আমি লিখি মানুষের কথা,মানুষ পড়ে না। তারা হাসে। তাদের হাসির জন্যে আমি লিখি 'সবকিছু হাসির বিষয় নয়' তারা হাসে না! তবু আমি লিখব। লাল কালির বৃত্ত
@তুষার আহাসান
সকালবেলা গঙ্গাস্নান করলে সারাদিন মন ভাল থাকে। কলকাতায় থাকতে তাই
করতেন রাঘব।
এখন মেয়ের বাড়িতে এসে তার ব্যতিক্রম হয়নি। মনেমনে
নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেন রাঘব,তাঁর জন্ম,কর্ম,সবই গঙ্গার তীরে!মেয়ের
বিয়ে দিয়েছেন গঙ্গার তীর-ঘেঁষা বাড়িতে। জামাই কলেজের অধ্যাপক। রাঘবকে
দেখে সর্বদা বিগলিত। সবসময় বলে, ‘বাবা,আপনার কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?
শুচি,তুমি কিন্তু বাবার সুবিধে-অসুবিধে গুলো একটু নজর রেখো।
’
মেয়ে সুচেতা হাসে। বলে,‘বাবার দিকে আমি খেয়াল রাখি,তোমাকে ওসব নিয়ে
ভাবতে হবে না। ’
জামাই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। কখনও কলেজ,কখনও টিউটোরিয়াল হোম।
তবে রাতে খাওয়ার সময় বলে, ‘বাবা,ইলিশ মাছ খেতে ডাক্তার আপনাকে বারণ
করেনি, কাল তাহলে দই-ইলিশ হয়ে যাক।
’
রাঘব বলেন,‘আমি কি খাব না খাব সব আমার মেয়ে ঠিক করে দেয়। বেশ,
তোমার যখন ইচ্ছে,কাল আমি দই-ইলিশই খাব। ’
শ্বশুর-জামাইয়ের কথায় ফুলের হাসি হাসে সুচেতা। সে বলে,‘আমি যখন ছোট
ছিলাম সবকিছু বাবার রুটিনমাফিক করতে হত,এখন এখানে বাবা আমার
রুটিন মত চলছেন’।
---‘তারমানে তুমি বাবাকে তাঁর নিজের মত থাকতে দিচ্ছো না?’
---‘আরে না,না,আমি এখানে নিজের মতই আছি,শুচি তো আমাকে কত বারণ
করে ভোরবেলা গঙ্গাস্নান করো না,আমি কি তা শুনছি।
’ বলে দরাজ হাসি হাসেন
রাঘব।
গঙ্গাস্নান সেরে ফিরে রাঘব দেখলেন,সুচেতা তার জন্যে চা তৈরী করেছে। টেবিলে
রাখা আছে ইংরেজী,বাংলা দুটি দৈনিক। চা খেতে খেতে সংবাদপত্রে চোখ
রাখলেন রাঘব। একটা সংবাদে চোখ আটকে গেল তাঁর।
ছোট্ট একটা দূর্ঘটনার সংবাদ। এক সাইকেল আরোহীকে পিষে দিয়ে চলে গেছে
মালবাহী ট্রাক। এমন তো কতই ঘটছে রাতদিন!কিন্তু দূর্ঘটনা শব্দটি লাল কালি
দিয়ে ঘিরে রেখেছে কেউ। জামাই মর্ণিং-ওয়াকে গেছে। সে যখন বেরিয়ে যায় তখন
খবরের কাগজ আসে না।
নাতি অর্ণব হোস্টেলে আছে। রোববার সে আসবে তার
দাদুকে দেখতে। তবে কি সুচেতা?
---‘কাগজ পড়তে-পড়তে কি অত ভাবছো বাবা’?
সুচেতার কথায় সম্বিত ফিরে পেলেন রাঘব। বললেন, ‘ভাবছি দূর্ঘটনা শব্দটি কে যেন
লাল কালিতে ঘিরে রেখেছে। ’
---‘ ওই দাগটা আমিই দিয়েছি?’
--- ‘কেন বল তো?’
---ও কিছু নয়,ছেলেমানুষী খেয়াল বাবা।
’সুচেতার কথায় আর হাসিতে যেন ফুলের
পাপড়ি ঝরে পড়ল।
ফের খবরের কাগজে মন দিলেন রাঘব। সুচেতা তাঁকে লক্ষ্য করতে থাকল।
রাঘব ঘোষাল,এককালের দাপুটে নেতা। তাঁর ভয়ে বাড়ি এবং এলাকার
লোক কাঁপত।
এখন তিনি মৃত-সূর্য। নতুন সব নেতা উঠে এসেছে রাজনীতির
অঙ্গনে। রাঘবের কোন কদর নেই।
শরীরও ভেঙে গেছে রাঘবের। পেটে আলসার।
মাথায় টাঁক। চশমার পাওয়ার
দিন-দিন বাড়ছে। স্ত্রী-বিয়োগের পর সংসার থেকে বিবাগী হয়েছেন। মাসের
পর মাস ছেলে-মেয়েদের বাড়ি বেড়িয়ে ফিরছেন। নাতি-নাতনিদের উপহার
দিচ্ছেন।
মুখটা সব সময় হাসিখুশি রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। যা দেখে
স্পষ্ট বোঝা যায়,তিনি শান্তি পাচ্ছেন না।
রাঘব কাগজ পড়তে পড়তে খেয়াল করলেন,সুচেতা দাঁড়িয়ে আছে। আঙুলে
শাড়ির আঁচল পাক দিচ্ছে সে। বললেন,‘কিছু বলবি?’
---‘ বাবা তোমার মনে আছে,আমাদের বাড়ির সামনে এমনই একটা দূর্ঘটনা
ঘটেছিল?’
---‘তাই বুঝি,কোন ইয়ারে বল তো?’
---‘আমি তখন ফার্ষ্ট-ইয়ারে পড়ি?’
ভুরু কুঁচকে গেল রাঘবের।
মেয়ের ভাবগতিক আজ সুবিধের মনে হচ্ছে না।
অন্যদিন এ সময়ে সে কিচেনে চলে যায়। গেরস্থালী নিয়ে ব্যস্ত হয়। আজ
কেন সেই কলেজ-জীবনের মত আদুরে গলায় কথা বলছে?ঝানু নেতার মত
নিজেকে সামলে নিয়ে রাঘব বললেন,‘ হবে হয়ত,কত কিছুই তো ঘটছে
জীবনে,সব কি আর মনে রাখতে পারি?’
---‘আমার মনে আছে বাবা,ছেলেটা আমার সহপাঠী ছিল,আমি খুব
কেঁদেছিলাম। ’ বলতে গিয়ে পুরোন কান্নাটাই যেন এখনকার চোখে চলে
এল সুচেতার।
বিব্রত রাঘব। তাঁর স্মৃতিশক্তি দূর্বল নয়। সেই ছেলেটার নাম-ধাম,চেহারার স্পষ্ট
বর্ণনা দিতে পারেন তিনি। তবে এখন তা করবেন না। মেয়েকে সেদিন তিরস্কার
করেছিলেন।
সে ছিল এক যুদ্ধজয়ের আনন্দ। মেয়েকে সেদিন যেমন
ভালবাসতেন। আজও বাসেন। মেয়ের সুখের সংসার দেখে এখন তিনি নিশ্চিত,
সেদিনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
সুচেতা কি সুখী হয়নি? গোবিন্দর মত ভাল বর ক’জন মেয়ের ভাগ্যে জোটে?
সাজানো সংসার।
নিরিবিলি জীবনযাপন। ঝরণার মত স্বচ্ছ,একমুখী। এই
ধারা বহমান হওয়ার আগে দু-একটি পাথর সরাতেই হয়। সমাজের জঞ্জাল
সাফ করার দায়িত্বে রাঘবও সরিয়েছেন।
পাথর না সরালে হয়ত সুচেতা সেই চায়ের দোকানীর ছেলের হাত ধরত।
চায়ের দোকানের এঁটো গেলাস ধুতে-ধুতে হয়ত একদিন ‘পয়সাওয়ালা’র
বউ হতে পারত। তবে তাতে স্বীকৃতি থাকত তালের রসের মত। সকালবেলা
রস,দুপুর হলেই তাড়ি।
মুখে একটা দু:খের ভাব ফুটিয়ে রাঘব বললেন, ‘পুরোন দিনের কথা মনে
করে কষ্ট পেয়ে কি লাভ,এখনকার মত বাঁচ মা,বেঁচে সুখী হ। ’
---‘না,না,কষ্ট আমি পাইনি বাবা,তুমি জিজ্ঞেস করলে,দূর্ঘটনা শব্দটিতে লাল
কালির দাগ কেন দিয়েছি,তাই বললাম।
খবরের কাগজে দূর্ঘটনা শব্দটি দেখলেই
আমি এমন করি। তোমার জামাই টের পায়না। ’
---‘বুঝেছি মা বুঝেছি,আমাদের জীবনের কিছু অংশ লাল কালির দাগ দিয়ে
ঘেরা থাকে,তাকে নড়ালেই রক্তাক্ত হতে হয়। ’
উদাস হয়ে গেছেন রাঘব। সুচেতা বলল, ‘তোমার চা জুড়িয়ে গেছে বাবা,আর এক
কাপ এনে দিচ্ছি, এক্ষুণি।
’
*
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।