শালিক পাখি সাইন্স ফিকশন লেখকদের কাছে যে বিষয়গুলো বেশ জনপ্রিয়, সেগুলোর মধ্যে আছে আন্তঃগ্যালাক্টিক যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষ-রোবট মারামারি, নতুন গ্রহের নতুন প্রাণী, কাল ভ্রমণ ইত্যাদি। কাল ভ্রমণ নিয়ে অনেক কথা-বার্তা হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। সেই ১৮৯৫ সালে এইচ জি ওয়েলসের লেখা টাইম মেশিন থেকে শুরু করে হালের টার্মিনেটর মুভি সিরিজ পর্যন্ত সাইন্স ফিকশন জগতেও এটা একটা হট টপিক! ছোটবেলায় যখন টাইম মেশিন উপন্যাসটা পড়ি, তখন থেকেই মাথায় প্রশ্ন ঘুরতে থাকে, কাল ভ্রমণ কি আসলেই সম্ভব? বয়সের পরিপক্কতার সাথে সাথে সেই চিন্তারও অনেক শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত হয়েছে। আমার আজকের লেখায় কাল ভ্রমণ সম্পর্কে আমার চিন্তা-ভাবনাই আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।
প্রথমেই দেখি, কাল বা সময় আসলে কী? আমাদের ত্রিমাত্রিক জগতের (সহজ করেই চিন্তা করি, স্ট্রিং থিওরির এগারো বা তার বেশি মাত্রার জগত নিয়ে আপাতত ভাবার দরকার নাই) তিন মাত্রার পরে আরো যে একটা মাত্রা ধরে নেয়া হয়, সেটাই হচ্ছে কাল বা সময়।
এই মাত্রা বাকি তিন মাত্রা হতে ইউনিক বা আলাদা। এর কারণ, আমরা অন্য তিন মাত্রার তিন অক্ষে ভ্রমণ করতে পারি, কিন্তু কাল অক্ষে (এখনো) ভ্রমণ করতে পারি না। এই চতুর্থ মাত্রা আসলে নিজ থেকেই চলে; এটাকে কেউ থামাতে পারে না বা এর গতি বাড়াতে বা কমাতেও পারে না। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, একটা ঢালু জায়গার উপর থেকে যেন আমাদের এই গোলকাকার জগতকে গড়িয়ে দেয়া হয়েছে, আর তা সমবেগে গড়িয়ে গড়িয়ে সময় অক্ষ বরাবর নিচে পড়ে যাচ্ছে। ত্রিমাত্রিক জগতের সময় অক্ষ বরাবর এই গড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে আমাদের, তথা এই ত্রিমাত্রিক কাঠামোর মানুষদের (শুধু মানুষ না, অন্য যেকোনো এলিমেন্টের) যেন কিছুই করার নাই!
কাল বা সময় পরিভ্রমণ কি সম্ভব? কেউ কি চাইলে আমাদের জগতের এই সময়ের স্রোতে গড়িয়ে চলাকে থামাতে পারেন? কিংবা এই গড়িয়ে পড়ার গতিকে স্লো বা ফাস্ট করতে পারেন? টাইম মেশিনে আমরা যেমন দেখি, কাল পর্যটক একটা টাইম মেশিনে করে ভবিষ্যতে পাড়ি জমিয়েছিলেন।
এরকম কাল ভ্রমণ বাস্তবে কতখানি সম্ভব? ধরেন, আপনার ল্যাবে বসে সারা রাত জেগে অনেক খেটে খুটে আপনি একটা টাইম মেশিন তৈরি করলেন। সকাল বেলা নাস্তা করে আপনি ঠিক ১০ টায় ল্যাবের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন, টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে পাড়ি দেয়ার জন্য টাইম মেশিনে উঠে বসে সব রেডি করতে করতে লেগে গেলো আধ ঘণ্টা। ঠিক ১০:৩০ টায় আপনি টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে পাড়ি দেয়া শুরু করলেন। পাড়ি দিতে দিতে যখন ঠিক আধ ঘণ্টা পেছনে গেলেন (অর্থাৎ ১০ টায়), তখন আপনার কোথায় থাকার কথা? ল্যাবের দরজা থেকে একটু ভেতরে। কিন্তু এখন আপনি বসে আছেন টাইম মেশিনের ভেতর! কাজেই, কাল ভ্রমণের সাথে সাথে আপনি কিন্তু নতুন অতীত বানিয়ে ফেললেন।
কথা হচ্ছে, তাহলে একটু আগে আসলেই যে অতীতটা ঘটে গেলো (যেখানে আপনি ছিলেন ল্যাবের দরজা থেকে একটু ভেতরে), সেটা কোথায় গেলো? সেটা বাস্তব, কারণ সেটা অলরেডি ঘটে গেছে। আবার এখন, ভ্রমণ করা অতীতে আপনি আছেন টাইম মেশিনের ভেতরে। সেটাও বাস্তব, কারণ সেটা এখন ঘটছে। কাজেই, এখানে একই সময়ে, একই পারিপার্শ্বিক অবস্থায় ও একই ব্যাক্তির সাথে ঘটে যাওয়া দুটো বাস্তব ঘটনা পাওয়া যাচ্ছে, যেটা আসলে সম্ভব না। একমাত্র একটা ক্ষেত্রেই সেটা সম্ভব, যদি প্যারালাল ইউনিভার্স বা সমান্তরাল জগতের অস্তিত্ব থেকে থাকে।
সেক্ষেত্রে আসলে সময় পরিভ্রমণের সাথে সাথে আমাদের কাল পর্যটক এক ইউনিভার্স বা জগত থেকে আরেক জগতে যাবেন। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, পাশাপাশি অসংখ্য জগত থাকতে পারে। কোন জগতে হয়তো আপনি এই মুহূর্তে আমার লেখা পড়ছেন, বাকি জগতে আপনারই আরেক রূপ হয়তো কম্পিউটারে ফেইসবুকিং করছে!
এই তো গেলো নিকট অতীতের কথা। এবার আসি দূর অতীত ভ্রমণের ক্ষেত্রে। অতীত ভ্রমণের অসাড়তা প্রমাণের জন্য একটা কথা প্রায়ই বলা হয় যে, কেউ যদি অতীতে গিয়ে ছোটবেলার তার শিশুরূপকে বা নিজের জন্মদাতাকে হত্যা করে আসে, তাহলে তার নিজের অস্তিত্বই বা কীভাবে আসে? এর ব্যাখ্যাও দেয়া যায় প্যারালাল ইউনিভার্স ধারণার সাহায্যে।
অর্থাৎ, আপনি দূর অতীতে গিয়ে ছোট নিজকে বা আপনার জন্মদাতাকে হত্যা করেও আসেন, তাহলেও তা হবে ভিন্ন একটা জগতে, কারণ আপনি যখন কাল ভ্রমণ করছেন, তখন আপনি আর আপনার জগতে নাই, অন্য কোন জগতে চলে গেছেন। সে জগতে আপনার কৃতকর্মের ফল ঐ জগতে থাকবে, আপনার জগতে তার প্রভাব পড়বে না। এক্ষেত্রে, ঐ জগতে আপনার কোন অস্তিত্ব থাকবে না, অর্থাৎ আপনার মতো (তথা আপনি) কেউ ছোট থেকে বড় হবে না বা হয়তো জন্মাবেই না। কিন্তু যে জগত থেকে আপনি ঐ জগতে কাল ভ্রমণের মাধ্যমে গেছেন, সে জগতে আপনার অস্তিত্ব ছিলো ও আছে।
এবার চলেন একটু ভবিষ্যৎ থেকে ঘুরে আসা যাক।
ভবিষ্যতের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে অবশ্য হঠাৎ করে জিনিসটার অসাড়তা মাথায় আসে না। কারণ এখানে অতীতে গিয়ে ছোট আপনাকে বা আপনার জন্মদাতাকে খুনোখুনি করার কোন ব্যাপার নাই। কিন্তু যদি আপনি এমন সুদূর ভবিষ্যতে চলে যান, যেখানে আপনার নিজেরই কোন অস্তিত্ব নাই, সেক্ষেত্রে কী হবে? কিংবা আপনি যদি নিকট ভবিষ্যতে যান, যেখানে আপনার অস্তিত্ব আছে, তাহলে কি আপনার দুটো অস্তিত্ব তৈরি হবে? এক্ষেত্রেও প্যারালাল ইউনিভার্সের হাইপোথেসিস সমাধান দিতে পারে। আপনি যখন ভবিষ্যতে ভ্রমণ করবেন, তখন আসলে ভ্রমণ করবেন আপনার জগত থেকে অন্য এক জগতে।
আপনার জগত থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য ঐ জগতে আপনার অস্তিত্ব থাকবে না, কিন্তু যে জগতে যাবেন, সেখানে আপনার দুটি অস্তিত্ব থাকবে।
এবার চলেন দেখি, আমাদের এই সময় পরিভ্রমণ বা কাল ভ্রমণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী হতে পারে? আমাদের বোধগম্য কম সংখ্যক মাত্রা দিয়েই শুরু করি। দ্বিমাত্রিক গ্রাফ পেপারের কথা চিন্তা করি। এরূপ গ্রাফে দুইটা অক্ষ থাকে, x-অক্ষ, আর y-অক্ষ। ধরেন, আপনি যদি x-অক্ষ বরাবর ডান দিকে যেতে থাকেন, তাহলে কী পাবেন? x = 1, x = 2, x = 3 ইত্যাদি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসবগুলোই কিন্তু আসলে একেকটা রেখার সমীকরণ। আর এরা হচ্ছে y-অক্ষের সমান্তরাল রেখা, যারা x-অক্ষকে যথাক্রমে x = 1, x = 2 ও x = 3 বিন্দুতে ছেদ করে। রেখাগুলো হুবহু একই রকম (Identical), শুধু এদের মধ্যে একক পরিমাণ পার্থক্য আছে। হিসাবের সুবিধার জন্য আমরা x এর মান 1 করে বাড়িয়েছি। অথচ 1 ও 2 এর মাঝেও x এর অসংখ্য মান আছে, যেগুলো ভগ্নাংশ।
অর্থাৎ, x অক্ষের যতই ডানে যাওয়া যাবে, আমরা একেকটা Identical, কিন্তু ভিন্ন রেখা পাবো। একই কথা x অক্ষের বামপাশের জন্যও প্রযোজ্য। মোট কথা, আমরা যদি x অক্ষে ভ্রমণ করি, তাহলে আমাদের ভ্রমণের প্রতিটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পয়েন্টের জন্য আমরা একটা করে সমান্তরাল y অক্ষ পাবো। একইভাবে, আমরা যদি y-অক্ষ বরাবর চলাচল করি, তাহলে y-অক্ষের প্রতিটা পয়েন্টের জন্য একটা করে সমান্তরাল x-অক্ষ পাবো।
এবার মাত্রা এক বাড়িয়ে তিন মাত্রায় যাই।
আমাদের এই জগত সরল কথায় ত্রিমাত্রিক তথা তিন অক্ষ বিশিষ্ট। এখানেও আপনি x-অক্ষ বরাবর তথা দৈর্ঘ্য বরাবর যদি যেতে থাকেন, তাহলে পাবেন x = 1, 2, 3 ইত্যাদি, যেগুলো আসলে x-অক্ষের উপর উল্লম্ব yz তলের সমান্তরাল তলসমূহের সমীকরণ। x এর বিভিন্ন মানের জন্য প্রাপ্ত এই তলগুলো কিন্তু হুবহু yz তলের মতোই তথা yz তলের Identical. একই কথা y-অক্ষ বা z-অক্ষ বরাবর ভ্রমণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ, n মাত্রার কোন কাঠামোতে আপনি যদি যেকোনো ১ মাত্রা বরাবর ভ্রমণ করেন, তাহলে আপনি বাকি n-1 সংখ্যক মাত্রাগুলোর দ্বারা গঠিত কাঠামো পাবেন, যারা একে অপরের সাথে Identical. যেমন, দ্বিমাত্রিক তলের x-অক্ষ বরাবর ভ্রমণ করলে পাবেন পরস্পর সমান্তরাল ও Identical y-অক্ষ। আবার ত্রিমাত্রিক অক্ষের x-অক্ষ বরাবর ভ্রমণ করলে পাবেন পরস্পর সমান্তরাল ও Identical yz-তল।
এবার ধরেন, আমাদের জগত আসলে চতুর্মাত্রিক, যেখানে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতার পাশাপাশি সময়ও একটা মাত্রা। আমাদের আগের আলোচনা অনুযায়ী, আপনি যদি সময় মাত্রা বরাবর ভ্রমণ করেন, তাহলে কী পাবেন? পাবেন তিন মাত্রার একেকটা কাঠামো, যারা সময় অক্ষ দ্বারা পরস্পর হতে আলাদা। ব্যাপারটা এমন, এক জগত হতে আরেক জগত কিছু সময় আগে বা পরে অবস্থিত। এই ‘কিছু সময়’ আসলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়। ১ ও ২ এর মাঝে যতগুলো সংখ্যা, সময় অক্ষে দুটো সময়ের মাঝে ঠিক ততগুলো সময়, তথা অসংখ্য সময়।
অর্থাৎ, আমরা যদি সময় বরাবর ভ্রমণ করি, তাহলে অসংখ্য একই রকম তথা Identical জগত পাবো, যারা একে অপরের থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময় আগে-পরে অবস্থান করে। এটা আসলে আমাদের আগের প্যারালাল ইউনিভার্সের ধারণাকেই প্রতিষ্ঠিত করছে। মনে হতে পারে, যদি দুটো জগতের মধ্যে ১ সেকেন্ডের ব্যাবধান থাকে, তাহলে তো কোন এক জগত থেকে ঠিক ১ সেকেন্ড পরেই অন্য জগতে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু এভাবে ভাবলে ভুল হবে, কারণ কোন জগতেই সময় স্থির না। ধরেন, পাশাপাশি দুটো জগত ক ও খ, যাদের মাঝে ১ সেকেন্ডের ব্যাবধান আছে।
এখন ক জগতে যখন ১০:০০:০০ টা বাজে, তখন খ জগতে বাজে ১০:০০:০১ টা। যখন ক জগতে ১০:০০:০১ বাজবে, তখন কিন্তু খ জগতেও ১০:০০:০২ বাজবে। অর্থাৎ, দুই জগতের মধ্যে ব্যাবধান কিন্তু সবসময়ই ১ সেকেন্ড থাকবে। কাজেই পাশাপাশি দুটো জগত কখনোই একে অপরের সাথে কোইনসাইড করবে না বা উপরিপাতিত হবে না। এজন্য এক জগত থেকে অন্য জগতে যাওয়াও সহজ কিছু হবে না।
যদি এরকম প্যারালাল ইউনিভার্স থেকেই থাকে, তাহলে কাল ভ্রমণ ছাড়া এক জগত থেকে আরেক জগতে যাওয়া সম্ভব হবে না। ফলে আপনি কখনোই এমন কোন জগতের অস্তিত্বও টের পাবেন না।
এতোক্ষণ অনেক কিছুই আলোচনা করলাম। এগুলো আসলে পুরোই মনের মাধুরী মেশানো কথা-বার্তা বলতে পারেন। চাইলে এই কথাগুলোর মধ্যে হয়তো অনেক বৈজ্ঞানিক ভুল ত্রুটি বের করা যাবে।
তবে আমি মনে করি, বিজ্ঞান কখনো চিন্তার জগতকে সংকুচিত করে না। কাজেই, চিন্তার স্বাধীনতা আমাদের সবারই আছে। অতএব, মনের মাধুরী মিশিয়ে চিন্তা করতে দোষ কোথায়? একটু Free thinking করলাম আর কি! যদি ব্যাক্তিগত মতামত জানতে চান, তাহলে আমার মনে হয়, এই প্যারালাল ইউনিভার্স, সময় পরিভ্রমণ কোন কিছুই আসলে সম্ভব না। তবে আসল উত্তর জানতে হলে হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে বিজ্ঞানের আরো অনেক অনেক অগ্রগতি পর্যন্ত…
পূর্বে সদালাপে প্রকাশিত ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।