আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাপ মুহাম্মাদ আমার!!!

নয়া যামানার নয়া পথিক,পথ হারিয়ে ছুটনা দিক্বিদিক খেজুর বিথীর আড়াল থেকে ভোরের সূর্য উঠল ঘন নীল আকাশে। আর মরুর বালু ছঁয়ে ছুঁয়ে বইছে শান্ত ভোরের বাতাস। মরুর আকাশ-বাতাসে আজ এক নতুন উল্লাস। কার প্রতিক্ষায় যেন তারা প্রহর গুনছে। খেজুর গাছের দীর্ঘ পাতাগুলো তিরতির করে নাচছে।

মক্কার ঘরে ঘরে আজ সজ্জার আয়োজন। আসবে যে আজ সেই মহান অতিথি! তবুও সেখানে একটা স্পষ্ট বিরোধ পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারা যেন এই খুশিতে যোগ দিচ্ছে না। এক আজানা ভীতিতে তারা শঙ্কিত,তাদের চাপা আর্তনাদ কান পাতলেই শুনা যায়। দিন বাড়ার সাথে সাথে আর্তনাদটা ক্রমেই বাড়তে থাকে।

এই বুঝি এল হানাদারের দল। শঙ্কিত হয়ে আড়াল থেকে বার বার তারা তাকাচ্ছে শান্ত মরুর দিকে আড়াল থেকে। ধূলোর ঝড় তুলে এসে পরল নাকি জান-মালের দুশমন!! না শত্রুর কোন চিহ্ন নেই। তবুও তারা ঘর ছাড়া । সবাই ছুটছে নিরাপদ স্থানে পাহাড় কিংবা গুহায়।

বাবা হোবল রক্ষা কর,মা মানাত একটু ফিরে চাও। দুশমন যেন রাস্তায় পড়ে মরে থাকে। রক্ষা কর আমাদের দোহাই তোমাদের... সূর্য যতই উপরে উঠতে থাকে ততই মরুর বালু উত্তপ্ত হতে থাকে। এ তপ্ত মরুর বালু লেলিহান শিখার মত গ্রাস করতে চায় সব। তবুও ছুটছে সবাই এ তপ্ত বালু মাড়িয়ে।

আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই সব শেষে রাখালেরা। ছেলে মেয়ে গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে সবাই ছুটছে পাহাড়ের আড়ালে। হাঁক-ডাক পরে যায় তাদের মধ্যে,মরুর উপারে তাকায় তারা। মেয়েরা কাঁদে আর বুড়ির দল পাড়ে গাল। ছুট ছেলে-মেয়েরা দৌড়ায়।

পথ চলতে চলতে মাথা নাড়ে সর্দার। আজ আর রক্ষা নেই। এই মক্কা থেকেই তাড়িয়ে ছিলাম তাঁকে। আজ তিনি নিয়ে আসছেন হাজার হাজার সেনা। আজ শুধু ধরে ধরে কাঁটবে আর লুটিয়ে দেবে মরুর বালুতে।

প্রতিশোধ নেবেই-নেবে! বাবা হুবল তুমিই একমাত্র ভরসা,বাঁচাও আমাদের! হঠাৎ চিৎকার পড়ে যায় পলাতকদেরন মাঝে। শত্রু আসছে তীর বেগে মরুর ধুলো উড়িয়ে হাজার হাজার। আত্মগোপন করতে থাকে বিধর্মীরা। সবাই ছুটছে প্রানপণে। হয়তো তারা বাঁচবে,কিন্তু বুড়িগুলো?... পাহাড়ের আড়াল থেকে বিধর্মীরা দেখল,হাজার হাজার মুসলমান এগিয়ে আসছে ধীর গতিতে,দৃঢ় পদক্ষেপে।

কোমরে বাঁধা খাপে মোড়া তলোরার। তপ্ত মরুর বুকে এক বুড়ি কাঁদছিল,ক্ষতবিক্ষত দেহ ,টপ টপ রক্ত ঝরছিল। পাশে তার বড় একটা বোঁচকা। একজন লোক শান্ত পদক্ষেপে তার সামনে দাঁড়াল। বুড়ি চোখ তুলে তাকাল,তারপর আবার মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

লোকটা স্নিগ্ধ কন্ঠে বললঃ কি হয়েছে বুড়ি মা ,কাঁদছো কেন?বল কি করতে হবে?- বুড়ি ধুলো থেকে মুখ তুলে তাকাল এবং আনেকক্ষন তাকিয়ে বলল-তুমি তো মুসলমান। লোকটা বললঃহ্যাঁ,আমি মুসলমান। বুড়ি আবার ডুকরে কেঁদে উঠল আর কদর্য কন্ঠে বললঃজানমালের দুশমন সর তুই। বাবা হুবল রক্ষা কর আমায়... লোকটা বাধা দিয়ে বললঃ কিন্তু আমি তোমাকে এভাবে ফেলে যেতে পারি না মা। বল,তোমাকে কোথায় নিয়ে গেলে তুমি শান্তি পাবে? বুড়ি আবার তাকালো,তাকিয়ে থাকল ছানিপড়া ঘোলা চোখে।

একটু আগে তার স্বজাতিরা তাকে ভারী মালের জন্য জোর করে ঘোড়া থেকে ফেলে দিয়ে গেছে। অথচ লোকটা বলে কী?!বুড়ি দ্রুত কন্ঠে বলে ওঠেঃ তা হ'লে বাবা-এই বোঁচকাটা ঐ পাহাড়ের ওপারে পৌঁছে দাও। লোকটা এক হাতে বোঁচকাটা ধরে আরেক হাতে বুড়ির হাত ধরল। তারপর নরম কন্ঠে বললঃ চল মা। ধীরে ধীরে তারা মরুর পথে পাড়ি জমায়।

যেতে যেতে বুড়ি তার নিজের কাহিনী শোনায়,দুঃখের কাহিনী। স্বজাতির লোকেরা আজ তাকে ঘোড়া থেকে ফেলে দিয়ে গেল,অথচ...। বুড়ির চোখ সজল হয়ে ওঠে। বলে-জান বাবা তোমার মত আমার এক ছেলে ছিল,সে আজ বেচেঁ থাকলে...! লোকটা তখন বলেঃ আমিই তোমার ছেলে মা। অকারণে বুড়ির চোখ আবার সিক্ত হয়ে ওঠে।

ছেলে মারা যাওয়ার পর কেউ তাকে এভাবে মা বলে ডাকেনি। বুড়ি বারবার তাকায়। তপ্ত মরু মাড়িয়ে তারা এসে পৌঁছে পাহাড়ের নিকট। আড়ালে নেমে বুড়ি বললঃ এখানে রাখ বাবা। বুড়ির হাত ছেড়ে বোঁচকাটা মাটিতে রেখে দিল লোকটা,তারপর ক্ষতে লাগা ধূলোবালি ধীরে ধীরে মুছিয়ে দিচ্ছিল।

হঠাৎ বুড়ি লোকটির হাত চেপে ধরে কেঁদে ওঠে বলিলঃ আমার কাছে থাক আজকের দিনটা,নইলে মুসলমানেরা মেরে ফেলবে আমায়। বুড়ির চোখের পানি মুছতে মুছতে লোকটা আবেগ-গাঢ় কন্ঠে বললঃ ছিঃ মা মিছিমিছি কেঁদো না। ঐ তো মুসলমানেরা চলে গেল,কই কিছুই বলল না তো? বুড়ি আরও ডুকরে কেঁদে ওঠে। বলেঃ ওরা কিছু বলবে না ঠিক আছে,কিন্তু...কিন্তু সেই মুহাম্মাদ,মুহাম্মাদ এসে খুন করবে,কাটবে। সেই পাষন্ড নিষ্ঠুর মুহাম্মাদ!! হঠাৎ লোকটি বুড়ির হাত আগ্রহের সংগে জড়িয়ে ধরে বললঃ মা আমি সেই অধম মুহাম্মাদ!!আমার ভয়ে যদি তোমার এত কষ্ট,কী শাস্তি দেবে দাও ,মাথা পেতে নেবো।

সভয়ে ক'হাত ছিটকে গেল বুড়ি। দূরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তারপর ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে হাত দুটি জড়িয়ে ধরে গভীর আবেগে বললঃ তুমি মুহাম্মাদ! তুমি!!তবে যে... নিজের পিরহান দিয়ে বুড়ির চোখ মুছে দিলেন দীনের নবী। তারপর পরম মমতায় একান্ত স্নিগ্ধ কন্ঠে বললেন,কেঁদো না মা। বসে বিশ্রাম করো।

একটু থেমে বললেনঃ আমি এখন যাই। আকস্মাৎ বুড়ি যেন অপরিসীম ব্যাথায় ভেঙ্গে পড়ল। কাতর কন্ঠে কি যেন বলতে গিয়েও বলতে পারলনা। অব্যক্ত অনেক কথা জমে রইল তার বুকের মাঝে। ঝিরঝির করে বইছে মরুর বাতাস।

ঝাপসা চোখটা মুছে দেখল,মরুর পথে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছেন দীনের নবী,দয়ার নবী। শান্তির দূত,হয়তো মুছে দেবেন আরো অনেকের চোখের পানি। হয়তো ভরিয়ে দেবেন অনেক বিধবার বুক। হয়তো............... অপরিসীম আবেগে চোখটা আবার ঝাপসা হয়ে এলো বুড়ির । দূর মরুর দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে ফিস-ফিস করে উচ্চারণ করল,বাপ মুহাম্মাদ আমার!!! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।