ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর
Click This Link
নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার বাড়িটির নাম 'বায়তুল আমান'। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বাড়িটিতে প্রচুর লোক মিটিং করছে- এমন খবর পেয়ে সিপাহিরা আসে। ঢোকার দরজার ওপর লাথি মারতে থাকে তারা। কিন্তু ভেতর থেকে শরীরের সব শক্তি দিয়ে তা ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে থাকেন বাড়ির নতুন বউ ও তাঁর বৃদ্ধ শ্বশুর। উল্টা দিক থেকে বুটের লাথির আঘাতে নতুন বউয়ের হাতের চুড়িগুলো ভেঙে মাংসে গেঁথে টপ টপ করে রক্ত ঝড়তে থাকে।
ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা এ নারীর নাম নাগিনা জোহা। আর তাঁর শ্বশুর হচ্ছেন আন্দোল সংগ্রামের এক অগ্রপুরুষ ওসমান আলী।
নারায়ণগঞ্জ স্মরণাতীত কাল থেকেই রাজনীতিতে জোরালো ভূমিকা পালন করে এসেছে। বলা হয়ে থাকে 'নারায়ণগঞ্জ ইজ দ্য পলিটিক্যাল হান্টিং গ্রাউন্ড অব বেঙ্গল'। রাজধানী ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ত এখানে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে, হাল আমলের প্রতিটি জনসমর্থিত আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেও নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি সচেতন মানুষ পালন করেছে উজ্জ্বল ও সংগ্রামী ভূমিকা। ওই সময় যাঁরা সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন, নাগিনা জোহা তাঁদের অন্যতম। গতকাল স্মৃতি হাতড়ে কালের কণ্ঠকে তিনি বলছিলেন ওইসব দিনের কথা।
নাগিনা জোহা ১৯৩৫ সালে অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলার কাশেম নগরে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁদের পরিবারের পূর্বপুরুষদের নামানুসারে গ্রামটির নামকরণ করা হয়। বাবা আবুল হাসনাত ছিলেন সমাজ হিতৈষী। বড় চাচা আবুল কাশেমের ছেলে আবুল হাশিম ছিলেন অল বেঙ্গল মুসলীম লীগের সেক্রেটারি ও এমএলএ। নাগিনা জোহা ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদালয়ের অধীনে মেট্টিক পাস করেন। ১৯৫১ সালে নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ওসমান পরিবারের সন্তান রাজনীতিবিদ এ কে এম শামছুজ্জোহার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন।
স্বামীর বাড়িতে নতুন বউ হিসেবে এসেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর শ্বশুর তৎকালী এমএলএ খান সাহিব ওসমান আলীর চাষাঢ়ার বাড়ি 'বায়তুল আমান' ছিল আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু।
বয়সের ভারে এখন শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না নাগিনা জোহার, তবুও দীর্ঘ ৬০ বছর আগের ইতিহাস মনে করতে অসুবিধা হলো না তাঁর। ভাষা আন্দোলনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে কখনো আবেগ আপ্লুত আবার কখনো তেজোদীপ্ত হয়ে উঠছিলেন তিনি।
নাগিনা জোহা জানান, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের মানুষ, ছাত্রসমাজ এক অনন্য ভূমিকা পালন করে।
ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকেই এখানে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। খান সাহিব ওসমান আলী, শামছুজ্জোহা, মফিজউদ্দিন আহমেদ, শফি হোসেন খান, আজগর হোসেন ভুঁইয়া, বজলুর রহমান, সুলতান মাহমুদ মল্লিক, শামছুল হুদা, মোস্তফা সারোয়ারসহ আরো অনেকে এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ঢাকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য রাজপথে আন্দোলন করতে থাকেন। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ছাত্র ধর্মঘটের আহ্বানে নারায়ণগঞ্জের সব স্কুল-কলেজে ধর্মঘট পালিত হয়।
নাগিনা জোহা বলেন, 'ওই সময় আন্দোলন সংগ্রামের দিক নির্দেশনামূলক সভাগুলো বায়তুল আমানেই অনুষ্ঠিত হতো। আমি নতুন বউ, এরপরও বাড়িতে আসা নেতা-কর্মীদের আপ্যায়ন ও কিছু বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নোট বা ড্রাফট করার দায়িত্ব আমার ওপরই ছিল।
সামছুজ্জোহার কোনো চিরকুট লোক মারফত যথাস্থানে পেঁৗছে দেওয়ার দায়িত্বও আমার ওপর ছিল। '
নাগিনা জোহা জানান, বাবার বাড়িতে ছোটবেলা থেকেই তিনি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বড় হন, শ্বশুরবাড়িতে এসেও পান সেই পরিবেশ। তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর মতামতও নেওয়া হতো।
২১ ফেব্রুয়ারির রাষ্ট্রভাষা দিবসকে সফল করতে নারায়ণগঞ্জের ছাত্রসমাজসহ আপামর জনতা ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। হ্যান্ডবিল বিতরণ করা হয় ও হাতে লেখা পোস্টার দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো হয়।
ওই দিনও নারায়ণগঞ্জের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। নাগিনা জোহা বলেন, 'ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে সেদিন আমরা কিছু মহিলাও রাজপথের বিক্ষোভ মিছিলে শরীক হয়েছিলাম। রাজপথের মিছিলে সম্মুখভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মফিজউদ্দিন আহমেদ, আজগর হোসেন ভুঁইয়া, বজলুর রহমান, সুলতান মাহমুদ মল্লিক, শামছুল হুদা, মোস্তফা সারোয়ার, শফি হোসেন খাঁন, মমতাজ বেগম, মোস্তফা মনোয়ার, জানে আলম, আলমাছ আলী (বড়) প্রমুখ। ' তিনি জানান, বিকেলে রহমত উল্লাহ ক্লাবে জনসভা হয়। ঢাকায় গুলি করে ছাত্র হত্যা করা হয়েছে, শহীদ হয়েছেন রফিক, বরকত, শফিক, জব্বারসহ বহু লোক- এমন খবরে নারায়ণগঞ্জের মানুষও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
সন্ধ্যায় বায়তুল আমানে লোকজন জড়ো হতে থাকে পরবর্তী করণীয় কী তা জানার জন্য। তিনি বলেন, 'এদিকে আমার স্বামী শামছুজ্জোহাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করার জন্য কিছুদিন ধরেই ওত পেতে ছিল। জোহাও এটা বুঝতে পেরে গা-ঢাকা দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকেই নেতা-কর্মীদের আন্দোলন সংগ্রামের দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। পরে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। '
নাগিনা জোহা বলেন, 'একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় প্রচুর লোক মিটিং করছে- এ খবর পেয়ে পুলিশ বায়তুল আমানে হামলা করে।
পুলিশ আমাদের বাসায় এসে জোহাকে খুঁজতে থাকে গ্রেপ্তারের জন্য। তখন বাসায় থাকা নেতা-কর্মীরা যে যেভাবে পেরেছে, সটকে পড়ে। একজন আত্মরক্ষার জন্য গাছে উঠেছিল, তাকে সিপাহীরা টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। আমাদের পরিবারের সবাই বিশেষ করে শিশুরা ভয়ে তটস্থ। আমরা ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে আছি।
এমন সময় প্রচুর সিপাহী এসে দরজা খুলতে বললে আমরা খুলিনি। পরিবারের সবাইকে ছাদে চলে যেতে বললাম, আর আমি ও আমার শ্বশুড় দুজনে দরজা আগলে রাখলাম। শ্বশুড় সাহেবকেও বলেছিলাম, ওপরে চলে যেতে, কিন্তু তিনি আমাকে একা ফেলে যাননি। ওদিকে সিপাহীরা দরজায় বুট দিয়ে লাথি মেরে ভাঙার চেষ্টা করছিল। আমরা সেটাকে আগলে রাখার চেষ্টা করছিলাম।
সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে, আমার হাতে স্বর্ণের ও কাচের চুড়ি ছিল। দরজা যেন ভাঙতে না পারে, এর জন্য শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজার ওপর শরীর ও বাহু চেপে রেখেছিলাম। উল্টা দিক থেকে বুটের জোরালো লাথির আঘাতে আমার চুড়িগুলি হাতের মধ্যে বিঁধে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। একপর্যায়ে তারা দরজা ভাঙতে সক্ষম হয়। ভেতরে ঢুকে সিপাহীরা সমস্ত বাড়ি তল্লাশি করে তছনছ করে খান সাহেব ওসমান আলীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।
আমি একসময় উত্তেজিত হয়ে সিপাহীদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ি। তারা আমাকেও গ্রেপ্তার করতে চাইলে এক বাঙালি সিপাহীর অনুরোধে রেখে যায়। পরে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমিও জোহার (স্বামী) সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাই। ৯ মাস আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে স্বামীকে নিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আত্মসমর্পণ করাই। '
নাগিনা জোহা আরো বলেন, 'আমরা সত্যি গর্বিত জাতি- কেননা, মায়ের ভাষার জন্য আর কোনো জাতিকে আন্দোলন করতে হয়নি, প্রাণ দিতে হয়নি।
আমাদের সে আন্দোলন সফল হয়েছিল বলে আমরা বাংলায় মা বলে ডাকতে পারি। ' তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'নতুন প্রজন্ম হয়তো ইতিহাস ভালো করে জানে না, তাই শহীদ মিনারের বেদিতে জুতা নিয়েই বসে পড়ে। তারাই বা করবেটা কী, কেননা নারায়ণগঞ্জে প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেওয়ার মতো একটা ভালো পার্ক নেই। ' তিনি নারায়ণগঞ্জের আন্দোলন সংগ্রামের স্থাপনাগুলির রক্ষণাবেক্ষণে সরকারকে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন, যেন স্থানগুলি নতুন প্রজন্মের কাছে ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি পায়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।