বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত দেহতাত্ত্বিক গানে মানবদেহকে ঘড়ির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যা অনেকের কাছেই অভাবনীয় মনে হতে পারে। তবে বাংলার লোকায়ত ভাবধারার সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে, তাদের বাংলার লৌকিক দর্শনের মূলভাবটির বিস্ময়কর সাঙ্গীতিক প্রকাশ লক্ষ করে গভীর বিস্ময় অনুভব করারই কথা। কেননা, বিখ্যাত ওই দেহতাত্ত্বিক গানটির বুনন অত সহজ নয়, বরং সেটি এমন একজন প্রতিভাবান সংগীতসাধকের সৃষ্টি, যিনি একই সঙ্গে বাংলার মারফতী ঘরানার ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ।
গানটির রচয়িতা আবদুর রহমান বয়াতী গানটিকে কেবল জনপ্রিয়ই করে তোলেননি, গানের মাধ্যমে তিনি বাংলার সমাজদেহে মারফতি শিক্ষার বীজটি ছড়িয়ে দিয়েছেন। দেহঘড়ি গানে তাঁর সঙ্গীতপ্রতিভা এবং দার্শনিক চিন্তার বিস্ময়কর সমন্বয় ঘটেছে। এ কারণে অদ্যাবধি গানটির অবস্থান সুফি-বাংলার শ্রোতাদের পছন্দের শীর্ষে ।
খ্যাতিমান লোকসঙ্গীত শিল্পী আবদুর রহমান বয়াতী আজ বৃদ্ধ হয়েছেন, বর্তমানে তিনি রোগশোকে কাতর এবং শয্যাশায়ী। তাঁর আশু রোগমুক্তি কামনা করে ‘ মন আমার দেহঘড়ি’ গানটির সঙ্গে সুফি-বাংলার ভাবদর্শনের অনিবার্য সম্পর্কটি অনুধাবনের চেষ্টা করব।
কিন্তু তার আগে পুরো গানটির পাঠ জরুরি -
ঘড়ি দেখতে যদি হয় বাসনা চইলা যাও গুরুর কাছে
যেই ঘড়ি তৈয়ার করে ভাই লুকায় ঘড়ির ভিতরে।
মেকার যদি হইতাম আমি ঘড়ির জুয়েল পালটাইতাম
জ্ঞাননয়ন খুইলা যাইত দেখতে পাইতাম চোখের সামনে।
মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন্ মেস্তরি বানাইয়াছে
ও একটা চাবি মাইরা দিসে ছাইড়া জনম ভইরা চলতে আছে।
মাটির একটা কেস বানাইয়া মেশিন দিছে তার ভিতর
রঙবেরঙের বার্নিশ করা দেখতে ঘড়ি কী সুন্দর!
দেহঘড়ি চৌদ্দতালা তার ভিতরে দশটি নালা
নয়টি খোলা একটি বন্ধ গোপন একটা তালা আছে।
ঘড়ির হেয়ার স্প্রিং ডেবরা কেসিং লিভার হইল কলিজা
ছলেবলে আজব কলে দিবানিশি প্রেম খেলায়।
ঘড়ির হেয়ার স্প্রিং ডেবরা কেসিং লিভার হইল কলিজা
ছয় তার বলে আজব কলে দিবানিশি প্রেম খেলায়।
তিনপাটে তার করণ সারা বয়লারে মেশিনের গোড়া
তিনশ ষাটটি ইসক্রপ মারা ষোলজন প্রহরী আছে।
এমন সাধ্য কার আছে ভাই এই ঘড়ি তৈয়ার করে
যে ঘড়ি তৈয়ার করে ভাই লুকায় ঘড়ির ভিতরে ।
তিন কাঁটা বারো জুয়েলে মিনিট কাঁটা হইল দিলে
ঘন্টার কাঁটা হয় আক্কেলে মনটারে তুই চিনে নিলে।
মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন্ মেস্তরি বানাইয়াছে
একটা চাবি মাইরা দিসে ছাইড়া জনম ভইরা চলতে আছে।
আবদুর রহমান বয়াতীর চিন্তার সূত্রপাত এভাবে: কত রকমের কলকবজা দিয়ে একটা ঘড়ি তৈরি হয়; তেমনি মানবদেহের অভ্যন্তরেও রয়েছে হরেক রকম কলকবজা । জড় এবং চেতন দুটি বস্তুর তুলনা সে কারণেই। কাজেই ‘ মন আমার দেহঘড়ি’ ...
আবদুর রহমান বয়াতীর চিন্তার দ্বিতীয় ধাপটি হল: কোনও যন্ত্রের কল-কবজা থাকলে তার তো একজন ‘মেস্তরি’ বা মেকার থাকার কথা। কাজেই, মানবদেহটিও কেউ না কেউ ‘মেইক’ করেছেন। বাংলার মারফতী জগতে সেই মেকার কে মালিক, মওলা কিংবা শাঁই বলে গভীর আবেগে সম্বোধন করা হয়।
কাজেই -
মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন্ মেস্তরি বানাইয়াছে
কেননা,
ও একটা চাবি মাইরা দিসে ছাইড়া জনম ভইরা চলতে আছে।
কী আশ্চর্য! জন্মের পর থেকেই দেখা যায় দম দেওয়া ঘড়ির মতোই দেহঘড়ি ‘চলতে আছে’। এ যে কী বিপুল বিস্ময়- তা একমাত্র সাধকই জানেন। এ দৃশ্য সাধক অভিভূত হয়ে দেখেন আর ক্ষণে ক্ষণে শিউরে ওঠেন। অবশ্য যান্ত্রিকতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ ভিড়ের মানুষের দেহমনে এতে বিন্দুমাত্র বিস্ময় জাগে না।
সে যাই হোক। আবদুর রহমান বয়াতী একজন উঁচুস্তরের সাধক। কাজেই, দেহঘড়ির মেস্তরিরূপী এক মহাচৈতন্যের (লা শরিক আল্লাহর) সন্ধান করাই তার জীবনের পরমব্রত। তিনি পথে নেমেছেন। সাধনমার্গের প্রথম পর্বে তিনি যেতে চান একজন সৎ গুরুর কাছে ।
কেননা, বাংলায় গুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়ার ঐতিহ্যটি দীর্ঘকালীন । নবম-দশম শতকের বাংলার বজ্রযানী বৌদ্ধ সাধকেরাই (অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এর ভাষায় গৃহত্যাগী বৌদ্ধ বাউল) প্রথম গুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। কাজেই মহাচৈতন্যের অধিকারী সেই দেহঘড়ির মেস্তরির সন্ধান করার আগে গুরুর পদধূলি নিতে হবে। তাইই সাধক আবদুর রহমান বলছেন:
ঘড়ি দেখতে যদি হয় বাসনা চইলা যাও গুরুর কাছে
যেই ঘড়ি তৈয়ার করে ভাই লুকায় ঘড়ির ভিতরে।
দ্বিতীয় চরণটিতেই যেন সব কথাই বলা হয়ে গিয়েছে।
মহাচৈতন্যের অধিকারী দেহঘড়ির নির্মাতা বাস করেন দেহঘড়ির ভিতরে। এই বিস্ময়কর ধারণাটির শিকড় নবম-দশম শতকের বজ্রযানী বৌদ্ধ সাধকের সাধনায় স্ফূরিত হয়েছে, যা ক্রমশ নানাবর্ণে ডালপালা মেলেছে বাংলার পরবর্তী যুগের লৌকিক ধর্মের সাধনপ্রক্রিয়ায়।
মেকার যদি হইতাম আমি ঘড়ির জুয়েল পালটাইতাম
কেন?
জ্ঞাননয়ন খুইলা যাইত দেখতে পাইতাম চোখের সামনে।
কাকে চোখের সামনে দেখার কথা হচ্ছে?
মওলা-মালিক-শাঁই কে।
মওলা- মালিক- শাঁই কে চোখের সামনে দেখতে পাওয়াই একজন বাউল কিংবা দেহতাত্ত্বিক মারাফতি সাধকের সাধনার মূল লক্ষ।
সে জন্য ঘড়ির জুয়েল পালটাতে হবে। অর্থাৎ দেহটি শুদ্ধ করে তুলতে হবে। বাংলায় এ ধারণাটিও বেশ প্রাচীন। নবম-দশম শতকের নাথযোগীরা হঠযোগ বা কায়াসাধনা করত। এর মাধম্যে শরীর নিরোগ এবং অধ্যাত্ম সাধনায় অমরত্ব লাভ সম্ভব বলে তারা মনে করতেন।
তারা এ ধারণা লাভ করেছিলেন বজ্রযানী বৌদ্ধদের কাছ থেকে। কেননা বজ্রযানী বৌদ্ধরা বিশ্বাস করতেন যে জড় দেহকে সিদ্ধ দেহ এবং সিদ্ধ দেহ কে দিব্যদেহে রূপান্তরিত করা সম্ভব। অর্থাৎ একান্ত সাধনার মাধম্যে মেটেরিয়াল বডিকে ডিভাইন বডি তে ট্রান্সফার করা সম্ভব।
এরপর গানটির সেই বিখ্যাত কোরাস। যা বাংলার শ্রোতাদের আজও দর্শন ও সঙ্গীতের সমন্বয়ে এক বিচিত্র আবেগে সিক্ত করে দেয়।
মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন্ মেস্তরি বানাইয়াছে
ও একটা চাবি মাইরা দিসে ছাইড়া জনম ভইরা চলতে আছে।
এরপর শরীরের বর্ণনা-
মাটির একটা কেস বানাইয়া মেশিন দিছে তার ভিতর
রঙবেরঙের বার্নিশ করা দেখতে ঘড়ি কী সুন্দর!
দেহঘড়ি চৌদ্দতালা তার ভিতরে দশটি নালা
নয়টি খোলা একটি বন্ধ গোপন একটা তালা আছে।
শেষ দুটি চরণের অর্থ সহজে বোঝা যাওয়ার কথা না। কেননা, চরণ দুটি বাংলার লৌকিক ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে নিগূঢ় তত্ত্বের শিকড়টি বাংলার প্রাচীন দার্শনিক চিন্তায় নিহিত।
নানান দার্শনিক সম্প্রদায়ের ধারণা এই তত্ত্বে মিশে আছে। রয়েছে অগ্রগন্য বাউলমতের প্রভাবও। বাউলের বিশ্বাস এই যে দেহের ভিতর রয়েছে আঠারো মোকাম (আঠোরোটি ঘর), ছয় লতিফা, বারো বরজ, চারচন্দ্র, চৌদ্দ ভুবন, ষড় রিপু ও দশ ইন্দ্রিয়। এসবই বাউলের কল্পনা। বাউলগণ যে কল্পনাসূত্র লাভ করেছেন ষোড়শ শতকের সহজিয়া বৈষ্ণবগণের কাছ থেকে ।
সহজিয়া বৈষ্ণবগণ সে ধারণা লাভ করেছিলেন বাংলার প্রাচীন তন্ত্রের কাছ থেকে।
নাথধর্ম এবং বজ্রযানী বৌদ্ধ দর্শন আবার তন্ত্রপ্রভাবিত। সে যাই হোক। তন্ত্রের অন্যতম সিদ্ধান্ত ছিল, ‘যা নাই দেহভান্ডে, তা নাই ব্রহ্মান্ডে’ । এরই সূত্র ধরে হাজার বছর পর সুফি-বাংলার মারফতী ঘরনার দেহতাত্ত্বিক সাধকগণ বললেন, দেহঘড়ির ভিতরে চৌদ্দতালা আর দশটি নালা আছে, যার নয়টি খোলা একটি বন্ধ আর গোপন একটা তালা আছে।
মওলা –মালিক- শাঁই কে চোখের সামনে দেখতে হলে প্রয়োজন দৈহিক এবং মানসিক শুদ্ধির । আর সেই শুদ্ধতা অর্জনে চাই দেহের অভ্যন্তরীণ নানা প্রকোষ্ঠ সম্বন্ধে পরিস্কার ধারণা। সে যাই হোক। আবদুর রহমান দেহঘড়ির আরও বর্ণনা দিয়েছেন:
ঘড়ির হেয়ার স্প্রিং (!) ডেবরা কেসিং (!) লিভার হইল কলিজা
ছলেবলে আজব কলে দিবানিশি প্রেম খেলায়।
ঘড়ির হেয়ার স্প্রিং ডেবরা কেসিং লিভার হইল কলিজা
ছয় তার বলে আজব কলে দিবানিশি প্রেম খেলায়।
তিনপাটে (!) তার করণ সারা (!) বয়লারে মেশিনের গোড়া (!)
তিনশ ষাটটি ইসক্রপ মারা ষোলজন প্রহরী আছে।
এই স্তবকের সব শব্দই যে বোঝা যায়, তা কিন্তু নয়। তা সম্ভবও নয়। তাছাড়া একই গানে আবদুর রহমান বয়াতীর এবং ফকির আলমগীর-এর উচ্চারণের মধ্যেও যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ‘ তিনপাটে তার করণ সারা বয়লারে মেশিনের গোড়া’-এ লাইনটি বোঝা না-গেলেও বোঝা যায় যে এ হল দেহঘড়ির 'এনার্জির' বর্ণনা, তথা রূপকের মাধ্যমে মানবদেহের উপস্থাপনা।
তবে শেষ লাইনটি - ‘তিনশ ষাটটি ইসক্রপ মারা ষোলজন প্রহরী আছে’ বেশ রহস্যময়। ‘তিনশ ষাটটি ইসক্রপ মারা’ মানে কি? ‘ষোলজন প্রহরী’ই বা কে? এসব প্রশ্নে আমাদের নাগরিক মননে মর্চে পড়াই স্বাভাবিক। তবে ‘ ছলেবলে আজব কলে দিবানিশি প্রেম খেলায়’ এই লাইনটিই এই অনুচ্ছেদের সবচে তাৎপর্যময়; এবং এই চরণের ব্যঞ্জনাও অত্যন্ত গভীর । মানবদেহে এবং মনে কখনও কখনও বিশুদ্ধ প্রেমের পবিত্র অনুভূতি জাগে। আবার কখনও ওঠে বন্য যৌনতার প্রবল ঢেউ।
আর এভাবেই লীলাময় মওলা- মালিক -শাঁই জানান দেন যে তিনি দেহের অভ্যন্তরেই আছেন।
সাধকের এখানেই পরম বিস্ময় ...
আবদুর রহমান বয়াতী এবার দেহঘড়ির নির্মাতার স্বরূপ সম্বন্ধে বলছেন।
এমন সাধ্য কার আছে ভাই এই ঘড়ি তৈয়ার করে
যে ঘড়ি তৈয়ার করে ভাই লুকায় ঘড়ির ভিতরে ।
ওপরের দুটি চরণের প্রতিধ্বনি শুনি গানটির প্রারম্ভের দুটি চরণে-
ঘড়ি দেখতে যদি হয় বাসনা চইলা যাও গুরুর কাছে
যেই ঘড়ি তৈয়ার করে ভাই লুকায় ঘড়ির ভিতরে।
গানটির শেষ দুটি চরণ দিক নির্দেশনামূলক।
যেখানে ঘড়ির ঘন্টা, মিনিট এবং সেকেন্ড এর কাঁটার কথা বলা হয়েছে। মিনিট কাঁটাকে দিল বা হৃদয় বলা হয়েছে। মনকে চিনলে (অর্থাৎ মওলা মালিক শাঁই) যে আক্কেল (জ্ঞানবুদ্ধি) হয় সে কথাও বলেছেন আবদুর রহমান বয়াতী।
তিন কাঁটা বারো জুয়েলে মিনিট কাঁটা হইল দিলে
ঘন্টার কাঁটা হয় আক্কেলে মনটারে তুই চিনে নিলে।
আবদুর রহমান বয়াতীর কন্ঠে
Click This Link
ফকির আলমগীরের কন্ঠে
পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই।
একজন শিল্পীর প্রতিটি গানই জনপ্রিয় হয় না। কোনও কোনও শিল্পীর একটি গানের মাধ্যমেই শ্রোতার হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেন। আবদুর রহমান বয়াতীর ‘ মন আমার দেহঘড়ি’ গানটি তেমনই একটি গান। যে কালজয়ী গানটির মাধ্যমে আবদুর রহমান বয়াতী চিরকাল বাঙালির অন্তরে বেঁচে থাকবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।