মিসরের রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারে ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি উল্লাসের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। উপলক্ষ—স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতন। মাত্র আড়াই বছরের ব্যবধানে একই রূপে তাহরির স্কয়ার। এবারের উত্সব সেনা অভ্যুত্থানে দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির পতন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভুল পথে হেঁটে জনগণের পাহাড়সমান আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থতাই তাঁর পতন ডেকে এনেছে।
টানা ১৮ দিনের গণ-আন্দোলনে মোবারকের ৩০ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এরপর দেশটির ক্ষমতা যায় সেনাবাহিনীর হাতে। নির্বাচিত বেসামরিক প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে তৈরি হয় নানা অনিশ্চয়তা।
গত বছরের ২৩ ও ২৪ মে মিসরে প্রথম দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। ১৬ ও ১৭ জুন দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়।
স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ওই ঐতিহাসিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে গত বছর দেশটির ক্ষমতায় আসেন ইসলামপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুড-সমর্থিত মোহাম্মদ মুরসি।
মুরসির এ জয়ে অনেকেই গণতান্ত্রিক মিসরের স্বপ্ন দেখেছেন। তখন দেশি-বিদেশি বিশ্লেষকেরা বলছিলেন, তাঁর পথ মোটেও সহজ হবে না। ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে তাঁকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপস করতে হবে।
ক্ষমতা গ্রহণ করেই সামরিক বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করেন মুরসি।
গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড তদন্তের আদেশ দেন তিনি।
এ ছাড়া পার্লামেন্ট বিলুপ্ত ও পুনরুজ্জীবিত করা নিয়ে সামরিক বাহিনীর সুপ্রিম কাউন্সিল ও সর্বোচ্চ সাংবিধানিক আদালতের সঙ্গে মুরসির বিরোধ চরমে পৌঁছে।
মিসরের তত্কালীন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিল্ড মার্শাল হুসেইন তানতাউয়ি ও সামরিক বাহিনীর চিফ অব স্টাফ সামি আনানকে অপসারণ করেন মুরসি। তানতাউয়ির জায়গায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী করা হয় জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসিকে। দুই জেনারেলকে বরখাস্ত করার পাশাপাশি মুরসি সামরিক পরিষদের আনা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা খর্বকারী সাংবিধানিক সংশোধনীও বাতিল করেন।
একটি বিতর্কিত ডিক্রি জারি করে নিজের ক্ষমতা বাড়িয়েছেন মুরসি। বিরোধীরা তাঁর এ পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করে। এ নিয়ে বিচার বিভাগের সঙ্গেও মুরসির বিরোধ দেখা দেয়। মুরসি একচ্ছত্র ক্ষমতা দখল করতে চান বলে অভিযোগ করে সরকারবিরোধীরা। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মুরসির সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষ হয়েছে।
নতুন মিসরে জনপ্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু মুরসি তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। মুরসির শাসনে আশা ভঙ্গ হয়েছে মিসরীয়দের। দেশটিতে বেড়েছে বিভক্তি।
সমালোচকদের মতে, মিসরে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মুরসি।
রাষ্ট্র পরিচালনায় বিরোধীদের আস্থায় নিতে পারেননি তিনি। তাই শুরু থেকেই তাঁকে নানামুখী বিরোধিতায় পড়তে হয়েছে।
মুরসির অধীনে দেশটির নিরাপত্তাব্যবস্থা দিন দিন খারাপ হয়েছে। অর্থনীতি নাজুক পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে। প্রবৃদ্ধির গতি নিম্নমুখী।
চরম আকার ধারণ করেছে বেকারত্ব। রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে।
শরিয়া আইনকে মিসরের নতুন সংবিধানের ভিত্তি করেছেন মুরসি। এটা ছিল হোসনি মোবারকবিরোধী অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থী। তা ছাড়া সংবিধানে নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়েও বৈষম্য করা হয়েছে।
এ পদক্ষেপে সংখ্যালঘু ও উদারবাদীরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
হোসনি মোবারক-পরবর্তী মিসর নানা সমস্যায় জর্জরিত। অথচ সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে মুরসির নজর ছিল নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার দিকে।
গত রোববার ছিল মুরসির দায়িত্ব গ্রহণের এক বছরপূর্তি। এ প্রেক্ষাপটে মুরসিবিরোধীরা রাজপথে নেমে আসে।
এ সময় মুরসিপন্থী ও বিরোধীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।
রোববার কায়রোর তাহরির স্বয়ারে বিক্ষোভের ডাক দেয় বিরোধীরা। ওই বিক্ষোভে লাখো জনতা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করে। মুরসিকে পদত্যাগের জন্য সময় বেঁধে দেয় বিরোধীরা।
চলমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার একটি বিবৃতি দেয় দেশটির সশস্ত্র বাহিনী। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সব রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দেয় সেনাবাহিনী।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়, জনগণের দাবি মেনে নেওয়ার জন্য আবার আহ্বান জানাচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী। শেষ সুযোগ হিসেবে সবাইকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দেওয়া হলো। দেশের জাতীয় নিরাপত্তা চরম হুমকির মধ্যে।
যদি সমস্যার সমাধান না হয়, তবে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের ঐতিহ্য অনুযায়ী হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হবে সেনাবাহিনী।
মিসরের সেনাবাহিনীর বেঁধে দেওয়া ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা প্রত্যাখ্যান করেন প্রেসিডেন্ট মুরসি। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, প্রাণ গেলেও সরে যাবেন না।
গতকাল বুধবার রাতে মুরসিকে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী।
একই সঙ্গে দেশের সংবিধান স্থগিত করে প্রধান বিচারপতি আদলি মানসুরকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করা হয়েছে।
গতকাল রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি বলেন, দেশকে বাঁচাতে মুরসিকে সরিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনী তাদের ‘ঐতিহাসিক দায়িত্ব’ পালন করেছে। মুরসি ক্ষমতা ভাগাভাগিতে বিরোধীদের দাবি পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। —বিবিসি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য কমেনটেটর অবলম্বনে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।