আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রক ক্যাডেট : গারদখানার আমলনামা-৮ (ক্যাডেট কলেজের জীবন নিয়ে মজা করে লেখা একটি প্রামাণ্য চিত্রপট)

বাংলার আলো-জলে ধূলো মেখে বেড়ে ওঠা মুক্তি দ্যা লাস্ট এপিসোড (পরিমার্জিত) আগের এপিসোডগুলো লিংক নিচে দেয়া আছে। ‘গ্রেটেস্ট শো অব ক্যাডেট কলেজ’ শেষ হয়ে গেল। বার্ষিক ক্রীড়ার পর সবাই খুব ক্লান্ত। ঢিমেতালে চলছে দিনকাল। তিন দিনের বিশাল অবসর।

ছেলেদেরকে তিনদিন বিশ্রাম দিয়েছিলেন প্রিন্সিপাল। গত দুইদিন তাও একটু কাজ ছিল। তদন্ত কমিটিতে সাক্ষ্য দেয়া আর মালু স্যারের বিদায় সংবর্ধণা। এসব নিয়ে কিছু সময় ভালোই কেটেছে। আজ অবসরের শেষ দিন।

তার উপর আবার শুক্রবার। জুমার নামাজটা বাধ্যতামূলক। জুমার সময়ে মসজিদে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে হয় দুই ঘন্টা। ছুটির দিনে কারো শাসন মানতে ভালো লাগে না। শুক্রবার বাদে অন্যদিনে ছুটি পেলে সেটাই বেশী উপভোগ করে ছেলেরা।

সমস্যাটা হলো আগামীকাল নিয়ে। আগামীকাল শনিবার। আবার ক্লাসে যেতে হবে। কালই অবশ্য শেষ ক্লাস। তারপর ঈদের ছুটি।

ছুটিতে লেখাপড়া করার জন্য কাল কিছু আউটলাইন দিয়ে দেবেন স্যাররা। কোরবানীর ঈদ অবকাশে কলেজ দুই সপ্তাহ বন্ধ থাকবে। এখনি সবাই ছুটি ছুটি একটা আমেজে ডুবে আছে। মালু স্যারের বিদায় আরো নির্ভার করে দিয়েছে ওদেরকে। অকারণের আতংকটা কেটে গেছে।

এমন ছুটির দিনেও মালু স্যার হাউসে আসতেন মাঝে মাঝে। রুমে রুমে ঘুরে দেখতেন ছেলেরা কে কি করছে। কাউকে গল্পের বই পড়তে দেখলে তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। ধুম ধাম পিটিয়েও দিতেন মাঝে মাঝে। অন্যান্য অনেক স্যার-ম্যাডামরাও ছুটির দিনে এসে ঘুরে যান ক্যাডেটদের রুম।

কিন্তু কেউ অযথা ছেলেদের ভুল খুঁজে বের করে তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেননা। বরং তারা এসে লেখাপড়ার ব্যাপারে খোঁজ নেন। ছেলেদের সাহায্য লাগলে সাহায্য করেন। কারো মন খারাপ থাকলে মন ভালো করারও চেষ্টা করেন অনেক সময়। অনেক আদর করেন তারা ছেলেদেরকে।

আর ছেলেরাও মন থেকেই ভালোবাসে এই স্যার-ম্যাডামদেরকে। সকালে নাস্তা করে এসে আবার শুয়ে পড়েছে রিজভী। বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে গল্পের বই পড়ে সময় কাটাচ্ছে সে। আর শরীফের মনে শুধু তুলির চিন্তা। এভাবে বিছানায় শুয়ে আরাম করেই দুপুর পর্যন্ত কাটিয়ে দিল ওরা।

মতির কথা মনে হলো খুব। ছেলেটার কোন খবরই জানেনা কেউ। জানার কোন উপায়ও নাই অবশ্য। এতোদিনে কি কোন মস্তিস্ক বিশারদের ছুরি-কাচি মতিকে আরো যন্ত্রণাকাতর করে তুলল! আর ভাাবতেই পারছেনা রিজভী। বিষাদে মনটা একেবারে মলিন হয়ে গেল।

চোখের সামনে মতির মায়ের ছলছল মুখখানা ভেসে উঠল। ক্লাস এইটের হাতেই থাকে সেভেনের নতুন ছেলেদেরকে কলেজ কালচার শিখিয়ে দেবার যাবতীয় কার্য। রিজভীর উপর ছিল মতির দায়িত্ব। মতি ওর মায়ের হাত ধরে এসেছিল। সেদিনই পরিচয় মায়ের সাথেও।

রিজভীর হাত ধরেই মতির কলেজ জীবন শুরু হল। মা কী পরম মমতায়ই না ওর হাতে মতিকে তুলে দিয়েছিল। ছেলের অভিষেক সময়ে মায়ের চোখে অনাবিল আনন্দ আর কিছু স্বপ্নরেখা বিজলীর মতোই চমক দিয়ে যাচ্ছিল। রিজভী সেদিন দিন দুপুরে মায়ের চোখে জোছনা দেখেছিল। ফুটফুটে পূর্নিমার মতোই মায়ের মুখটা ছিল আলোকবিলানো।

আর বিদায় বেলায় আরেকবার হয়তো ধারিণীর নাড়ীতে টান পড়েছিল। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বিচ্ছেদে কেঁপে উঠেছিল মা। আর অজানা আশংকায় মাকে জড়িয়ে ধরে বালক মতির চোখ ভিজিয়েছিল। মা তার আঁচলে মতির ফোঁটা ফোঁটা রোদন মুছে দিয়েছিল। প্রথম কিছুদিন মতি নিয়মিতই লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের পানি ফেলত।

অনেক বুঝিয়ে রিজভী তাকে শান্ত করে। ধীরে ধীরে ছোট্ট মতি সবে বুঝতে শিখেছিল। আর অমনি এসে অসুখ তাকে শকুনের মতো খুবলে ধরল। অসুখ তো ছোটই ছিল। শুধু ডাক্তারের অবহেলাই বালকটিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল।

আর ভাবতেই পারছে না রিজভী। মাথা ঝিমঝিম করে উঠছে। ডাক্তারের উপর আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলতে ইচ্ছা হল। মতি তো দুষ্ট ছিল না। কী শান্ত, ছোট্ট বালক।

একটু যতœ করে ওর মাথাটা ভালো করে পরীক্ষা করলে ডাক্তারের কী এমন ক্ষতি হতো! নামাজের সময় হয়ে গেছে। জুমার নামাজ পড়তে হবে। শরীফ রিজভীকে রেডি হতে বললো। সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা পড়ে রুম থেকে বের হয়ে ওরা মসজিদে গেল। প্রায় একঘন্টা মসজিদে বসে থেকে ইমাম সাহেবের বয়ান শুনলো রিজভী।

অনেকে খুব মনোযোগ দিয়ে বয়ান শোনে। আবার এসময়টায় কারো কারো চোখ ঘুমে ঢুলঢুল করে। এমন সময় নামাজ শুরু হল। শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠে সবাই দাড়িয়ে গেল নামাজে। খুব দ্রুতই শেষ হয়ে গেল দুই রাকাত জুমার নামাজ।

মোনাজাত করার আগে ইমাম সাহেব সবাইকে কিছুক্ষণ দোয়া পড়তে বললেন। তিনি সামনে দাড়িয়ে বললেন- আপনারা সবাই একবার সূরা ফাতেহা, তিনবার সূরা এখলাস ও সাতবার দরূদ শরীফ পাঠ করেন। মোনাজাতের আগে অবশ্য প্রতি শুক্রবারেই এভাবে দোয়া পড়া হয়। দোয়াপাঠ শেষে তিনি আবার দাড়ালেন। সামনে সমবেত ছেলেদের দিকে তাকিয়ে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বললেন- একটা দুঃসংবাদ আছে।

ছেলেরা সবাই নড়েচড়ে বসল। চারপাশে তাকিয়ে একটু সময় নিয়ে ইমাম সাহেব বললেন- একজন ক্যাডেট মারা গেছে। আমাদের সবার প্রিয় ‘ক্যাডেট মতি’ অসুস্থ্য অবস্থায় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। ইন্নানিল্লাহে...পড়ার মধ্যেই ‘মতি মারা গেছে!’ ‘মতি মারা গেছে!’ বলে অবাক বিস্ময়ে ছেলেদের মধ্যে ফিসফিসানি শুরু হলো। কলেজ ক্যাপ্টেন চিৎকার করে উঠল- কিপ কোয়াইট।

আবার সবাই চুপ হয়ে গেল। ইমাম সাহেব আবার শুরু করলেন- দীর্ঘদিন ধরেই সে মাথার সমস্যায় ভূগছিলো। মরহুমের মা আজ সকালে প্রিন্সিপাল স্যারকে ফোন দিয়েছিল। আপনারা মতির আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করবেন। ইমাম সাহেবের কথা শেষ হবার আগেই মসজিদের ভিতর আবার গুঞ্জন শুরু হলো।

কী ভয়ংকর! একটু আগেও মতির স্মৃতিগুলো ভেবে সবকিছুই কতো জীবন্ত মনে হলো। আর ইমাম সাহেব একনিমিষেই তাকে মরহুম বানিয়ে দিল! ঘৃণামাখা চোখে রিজভী ডাক্তারের দিকে তাকালো। টপটপ করে পানি পড়ছে ওর চোখ বেয়ে। শরীফের চোখেও ছলছল বান ডেকেছে। আর মতির বন্ধুরা কেঁদে উঠছে ডুগরে ডুগরে।

ছেলেরা অনেকেই কথা বলতে চাইল। কিন্তু ইমাম সাহেব দরাজ কন্ঠে মিলাদ মাহফিল শুরু করে দিলেন। সবাই সুর করে মিলাদ পড়তে বাধ্য হলো। মিলাদের সুরে ঢেকে গেল ডাক্তারের অপকর্ম। মসজিদের এককোণায় বসে বাইরে তাকিয়ে আছে রিজভী।

আর আনমনে ভাবছে- বেঁচে থাকার আকুল আবেদন নিয়ে শেষ পর্যন্ত মতি চলে গেল। মেজর নালায়েক যদি সময়মতো মতিকে সামরিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দিত তাহলে হয়তো মতি বেঁচে যেত। মাসের পর মাস মাথাব্যথার জন্য ছেলেটা ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। কতো আকুতি করেছে বাঁচার জন্য। কিন্তু ডাক্তার ওর ব্যথাকে পাত্তাই দেয়নি কখনো।

কোন চিকীৎসাই হয়নি ওর। কত অবহেলায় একটা জীবন শেষ হয়ে গেল! মতি চিরতরে হারিয়ে গেল। এবড়ো থেবড়ো পিচের রাস্তায় দেবদারু গাছের হালকা ছায়া পড়েছে। সবুজ মাঠে কিছু কাউয়া পাখি এলোমেলো ওড়াউড়ি করছে। ভেজা হাওয়া কাঁপিয়ে যাচ্ছে পেয়ারা বনের পেয়ারা ফুলে।

শীতের দুপুরের মলিন রোদে কোন তেজ নেই। তাপহীন আলো। আর মনটা এমনিতেই অনেক আর্দ্র। দুপুরে কিছু খেল না রিজভী। মনটা বিষণ্ন।

অনেক বিষণ্ন। আনমনে সে উত্তরের বারান্দায় গিয়ে গ্রীল ধরে দাড়ালো। মতির মায়ের মুক্তোফোটা রোদন পূবের বাতাসে ভেসে এসে হয়তো রিজভীকেও ছুঁয়ে গেল। চোখের কোন ভাষা নেই আর, বাঁধভাঙ্গা স্রোতে শুধু মন কেঁদে গেল। @@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@ (পরে খাগড়াছড়িতে বদলি করে দেয়া হয়েছে ওই ডাক্তারকে।

কিন্তু ! যে ফুল ফোটার আগেই ঝড়ে গেল, সে কি আর কখনো হেসে উঠবে! ) আগের পর্বগুলোর লিংক- ১ম পর্ব- Click This Link ২য় পর্ব- Click This Link ৩য পর্ব- Click This Link ৪র্থ পর্ব- Click This Link ৫ম পর্ব- Click This Link ৬ষ্ঠ পর্ব- Click This Link ৭ম পর্ব- Click This Link -আলীম হায়দার। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।