আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আয় কম, ব্যয় বেশি পরীক্ষা অর্থমন্ত্রী

ভালবাসি রসরকারের খরচ কমানোর উদ্যোগ, ছোট হচ্ছে এডিপি : নতুন জনবল নিয়োগ ও বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরে চলো নীতি সরকারের আয় কম। ব্যয় বেশি। এ অবস্থায় কঠিন পরীক্ষায় পড়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ জন্য তিনি অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাসের উদ্যোগ নিয়েছেন। এর অংশ হিসেবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ছোট করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

নতুন জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে ধীরে চল নীতি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। সূত্র জানায়, ডলাদের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার বিভিন্ন খাতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ ধারণার থেকেও বেশি বেড়ে গেছে। ফলে ভর্তুকির খাতে সরকারের যে বরাদ্দ ছিল তা বাড়াতে হচ্ছে। বিশেষ করে সার, জ্বালানি তেল এবং বিদ্যুৎ খাতে। অপর দিকে অর্থের অভাবে বড় বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে ধীরে চল নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে সরকারি ব্যয়ে হ্রাসের কৌশল নির্ধারণে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অর্থমন্ত্রী সরকারি ও বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণ পরিস্থিতি, ভর্তুকি, মূল্যস্ফীতি, নিত্যপণ্যের বাজার, কৃষি, রাজস্ব আহরণ এবং সরকারি ব্যয় ইত্যাদি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন এবং সরকারের সামগ্রিক ব্যয় সংকোচন ও আয় বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন। এর আগে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সরকারকে একাধিকবার ব্যয় সংকোচনের পরামর্শ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই ধরনের পরামর্শ দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। দেশের অর্থনীতিবিদরাও বিভিন্ন সময় সরকারকে ব্যয় সংকোচনের পরামর্শ দেন।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, অর্থ সঙ্কটের কারণে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই এডিপি বাস্তবায়ন নিয়ে টানাপড়েন চলে। চলতি অর্থবছরে ৪৬ হাজার কোটি টাকার এডিপি প্রণয়ন করা হয়। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পদের পরিমাণ ২৫ হাজার ১৮০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক সম্পদের পরিমাণ ২০ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (্এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ। জানা গেছে, ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে বৈদেশিক ঋণ সহায়তা কমে যাওয়ার কারণেই সরকার বেশি বিপদে পড়েছে।

পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে বিরোধ সৃষ্টি হওয়ায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। এছাড়া অর্থবছরের ৬ মাসের মাথায় নিট বৈদেশিক সাহায্য ছাড় হয়েছে মাত্র ৪৬ লাখ ডলার। যা বিগত ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। সূত্র জানায়, সরকারের আয় কমে যাওয়ায় ও দাতাদের অর্থ ছাড়া করতে দেরি হওয়ায় সরকার নিয়মিত ও উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভেঙে আমদানি ব্যয় মেটানো হচ্ছে।

এতে কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। অন্যদিকে ভর্তুকি নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার। বিদ্যুৎ কেনা ও সার আমদানিতে এরই মধ্যে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। অর্থবছরের আগামী ছয় মাসে এই খাতে লাগবে আরো ৬ হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে, চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে মূল বাজেটে সারে ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

গত ২০১০-১১ অর্থবছরে মূল বাজেটে সারের জন্য ভর্তুকি ছিল ৪ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা করা হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে বলা হয়েছে, এ অর্থবছরের ৬ মাসে ২ হাজার ৮২২ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। হাতে আছে মাত্র ১ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। তাই বাকি ৬ মাসে ভর্তুকির পরিমাণ আরো বাড়বে।

সে হিসেবে এবার ভর্তুকির পরিমাণ গত অর্থবছরের প্রায় দ্বিগুণ হবে। এ বছর সার ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ভর্তুকির পরিমাণ গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন। সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হওয়া যায় কি না তা জানতে চেয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে। অর্থমন্ত্রণালয়ের বক্তব্য, সারের ব্যবহার ২৪ থেকে ২৫ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক কমে যাবে। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় সার নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না।

কারণ মৌসুমে যদি কোনো কারণে সার সঙ্কট দেখা দেয় তাহলে সরকার বেকায়দায় পড়তে পারে। তাই ভর্তুকি বাড়লেও কৃষি মন্ত্রণালয় ৩০ লাখ টন সারের মজুদ রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছে। অন্যদিকে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুতেও ভর্তুকির পরিমাণও বাড়ছে। ভাড়ায় আনা কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার সাথে সাথে বেড়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) খরচ। পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, বাজেটে বিদ্যুতে যে ভর্তুকি রাখা হয়েছিল তা ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে।

গত ৬ মাসে বিদ্যুতের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। এ বছর আরো লাগবে ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ বছর বিদ্যুতের জন্য মোট ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা ভর্তুকি লাগবে বলে পিডিবি থেকে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও আগামী ছয় মাসে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে, তা যদি আসে তাহলে আরো ৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রয়োজন হবে। ইতোমধ্যে ৩ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে।

নতুন কেন্দ্রের ভর্তুকি যোগ হলে দরকার হবে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, গত এক বছরে বিদ্যুতের দাম ৩ বার ও জ্বালানি তেলের দাম ৪ বার বাড়ানো হয়েছে। বেশি দাম বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে বছরের শেষ দিকে এসে। এখন সরকার বলছে বিদ্যুতের দাম আরো বৃদ্ধি করা হবে। এতে জনগণের ওপর আরো চাপ বাড়বে।

মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। বর্তমান মূল্যস্ফীতি প্রায় ১২ শতাংশ। এদিকে সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। প্রথম ৫ মাসে এনবিআর সরকারকে আশার আলো দেখাতে পারেনি। প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।

যদিও প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ০৯ শতাংশ। আর মোট আদায় হয়েছে ৩৮ হাজার ৯৮৭ কোটি ৮ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯১ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, সরকারের আরো উদ্বেগের কারণ এরই মধ্যে ইউরোপ আমেরিকায় দ্বিতীয় দফা মন্দা দেখা দেয়ায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করেছে। অর্থবছরের জুনে তৈরি পোশাক শিল্পে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪৩ শতাংশ।

অর্থবছরের প্রথম ৭ মাস কাটার পর এই প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশে। এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে তাতে অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় থাকছে না। এ অবস্থায় সরকারের ব্যয় কমানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তবে জিডিপি'র প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। এজন্য সরকারকে ঋণ নির্ভরতা কমিয়ে বেসরকারি খাতকে ঋণ নেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।

এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার ব্যয় হ্রাসের যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে এডিপির আকার ছোট করাই মূল উদ্দেশ্য। তবে জিডিপি'র প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত না করেও তা করা সম্ভব। এজন্য এডিপি'র গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ ছাড় অব্যাহত রেখে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অর্থ কমিয়ে দেয়া যেতে পারে। এতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ড. মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, বর্তমানে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে গেছে।

ব্যয়ের ভারসাম্য আনতে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অনেক ঋণ নিয়েছে। তারপরও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। এ অবস্থায় ব্যয় কমানো ছাড়া অর্থমন্ত্রীর সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই চিফ ইকোনমিষ্ট বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ আয় এবং বিদেশি সাহায্য কমে গেছে। জিডিপি'র প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে।

এজন্য ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেও আর ঋণ নেয়া ঠিক হবে না। তাই যে সব প্রকল্প একটু দেরিতে হলে সমস্যা হবে না, সেসব প্রকল্পের অর্থ কমিয়ে দেয়া যেতে পারে। এতে দোষের কিছু হবে না বলে তিনি বলেন।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।