আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওরা কাল এসেছিল চুপিচুপি!! (৫ জন ভাষা শহীদের আর্তনাদ)

ঘড়িতে তখন রাত ৪.৪৫ মিনিট। সবেমাত্র লাইট অফ করে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। একবার এপাশ ওপাশ করছি ঘুম আসছিল না। হঠাৎ রুমের মধ্য একটু ঠাণ্ডা বাতাস অনুভব করলাম। আমি বারান্দা দরজা ও আমার বিছানার পাশের জানালা সবসময় খোলা রেখে ঘুমাই।

ভাবলাম হয়তো সেদিক দিয়েই একটু গাছের পাতা নড়ে উঠেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আমার ভুল ভাঙলো। এতো কোন সামান্য বাতাস নয়, যেন এক কালবৈশাখীর দমকা বাতাস। অল্পকিচ্ছুক্ষন দমকা বাতাস বয়ে আবার শুনশান নীরবতা নেমে এলো। এমন সময় আমার রুমের মাঝে মানুষের পায়ের আওয়াজ এর শব্দের মতো কিছু শুনতে পেলাম।

এবার সত্যিই কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। আমার পুরো শরীর ঘেমে গেলো। আমি তখন রুমের লাইট জালানোর জন্য উঠলাম, ঠিক তখনই একটি কণ্ঠ ভেসে এলো '' কবি ভয় পেয়োনা ! আমরা তোমার ভাই। পেছনে চেয়ে দেখো''! কণ্ঠটা আমার খুব অপরিচিত মনে হলো ,কিন্তু কণ্ঠটা ছিল অনেক মধুর। আমি পেছনে তাকিয়ে দেখে তো পুরো তাজ্জব!!!!!! দেখি পাঁচ পাঁচজন রক্তাক্ত ব্যক্তি।

নিজেকে সাহস দিয়ে ওদের প্রশ্ন করলাম ''কে তোমরা? এখানে কি চাও''? সাথে সাথে বামদিকে দাঁড়ানো একজন বললো '' আমি রফিক''! এরপর ২য় জন বললো ''আমি সালাম''। এরপর ৩য় জন বললো ''আমি জব্বার''। ৪র্থ জন বললো '' আমি বরকত ''! এবং ৫ম জন বললো ''আমি শফিউর''। এভাবে ওরা ৫ জন যখন আমাকে ওদের পরিচয় দিচ্ছিল তখন আমার পুরো শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। কিন্তু শরীরের ভেতরে রক্ত টগবগ করে জ্বলে উঠাটা অনুভব করছিলাম।

এমন সময় শহীদ রফিক আমাকে বললো- ''কবি, এবার হয়তো বুঝতে পেরেছো আমরা কারা? '' আমি সাথে সাথে তাঁর প্রশ্নের জবাবে বললাম,- ''হ্যাঁ ,হ্যাঁ চিনতে পেরেছি। তোমরা আমাদের সেই বীর ভাষা শহীদ ভাইয়েরা। তোমাদের জন্যই আজ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি। '' আমার কথা শেষ না হতেই শহীদ জব্বার আমাকে বললো - ''আমরা তোমার কাছে আমাদের কিছু কথা বলার জন্য এসেছি। যে কথাগুলো আমরা গত ৬০বছর ধরে বলে যাচ্ছি কিন্তু কেউ সেই কথাগুলো শুনতে পায়না।

তাই আজ তোমাকে সেই কথাগুলো বলতে এসেছি। তুমি সবাইকে তা জানিয়ে দিও''। শহীদ জব্বার এর কথা শুনে আমি ফের প্রশ্ন করলাম - '' এতো বড় বড় মানুষ থাকতে, বুদ্ধিজীবীরা থাকতে আমাকে কেন তোমরা বলতে এসেছো?" আমার কথা শুনে শহীদ বরকত একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো- '' কবি তোমরা যাদের বড় মনে করো ওরা আসলে বড় নয়। ওরা ভণ্ড। তোমরা ওদের বুদ্ধিজীবী মনে করো, কিন্তু আসলে ওরা তা নয়।

ওরা হচ্ছে কিছু মুখোশধারী দেশপ্রেমিক। যারা তাঁদের সর্বস্ব বিক্রি করে নিজের স্বার্থের জন্য। তোমাদের জন্য নয়, এই দেশের জন্য নয়। আমরা তোমার কাছে এসেছি কারন জন্মের পর থেকে আজো তুমি বিদেশের কোন কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হওনি। সবসময় অন্তর থেকে ওদের ঘৃণা করেছো।

যতটুকু সম্মান দেয়ার দরকার এর বেশী ওদের তুমি কোনদিন দাও নি। আমাদের মত তোমার ভেতরটাও অনবরত কাঁদে এই দেশের এতো অধপতন দেখে। তোমার কর্মকাণ্ডের জন্য তোমার আপনজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই তোমাকে নিয়ে পেছনে হাসে তবুও তুমি থেমে যাওনি, তবুও তুমি অনবরত একা একা কিছু করার চেষ্টা করেছো। আমরা এই ৫ জন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি সেই ৫২ তে যদি তুমি আমাদের মত থাকতে সেদিন হয়তো আমাদের ভাগ্যটাও তোমার বরন করতে হতো। আমরা বহুদিন ধরে তোমাকে দেখে আসছি।

আমরা এদেশের ১৬ কোটি মানুষের সবার অন্তরের খবর জানি। সবাইকে চিনি, তাইতো সেই ১৬ কোটি মানুষের মাঝে তোমাকেই আমরা বেছে নিয়েছি''। বরকত এর কথা শুনে আমার চোখ দিয়ে কখন যে অঝোরে জল ঝড়তে শুরু করলো তা টেরই পেলাম না। এমন সময় শহীদ সফিউর বললো - '' শোনো কবি- কথা আর না বাড়িয়ে এবার আসল কথা বলে ফেলি। সময় খুব অল্প।

একটু পরেই ভোরের আলো ফুটে উঠবে। ভোরের আলো উঠার আগেই আমাদের চলে যেতে হবে। সালাম তোমাকে এখন যে কথাগুলো বলবে তা মন দিয়ে শুনে রেখো। এই কথাগুলো সবাইকে জানানোর দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে গেলাম। আশাকরি তুমি তা পারবে।

কোন ভয় পেয়ো না। আমরা সবসময় তোমার সাথে আছি। কেউ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না''। এই কথা বলেই সফিউর সালাম এর দিকে ইশারা করলো। সালাম তখন আমাকে বলতে লাগলো - শোন কবি, যে কথাগুলো গত ৬ টি দশক ধরে আমরা ভাষা শহীদরা তোমাদের বোঝাতে পারেনি সেই কথাগুলো শোন- ''আমাদের সাথে তোমরা অনবরত ''শ্রদ্ধা'' ''শ্রদ্ধা '' নামক এক খেলা খেলে যাচ্ছো ! অথচ তোমাদের কাছে গত ৬০বছর ধরে এই খেলা বন্ধ করার জন্য আর্তনাদ করে যাচ্ছে।

কিন্তু সেই আর্তনাদ তোমরা কেউ শুনতে পাওনা । যে ভাষার জন্য আমরা আমাদের বুকের রক্ত দিতে কার্পণ্য করেনি সেই ভাষার দেশে আজ চলে বিদেশী সংস্কৃতিকে লালন করার প্রতিযোগিতা! সেই দেশের প্রচার মাধ্যম এফ এম রেডিওতে চলে বাংলিশ , হিন্দিংলা (হিন্দি +বাংলা) ভাষার কথপোকথন! সেই দেশের বড় কোন উদযাপনে চলে ভারতীয় নর্তকীদের নৃত্য! সেই দেশের নাগরিকদের প্রতিবেশী পেয়ারা দোস্তরা গুলি করে নির্বিচারে মেরে তারকাটায় ঝুলিয়ে রাখে আর সেই দোস্তরে আমাদের সরকার ২০০ ভরি স্বর্ণের উপহার দেয়!!!! অথচ সেই সালাম,রফিক ,বরকত ,জব্বার এর পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করে! আমাদের মতো অসংখ্য শহীদের পরিবারের কোন খোঁজ এই রাষ্ট্রের কেউ রাখেনা। আমাদের পরিবারকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেখানোর মত উদার আজো কোন সরকার হতে পারিনি!!! আমরা সেদিন আমাদের পিতা -মাতা সহ আপনজনদের কথা না ভেবে শুধু এই দেশের জন্য, তোমাদের জন্য নিজেদের জীবন দিয়ে গিয়েছিলাম আর সেই তোমরাই আমাদের বৃদ্ধ মা বাবার কোন খোঁজ তোমরা রাখোনি ! আমাদের আপনজনেরা অবহেলা অযত্নে মানবেতর জীবন যাপন করে! যে সরকার সালাম রফিক জব্বার এর দেশের নাগরিক দের হত্যার বিচার চাইতে পারে না সেই সরকারই ২১ শের ১ম প্রহরে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে যায়! এমন নির্লজ্জ ভণ্ডামি দেখে আমাদের আত্নারা আর্তনাদ করে আর বলে ''আমরা তোমাদের কাছে এই ভণ্ডামি শ্রদ্ধা চাই না। তোমরা চলে যাও! চলে যাও! জীবিত অবস্থায় আমরা কারফিউ ,বন্দুকের নলের সামনেও হার মানি নাই! কিন্তু গত ৬০ বছর তোমাদের এই ভণ্ডামির কাছে আমরা বারবার পরাজিত হচ্ছি! তোমাদের কাছ থেকে বছরে একদিন ফুলের শুভেচ্ছা আমরা চাই না,চাইনা ,চাই না! যতদিন না পর্যন্ত যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা আমাদের জীবন দিয়েছিলাম সেই স্বপ্ন পূরণ না হয় ততদিন আমাদের আত্নারা কোনদিন তোমাদের ক্ষমা করবেনা ! করবে না এবং করবে না! ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই সেই ভাইদের মুখগুলি আমার চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেলো আর আমি নিথর নিস্তব্দ হয়ে একা ঘরে পড়ে রইলাম । নিজেকেই যেন নিজে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এই আমি কি দেখলাম!!!!! কবি ও কাব্য- ২১.০২.১২  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।