেই পারলেন না।

যে কারণেই হৌক ছেলেকে সেই দিন ও রাতে হাটতে দেখেননি। ২/১ দিন পরে যখন দেখলেন ও প্রশ্ন করলেন তখন জবাবে ছেলেটি বলল "বাবা ২২ তারিখে ঘুড্ডি ধরতে যায়া টিনের চালের উপর লাফ দিছিলাম"। পিতা তখন রাগ হয়ে বললেন "হ ঘুড্ডি উড়ায়াই জীবন পার কইর পড়া-লেখা ও স্কুলের চিন্তা কি তোমার আছে?"। পিতাতো আর জানে না যে পুত্র স্রেফ ঘুড়ি নয় স্কুল, আড্ডা ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চষে বেড়ানো তার জন্মগত অভ্যাস, ঘরে পড়ে থাকার পাত্র সে নয়। তো যাই হৌক বন্ধু সহ মহল্লার অনেকের কাছেই সেই দিনের ঘটনা বলেছিল এবং তারাও খুশী হয়েছিল।

এই ভাবে ২-৩ সপ্তাহ পরে যখন ছেলেটি আবার ঠিকমত হাটতে লাগল তখন পিতা বাসায় এসে হুংকার ছুড়লেন নিজ স্ত্রীকে বললেন তোমার পুত্র কোথায় তখনই ছেলেটি সামনে আসা মাত্র তিনি হাতের ছাতা দিয়ে একটা ধাওয়া দিলেন "হারামজাদা তুই একুশে ফেব্রুয়ারীর মিছিলে গিয়েছিলি!"। ছেলেটিকে অবশ্য তিনি প্রহার করতে পারেননি। কারণ তার মা! এত রাগচটা হলেও স্ত্রী ছিল প্রাণপ্রিয়। তাই মায়ের জন্যই এই ঘটনায় সে রেহাই পায়। এই ঘটনাটির সেই ছেলেটি হচ্ছেন আমার পিতা।

দাদা খুব ভয়ংকর ব্যাক্তি ছিলেন অন্তত আমার পিতা ও চাচা-ফুফুদের জন্য কিন্তু নাতি-নাতনীদের জন্য নয়। আমার দাদীও ছিলেন অনেক ভাল মানুষ। বস্তুত ঐ সময়ের মায়েরা তাদের পুত্র স্নেহতো বটেই ও সঠিক ভাবে তথা আদর্শ শিক্ষার কারণেই ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১এ আমাদের ন্যায্য অধিকারের আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ যথাযথ ভাবে হয়েছিল। স্বাধীনতার পূর্বে ছাত্ররা বলতে সোনার মানুষ ছিলেন। কোন লোভ, লালসা, অবৈধ পথে উপার্জন তথা অসততা ছিলনা।

দেশের জনগণ তাদেরকে শ্রদ্ধা করত। অনেক জায়গায় মানুষের সমস্যা ও বিবাদ মিটানোতে ছাত্রদের পরামর্শ নিয়ে এগুলোর সমাধান হতো। আজকের সময়ে যে ভাবে অবস্থা যখন বিপরীত তাই সেই দিন গুলোর ছাত্র ও ছাত্র নেতৃবৃন্দকে স্যালুট!  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।