ভেবেছিলাম নিজেকে স্রোতের বিপরীতে একজন... SOPA- Stop Online Piracy Act, PIPA- Protect IP Act ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ আইন বাস্তবায়ন না করার দাবীতে ইউকিপিডিয়ার ধর্মঘটের ঘোষণার পরই মূলত ব্যাপারটা সাধারণের নজরে এসেছে। গুগল ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭ মিলিয়নের বেশী সাক্ষর সংগ্রহ করেছে বিলটির বিরুদ্ধে অনলাইন পিটিশনের জন্য।
তবে জিনিসটা কি, কি এর ক্ষমতা, এর প্রভাবগুলাই কি হতে পারে এ ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষই অন্ধকারে রয়েছেন। অনেকেরই ধারণা, এটা নিতান্তই আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং এতে বহির্বিশ্বের লাভক্ষতির কিছু নাই।
তাদের ভাবনাটা অনেকটা এমন যে, বিশালাকার কোন বট গাছের গোড়া কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত javascript:void(1);নেয়া হয়েছে আর আপনি ওই গাছের মগডালে বসে ভাবছেন, গোড়া কেটে ফেললে ফেলো, আমার তো মাথাব্যাথার কোন কারন দেখছি না...বিশেষজ্ঞ মতামত বিশ্লেষণে একটু সহজভাবে মূল বিষয়টা দেখা যাক।
সোপা'র মূল বক্তব্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পত্তির অবৈধ ব্যবহার প্রতিরোধের মাধ্যমে সমৃদ্ধি, সৃজনশীলতা, ব্যবসায় উদ্যোগ ও নতুন কিছু উদ্ভাবনের প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করা।
২০১১ সালের ২৬ অক্টোবর মার্কিন সিনেটে উত্থাপিত বিলটি একটি মেধাস্বত্ব বা কপিরাইট সংরক্ষন আইন যেটি প্রকারান্তরে পুরো ইন্টারনেট বিশ্বকেই নিয়ন্ত্রন করার একটি ভয়ংকর অপচেষ্টা! বিশ্লেষকদের মতে, ৮০ পৃষ্ঠার বিলটিতে প্রচুর ফাঁকফোকর রাখা হয়েছে যার ব্যাপক অপব্যবহার সম্ভব।
উইকিপিডিয়ার কর্তৃপক্ষ উইকিমিডিয়ার বিবৃতিতে বলা হয়,
"আইনটি পাস হলে বিনামূল্যের উন্মুক্ত ইন্টারনেট সেবা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এটি হবে মার্কিন মালিকানাধীন ওয়েবসাইটগুলো নিয়ন্ত্রনে একটি মোক্ষম অস্ত্র"
প্রশ্ন হচ্ছে, "মার্কিন মালিকানাধীন ওয়েবসাইট" এর সংজ্ঞাটা কি? যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ডোমেইন এক্সটেনশানের সকল ওয়েবসাইট "যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েবসাইট" বলে বিবেচিত হবে। সে হিসেবে .com, .org, .net, .info ডোমেইন এক্সটেনশানের সকল ওয়েবসাইট সংজ্ঞানুসারে "যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েবসাইট" এর আওতায় পড়ে যাবে।
এবার চিন্তা করে দেখেন, এই ডোমেইন এক্সটেনশানগুলো বাদ দিলে আর বাকি থাকে কি? ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, উইকিপিডিয়া...আমাদের এই ব্লগ, বাদ পড়ছে কে?? সুতরাং, পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে যাচ্ছে গোটা ইন্টারনেট জগৎ!
এবার আসা যাক, ব্যবস্থাগুলো আসলে কি নেয়া হবে?
আইনটার নামই হচ্ছে কপিরাইট সংরক্ষণ আইন, সুতরাং সহজ বাংলায় কপিরাইট রক্ষা করবে। কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব জিনিসটা কি? বইয়ের শুরুতে আমরা দেখে থাকি "সর্বস্বত্ব লেখক/প্রকাশক কর্তৃক সংরক্ষিত", একটি সিনেমার স্বত্ব সেটির প্রডিউসারের, একটি সফটওয়্যারের স্বত্ব তার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের, এমনকি আপনার তোলা একটি ছবির স্বত্ব আপনার নিজের, আপনি চাইলে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত করে দিতে পারেন।
এখন আপনি একটি মুভি বা মুভির গানগুলোর ডাউনলোড লিংঙ্ক আপনার ওয়েবসাইটে শেয়ার করলেন। কাজটি আপনি করেছেন সেই মুভির স্বত্বাধিকারীর অনুমতি ছাড়াই, আবার আপনি যে লিঙ্কগুলো দিচ্ছেন যেমন টরেন্ট, মিডিয়াফায়ার বা কোন ফাইল আপলোড সাইটের লিঙ্ক, সেগুলোও তো অবৈধ! সুতরাং, এই আইন অনুসারে আপনি ভয়াবহভাবে "মেধাস্বত্ব" লঙ্ঘন করছেন! মামলা হলে কোনরূপ সতর্কবাণী ছাড়াই বন্ধ করে দিতে পারবে আপনার ওয়েবসাইট! এককথায় কোনকিছু ফ্রী ডাউনলোডের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে পুরোপুরি।
আবার কোন ব্লগ বা সামাজিক যোগাযোগ সাইটে আপনি একটি ছবি শেয়ার করলেন যেটি মালিক কর্তৃক কপিরাইট করা, এখন ওই সাইট বা ব্লগ কর্তৃপক্ষ আপনার ছবিটি ডিলিট করলো না (সাধারণত আনসেন্সরড ছবি না হলে কেউ ডিলিট করেও না), মালিকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুরো ব্লগ বা সাইটটিই বন্ধ করে দেবার ক্ষমতা রাখবেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল।
কপিরাইট আইন ভঙ্গের অভিযোগের ভিত্তিতে আপনার ওয়েবসাইটটি সার্চ ইঞ্জিনগুলোর রেসাল্ট থেকে মুছে ফেলা হবে, বন্ধ করে দিতে পারবে আপনার গুগল এডসেন্স একাউন্ট। আপনার ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার আপনার ওয়েবসাইটের আইপি পাঁচদিনের মধ্যে ব্লক করে দিতে বাধ্য থাকবে।
সঙ্গীতের পাইরেসি রোধে প্রণীত ধারাবলে অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে তিন বছরের সাজা ও অর্থদণ্ড দেয়া যাবে। এক্ষেত্রে অভিযুক্তের অপরাধটা কেমন হতে পারে? আজকাল জনপ্রিয় হওয়া গানগুলোকে অনেকেই নিজের মতো করে গেয়ে ইউটিউবে আপলোড দিচ্ছেন, অনেকসময় সেগুলো মূল গানের চেয়েও জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই আইনের মাধ্যমে মূল গানটির স্বত্বাধিকারী আপনার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিতে পারবেন, জেল ও মোটা অঙ্কের জরিমানাও হয়ে যাবে! আপনার আপলোড করা অবৈধ(!) ভিডিওটি রিমুভ না করার অপরাধে(!) পুরো ইউটিউব সাইটটিই বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে এই আইন!
এরকম আরও বহু ধারা-উপধারায় সমগ্র ইন্টারনেট ব্যবস্থাটাকেই নিজেদের পূর্ণ দখলে নেয়া হবে।
মেধারক্ষার নামে মুক্তচর্চা আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবাধ প্রবাহে চরমভাবে বাঁধাগ্রস্ত হবে। টাকা দিয়ে নেট চালানো আর বিদ্যুতের বিল উঠাইয়া বিটিভি দেখা বোধ করি এক ব্যাপার হইয়া যাবে।
সুতরাং, ব্যাপারটা মোটেও যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় ভাবার কোন সুযোগ নেই। বরং পশ্চিমা শাসকদের খবরদারির বাইরে থাকা দুনিয়ার একমাত্র ক্ষেত্রটির ওপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার এক ভয়াবহ নীলনকশা। অনলাইনে আমেরিকা-বাংলাদেশ বলে কিছু নেই...স্থান-কাল, জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এখানে সকল ইন্টারনেট ব্যাবহারকারী এক সত্তা, এক পরিবার।
সে পরিবারকে শৃঙ্খলিত করার এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে প্রত্যেককেই। হয়তো মূল প্রতিবাদটা আমেরিকানদেরই করতে হবে, তবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে স্ব স্ব অবস্থান থেকে প্রতিবাদ এই আন্দোলনকে নিঃসন্দেহে একটি বৃহৎ রুপ দিতে সহায়তা করবে। অতএব, নিজে জানুন, পাশের মানুষটিকে জানান। ফেসবুকে, ব্লগে, গোটা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আওয়াজ তুলুন... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।